বিচ্ছেদ

বিচ্ছেদ

রোদেলার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। চার বছর ধরে একা থাকি। অনেক দিন পর আমি অনেক খুশি। মন থেকে খুশি। আমার মেয়ের একটা চিঠি পেয়েছি। নিজের হাতে বানানো চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পড়তে লাগলাম।
“ প্রিয় বাবা, তুমি কেমন আছো জানি না। আমরা কেমন আছি তোমার কী কখনো জানতে ইচ্ছে হয়? তোমরা কেন একসাথে থাকো না? তাও আমি জানি না। বাবা, খুব খারাপ লাগে যখন স্কুল শেষে বান্ধবীরা দৌড়ে বাবার কোলে উঠে। খুব কষ্ট হয় যখন বান্ধবীরা বলে, ‘ আমার বাবা, দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো বাবা। ’

আমি তা বলতে পারি না। আমার বাবা তো আমার জন্য টিফিন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না। আমার বাবা তো আমাকে নিয়ে ঘুরতে যায় না। আমার বাবা তো আমার জন্য চকলেট নিয়ে বাড়ি ফেরে না। আমার বাবা তো কোনোদিনও আমার সাথে কানামাছি খেলে না! বাবা, আম্মু যখন রান্না করে তখন একটা কথা বলে। রান্না করা শিখো। নাহলে শ্বশুরবাড়িতে গেলে বলবে। মা বাপে কিছু শেখায়নি? মা কেন তোমার কথা বলে? তুমি তো আমাদের সাথেই থাকো না। শেখাবে কীভাবে? বাবা, আমার জ্বর হলে আম্মু অফিসে যেতে পারে না। মাঝেমাঝে আম্মুকে যেতেই হয়। জরুরী কাজ পড়ে যায়! আমি জানি তুমি হলে তা পারতে না। শত কাজ থাকলেও না। বাবা, ঈদের কেনাকাটা করতে সবাই বাবার সাথে যায়। আর আমি আমার বাবাকে এক নজর দেখতেও পারি না ঈদের দিনে!

বাবা, আম্মু বলে আমার মা বাবা দুটোই নাকি আম্মু। আমি তখন টিফিনের টাকা জমিয়ে তোমার জন্য কেনা পাঞ্জাবিটা দিয়ে বলি। ‘ তাহলে পাঞ্জাবিটা পড়ে জুম্মায় যাও। আমার জন্য জিলাপি আনবা কিন্তু। ’ আম্মু তখন কিছু বলে না বাবা। চুপ করে থাকে। মাঝেমাঝে আমাকে চড় থাপ্পড়ও দেয়। দিয়ে নিজেই কাঁদে! বাবা, আমি বাইরে একা যেতে পারি না। আম্মু সবসময়ই সাথে যায়। একা যেতে পারলে তোমার কাছে ছুটে যেতাম। ট্রেনের টিকিট আমি কাটতে পারি। বাবা, তোমার কী বেষ্ট ফ্রেন্ড আছে? আছে মনে হয়। থাকবে না কেন? সবারই বেষ্ট ফ্রেন্ড থাকে। আমার বান্ধবীদেরও আছে। তাঁদের বেষ্ট ফ্রেন্ড হলো বাবারা। আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড আম্মু!

বাবা, আমি পরীক্ষাতে পাশ করি। শুধু পাশ করি না। স্কুলের মেধাবীদের তালিকায় আমার নাম আছে। স্যারেরা সব মেধাবীদের বাবাকে ডেকে উপহার দেয়। তোমার অনেকগুলো উপহার আম্মুর কাছে। বাবা, আমি গান গাইতে পারি না। ছবি আঁকতে পারি না। আমার বান্ধবীরা পারে। ওদের বাবা শেখায়। আমার আম্মু শেখায় শুধু কোন তরকারীতে কতটুকু লবণ দেয়া দরকার! বাবা, আমি ঝগড়া করতে চাই আম্মুর সাথে। একা একা পারবো না। আম্মু যেই রাগি। তুমি কী আমার পার্টনার হবে? বাবা, আমি আম্মুকে বোকা বানাতে পারি না। আম্মু অনেক চালাক। তুমি কী আম্মুর বোকাবোকা চেহারাটা দেখার সৌভাগ্যটা করে দিবে?

বাবা, আমি দুয়েকদিন বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যেতে চাই। তোমার আশকারা পেয়ে আম্মুর মাথায় চড়ে বসতে চাই।
বাবা, আমি তোমার সাথে রাগ করতে চাই। তোমাকে শাসন করতে চাই। যখন আমি কষ্ট পাবো। তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাই। বাবা, আমি তোমার হাতটা ধরে আমি সারা বাংলাদেশ ঘুরে দেখতে চাই। তোমার কাঁধে হাত রেখে আকাশ দেখতে চাই। বাবা, আমি তোমার সাইকেলের পিছনে বসে স্কুলে যেতে চাই। বাবা, তুমি কী আমার কথা শুনছো? কোনোদিন কী এসব সম্ভব হবে না? কোনোদিন কী আম্মুকে সাথে নিয়ে আমরা একটা পিকনিক করতে পারবো না?

এই দেখো, আম্মু ডাকছে ঘুমাতে। কত অভিযোগ ছিলো তোমার নামে! লিখতে পারলাম না আর! ” আমি ভীষণ কঠিন মনের একটা মানুষ। তাও কেন যে চোখটা ভিজে গেলো! এর মাঝে দারোয়ানটা এসে বললো। “ সাহেব আমার মেয়েটার জ্বর। বাড়ি যেতে হবে। জরুরী ফোন এসেছে! আমি না গেলে আবার ওর জ্বর সারে না! ” আমি মাথা নাড়িয়ে যেতে বললাম। আজকে আমার চিৎকার করে কান্না করার দিন! দারোয়ানটা থাকলে বিরক্ত হতে পারে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত