সুইসাইড নোট

সুইসাইড নোট

আপুর লাশটা দাফন করার জন্য নিয়ে গেছে।বাড়ির সবাই কান্নাকাটিতে মগ্ন। মা বেহুশ হয়ে পড়ে আছে সেই কখন থেকে।গ্রামের লোকজন আপুর জন্য আফসোস করেছিলো। আপু রাতে সুইসাইড করার আগে আমাকে কল দিয়ে বলেছিলো,রিতু তোকে অনেক মিস করছি।অনেক ভালোবাসি বোন।বাড়িতে আসলে তোর জন্য একটা ডাইরি রেখে যাচ্ছি। সেটা নিয়ে যাস। আমি রেখে যাওয়া সেই আপুর ডাইরিটা খোলে পড়তে বসেছি।কিছু কিছু কথা আপু তারিখ সহ লিখে রেখেছেন। শুরুর কথাটা দুইদিন আগের লিখা।

১২/৭/২০১৯ বোন যা লিখছি তোর জন্য লিখছি।পড়তে পড়তে তোর বোনটাকে ক্ষমা করিস। তখন বয়স বারো হবে।আমার ফুফাতো ভাইয়ের হাতে প্রথম রেপ হয়েছিলাম। ভাই সেদিন বলে দিয়েছিলো,যদি কাউকে এই বিষয়ে কিছু বলি তাহলে মেরে ফেলবে।আমি ভীতুর ডিম।মরার ভয়ে সেই বিষয়টা মাকেও বলিনি।পাঁচে যদি ভাই আমাকে মেরে ফেলে।সেদিন আমি সবচেয়ে বড় ভুলটাই করে ফেললাম।মরার ভয়ে প্রতিবাদ করেনি। ভাই প্রতিদিন পড়াতো আসতো আমাকে।বাবা-মা খুব বিশ্বাস করতেন ভাইকে।বাবা ভাইকে বলতেন,বাতেন,আমারতো কোন ছেলে নেই তুই আমার ছেলের মতো বাপ।বাতেন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলতেন,হ্যা মামা শিউলিতো আমার বোনের মতো।কথাটাতে কতটা খারাপ উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিলো বাবা না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝতাম।

আমাদের মস্ত বড়ো ঘরে আমার আরো তিন চাচারা সবাই এক সাথে থাকতো।ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যাতে পড়ার সময় ডিস্টার্ব করতে না পারে বাতেন ভাই ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিতেন।আমি যখন মাকে বলতাম,দরজা খোলা থাকুক না মা।এখানে আমার মা একটু সাবধান হলে পারতেন।কিন্তু তখন বাতেন ভাই শাসন করে বলতেন, এসব না পড়ার বাহানা।দরজা খোলা থাকলে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের চিল্লাচিল্লিতে উনার পড়াতে সমস্যা হয়।
মাও বাবার মতো বাতেন ভাইকে ছেলের মতোই ভাবতেন।উনার যে কোন কথা খুব সহজে বিশ্বাস করে নিতেন।
প্রতিদিন মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে রুটিন করে রেপ করতেন বাতেন ভাই।আমিও ভিতুর মতো চুপ করে থাকতাম।
ক্লাস নাইনে এসে পড়লাম মহা বিপদে।পিরিয়ড হয়নি দুমাস ধরে।সবসময় শরীরটা দুর্বল দুর্বল লাগে।একদিন দুপুরবেলা মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।

হাসপাতালের ডাক্তার জানালো আমি প্র্যাগনেন্ট।বাবা আমার গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিলেন।বাতেন ভাই অস্বীকার করলেন, বলল নিজের বোনকে কেউ কখনো এসব করতে পারে।কোরআন শরীফ ধরে সওম করলেন।এরকম ভয়ডর ছাড়া কাউকে পবিত্র কোরআনে হাত রাখতে দেখে আমার শরীর কাপছিলো।তারপর সেও আমার গালে কষিয়ে চড় বসিয়ে দিলেন।

মাতো আমাকে তার মেয়ে হিসেবে মানতেই পারছেনা।যে একজনের দয়ায় বাড়িতে স্থান পেয়েছি তিনি আমার বড় চাচা।বড় চাচা ভালো বুদ্ধিমান মানুষ।স্থানীয় সরকারি কলেজের প্রফেসর।বিয়ে করেননি একজনকে ভালোবেসেছিল বলে।এখনো ভালোবাসে। আমার কাছ থেকে নানান ভাবে কথা আদায়ের চেষ্টা করছেন উনি।বড় চাচার কাছে সেদিন হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম, আমার মা দরজা বন্ধ করে চলে আসলে বাতেন ভাই আমাকে আর পড়াতেননা।বাকিটা চাচাও বুঝে গিয়েছিল।

আমি আগে বলেনি কেন বলে চাচাও হাত তুলতে গিয়ে আর তোললেন না।তারপর যা হওয়ার তাই হলো।এবরশন করতে হাসপাতালে নিয়ে গেলো আবার। স্কুল বা পাড়ায় সবখানে তখন আমার একটাই পরিচয়,আমার চরিত্র নাই।বেইশ্যা কাকে বলে তখন কিন্তু জানতামই না।বেইশ্যা ডাকটা শুনতে আমার ভালো লাগতোনা। আমি একা ফিল করেছিলাম খুব।কেউ কথা বলেনা বাড়িতে। বাতেন ভাইয়ের সাথে ঠিকই কথা বলে।তুইও বলেছিস। এটুকু পড়ে ডাইরিটা অনেক্ষণ বুকে জড়িয়ে ধরেছি।সত্যটা কেউ শুনেনি,শুনেছে এক নরপশুর ক্ষুধার্তের কথা।বাতেন ভাইকে পশুর সাথে তুলনা করলেও পাপ হবে।

আরেক পৃষ্ঠা উল্টালাম শেষ লেখা আপুর এটা, তারিখ ১৫/৭/২০১৯ বড় চাচা এসএসসি শেষে আমাকে শহরে পাঠিয়ে দিলে ভেবেছিলাম একটু মুক্তি পাবো।কিন্তু পুরনো ঘা কিন্তু সেরে ওঠেনি। বাড়িতে এসেছিলাম দীর্ঘ পাঁচ বছর পর।তুইও শহরে চলে গেছিস।কাল রাতে বাবারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাতেনের সাথে আমার বিয়ে দিবে।বাতেনের বয়স চল্লিশ আর আমার একুশ।মাকে বলেছিলাম মা উনাকে আমি বিয়ে করবোনা।মা বলল,আমার চরিত্র নেই জেনেও বাতেন আমাকে বিয়ে করছে আমার জন্য কোনো সম্বন্ধও আসেনা।আমার পরিবারের লোকজনের কারো এটুকু বুদ্ধি নেই যে,লোকটা পাঁচ বছর আগে কোরআন শরীফ ধরে বলেছিলো, শিউলি আমার বোনের মতো,ওর সাথে আমার এধরনের সম্পর্ক আমি হারাম মনে করি।শুনেছি বাতেন ভাইকে কোনো মেয়ে পছন্দ করেনা।কারণ গত চার বছর ধরে কি একটা অসুখে তার হাত দুটোই অচল। সাবধানে থাকিস বোন।তোকে একটিবার দেখার ইচ্ছে ছিলো।পূরণ হয়নি।ইতি তোর শিউলি আপু।

মায়ের হুস এখনো ফেরেনি।মনে মনে বললাম, এই হুশ না ফিরুক।যে হুস সন্তানের দূর্দশায় ফিরেনা,সে হুশ মৃত্যুর পর আর ফিরার দরকার কয়।পাড়ার মানুষজন আজ যেভাবে আপুর জন্য আফসোস করে মায়া কান্না করছে সেদিন যদি কেউ একজন বলতো, তোমার কথা আমি বিশ্বাস করেছি।আমরা সমাজের সবাই বিশ্বাস করেছি।আমরা সবাই তোমার পাশে আছি।কোন পশু আছড়িয়ে তোমার শরীর খেলে তুমি তার ব্যাথায় মরে যাবে এমন কোন কথা নেই,আমরা এধরণের পশুগুলোর আছড়িয়ে খাওয়ার বিষাক্ত দাত ভেঙে দিবো।এই কথা কেউ তখন কেউ বলেনায়।শুনেছে উল্টো বাতেনের কথা। আপুর কথা কেউ শুনলনা।যদি শুনত,তাহলে হয়তো আপুর এই দশা হতোনা।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত