” শোভন তুমি এমন ব্যবহার করছো কেনো “?
-” কেমন ব্যাবহার “?
-” তুমি আমাকে কি আর সত্যিই ভালোবাসো না “?
-” নাহ্ । সত্যিই তোমার সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করা সম্ভব হচ্ছে না “।
-” কারণটা জানতে পারি “?
-” কারণ আবার কি । তোমায় আর সহ্য হচ্ছে না “।
-” ওহ, মাত্র দেড় বছর রিলেশনেই আমাকে আর ভালো লাগছে না “?
-” না। তোমার চেয়ে সুমি অনেক সুন্দরী “।
নাবিলার চোখে-মুখে ঘৃণার ছাপ এনে মুখটা কালো জামের মতো করে খুব কড়া গলায় বলতে লাগলো,
-” তোর মতো ফালতু পোলার সাথে রিলেশন করাটাই ভুল হয়েছে । তুই একটা প্রতারক,লুচ্চা, ভন্ড । আমারই ভুল হয়েছে তোর মত লুচ্চার সাথে রিলেশন করা “।
-” প্লিজ, আস্তে বলো “।
-” আস্তে বলবো মানে ? আরো জোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলবো । তুই লেখক তাই না। লুচ্চামি কইরা কইরা লেখালেখি করে বেড়াস। তুই তুই “।
আরো অনেক কথাই বলেছিলো নাবিলা । কথা শেষে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিলো নাবিলার চোখ বেয়ে । জানি, ওর সমস্ত কথাগুলোর মাঝে ভালোবাসা না থাকলেউ এই চোখের পানিতে পূর্ণ ভালবাসা ছিলো। প্রচন্ড অভিমান করে কাঁদতে কাঁদতে নাবিলা চলে গিয়েছিলো । নাবিলার সাথে সম্পর্কটা পরিকল্পিত ভাবেই হয়েছিলো। ওর সাথে রিলেশন করতে আমাকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছিলো। রোজ রোজ ওর দরজার বাইরে একটা করে চিরকুঠ দিয়ে আসতাম। নীল রঙের চিরকুঠে টুকরো টুকরো লেখা থাকতো। একদিন নাবিলার ছোট বোন আমায় দেখে ফেলেছিলো। তারপর কিছুদিন যেতেই ধরা খেতে হয়েছিলো নাবিলার হাতে । প্রথম যেদিন ধরা খেয়েছিলাম সেদিন বেশ কড়া করে শাসিয়েছিলো নাবিলা । তবুও আমি ওর দরজার বাইরে চিরকুঠ দিয়ে যেতাম।
এরপর একদিন ও আমায় ক্লাসিক কফি হাউজে ডাকলো । সেদিন ও নীল রঙের শাড়ি পড়ে এসেছিলো । ওকে দেখে সেদিন খুবই অদ্ভুত লেগেছিলো আমার। আমাদের ভালোবাসার প্রথম ঐতিহাসিক মুহুর্ত ছিলো সেদিন। নাবিলা খুব শান্ত গলায় বলেছিলো,
-” আপনি কি আমায় সত্যিই ভালোবাসেন “?
আমি কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলেছিলাম,
-” হ্যাঁ “।
-” কেনো ভালোবাসেন “?
ওর প্রশ্নে কিছুটা বিব্রত হয়েছিলাম। কিন্তু সাহস করে সত্যিটা বলেওছিলাম,
-” তোমার সৌন্দর্য দেখে ” ।
-” শুধু কি সৌন্দর্য দেখেই “?
-” নাহ্ আরও কারন আছে । তবে আমাকে ভালোবাসলে সেগুলো জানতে পারবে “।
বড্ড ছেলেমানুষী ভাব করে চোখটা চিকন করে পাকিয়ে বলেছিলো,
-” কেনো কেনো, ভালোবাসলে বলবে কেনো “?
আমাকে তুমি করে বলতেই ও লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। বেশ ভারী হয়ে গেছিলো মুহুর্তটা । সেদিন আর কোনো কিছু বলেছিলো না নাবিলা। এরপর থেকে আমাদের ভালবাসার গল্পটা শুরু হয়েছিলো ।
সময় অসময় মোবাইলটা ব্যস্ত থাকতো। বৃষ্টির মুহুর্তটা আরও রসাত্মক হয়ে উঠতো । শীতের সকালে দুজনেরই ঠোঁট ছুঁয়ে দিতো গরম চা । জোৎস্নাটাকে বেশ ছুঁয়ে দেখতাম দুজনেই। স্বল্প সময়ের মাঝেই একে অপরকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমার লেখালেখির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতো নাবিলা। প্রতিদিন ওকে চার লাইন করে কবিতা লেখায় ছিলো ওর আবদার। আর সেই কবিতার লাইন গুলো আমাকে নীল চিরকুঠে করে ওর দরজায় লাগিয়ে আসতে হতো। চার লাইনে কাউকে নিয়ে সম্পূর্ণ কবিতা লেখা যায় না। তবুও ও চার লাইনেরই আবদার করতো। এর বেশি হওয়া যাবে না । নাবিলার ইচ্ছে গুলো নিয়ে , ওর ভালবাসা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। যা কোনোদিন আর প্রকাশিত হবে না ।সেদিনই ছিলো নাবিলার সাথে শেষ কথা। আর শেষ দেখা । নাবিলার চিকচিক করা চোখের পানি নিয়ে চার লাইন কবিতা লিখেছিলাম । ওকে দেওয়ার সাহস হয় নি । কবিতার লাইনগুলো এমন ছিলো,
-” তোমার ছলছল করা চোখের বৃত্তে,
যে ভালবাসাটুকু দেখলাম ,
তার পুরোটাই জানি আমায় ঘিরে,
তবুও তোমায় আজ কষ্ট দিলাম “।
নাবিলার সাথে সেদিনের সেই ব্যবহারটা ওর ভালোর জন্যই করেছিলাম । ও যদি সত্যিটা জানতো তবে আমায় জড়িয়ে কান্না জুড়ে দিতো। ওর টানাটানা চোখের নিচে কালো মোটা দাগ পড়ে যেতো। হয়তো ওর জীবনটাও শেষের পথে থাকতো । কিন্তু আমি ওগুলোর কিছুই চায় নি। আমি চেয়েছি নাবিলা ভালো থাকুক। অনেক ভালো । আমার জন্য ওর যেনো আর ভালবাসা অবশিষ্ট না থাকে । ভাবতে ভাবতেই চোখটা ঘুমিয়ে গেলো।
কেমো থেরাপির অসহ্য ধৈর্য্য আমাকে খুব অতিষ্ঠ করে তুলেছে । হঠাৎ করে কারও উপস্থিতিতে আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো । কাঁধটা ঘুরে তাকাতে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম । পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের মতো আশ্চর্য । আমার সামনে নাবিলা দাড়িয়ে আছে। চোখের নিচে কালো মোটা দাগ । আর খন্ড খন্ড অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে ওর চোখ বেয়ে । নাবিলাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছে । ওর চেহারায় আজকে ভালবাসার কোনো কমতি নেই। হঠাৎ করে হাঁটুটা গেড়ে বসলো হাসপাতালের মেঝেতে । এটা একটা কেবিন জন্য আর কেউ নেই । আমার মুখটা আলতো করে স্পর্শ করলো নাবিলা। খুব কোমল হাত ওর। আমার জীর্ণ হাতটা ওর মুখের কাছে এগিয়ে নিলো । চোখের পানিটা এখন আরও বেশি করে পড়ছে । জীবনের হাজার ভালবাসার মাঝে আজকের এই ভালবাসাটাই সবচেয়ে পরিপূর্ণ ভালবাসা। ওর অবুঝ নিষ্পাপ ঠোঁটের ফাঁকে অস্পষ্ট একটা শব্দ শুনতে পেলাম। ভালবাসা কোনো কষ্ট নয় । কষ্টের কোনো উপরের ধাপ হবে।
আমার মাথাটা সাদা কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কেমোথেরাপিটা আজ রাতেই শেষ হবে। আমার এই কঠিন লিউকেমিয়ার কারনেই আমি নাবিলাকে ছাড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটি আমায় আজকে বেঁচে থাকার স্বাদ জাগাচ্ছে। কিন্তু এটা অসম্ভব। আজকের রাতের শেষে ভোরটা দেখতে পাবো না। ডাক্তার একে একে সবার সাথে দেখা করাবে বলেছে। প্রথমেই নাবিলা এসেছে আমার কাছে । নাবিলার চোখের পানিটা মুছে দিতে দিতে বললাম,
-“আমি তোমার হাসি দেখতে চেয়েছিলাম। এভাবে কাঁদবে জন্যই তোমাকে দুরে সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তুমি……”
কথাটা শেষ করার আগেই ও আমার মুখে থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে বললো,
-” কিন্তু কি ? তুমি আমায় সত্যিকারের ভালবাসো নি কখনও। বাসলে তুমি আমায় ঠিকই জানাতে “।
আমার প্রচন্ড কান্না করতে ইচ্ছে করছে । কিন্তু পারছি না। নাবিলাকে থামতে বললাম। কিন্তু ও থামছে না। মাথার ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করছি। মৃত্যুর খুব কাছের সময়টাতে অসহ্য কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিঃসঙ্গ জীবনে এসেছিলাম আবার ওভাবেই চলে যাচ্ছি। তবে এই সময়ের মাঝে অনেকেই আপন হয়ে গেছে । পৃথিবীর মায়ার বাঁধনে আটকে গেছি । নাবিলাকে ভালবেসে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি । আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে না। হাজার বছর ধরে বাঁচবো নাবিলাকে সাথে নিয়ে।
জীবনের অন্তিম শয্যায় শুয়ে থাকতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে । সিস্টার আর্ম ডি ন্যানী নাবিলাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে। এরপর কে দেখতে আসবে জানি না। মা আসবে না । সবার বিদেশে আসার সামর্থ্য নেই। তবে মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে । আস্তে আস্তে আমার জীর্ণ হাতটা ছেড়ে দিচ্ছে নাবিলা । সিস্টার ওকে পিড়াপিড়ি করে নিয়ে যাচ্ছে । আমার নিথর দৃষ্টি ওকে শেষবারের মতো দেখতে পেলো। আস্তে করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। নাবিলাকে ওরা নিয়ে গেলো। আমার অন্তিম শয্যাটা আমার কাছেই ভয় করছে । অচল দৃষ্টি বেশ কিছুটা পানি ঝরালো । এশার আযান দিচ্ছে । আমার কানটাও আস্তে আস্তে অক্ষম হয়ে যাচ্ছে । আমার শেষ ইচ্ছে মাকে দেখার। জানি মা আসে নি। তবুও একবার আমার আদরিনী মায়ের মুখটা যদি ছুঁয়ে দেখতে পারতাম। জানি না এখন কে আসবে। সাদা বিছানায় আমাকে অক্সিজেন মাক্স দিয়ে দিলো। স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো । মৃত্যুর আগ মুহুর্তে দরজার দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি । জানি না এখন কে আসবে।