সারাজীবন ক্লাস করতে করতে আজ প্রথমবার ক্লাস করাতে আসলাম। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে নবম শ্রেণী দেখিয়ে দিলেন। একটু ভাব নিয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়লাম। কিছু বলতে যাবো তখনই একজন হেঁসে উঠলো! তার দেখাদেখি সবাই একসাথে হাঁসতে শুরু করলো! হাঁসির শব্দ শুনে পাশের কক্ষ অর্থাৎ দশম শ্রেণী থেকে ম্যাডাম এসে দরজায় দাঁড়ালেন। কিছু বলতে যাবো তখন মেডামও স্ব-শব্দে হাঁসতে শুরু করলেন! আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। একেবারে লাস্ট ব্রেঞ্চ থেকে আওয়াজ আসলো, স্যার আপনার গেইট খোলা! বুঝতে বাকি রইলো না। হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিয়ে সোজা চলে গেলাম ওয়াশরুমে। তারপর গেইট অর্থাৎ চেইন আটকালাম। ভাবতেই অবাক লাগে এখন আমি সবাইকে মুখ দেখাবো কিভাবে?
মুখে এক ঝাপটা পানি মারলাম। তারপর লজ্জা-শরম পকেটে রেখে বেরিয়ে পরলাম ওয়াশরুম থেকে। আর ফীরে তাকাইনি ওই শ্রেণীকক্ষের দিকে। বাকি সব শ্রেণীর স্টুডেন্টদের ভালোই লেগেছে। তারাও আমায় মেনে নিয়েছে খুব। অবশেষে ছুটির ঘন্টা। বিকেল ৪ঃ০০টা বাঁজে। একা একা হাঁটা ধরলাম। স্কুল থেকে বাড়ি পর্যন্ত অনেক লম্বা রাস্তা। প্রায় দশ মিনিট যাবৎ হাঁটছি তাও অর্ধেক রাস্তা পাড়ি দিতে পারিনি। হঠাৎ নতুন একটা ঘ্রান নাকে ভাসলো। চেনা চেনা লাগতেছে। নাক টেনে শুকতে শুকতে এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলাম। পিছন ফিরতেই দেখি মুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে
– কি খবর মাস্টার মশাই সারাদিন কেমন কাটছে?
– ফাজলামো করবা না একদম। এমনিতেই যে একটা বিপদে পরছিলাম
– বিপদ! কি বিপদ? আরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেনো?
আমি দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে দাঁড়িয়ে আছি। তবুও মুচকি হাঁসিটা আড়াল করতে পারিনি।
– তুমি কি আমার সাথে ফাইজলামি করতেছো? আশ্চর্য আমার কথার উত্তর না দিয়ে মেয়ে মানুষের মত হাঁসতেছ কেনো?
– সে এক আজব কাহিনি। তোমাকে বলা যাবেনা। আমি হাঁটা ধরলাম। পিছন থেকে মুনিয়া আমার হাত ধরে আটকে রেখেছে।
– আরে ছাড়ো। ধরে রাখছ কেনো?
– তুমি আগে বলো, আজকে কি হইছে তোমার সাথে?
– বাদ দাওনা এসব
– বাদ দিবো! কি বাদ দিবো? তুমি বলবা কিনা তাই বল
মাথা নিচু করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলে ফেললাম। কোনো সাড়া শব্দ নেই! মুনিয়া চলে গেছে নাকি? মাথা উপরের দিকে তুলতেই মুনিয়া হাঁসতে শুরু করল। হাঁসতে হাসঁতে পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। মুনিয়া হাঁসতে হাঁসতে সোজা হাঁটা দিলো। আমিও চলে আসলাম বাসায়। পত্রিকা হাতে নিতেই উপরের অংশটায় চোখ পড়ল। তারিখ না দেখলে তো মনেই হতনা আগামীকাল ভ্যালেনটাইনস ডে! পত্রিকা হাত থেকে রেখে লেপটপ নিয়ে বসে পরলাম। ফেসবুকে ঢুকতেই দেখি মুনিয়া একটিভ। মেসেজ দিলাম
– হাই বাবু
– একদম বাবু বলবা না। বাবু আমি না তুমি হ্যায়? আজকের ঘটনার কথা ভুলে গেছো? (সাথে রাগান্বিত কয়েকটা ইমুজি)
– তোমাদের মেয়েদের এই একটাই দোষ। একটা উদাহারন পেলেই খুঁচা মারতে মারতে শেষ
– এই এই একদম না আমি খুঁচা দিলাম কই? আমি মিথ্যা কিছু বলছি?
– আচ্ছা বাদ দাও আগমীকাল কি মনে আছে?
– ভালো করে মনে আছে বুঝছ? তুমি একটা কাজ করবা আগামীকাল কলেজের সামনের কফিশপ যেখানে আমাদের প্রথম ডেট সেই কফি শপে আসবা সকাল ৯টায়। আর শুন নীল রঙের পাঞ্জাবিটা পড়ে আসবা।
– নীল নীল আর নীল এত পছন্দ?
– হ্যা এতই পছন্দ
– আচ্ছা ঠিক আছে তুমিও নীল শাড়ি পড়বা
মুনিয়া মেসেজ সিন করে অফলাইন গেছে। আমিও চলে আসলাত ফেসবুক জগতের বাইরে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিয়ে দেখি ২২টা মিডস কল! মুনিয়া এত মিডসকল কেনো দিলো? ৮.৫২মিনিট! আমার হাতে মাত্র ৮মিনিট বাকি। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। ৩মিনিট লেট!
তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বেরুলাম। তারপর একটা রিকশা নিয়ে সোজা কলেজের সামনে। কিন্তু এত ভীড় কিসের? মনে হয় এক্সিডেন্ট হয়েছে! ভীড় ঠেলিয়ে সামনে এগোলাম। নীল শাড়ি পড়া একটা রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে আছে! নীল! মুনিয়া অতো নীল শাড়ি পড়ার কথা! আমার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। চোখদুটো ঘোলাটে হয়ে গেছে। সবকিছু কেমন আবছা দেখাচ্ছে। তবুও সামনে গেলাম। এতক্ষণে পুলিশ চলে এসেছে। একজন সামনে এগিয়ে গিয়ে বডিটা ঘুড়িয়ে দেখালেন।
আমার ভীতরটা শুকিয়ে গেছে। চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে বহু কথা কিন্তু বলার মত শক্তি নেই। মাটিতে বসে পড়লাম। একটা এম্বুলেন্স এসে নিয়ে গেলো মুনিয়ার মৃতদেহ। একে একে সবাই চলে গেছে। কিন্তু আমি সেই আগের জায়গায় বসে আছি। উঠতে পারছি না। কিছু ভাবতেও পারছিনা। সবকিছু অদ্ভুত লাগতেছে। হাত-পা শীতল হয়ে গেছে। আর বসে থাকা সম্ভব নয়। শুয়ে পড়লাম মাটিতে। চোখদুটো আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেছে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।