শেষ সময়

শেষ সময়

কাল আমার বিয়ে,আজ গায়ে হলুদ। বিয়ে মানে,বিয়ে হয়ে গেছে ১ সপ্তাহ আগে,কাল প্রোগ্রাম করা হবে ধুমধাম করে। শুভ্রের সাথে আমার ৪বছরের সম্পর্কের পর বিয়ে হচ্ছে আমাদের।সারাবাড়িতে ধুমধাম চলছে,অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছেন,আরো অনেকে আসছেন।সবাই গল্প,আড্ডা,গান,ছবিতে মেতে আছে।এক বিশাল উৎসব উৎসব ভাব সবার মাঝে।কাজিনদের একটা গ্রুপ এক রুমে দরজা বন্ধ করে নাচ প্র‍্যাকটিস করছে,রাতে সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে তাই।বাচ্চারা খেলছে আপন মনে,মা,কাকী,খালা,মামী রা বসে গয়নাগাটি, খাওয়াদাওয়া নিয়ে আলোচনা করছে।বাবা,চাচা,মামা,খালু রা বাইরে গেছে কেউ,কেউ বা ছাদে গিয়ে রাতের আয়োজনের ব্যবস্থা দেখাশোনা করছে। সবাইকে এতোদিন পর এভাবে একসাথে দেখতে আসলেই খুব ভালো লাগছে।

সবাই যেনো সবাইকে নিয়েই ব্যস্ত,কাউকে ডিস্টার্ব করতে ইচ্ছা হচ্ছে না।কিন্তু আমার পার্লার এ যেতেই হবে মেহেদী দিতে।একাই চলে যাবো ভাবছি কিন্তু মা বাসা থেকে একা বের হতে নিষেধ করেছে। পার্লার টা কাছেই,তাই সবার ব্যস্ততার আড়ালে মুখ ঢেকে চুপটি করে চলে আসলাম বাইরে।আহ!কি সুন্দরআকাশ,বাতাস।এই ৩দিনেই মনে হচ্ছিল যেনো অনেকদিন বের হই না। আকাশে কিছুটা মেঘ করেছে,বৃষ্টি আসবে মনে হয়।বিয়ের ডেইট টা পিছাতে পিছাতে শীতকাল চলে গেলো,এখন বসন্ত,কিন্তু প্রায়ই বর্ষাকালের মত বর্ষনের দর্শন পাওয়া যায়।

আমার ইচ্ছা করছে ইচ্ছামত বৃষ্টিতে ভিজি,একা একা হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে আনমনে হাঁটছিলাম।হঠাত ভাবনায় ছেদ পরল গাড়ির হর্ণ এ,একটানা হর্ণ দিয়েই যাচ্ছে এমন গলির রাস্তায়,যেখানে কয়েকটা রিকশা আর এক দুটো প্রাইভেট কার ছাড়া কিছুই চলে না।আর আমি হাঁটছি ফুটপাত ধরে,তাহলে আমাকে উদ্দেশ্য করে দেয়ারও প্রশ্ন আসে না।।বিরক্ত হয়ে পিছনে তাকাতেই দেখি নীল রঙের গাড়ির ভিতরে ড্রাইভিং সিট এ শুভ্র বসে হর্ণ বাজাচ্ছে আর হাসছে।

-এই নীরা,তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠো। আমি দেখা মাত্র তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলে গিয়ে বসে শুভ্রের মাথায় একটা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কি এই সময়ে!?

-ভালো লাগছিল না,আকাশে মেঘ করেছে দেখেই বের হয়ে গেলাম,খুব ইচ্ছা করছিল তোমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হই। কিন্তু বিয়ের আগের দিন বাসা থেকে তোমাকে নিয়ে বের হয়ে এভাবে উদাস হাঁটা দিলে পা ভেঙ্গে দিবে।

-কিন্তু তুমি কিভাবে জানলে আমি এখানে থাকবো,আমিতো পার্লারে যাচ্ছিলাম মেহেদী দিতে।

-তুমি কাল রাতে বলেছিলে আজকে পার্লারে যাবে,তো ভাবলাম পার্লারের সামনে গাড়ী নিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করি,বের হলে দেখা হবে।।কিন্তু তার আগেই তোমার দেখা।এখন কি পার্লারে যাবে নাকি ঘুরবে?

-চলো একটু ঘুরে আসি এই সুন্দর আবহাওয়ায়!

শুভ্র গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো,শহরের অলিগলি পেরিয়ে হাইওয়ে তে উঠে গেলো।জানালার কাচ নামিয়ে চুল খুলে দিলাম।মনে হচ্ছে বহুদিন পর মুক্ত পাখির মত উড়ছি।হঠাত ই ঝুম করে বৃষ্টি নামলো,শুভ্র গাড়ির গতি একটু কমিয়ে রবীন্দ্র সংগীত ছেড়ে দিল।আমি হাত বের করে বৃষ্টিকে ছুঁয়ে দেখছি। হঠাত মাঝরাস্তায় একটা বিশাল বড় মাঠের সামনে শুভ্র গাড়ি থামালো।গাড়ি থামিয়েই বলল-চলো,বৃষ্টিতে ভিজি। যেই বলা সেই কাজ,আমিও বের হয়ে মাঠে দিলাম দৌড়! লাফালাফি,ঝাপাঝাপি কিছুই বাকি নেই,শুভ্র আমায় কোলে নিয়ে ঘুরতে লাগল আর গান গাইতে লাগলো। আমি চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে ভিজতে লাগলাম।মনে হচ্ছিল অন্য জগতে ভেসে বেড়াচ্ছি। হঠাত,শুভ্র থেমে গেলো,কেমন যেন পরে যেতে লাগলো।আমাকে নামিয়ে দিলো,তারপর হঠাত করেই শুভ্র মাঠের জমে থাকা পানিতে পরে গেলো।

আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না কি করব,অন্য জগত থেকে যেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে ফিরে এলাম।শুভ্র কে অনেক ডাকাডাকি করলাম,শুভ্র চোখ খুলতে পারছে না।আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই,তুমুল বৃষ্টির জন্য রাস্তায় ও লোকজন নেই।একজন রেইনকোট পরা লোক সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল,উনাকে থামিয়ে উনার সাহায্য নিয়ে শুভ্রকে অনেক কষ্টে গাড়িতে উঠালাম।পালস বিট দেখলাম,অনেক কম পাচ্ছি। সাথে সাথে গাড়ি স্টার্ট দিলাম,খুব ভালো ড্রাইভিং না পারলেও এখন রাস্তা খালি তাই আল্লাহর নাম নিয়ে চলতে শুরু করলাম।মাথায় অনেক কিছু ঘুরছে।কোনোভাবে হাসপাতাল পৌঁছাতে পারলে হয়।

২ঘন্টা পর, হাসপাতালের বারান্দায় আমার বাড়ির ও শুভ্রের বাড়ির অনেকে অপেক্ষা করছে।লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে তাকে।আমার মা শুধু কান্না করছে আর বলছে- নীরা কিভাবে এতো বড় কথা আমাদের কাছে লুকাতে পারলো? শুভ্রের লাংস ক্যান্সার এর লাস্ট স্টেজ,ধরা পরেছে বেশিদিন হয়নি।কয়েক মাস আগেই ধরা পরে,তারপর শুভ্র দূরে সরে যেতে চায়,কিন্তু আমি নাছরবান্দার মত বিয়ের জন্য বাসায় সবাইকে বললাম কিন্তু শুভ্রের অসুখের কথা কাউকে বলিনি, এবং শুভ্রকেও কাউকে বলতে নিষেধ করে দিই।

আমি জানি ক্যান্সার হলে কেউ বেশিদিন বাঁচে না,কিন্তু কেন জানি না বাচ্চাদের মত মনে অগাধ বিশ্বাস ছিল যে শুভ্রের অসুখ টা ভুল।আসলে কিছুই হয়নি,যদিও বা কিছু হয়ে থাকে তবে বিয়ের পর একদম ভালো হয়ে যাবে।আমাদের সুন্দর সুখের সংসার হবে। আচ্ছা কারো যদি ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ হয়,এতো সুন্দর করে হাসতে পারে সে?হাসিতে এতো প্রাণবন্ত ভাব থাকতে পারে?এতো সজীব চেহারা হতে পারে?আমার তা বিশ্বাস হয়নি। তাছাড়া ওর সিগারেট খাওয়ার ও অভ্যাস ছিল না। তাই সব সত্য কে দূরে ঠেলে কিছুদিনের জন্য হলেও ভালোভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম। অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলো,বাড়িতে প্রোগ্রামের রান্না সেই দুপুরেই শেষ। রান্নার ঘ্রাণ সারাবাড়িতে।সেই ঘ্রাণের সাথে আগরবাতির ঘ্রাণ মিশে যাবে কে জানতো!? রাত ৮টায় খবর এলো,শুভ্র আর নেই!!!

আমার হাতে বোধহয় এইজন্য মেহেদী দেয়াটা আর হয়নি,নতুন বউ এর হাতে মেহেদী অবস্থায় তার স্বামী মারা গেলে,সেই মেহেদী রাঙা হাত টা দেখতে কেন যেন অনেক বেশি ই খারাপ লাগে। আমি কান্না করছি না,তাই সবাই অবাক চোখে আমাকে দেখছে। বুকের ভিতর একটা পৃথিবী সমান পাথর আটকে আছে বলে মনে হচ্ছে। হাউমাউ করে কান্না করতে ইচ্ছা করছে,কিন্তু চুপচাপ বসে বৃষ্টি দেখছি আর ভাবছি জীবনের শেষ সময়টুকুতেও শুভ্র এই নীরাকেই পাগলের মত ভালোবেসেছিল,আর উপহার দিয়েছিল শ্রেষ্ঠ কিছু সময়! এই স্মৃতিগুলো দিয়েই নাহয় জীবন চলে যাবে কোনোভাবে।ভালো থেকো শুভ্র।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত