–রুপা, কাল আরেকটু পরে এসো।মানে কাল সন্ধ্যায় পড়তে এসো।তোমাকে একা পড়াবো , একটু বেশি পড়াবো।বুঝলে ?
রায়হান স্যার, আলাদা করে ডেকে নিয়ে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে কথাগুলো বলছিলো।স্যারের কাছে আমরা কয়েকজন ইংরেজি পড়তাম। স্যারের তাকানোর ভঙি, কথা বলার স্টাইল কিছুই আমার ভালো লাগছিলো না।তাড়াতাড়ি স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। বাসায় আসার পর ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাদের এলাকায় কোনো টিচারই পাওয়া যায় না।গ্রাম্য এলাকা,তার জন্যই মাধ্যমিক শেষে ভালো ছাত্রছাত্রীরা গ্রাম থেকে শহরে পড়ার জন্য চলে যায়।এই কারণে বরাবরই আমাদের এখানে বাইরের কোনো শিক্ষক বা ভালো কোনো শিক্ষক পাওয়া যায় না।
কলেজে এই স্যার খুব ভালো ইংরেজি পড়ায় এবং খুব ভালোই বুঝায়।তাছাড়া খুব মেধাবী একজন টিচার।পরীক্ষাতে ভালো করতে হলে এই স্যারের কাছেই পড়তে হবে।কিন্তু এভাবে পড়াটা অসম্ভব ! প্রায় উনি গায়ে হাত দিয়ে কথা বলে। কিছু ভেবে না পেয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বললাম,
–মা, আমি রায়হান স্যারের কাছে আর পড়বো না।
–কেন ? স্যারের কাছে না পড়লে তুই পরীক্ষা কিভাবে দিবি ? এসব ফাঁকিবাজি ন্যাকামি চলবেনা।যা নিজের রুমে গিয়ে পড়তে বোস।।
মা ধমকের স্বরে আমাকে কথাগুলো বললো।মা আমার কথাটা শোনার প্রয়োজনই মনে করলো না।
কি করবো ? কিছুই মাথায় আসছে না ! স্যারের কাছে পড়ার সুবিধা হচ্ছে উনি টিউশন ফি অর্ধেকটা রাখেন। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে এটাও বা কম কিসে ? কিন্তু মা আমাকে একটুও বুঝলো না।
আমি কলেজের তেমন কাউকেই চিনিনা।নতুন ভর্তি হয়েছি, তার জন্য কারো সাথে রায়হান স্যারের ব্যাপারটা শেয়ার করতে পারছি না।পরদিন যথারীতি একই সময়ে স্যারের কাছে পড়তে গেলাম। পড়া শেষে স্যার আজও সবাইকে বের করে দিয়ে আমায় একা রুমে রাখলেন।ভীষণ ভয় হচ্ছিলো ! স্যার ক্রমশ আমার সামনে আসলো !
–বুঝলে রুপা , দুনিয়াতে কারো ভালো চাইতে নেই।এই দেখো, তোমাকে বললাম, একটু দেরি করে আসতে, যেন একটু বেশি পড়াতে পারি।আর তুমি এটা কি করলা বলোতো?
–স্যার,আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।মা চিন্তা করবে । আমি বাসায় যাবো।
–বাসায় যাবা, ভালো কথা।আমি তো তোমাকে এখানে রেখে দিবোনা, বলো।কিন্তু তুমি এমন কেন ? বুঝোনা, আমি কি চাই ?
রায়হান স্যার, হাতের স্পর্শে ক্রমশ আমার পিঠের উপর থেকে স্কার্ফটা সরিয়ে ফেলছিলো।ভীষণ ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
–কি চান আপনি ? এভাবে আমাকে কেনই বা বিরক্ত করেন? দেখুন স্যার, আপনি আমার শিক্ষক, আমার বাবার মত।আপনি আমার সাথে এমন কেন করছেন ?
–হাহাহা, বোকা মেয়ে । সবাই যদি বাবার মত হয় তাহলে লাইফে এনজয় কিভাবে করবা?
কেমন বিদঘুটে ভাবে হাসছিলো লোকটা ! হঠাৎ স্যারের রুমের দরজায় নক পড়লো।স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–এই মেয়ে শোনো, সাবধান ! এসব কথা যেন কেউ জানতে না পারে।ওরা পড়তে এসে গেছে আজ তুমি যাও।
কাল অবশ্যই সন্ধ্যায় আসবা।নতুবা তোমার মায়ের কাছে ফোন দিয়ে তোমার নামে উল্টাপাল্টা কথা বলবো।যাও এখন।
স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় চলে আসলাম।স্যারের ব্যাপারটা মা’কে বললে মা বিশ্বাস করবে না।ভাববে,আমি ফাঁকিবাজির জন্য মিথ্যা বলছি।আমার মাথায় কিছু আসছেনা।সত্যি কি কাল না গেলে রায়হান স্যার মা’কে ফোন করে উল্টাপাল্টা কথা বলবে ? কিন্তু কি করবো আমি ?
পরেরদিন আমি আর কলেজ বা প্রাইভেট কোথাও যাইনি।ইদানিং রায়হান স্যার একটু বেশি বিরক্ত করছে।ভীষণ ডিপ্রেশড ছিলাম।কাউকে পাশেও পাচ্ছিনা।আচ্ছা, মেয়ে হয়ে জন্মানোটা কি ভুল ? আজও কেন মেয়েদের চলার পথে বাধার সৃষ্টি হয় ? হঠাৎ মা রুমে এসে আমার পাশে বসলেন।দেখে মনে হচ্ছে খুব রেগে আছে।তার মানে রায়হান স্যার কিছু বলেছে ?
–তুই আজ পড়তে গেলি না কেন ? তাছাড়া কলেজে কি করে বেড়াস ? তোর নামে এসব কি শুনছি ?
–মা শোনো,…
–একদম চুপ।একটা কথাও বলবি না।কাল যদি প্রাইভেট পড়তে না যাস তাহলে দেখিস, আমি কি করি ? সামনে এক্সাম,এই সময়ে এমন ফাঁকিবাজির কোনো মানেই হয়না।
মা কথাগুলো বলতে বলতে আমার রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।মনোবল সম্পূর্ণ হারিয়ে যাচ্ছে ! আমার কি করা উচিৎ ? কিছুই বুঝতে পারছি না ! আমি কি আত্মহত্যা করবো ? কিন্তু এতে রায়হান স্যারের মত নরপিশাচের তো কিছুই হবেনা।সমাজের চোখে ওরা ভদ্রের কাতারে এক নম্বর লিস্টে থাকবে ! এমন একজন নির্লজ্জ শিক্ষকের এইটা প্রাপ্য নয়।
হঠাৎ পাশের রুম থেকে টেলিভিশনের আওয়াজ কানে আসলো।সায়মা নামের একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।কিছুদিন যাবত মেয়েটাকে কয়েকজন বখাটে উত্যক্ত করেছিলো।মেয়েটাকে নিয়ে ভীষণ বাজে কথা, পুরো ভার্সিটিতে ছড়িয়ে পড়েছিলো।মেয়েটা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। না,আমি আত্মহত্যা করবো না।সায়মার মত ভুল, আমি করবো না।এর শেষ কোথায় ইনশাআল্লাহ্ আমি দেখে ছাড়বো।উপরে ন্যায় বিচারক ঠিকই আছেন।তিনি এর বিচার ঠিকই করবেন।
পরেরদিন কলেজে গিয়ে জানতে পারি, সায়মা নামের মেয়েটা রায়হান স্যারের মেয়ে।গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে, হোস্টেলে থেকেই লেখাপড়া করতো। আজ মেয়েটার লাশ নিয়ে আসবে শহর থেকে। কথায় আছে, পাপ বাপকেও ছাড়েনা। কিন্তু মেয়েটার কি দোষ ছিল ? এভাবে কেন মেয়েটাকে মরতে হলো ? তবে কি বাবার অপরাধের শাস্তি, মেয়েটার মৃত্যু দিয়ে হয়েছে !