মাগরিবের আযান যেন এলার্মের মতো কাজ করলো। যারা এতক্ষণ নদীতে পাথর আর বালু তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলো তারা পাড়ে নৌকা বেঁধে নদী থেকে উঠে গেছে। নদীর ওপাড়ের বাজারের দোকানগুলোতে একসাথে আলো জ্বলে উঠলো। নদীর এপাশের বাগানে ধীরে ধীরে অন্ধকার আরো গাঢ় হতে থাকলো। কয়েকজন টর্চ নিয়ে নদীতে নেমেছে পলো দিয়ে মাছ ধরতে। টর্চের আলো পানিতে প্রতিফলিত হয়ে আকাশের দিকে চলে গেছে। একসময় আনিছও নৌকা নিয়ে রাত জেগে কোঁচ দিয়ে মাছ ধরতো।
সে বহুবছর আগের কথা। এখন নদী শুকিয়ে গেছে। আনিছ বিকেল থেকে অনেকজনকে দেখেছে লুঙ্গি কাছা মেরে হেঁটে নদী পার হতে। মাছ ধরতে ধরতে একজন এপাড়ের কাছাকাছি আসতেই আনিছ বলল, মাছ কেমন পাওয়া যায়? হুট করে আনিছের কণ্ঠ শুনে লোকটা মনে হয় ভয় পেয়েছে। সাথে সাথে আনিছের দিকে টর্চের আলো ফেলে ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো, কেডা? লোকটার ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারন রয়েছে। কেন না আনিছ শ্মশান ঘাটের পাশেই বসে আছে। তাছাড়া এপাশটায় যতদূর চোখ যায় সারি সারি ইউক্যালিপটাস গাছ ছাড়া কিছু নেই। সন্ধ্যার পরে মানুষ এদিকে আসে না। তার উপর আনিছ সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা পড়েছে। মুখ ভর্তি লম্বা কাচাপাকা দাড়ি।
‘কথা কয়না ক্যান, কেডা?’ লোকটার কণ্ঠে ভয় স্পষ্ট। ‘চাচা ভয় পাইছেন নাকি? ভয়ের কিছু নাই আমি জ্বিন ভুত না।’ আনিছের কথা শুনে লোকটা মনে হয় নিশ্চিন্ত হলো। আনিছের মুখ থেকে টর্চের আলো সরিয়ে বলল, এই সময় এইখানে বইসা রইছেন ক্যান? ‘এমনি। মাছ কেমন পাওয়া যায়?’ ‘যায় অল্প-স্বল্প।’ ‘চাচার বাড়ি কি নদীর ঐপাড়?’ ‘হ’ ‘খালিদ মাস্টারের বাড়ি থেইকা কয় বাড়ি পরে?’ ‘আমাগো বাড়ি শেষের দিক। খালিদ মাস্টারের বাড়ি তো সামনত। এইখান থেইকা দেখা যায়।’ লোকটা নদীর ওপাড়ে টর্চ মেরে বাড়ি দেখালো।
‘হ দেখছি। মাস্টার বাড়ি পাকা করছে কবে?’
‘হইলো মেলা দিন।’
‘মাস্টারের পোলা মাইয়া কয়ডা?’
‘একটা পোলা একটা মাইয়া, জমজ।’
‘মাস্টার কি এখনো চাকরি করে?’
‘গতবছর রিটায়েট করছে। এখন বাজারে দোকান দিছে।’ লোকটার কণ্ঠে বিরক্তি। হয়তো তিনি অকারনে গল্প করতে পছন্দ করেন না। অথবা মাছ না পাওয়ায় তিনি বিরক্ত হচ্ছেন। লোকটা বিরক্ত হলেও আনিছ চেষ্টা করলো লোকটার সাথে গল্প জমাতে। কিন্তু কোন লাভ হলো না। লোকটা পাড় থেকে নদীর মাঝামাঝি চলে গেলো।
লোকমান দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে খালিদ মাস্টারের দোকানে খরিদ্দার আসার। খরিদ্দার আসলে খালিদ মাস্টার ব্যস্ত থাকবে সেই সুযোগে সে পার হয়ে যাবে। খালিদ মাস্টারের সম্মুখীন হতে না চাওয়ার কারন হলো লোকমান তার কাছে বেশ কিছু টাকা ধার নিয়ে আজ দিবো কাল দিবো করে বহুদিন পার করেছে। এখন দেখা হলেই তাকে ডেকে টাকা চায়। টাকার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত খালিদ মাস্টারের সামনে পড়া যাবে না। কিন্তু সমস্যা হলো খালিদ মাস্টারের দোকানে তেমন কেউ আসে না।
কেন না খালিদ মাস্টার বাকি দিতে চায় না। তার উপর দোকানের সামনে তিনি কোন বেঞ্চ রাখেননি। বেঞ্চ রাখলে লোকজন টিভি দেখার জন্য দোকানে এসে বসে থাকে। এতে করে খালিদ মাস্টার বিরক্ত হন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে লোকমান সিদ্ধান্ত নিলো মাথা নিচু করে দ্রুতপায়ে দোকান পার হয়ে যাবে। খালিদ মাস্টার তাকে দেখে ডাকলে শুনেও না শোনার ভান করে চলে যাবে। লোকমান ভেবেছিলো খালিদ মাস্টারের ডাক উপেক্ষা করে চলে গেলেই হয়ে যাবে। কিন্তু খালিদ মাস্টার যে ডাকতে ডাকতে পেছন পেছন আসবে সেটা সে কল্পনাও করেনি। লোকমান মনে মনে খালিদ মাস্টারকে গালি দিলো, সালা মরলে কি টাকা কবরে নিয়া যাবি। কয়টা টাকার লাইগা কুত্তার মতো পেছন পেছন আসতে হইবো।
খালিদ মাস্টার লোকমানের কাছাকাছি এসে বলল, কি ব্যাপার ডাক শুনতে পাও না। ডাকতে ডাকতে দোকান ছেড়ে উঠে আসলাম। ‘বাড়িত রোগী আসছে শুনলাম।’ ‘ইদানিং তোমার রোগী বেড়ে গেছে দেখছি।’ ‘একজনের উপকার হইলে সে আরেকজনরে পাঠায়।’ ‘মানুষের উপকার হয়।’ কথাটা খালিদ মাস্টার তাচ্ছিল্য করে বলল নাকি কথার সত্যতা জানতে জিজ্ঞাসা করলো ঠিক বুঝতে পারলো না লোকমান। লোকমানকে চুপ করে থাকতে দেখে খালিদ মাস্টার বলল, ‘সকালে দেখলাম কমবয়সি একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছিলো। মেয়েটার সমস্যা কি?’
‘জ্বিনের আছর। নতুন বিয়া হইছে। জ্বিনে স্বামীর কাছে যাইতে দেয় না।’
‘তুমি সমাধান দিতে পারছো?’
‘তাবিজ দিছি দেখা যাইক কি হয়।’
‘দেখ লোকমান লোক ঠকানো ভালো না। খোঁজ নিয়ে দেখ মেয়ের অমতে বিয়ে দিয়েছে সে কারনে মেয়ে এমন করছে। অথবা মেয়ের মাথার সমস্যা থাকতে পারে।’ খালিদ মাস্টারের জায়গায় অন্য কেউ এমন কথা বললে লোকমান কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দিতো। কিন্তু খালিদ মাস্টারকে বলা যাবে না। মাস্টার শিক্ষিত মানুষ, তার ওপর পাওনাদার। গ্রামে সম্মান ও প্রভাব দুটোই আছে। এ রকম মানুষকে যতটা ভদ্রভাবে এড়িয়ে চলা যায় ততো ভালো। লোকমান বলল, মাস্টার যাই, দেরি হইয়া যাইতেছে। মাস্টারের জবাবের অপেক্ষা না করে লোকমান বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলো। মাস্টারকে সে মিথ্যা বলেছিলো যে রোগীর খবর পেয়ে সে তড়িঘড়ি করে বাসায় যাচ্ছে। বাসার দরজা খোলা।
বাসায় ঢুকে লোকমান অবাক হলো। সত্যি সত্যি রোগী এসে বসে আছে। উনিশ কুড়ি বয়সের একটা ছেলে। সঙ্গে সম্ভবত তার বাবা মা। তাদের আঙিনায় চেয়ারে বসতে দেয়া হয়েছে। ছেলেটা লতার ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। লতা লোকমানের বড় মেয়ে। লতা ঘর থেকে বের হয়ে বলল, আপনারা চলে যান। বলছি না আব্বা আজকে আসবোনা। লোকমান মেয়ের কথা শুনে কাঁশলো। বাবার দিকে তাকাতেই লতার মুখ শুকিয়ে গেল। লতা মাথা নিচু করে নিজের ঘরে চলে গেল। চেয়ারে বসে থাকা মহিলা বললেন, ‘আপনি লোকমান কবিরাজ?’ ‘জ্বি আপনারা একটু বসেন।’ লোকমান লতার ঘরে ঢুকলো। লতার গালে থাপ্পড় দিয়ে বলল, ‘তুই মিথ্যা কইলি ক্যান? তোরে কেডা কইছে আমি বাড়ি আসুম না?’
লতা গালে হাত দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। বাবার এমন আচরনে লতা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম তার খারাপ লাগতো। এখন আর খারাপ লাগে না। লোকমানের ছোট মেয়ে লাবনী পড়ছিলো। পড়া থামিয়ে সে লোকমানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। লোকমান ধমক দিলো, ‘থামলি ক্যান, পড়।’ লোকমান লতার ঘর থেকে বের হয়ে বলল, ‘আমি তো রাইতের বেলা রোগী দেখি না। আমার সমস্যা হয়। আসছেন যখন কিছুক্ষণ বসেন।’ লোকমান লক্ষ্য করলো ছেলেটা এখনো লতার ঘরে উঁকি দিচ্ছে। লোকমানের ইচ্ছা করছে ছেলেটার গালেও একটা থাপ্পড় দিতে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। লোকমান ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সমস্যা তোমার বুঝতে পারছি। যাও কলপাড় থেকে অযু করে আসো।’ লোকমান হাতের ইশারায় ছেলেটাকে কলপাড় দেখিয়ে দিলো।
লোকমান রান্নাঘরে গিয়ে ফিসফিস করে তার স্ত্রী রাশিদাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘পোলার কি সমস্যা কিছু বলছে তোমারে?’ ‘শুনলাম গতকাল রাইতে কি যেন দেখছে।’ লোকমান মনে মনে বলল, পোলায় নিশ্চই কিছু খাইছে। আইজ কাইলকার পোলাপাইন শখ কইরা নেশা করে। তারপরের দিন দৌঁড় দেয় কবিরাজের বাড়ি। এককালে দেশি মদ খাইয়া নিজেই কতো কি দেখছি। তাড়াতাড়ি রান্ধন শেষ করো খিদা লাগছে। যাই এগুলানরে তাবিজ দিয়া বিদায় করি। কথাটা বলে রান্নাঘর থেকে বের হলো লোকমান।
রোগী বিদায় করে রাতে খেতে বসে লোকমান দেখলো লতা নেই। রাশিদার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লতা খাইবো না? নাকি থাপ্পড় খাইয়া পেট ভইরা গেছে?’ রাশিদা লোকমানের থালায় ভাত তুলে দিতে দিতে বলল, ‘লতার বিয়ায় লাইগা যেই প্রস্তাবটা আইছিলো সেইটার কি হইলো?’ ‘কি আর হইবো। লোকে ভেটো দিছে। তারা জানা পাইছে মেয়ের মায়ের চরিত্র খারাপ আছিলো। সংসার থুইয়া পরপুরুষের হাত ধইরা পালাইছিলো।’
লতা বিছানায় শুয়ে বাবা মায়ের কথা শুনতে পাচ্ছে। লতা ওড়না দিয়ে চোখ মুছলো। বাবা মেরেছে সেকারনে লতা কাঁদছেনা। বিয়ে ভেঙ্গে গেছে সেকারনেও না। লতা কি কারনে কাঁদছে সে নিজেও জানেনা। বাবার প্রতি লতার কোন রাগ নেই। এই মানুষটা তাকে তিনবেলা খাওয়াচ্ছে, নিজের ঘরে রাখছে তাতেই সে মানুষটার কাছে ঋণী। লতার মা পালিয়ে যাবার পরে নাকি অনেকেই বলেছিলো লতা লোকমানের মেয়ে না। অন্য কারো পাপ। যদি লোকমানের মেয়ে হতো তাহলে বাবার বৈশিষ্ট্য কিছুটা হলেও তো পেতো। লতা যখন বুঝতে শিখলো অনেকে বলতো লতা নাকি তার মায়ের মতো হয়েছে দেখতে। অসম্ভব সুন্দরী। লতা তার মাকে কখনো দেখেনি। মাঝে মাঝে মাকে দেখতে তার খুব ইচ্ছে করে।
খাওয়া শেষ করে লোকমান সিগারেট ধরালো। লতাকে নিয়ে সে পড়েছে বিপদে। লতার বয়স প্রায় কুড়ি হতে চললো। গ্রামের লোকজনের ভেটোর কারনে মেয়েটার বিয়ে দিতে পারছে না। লোকমানের যত রাগ এসে পরে লতার ওপর। মেয়েটা কোন প্রতিবাদ করেনা। চুপ করে থাকে। তখন কেমন যেন মায়া হয় লোকমানের। সিগারেটটা শেষ করে লোকমান ঘুমাতে চলে গেলো। আষাঢ় মাসের শেষের দিক। রাতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো।
মিরাজ বেশ কিছুক্ষণ ধরে লোকমান কবিরাজের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় মাটির রাস্তায় ভীষণ কাদা হয়েছে। কাদায় জুতা আর প্যান্টের নিচের অংশ মাখামাখি হয়েছে। মিরাজ গতকাল রাতে মায়ের জোরাজুরিতে এখানে এসেছিলো। আজ এসেছে নিজের ইচ্ছায়। এক রাতের ব্যবধানে কবিরাজিতে তার বিশ্বাস এসেছে এমনটা না। সে এখনো এসবে বিশ্বাস করে না। লোকমান নামের কালো করে বেঁটে লোকটা যে মানুষ ঠকিয়ে চলে সেটা সে বুঝে। সে এসেছে ভিন্ন কারনে। লতা নামের যে মেয়েটাকে গতকাল রাতে সে দেখেছিলো, তাকেই দেখতে এসেছে সে। কিছু সৌন্দর্য মানুষকে এমনভাবে কাছে টানে যে মানুষ সাড়া না দিয়ে পারে না। লতার মাঝে এমন কিছুই ছিলো যা আজ মিরাজকে আসতে বাধ্য করেছে। মিরাজের কেমন যেন ভয় ভয় করছে। সে কি লোকমান লোকটাকে ভয় পাচ্ছে? হয়ত। ‘বাড়িতে কেউ আছেন?’ ‘কে?’ লতার কণ্ঠস্বর। কিছু কণ্ঠ একবার শুনলেই মনের মাঝে এমন ভাবে গেঁথে যায় যে শত কণ্ঠস্বর থেকে সহজে আলাদা করে চেনা যায়। মিরাজ চুপ করে থাকলো। তার নাম বললে তো চিনবে না। তারচেয়ে বরং লতা এসে দরজা খুলুক। লতা দরজা খুলে দেখলো গতরাতের সেই ছেলেটা এসেছে।
‘আপনি এতো সকালে।’
‘কবিরাজ চাচা আছেন?’
‘আব্বা ঘুমাইতেছেন। আপনি পরে আইসেন।’
‘তিনি ঘুম থেকে না জাগা পর্যন্ত বসে অপেক্ষা করি?’
‘কইলাম না পরে আইসেন।’
লতা মিরাজের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো। মিরাজ হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে আসলো। ঘাটে বেঁধে রাখা নৌকাগুলোর একটাতে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পরে সে আবারো লতাদের বাসায় যাবে। কেন যাবে, গিয়ে বা কি লাভ, লতার সাথে আদৌ কি তার কিছু হবে? নিজেকে প্রশ্ন করে। নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দেয়, এসব করে কোন লাভ নেই। তাহলে সে কেন এসব করছে? জানি না, আমি কিছু করছি না। আমি যেন অন্য কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি। নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলো মিরাজ। মিরাজ লক্ষ্য করলো কয়েকজন লোক তড়িঘড়ি করে যাচ্ছে। সবার চোখে কৌতুহল যেন কিছু একটা ঘটেছে। একের পর এক লোক যাচ্ছেই। একজন মহিলা পেছনে পড়ে যাওয়ায় আরেকজন মহিলা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দেরি করতাছস ক্যান আয়।’ মিরাজ নৌকা থেকে উঠে তাদের পিছু নিলো।
খালিদ মাস্টারের বাড়ির সামনে যেন পুরো গ্রামের মানুষ ভীড় করেছে। বাড়ির দরজা বন্ধ থাকায় কেউ ভেতরে ঢুকতে পারছে না। অনেকেই বাড়ির দেয়াল ধরে উঁকি দিচ্ছে। খালিদ মাস্টার বারান্দার চেয়ারে বসে আছে। তার সামনে আনিছ দাঁড়িয়ে। আনিছের দু’হাতে দুটো মিষ্টির প্যাকেট। আনিছের সাথে তার স্ত্রী। বোরখা পরার কারনে চোখ দুটো ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। খালিদ মাস্টার তাকিয়ে আছে আনিছের স্ত্রীর দিকে। আনিছ মাথা নিচু করে আছে। খালিদ মাস্টার বলল, তুই এতোদিন পরে কোন মতলবে? আনিছ মাথা তুলে একবার তাকালো। তারপর নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি ঘরে গিয়ে বসো।’ ‘না ঘরে ঢুকার দরকার নেই। যেভাবে মানে সম্মানে এসেছিস সেভাবে বিদায় হ।’
আনিছের স্ত্রী ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিলো কিন্তু খালিদ মাস্টারের কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো। আনিছ অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘ভাইজান আমি চলে যাবো। আমার কথাটা শুনেন।’ ‘তোর কোন কথা শোনার ইচ্ছা আমার নাই। আবার কোন কুমতলবে এসেছিস তুই ভালো জানিস।’ খালিদ মাস্টারের স্ত্রী জামিলা বেগম স্বামীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, ‘বাইরে মেলা লোকজন। তারা বসুক পরে চইলা যাবে।’ খালিদ মাস্টার কথার জবাব না দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে আঙিনায় এসে দাঁড়ালেন। যারা বাড়ির দেয়ালের ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলো খালিদ মাস্টারকে দেখে তারা সবাই সরে গেলো। জামিলা বেগম আনিছের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমারা ঘরে আইসা বসো।
খালিদ মাস্টার কখনো ভাবেনি এতো বছর পরে আনিছ ফিরে আসবে। আনিছ সম্পর্কে খালিদ মাস্টারের চাচাতো ভাই। বাপ মা মরা ছেলেটাকে বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলো খালিদ মাস্টারের বাবা। যে বাড়িতে খেয়ে পরে বড় হলো সেই বাড়িতে চুরি করে পালাবে কে জানতো। আনিছের প্রতি রাগটা ফুরিয়ে গিয়েছিলো কিন্তু আজ এতো বছর পরে রাগটা কেমন যেন মাথা নাড়া দিয়ে উঠেছে। এই রাগটার কারন মরিয়ম নয়তো। মরিয়ম লোকমানের স্ত্রী। প্রায় উনিশ বছর আগে রাতের আঁধারে আনিছ মরিয়মকে নিয়ে পালিয়ে যায়। খালিদ মাস্টার একবার ঘরে এসে উঁকি দিয়ে গেলো। মরিয়ম এখনো বোরখা খুলেনি। মরিয়মের মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে তার। লোকমান যেদিন মরিয়মকে বিয়ে করে ঘরে তোলে পুরো গ্রামের মতো খালিদ মাস্টারও অবাক হয়েছিলো। লোকমানের মতো মাতাল যে ভাঁটিখানায় মদ খেয়ে পড়ে থাকে। যার একবেলা ভাত জুটে তো অন্যবেলা উপোস দিয়ে যায়। তার ঘরে এমন রূপবতী বউ যেন সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলো। খালিদ মাস্টার মরিয়মের প্রতি একধরণের টান অনুভব করতে থাকে। কারনে অকারনে লোকমানদের বাসায় যাওয়া শুরু করে। মরিয়মের দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে খালিদ মাস্টারের মনে হতাশা বাসা বাঁধতে শুরু করে। যেদিন জানতে পারে মরিয়ম আনিছের সাথে পালিয়ে গেছে ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে যায়।
লতা রান্নাঘরে সকালের নাস্তা বানাচ্ছিলো। লোকমান বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে। লতা তাড়াহুড়া করছিলো কারন লোকমান একটু আগেই বলেছে, ‘নাস্তা বানাতে এতো সময় লাগে।’ খালিদ মাস্টারের বাসার কাজের মেয়ে সুলতানা দৌড়ে এসে আঙিনায় দাঁড়ালো। মেয়েটা পুরো রাস্তা দৌড়ে এসেছে বুঝা যাচ্ছে। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। সুলতানা লোকমানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘চাচা লতা কই?’ লতা রান্নাঘর থেকে জবাব দিলো, ‘কে সুলতানা?’ সুলতানা রান্নাঘরের সামনে গিয়ে বলল, ‘তোর মা আইছে। দেখবি তো আয়।’ কথাটা শুনে লোকমানের বুক ধ্বক করে উঠলো। সে বারান্দা থেকে নেমে সুলতানার কাছে এসে বলল, ‘কি কইলি? কেডা আইছে?’
সুলতানা কিছুটা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘মরিয়ম চাচি আইছে।’ লতা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে সুলতানার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বলল, ‘চল।’ লতা বাবার অনুমতি নেয়া তো দূরের কথা একবার তার দিকে একবারের জন্যেও তাকালো না। লোকমানের গলা শুকিয়ে গেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। হাত পা কেমন যেন কাঁপছে। লোকমান সিগারেটে দুটো টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বাসা থেকে বের হলো। লতাকে দেখে ভীড় একটু সরে গিয়ে লতাকে যাওয়ার জায়গা করে দিলো। খালিদ মাস্টার দেখলো লতা এসেছে। লতা আঙিনায় দাঁড়িয়ে খালিদ মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘চাচা আমার আম্মা কই?’ কথা বলতে গিয়ে লতা কেঁদে ফেললো। এই সময়টার জন্য লতা কবে থেকে অপেক্ষা করছিলো। নিজের মাকে একটাবার দেখার জন্য।
খালিদ মাস্টার বলল, ‘ঘরে আছে যা।’
লতা দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকলো। বিছানার উপর বোরখা পড়া একজন মহিলা বসে আছেন। ইনিই কি তাহলে লতার মা। লতা কাঁদতে কাঁদতে মহিলাকে জড়িয়ে ধরলো। মহিলা আপ্রান চেষ্টা করছে লতাকে দূরে ঠেলে দিতে। লতা তত শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। পরিস্থিতি দেখে আনিছ জামিলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাবি এইসব কি হইতেছে? এই মেয়ে কে?’ জামিলা বেগম আনিছের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মরিয়ম চিনতে পারোনাই। এইটা লতা। তোমার মাইয়া।’ আনিছ অবাক হয়ে বলল, ‘ভাবি কি কইতাছেন এইসব। সে আমার স্ত্রী নীলূফা। মরিয়ম ভাবি আমার স্ত্রী হইবো ক্যান?’
আনিছের কথা যেন বাজ ফেলল। খালিদ মাস্টারের সাথে এলাকার আরো দু তিনজন মুরুব্বি বসে ছিলো। তারাও ঘরে ঢুকলো। খালিদ মাস্টার আনিছের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি বলতেছিস মাথা ঠিক আছে। মরিয়ম কই?’
‘মরিয়ম ভাবি কই আমি জানমু ক্যামনে?’ ‘তুই জানবিনা তো কে জানবে? তুই লোকমানের বউ মরিয়মরে নিয়া পালায়ে গেছিলি না।’ খালিদ মাস্টার কথা আনিছ কিছু বুঝতে পারছেনা। আনিছ বলল, ‘ভাই আমি পলাইছি একা। মরিয়ম ভাবিরে নিয়া পলামু ক্যান? আপনাগো কোথাও ভুল হইতাছে।’
‘দেখ আনিছ সত্যি করে বল ঘটনা কি?’ ‘ভাই বিশ্বাস করেন। আপনেরা কি কইতাছেন আমি বুঝতাছি না। আমি পলাইবার দিন রাইতে লোকমান ভাইয়ের বাড়িত গেছিলাম চুরি করা টাকাগুলান নিতে। টাকাগুলান মরিয়ম ভাবির কাছে রাখছিলাম এই কইয়া যে সেগুলান আমার জমান টাকা। আর আমি মিথ্যা কইলে, এমন কাম করলে এতো বছর পর ক্যান ফিইরা আসমু? চুরি করে আপনাগো বদদোয়া নিয়া পলাইছিলাম বইলা হয়তো আল্লাহ্ নারাজ হইয়া আমাগো নিঃসন্তান রাখছে। এতো বছর পর ফিইরা আসছি খালি মাফ চাইবার লাইগা।’ কথাটা বলে আনিছ কেঁদে ফেললো। আনিছকে দেখে মনে হচ্ছে সে সত্যি বলছে। তাহলে মরিয়ম গেলো কোথায়। সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। সবার চোখে মুখে বিষ্ময়। একজন মুুরুব্বি বললেন, ‘কেউ যাইয়া লোকমানরে খবর দে। তারে সাথে নিয়া আয়।’ গ্রামের লোকজনদের কৌতুহলে যেন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সবাই লোকমানের খোঁজে নেমেছে। যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি হয়েছে তার উত্তর হয়তো লোকমানই দিতে পারবে।
লোকমান নদীর পাড়ে বসে আছে। আতংকগ্রস্ত লোকমান বারবার মুখ গলা ঘাড়ে হাত বুলাচ্ছে। ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে ধরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। হাত থরথর করে কাঁপছে। চোখের সামনে বারবার পুরোনো সেই রাতের স্মৃতী ভেসে উঠছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। নদীতে প্রবল স্রোত। যে কোন মুহূর্তে নদীর পানি গ্রামে ঢুকে পড়বে। লোকমান নদীর পাড়ে বসে কলা গাছ দিয়ে ভেলা বানাচ্ছে। পাশেই বৃষ্টির পানিতে মরিয়মের নিথর দেহটা ভিজছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমানোর আলোয় মরিয়মের ফ্যাকাশে রক্তশূণ্য মুখটা দেখতে পাচ্ছে লোকমান। ভেলা বানানো শেষ হলে মরিয়মের দেহটা ভেলায় শুইয়ে দিলো লোকমান। ভারি পাথর দিয়ে মরিয়মের মুখটা থেতলে দিলো। ভেলাটা ভাসিয়ে দিলো নদীতে। তারপর চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদলো। লোকমান মরিয়মকে মারতে চায়নি। মরিয়মকে বিয়ে করার পর থেকেই সে লক্ষ্য করেছে অনেকের নজর পরেছে মরিয়মের ওপর। অনেকেই তার বাড়ি আসতো। লোকমান মরিয়মকে নিষেধ করছে। মরিয়ম বলেছিলো, ‘আমি তো কাউরে আসতে কই না। তারা আপনার খোঁজে আইসা বইসা থাকেন। আমি কি খেদায়া দিমু?’
সেদিন রাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে লোকমানের। মরিয়ম নিঃশব্দে উঠে দরজা খুলে বের হয়। কে এসেছিলো কি কথা হচ্ছিলো লোকমান শুনতে পায়নি শুধু এটুকু শুনতে পেয়েছে কেউ একজন মরিয়মকে বলছিলো, ‘আইজ পলামু।’ মরিয়ম ঘরে ঢুকতেই দুজনের কথা কাটাকাটি শুরু হয়। লোকমান রাগের মাথায় মরিয়মকে ধাক্কা দেয়। মুহূর্তেই ঘরে রাখা মাছ মারার কোঁচ মরিয়মের পেটের এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়। মরিয়ম মারা যাওয়ার সময় লতাকে একবার দেখতে চেয়েছিলো। ছয় মাসের লতা তখনো ঘুমে। পরেরদিন যখন লোকমান জানতে পারলো আনিছ পালিয়েছে। তখন সুযোগ বুঝে মরিয়মকে নিয়ে পালিয়ে যাবার কথা রটিয়ে দেয় সে। এত বছর পরে তার মিথ্যা ধরা পড়বে বুঝতে পারেনি লোকমান। কেউ একজন লোকমানের কাঁধে হাত রাখলো। লোকমান বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি ইচ্ছা কইরা তারে মারিনাই।
দুপুরে গ্রামে পুলিশ আসলো লোকমানকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেলো। আছরের নামাজের পরে স্কুল মাঠে মরিয়মের জানাজার নামাজ হলো। মিরাজ জানাজার নামাজে শরিক হলো। নামাজ শেষে বুঝতে পারছে না কি করবে। লতার বাসায় যাওয়া ঠিক হবে না। মিরাজ উপস্থিত হলো খালিদ মাস্টারের বাড়িতে। মিরাজকে দেখে খালিদ মাস্টার জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কে?’ মিরাজ বলল, ‘লতার এখন কি হবে?’ খালিদ মাস্টার ছেলেটার কথায় অবাক হলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘লতা আনিছের সাথে চলে গেছে।’ ‘চলে গেছে মানে?’ লতা নিজেই এসে আনিছের স্ত্রীকে বলেছে সে তাদের সাথে যেতে চায়।’ ‘তাদের ঠিকানা আছে আপনার কাছে?’
অল্প সময়ে এতকিছু ঘটে গেছে যে খালিদ মাস্টার আনিছের ঠিকানাটাই নেয়নি। মিরাজ আবারো প্রশ্ন করলো, ‘লতা যাদের সাথে গেছে তাদের ঠিকানা আছে আপনার কাছে?’ ‘না নেই।’ প্রত্যেক রূপবতী নারীকে নিয়ে কোন না কোন পুরুষের মনে সর্বদা না পাওয়ার একটা আকাঙ্খা থেকে যায়। একটা শূণ্যস্থান। যে শূণ্যস্থান কখনো পূরণ হয় না। মরিয়মকে নিয়ে খালিদ মাস্টার মনে যে শূণ্যতা ছিলো আজ লতাকে নিয়ে মিরাজের মনে সেই শূণ্যতা।