বাবা-মায়ের অনেক জোরাজুরির পর শেষ পর্যন্ত এই পড়ন্ত বিকেলে মেয়ে দেখতে এলাম। অবশ্য এর আগে আরো ছয়জনকে দেখেছি,এটা সাত নম্বর!আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট শিওর,অন্য মেয়েগুলোকে দেখে যেমন আমার পছন্দ হয়নি,এই মেয়েকেও পছন্দ হবে না। কিন্তু অন্য মেয়েগুলোকে দেখতে গিয়ে যেই ঘটনা কখনোই ঘটে নি,আজকে তাই ঘটছে! প্রায় দুই ঘন্টা ধরে বসে আছি,কিন্তু মেয়ের কোনো দেখাই নেই।এই দুই ঘণ্টায় মেয়ের বাবা-মা,ছোট বোন,আত্মীয় সবার পরিচয় মুখস্থ হয়ে গেছে।কিন্তু এখনো মেয়েটাকেই দেখা হয়নি! মেয়ে কি আদৌ আসবে কিনা,তাও বুঝতে পারছি না!মেয়েকে কি সাজিয়ে একেবারে ভুত বানিয়ে আনছে নাকি,তা আল্লাহই জানেন! আমি আর আমার আত্মীয়রা চলে যাব নাকি ভাবছি,এই সময় হঠাৎ একটা মেয়েকে দেখলাম,যাকে দেখতে এসেছি তার বোনের সাথে হেঁটে আমাদের দিকে আসছে।তার মানে এটাই কি কনে? কিন্তু মেয়েটা দেখছি একদমই সাজেনি!চোখে কাজল পর্যন্ত নেই!
আমার চাচী মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
–তোমার নাম কি মা?
–রায়না।
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।হঠাৎ মেয়েটার কথা বলা শুনে তার দিকে তাকাতে বাধ্য হলাম!এত মিষ্টি
গলা আমি কারোর শুনিনি।মেয়েটার গলার স্বরই শুধু মিষ্টি না,এতক্ষণে খেয়াল করলাম,তার চেহারাটাও
অপূর্ব সুন্দর!কোনো কৃত্রিমতা নেই চেহারার মাঝে।যেন সাধারণত্বের মাঝেও সে অসাধারণ!শুধু
একটাই সমস্যা,মেয়েটা অনেক বেশি চুপচাপ! প্রয়োজনের বেশি একটা কথাও বলে না।
একটু পর আমাকে আর মেয়েটাকে আলাদা রুমে দেওয়া হল কথা বলার জন্য।আমি কি বলব বুঝতে
পারছিলাম না।মেয়েটাও নিজে থেকে একটা কথাও বলছিল না!কিছুক্ষণ চেষ্টা করে আমি বললাম,
–আপনার নাম কি?
–একটু আগেই তো বলেছিলাম!
–ও হ্যা,রায়না।
মেয়েটার এভাবে উত্তর দেওয়া শুনে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম,সে নিশ্চয়ই এনির মতই অনেক ভাব
দেখায়।আমি জানতাম সব মেয়েরাই এক!আর এই মেয়েটাও তার বাইরে না। এনি আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড।আমাদের সম্পর্ক
টিকে ছিল প্রায় এক বছর!এর মাঝেই সে আমাকে মোটামুটি নিঃস্ব করে দিয়েছিল।ভাগ্গিস ওইটা আমার
শখের কারণে করা টিউশনির টাকা ছিল!এক বছর পর
শুনলাম,ঐ মেয়ে নাকি আরো অনেক ছেলের সাথে এমন করে তাদেরকে নিঃস্ব করে ছেড়ে দিয়েছিল।এই কারণেই ওর সাথে আমার ব্রেকাপ হয়।আর এরপর থেকে আমি কোনো মেয়েকেই আর বিশ্বাস করতে পারি না!কিন্তু বাবা- মায়ের চাপে পড়েই আমাকে মেয়ে দেখতে
যেতে হয়!
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
–আমাকে বিয়ে করতে আপনার কোনো আপত্তি
নেই তো?
–আমার কোনো মতামতেই এখন আর কারো কিছু
আসে যায় না!
রায়না নামের এই মেয়েটার এমন কাটাকাটা কথার পর তো আর আমাদের কথাবার্তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়
না!তাই আমি সেখান থেকে চলে এলাম। রাতে ফেরার পর মা যখন আমার মতামত জানতে
চাইলেন,আমি সাথে সাথেই না করে দিলাম!
২.
–হ্যালো,আপনি কি ঈশান?
–হুম,আপনি কে?
–আমি রায়নার বোন,রিহানা।সেদিন যে মেয়ে
দেখতে এলেন..
–ওহ,মনে পড়েছে।
–আপনার সাথে কিছু কথা ছিল,আপনার কি সময় হবে
দেখা করার?
–উম..হুম,হবে।বিকেল চারটায় কফিশপে..
–ওকে।
বিকেল চারটায় কফিশপে গিয়ে দেখি রিহানা অপেক্ষা
করছে।আমি গিয়েই মুখে একটা হাসি নিয়ে বললাম,
–কি?কি খবর তোমার?
–ভাল।আপনাকে কিছু কথা বলতে এসেছি!আমি
অনেক ছোট বলে হয়ত আপনি আমার কথার গুরুত্ব নাও দিতে পারেন,কিন্তু কথাটা অনেক বেশি
গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমি এসেছি তা বলতে.. আমি মুখে গাম্ভীর্যের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বললাম,
–বল,কি বলবে?
–আপনি আমার আপুকে সেদিন যেভাবে দেখেছেন,আমার আপু কিন্তু আসলে তেমন না!
আমার আপুর জীবনে কি কি ঘটেছে,না জানলে কেউ বুঝতেই পারবে না,কেন আপু এমন
য়েছে।আপনি হয়ত ওকে বিয়ে করার জন্য মত দিতে পারেন,কিন্তু এই কথাগুলো না শুনে
বিয়েতে মত দিলে আপনারও ক্ষতি হবে,সাথে আপুরও!যদিও আমি বিয়েটা ভাঙতে আসিনি..
এতক্ষণে আমার মাঝে কৌতুহল হতে শুরু করল।আমি জিজ্ঞেস করলাম,
–কি হয়েছে তোমার আপুর জীবনে?
–আপু আগে অনেক হাসিখুশি ছিল।সবার সাথে
মিশত,ভাল ব্যবহার করত।একটা ছেলেকে ও
অনেক ভালবাসত।আমরা পরিবারের সবাই জানতাম এই
কথা!তিন বছরের রিলেশনশিপের পর হঠাৎ
শুনলাম,ছেলেটা কোনো কারণ ছাড়াই আপুর সাথে
ব্রেকাপ করেছে!পরে অবশ্য জানলাম,আপুকে
সে বলেছিল বিয়ের আগেই তার সাথে এক রাত
থাকতে,আপু রাজি হয়নি।তাই সে এভাবে ব্রেকাপ
করেছে।সে নাকি আরো অনেক মেয়ের
সাথেই এমন করেছে!
–ও।
–ওর স্বাভাবিক হতে অনেকদিন লেগেছিল।তারপর
হঠাৎ করেই একটা ছেলের সাথে ওর ফ্রেন্ডশিপ
হয়।খুব স্বাভাবিক বন্ধুত্বই ছিল তাদের মধ্যে।
ফেসবুকে পরিচয়।একদিন আপু ফেসবুকে ঢুকে
দেখে,আপুর আইডি হ্যাক করে তার ছবি এডিট করে
অনেক খারাপ খারাপ ছবি দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে।
চেনা-পরিচিত যারা ছিল,সবার কাছেই আপুকে
চরমভাবে অপমানের স্বীকার হতে হয়!এরপর
থেকেই আপু আর বাইরে যায় না।কোনো
ছেলের সাথে কথা বলেনা,ফেসবুকেও বসে না।
–হুম,আসলেই তোমার আপুর সাথে অন্যায়
হয়েছে!
–এইটুকুতেই শেষ না।
–আরো আছে?
–হ্যা।গত বছর একটা ছেলে এসে আপুকে
দেখে যায়।পরিবারের সবার আপুকে খুব পছন্দ হয়।
আপুও বিয়েতে মত দেয়।ভেবেছিল,সব
ছেলেই তো আর এক না!কত আনন্দের ছিল
বিয়ের আগের দিনগুলো!আপুর সাথে ছেলেটার
প্রায়ই কথা হত।শুনে মনে হত দুজনেই খুব খুশি!
–তোমার আপুর আগে বিয়েও হয়েছিল?
–না।ছেলেটা আগে আপুকে কিছু না বললেও
বিয়ের দিন বলল,সে এই বিয়েতে রাজি না!অন্য
মেয়েকে তার পছন্দ,কিন্তু বাবার চাপে পড়ে সে
বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল।ব্যস,ভেঙে গেল
বিয়েটা!
আমি শুনে এতই অবাক হলাম যে,কিছু বলতেই ভুলে
গেলাম!এত ট্র্যাজিডিও একটা মেয়ের জীবনে
ঘটতে পারে!রিহানা বলে চলল,
–এরপর থেকে আপু কোনো ছেলেকে
দেখতে পারে না!কথাও বলতে চায়না।শুধু বাবা-মায়ের
চাপাচাপিতেই এবার পাত্র দেখতে রাজি হয়েছে।
এখন বিয়ে করবেন কি করবেন না এটা আপনার ইচ্ছা!
বলে চলে গেল রিহানা।সে জানতেও পারল না যে
আসলে আমি আগে ঠিক করেছিলাম বিয়েটা করব না।
কিন্তু এখন ভাবছি,বিয়ে করাই উচিত!
৩.
আজকে আমাদের বিয়ের প্রথম রাত।তাকিয়ে আছি
ঘুমন্ত রায়নার দিকে!আমাদের মাঝখানে একটা
কোলবালিশ রেখে কখন যে ঘুমিয়ে
পড়েছে,নিজেই হয়ত টের পায়নি!
যদিও আমি এনির কাছ থেকে ধোকা খাওয়ার পরে
ভেবেছিলাম,কোনোদিন আর কোনো
মেয়েকে বিয়ে করা দূরে থাক,বিশ্বাসও করব না।
কিন্তু আমি এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি,যার
জীবন আমার চেয়েও কঠিন হয়ে গিয়েছে!আমি
মাত্র একটা মেয়ের কাছ থেকে ধোকা খেয়ে
দুনিয়ার সব মেয়েকে অবিশ্বাস করতে শুরু
করেছিলাম,কিন্তু ও তো তিনটা ছেলের কাছ
থেকে তিনভাবে ধোকা খেয়েছে।যখনই
কাউকে বিশ্বাস করেছে,তখনই সে তার বিশ্বাস
ভেঙেছে!রায়নার এই অবিশ্বাসের জীবন
থেকে তো আমাকেই ওকে উদ্ধার করতে
হবে!নাহয় ওর এই জীবন হয়ত সব ছেলেকেই
অবিশ্বাস করতে করতে কেটে যাবে!
রায়না কাজে খুব চটপটে!সারাদিন মাকে হেল্প
করে,রান্নাবান্না করে।মা-বাবাকে গল্প
শোনায়,হাসিখুশি থাকে।কিন্তু আমি যখন রাতে অফিস
থেকে ফিরি,তখনো ও মায়ের আশেপাশেই
ঘুরঘুর করে।এমন ভান করে যেন আমি যে
এসেছি,সে দেখেইনি!এতে অবশ্য আমি
কোনো কষ্ট পাই না।কারণ আমি তো ওর অতীত
জানি।আমাকে দেখে রায়না ভয় পাবে,এটাই হয়ত
স্বাভাবিক।ওকে ঠিক হতে আমার সময় দিতে হবে।মা
অবশ্য ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে,কিন্তু ও
কিছু বুঝতে পারেনা,বা বুঝতে চায় না!
ছুটির দিনগুলোতেও একই অবস্থা!সারাক্ষণ সে
মায়ের আশেপাশে ঘুরে।ভুলেও আমার কাছে
আসে না!
একদিন বস অফিস থেকে আসার সময় বললেন,আমার
এরপরের দিন রেস্ট।অফিসে আসা লাগবে না।
রেস্ট নিয়ে যাতে আমি আরো ভালভাবে কাজ
করতে পারি,সেই জন্যই এই ব্যবস্থা।আমি অফিস
থেকে এসে অবশ্য কাউকে বলিনি যে পরের দিন
আমার অফিস ছুটি।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার আগেই রায়না সব
কাজ করে গোসল করতে যায়।আমি অফিসে যাওয়ার
আগে পর্যন্ত ওর কোনো হদিস পাওয়া যায় না।কিন্তু
আজকে একেবারেই ভিন্ন।রায়না গোসল করে
এসে কল্পনাও করেনি আমাকে দেখবে!আমাকে
দেখে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।তারপর
তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে যেতে চাইল।আমি
পেছন থেকে হাত ধরে টেনে ওকে বিছানায়
বসালাম।ওর হাত দেখি ভয়ানক ঠাণ্ডা!আর থরথর করে
কাঁপছে!আমার হাত থেকে ওর হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার
চেষ্টা করল।কিন্তু আমি ওকে শক্ত করে ধরে
রেখে বললাম,
–আমাকে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?আমি তো তোমারই
হাসবেন্ড।জানি,তুমি সব ছেলেকেই অবিশ্বাস
করো।কিন্তু আমাকে একবার বিশ্বাস করেই
দেখো,আমি কখনোই তোমার বিশ্বাস ভাঙব
না,প্রমিস।
রায়না চোখে অবিশ্বাস নিয়ে বলল,
–সব ছেলেরা বিশ্বাস ভাঙার আগে এই কথাই
বলে,কিন্তু ঠিকই পরে সব তছনছ করে দিয়ে যায়!
তাই আমার পক্ষে আর কাউকেই বিশ্বাস করা সম্ভব না!
হাত ছাড়ুন,আমাকে যেতে দিন।
আমি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ওর হাত ছেড়ে দিলাম,ও
রান্নাঘরে চলে গেল।
একটু পরেই রায়নার চিৎকার শুনে ভয়ে আমার শরীর
ঠান্ডা হয়ে গেল।দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি,মা
রায়নার হাতে ঠাণ্ডা পানি ঢালছে।রায়না ব্যাথায় ছটফট
করছে!কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম,কি হয়েছে।মা
বলল,রায়না রান্না করতে গিয়ে গরম তেল ছিটে ওর
হাতে এসে পড়েছে।অনেকখানি পুড়ে গেছে
ডান হাত।
আগে তো এমন কখনো হয়নি,আজ কেন হল?
আমাকে ভয় পেয়েই কি ওর কাজেও ওলটপালট
হয়ে গেছে?
আমি রায়নাকে তাড়াতাড়ি ডাক্তার কাছে নিয়ে গেলাম।
ডাক্তার হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিল,আর ডান হাত বেশি
ব্যবহার করতে না করল।
রাতের বেলা রায়না না খেয়েই ঘুমিয়ে যাচ্ছিল।ওর
ক্ষুধা লেগেছিল ঠিকই।কিন্তু ও আমার হাতে খাবে
না,নিজের হাত ব্যবহার বন্ধ,কাউকে বলতেও পারছিল
না খাইয়ে দিতে।ও যত যাই করুক,আমি যখন একটা ধমক
দিয়ে ওকে খাইয়ে দিতে শুরু করলাম,তখন আর না
করল না।লক্ষ্মী মেয়ের মত আমার হাতে
খেতে শুরু করল।আর আমি ওর মিষ্টি মুখটা আর
অপূর্ব চোখ দুটোকে অনেকদিন পর খুব কাছ
থেকে দেখার সুযোগ পেলাম!
৪.
ছুটির দিনগুলোতে এখন আর রায়না আমার থেকে
দূরে থাকতে পারেনা।আমি বুঝতে
পেরেছি,নিজে থেকে ওর কাছাকাছি থাকার চেষ্টা
না করলে ও আমার থেকে আরো দূরে চলে
যাবে।তাই যতক্ষণ বাসায় থাকি,ততক্ষণ ওকে ডাকতে
থাকি আর আমার এটা ওটা কাজ দিতে থাকি।এতেই ওর
কিছুটা হলেও কাছাকাছি থাকতে পারি।
আজকেও অফিস থেকে ছুটি দিয়েছে।কিন্তু
আজকের কথা অবশ্য পুরাই ভিন্ন!আজকে
বিকেলের ট্রেনে বাবা-মা দুজনেই অনেকদিন পর
গ্রামে বেড়াতে গিয়েছেন।একসপ্তাহ ঐখানে
থাকবেন।
এই এক সপ্তাহের স্বাধীনতায় আমি যে কি খুশি
হয়েছি!প্রত্যেকদিন শুধু রায়না আর আমি থাকব
বাড়িতে।অফিসের দিন আর ছুটির দিনগুলোতে কি কি
করব,তাই ঠিক করতে শুরু করলাম!অনেক জায়গায়
ঘোরাঘুরির প্ল্যান করলাম,যদিও হয়ত রায়নাকে
যেতে রাজি করাতে কষ্টই হবে,কিন্তু রাজি করানো
যাবে।আর মনে মনে প্রস্তুত হয়ে রইলাম,ঠিক
সপ্তমদিন আমি রায়নাকে প্রপোজ করব!
প্রথমদিন অফিস থেকে সন্ধ্যায় ফিরে তাকে
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে বললাম।আজকে আমরা
বাইরে খেতে যাব!এনির সাথে প্রেম করে আর
কোনো লাভ হোক বা না হোক,মেয়েরা কি
টাইপের জিনিস পছন্দ করে,এটা ঠিকই জেনে
গিয়েছিলাম।তাই বাবা-মা গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার প্রথম
দিন থেকেই আমি মেয়েদের সব পছন্দের সব
কাজগুলো রায়নার সাথে করব বলে ঠিক করলাম।
তাই আজকে রায়নাকে নিয়ে ক্যান্ডেল লাইট
ডিনারে গেলাম।যদিও রায়না যেতে রাজি হচ্ছিল না।
ওকে সেজেগুজে শাড়ি পড়ে আসতেও রাজি
করিয়েছি।এই আলো-আঁধারের খেলায় রায়নাকে
যে কি অপূর্ব সুন্দর আর স্নিগ্ধ লাগছে,আমি বলে
বোঝাতে পারব না।আমি নতুন করে আবার ওর
প্রেমে পড়তে শুরু করলাম!কিন্তু ওর মধ্যে আমার
প্রতি একটুও ভালবাসা আর বিশ্বাস জন্মাতে পেরেছি
কিনা,বুঝতে পারলাম না।কিছুক্ষণ চুপচাপ খেতে
খেতে একটু পর জিজ্ঞেস করলাম,
–তোমার এতদিন পর বাইরে ঘুরতে এসে কেমন
লাগছে?
–অনেক ভাল লাগছে!কিন্তু আপনি আবার ভেবে
বসবেন না যে,আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে শুরু
করেছি।আপনার প্রতি আমার কোনোরকমই দুর্বলতা
নেই,মনে রাখবেন।
আবার সেই কাটাকাটা উত্তর!কিন্তু আমি সেই কথার
তোয়াক্কা না করে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললাম,
–সমস্যা নেই।আমার চেষ্টা আমি করে যাব যতদিন
পারি!
মনে মনে বললাম,
–অমূল্য কিছু পেতে হলে তো কষ্ট করতেই
হবে!
আজকে রাতেও রায়না আমাদের মাঝখানে
কোলবালিশ দিয়ে ঘুমাল।সে আসলে আমাদের
মাঝে যেন কোলবালিশ দিল না,অবিশ্বাসের দেয়াল
দিয়ে আলাদা করে দিল আমাকে!কবে যে সেই
দেয়াল ভাঙবে?
দ্বিতীয়দিন আমি অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই ছুটি
পেলাম।রায়নাকে নিয়ে সেদিন গেলাম পার্কে।
এনিকে দেখতাম পার্কে ঘুরতে খুব পছন্দ করত।
ইচ্ছা,রায়নাকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে
একসাথে ফুচকা খাব।পার্কে যাওয়ার প্রায় সাথে
সাথেই দেখলাম,অনেকগুলো পিচ্চি আমাদের
ঘিরে ধরেছে।এদেরকে আমার ভালই লাগে,কিন্তু
এনি এদেরকে সহ্য করতে পারত না!
আমি অবাক হয়ে দেখলাম,আসার সময় আমি যে
দুশো টাকা দিয়েছিলাম রায়নাকে প্রয়োজনের সময়
ব্যবহারের জন্য,ও সেগুলো দিয়ে
বাচ্চাগুলোকে আইসক্রিম কিনে খাওয়াল।আর
বাচ্চাদের সাথে এমনভাবে মজা করতে লাগল যে
দেখে মনে হল,বাচ্চাগুলো তার নিজেরই!ওকে
আমি সেদিন প্রথমবারের মত হাসতে দেখলাম!এত
মিষ্টি কারো হাসি হতে পারে,তা আমি কল্পনাও
করতে পারিনি!
আমি অবাক হয়ে ওর পাগলামিগুলো দেখতে লাগলাম
আর ভাবতে থাকলাম,এত সুন্দর মনের একটা
মেয়েকে ছেলেগুলো কেন এভাবে কষ্ট
দিল যে ওর মনে ছেলেদের নিয়ে একেবারে
বিতৃষ্ণা জন্মে গেল!ঐ ঘটনাগুলো না ঘটলে আমরা
কি সুন্দরভাবে একসাথে দিনগুলো কাটাতে পারতাম!
আমি যখন তাকে ফুচকা খেতে নিয়ে গেলাম,ও
যে কি খুশি হল!আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি।কালকেও
তো রায়নাকে নিয়ে দামী রেস্টুরেন্টে বসে
ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করেছি,কিন্তু কাল তো ওর
মাঝে এত খুশি দেখিনি!বুঝলাম,ওর এক্সপেকটেশন
অন্য মেয়েদের মত অনেক বেশি না,একটুতেই
ও খুব খুশি হয়।আজকে বাচ্চাগুলোকে দেখে
যেমন হয়েছে!
তৃতীয়দিন আমি ঠিক করলাম,আমরা শপিং এ যাব।কিন্তু
রায়নাকে এতে তেমন আগ্রহী দেখলাম না!
বুঝতে পারলাম,অন্য মেয়েদের মত ওর শপিং এ
যেতে অতটা ভাল লাগে না!আমি যতই রায়নাকে
আবিষ্কার করছি,ততই অবাক হচ্ছি,মেয়েটা অন্যদের
চেয়ে একেবারেই আলাদা!
কিন্তু শপিং এ গিয়ে দেখা গেল,খুব শখ করে রায়না
এক একটা ড্রেস কিনছে,কিন্তু একটাও নিজের জন্য
না!মায়ের জন্য শাড়ি,বাবার জন্য পাঞ্জাবি,তাদের
প্রয়োজনের আরো টুকিটাকি জিনিস কিনল।এর
ফাঁকে আমি গিয়ে ওর জন্য সুন্দর মেরুন রঙয়ের
একটা শাড়ি কিনলাম,যেহেতু ও নিজের জন্য কিছুই
কিনে নি।
বাসায় ফিরে যখন শপিং এর ব্যাগগুলো খুলে খুলে
দেখছিলাম,তখন খুব অবাক হয়ে দেখলাম,আমার নাম
লেখা একটি প্যাকেট!খুলে দেখি,ভেতরে নীল-
সাদা স্ট্রাইকের একটি সুন্দর শার্ট।বুঝতে পারলাম,আমি
যখন ওর জন্য শাড়ি কিনছিলাম,তখন রায়নাও আমার জন্য
শার্ট কিনেছে,আমাকে সে যতই অপছন্দ করুক!কি
যে আনন্দ লাগছে!আসলে প্রিয় মানুষের কাছ
থেকে কিছু পাওয়ার আনন্দই আলাদা!
৫.
আজ চতুর্থদিন।শুক্রবার বলে আজ অফিসও বন্ধ।ছুটি
ছিল বলে একটু দেরিতেই উঠলাম।আর উঠার সাথে
সাথেই আমার নাকে খিচুরির সুঘ্রাণ এল!আমার
সবচেয়ে প্রিয় খাবার।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি রায়না মিষ্টি গলায় গান
গাইছে,আর রান্না করছে আমার প্রিয় খিচুরি আর গরুর
মাংস।আমি অবাক হয়ে গেলাম।কারণ আজ ছুটির দিন
বলে প্ল্যান করেছিলাম রায়নাকে বলব,ভাল কিছু রান্না
করতে যেন বাসায় বসে দুজন একসাথে মজা করে
খেতে পারি।কিন্তু রায়না তো আমার প্ল্যান শোনার
আগেই সব করে ফেলেছে!
আজকে প্রথম দুজন একসাথে বাসায় বসে খাচ্ছি।
রায়না একটু পর পরই এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে।কিযে
ভাল লাগছে!আর ওর হাতের রান্না তো আজকে
একেবারে অমৃতের মত মনে হচ্ছে!অনেকদিন
পর এত তৃপ্তি নিয়ে খেলাম!
রাতে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।ঘুমঘুম
চোখে উঠে অবাক হয়ে দেখি,রায়না হাটুতে মাথা
গুজে বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে!
জিজ্ঞেস করলাম,
–কি হয়েছে তোমার?
রায়না কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
–ঈশান,বাবা হঠাৎ করে অনেক অসুস্থ হয়ে
পড়েছে!
–এখন কোথায় আছেন?
–হাসপাতালে।কিন্তু এত রাতে কাকে বাবার কাছে
আমাকে নিয়ে যেতে বলব বুঝতে পারছি না!
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা হালকা করার জন্য
মুখে একটু হাসি টেনে বললাম,
–পাগলি মেয়ে!এর জন্য এত কাঁদে?আমি আছি না?
আমি তোমাকে তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাব।
বলে আমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে
বললাম,যেহেতু এত রাতে কোনো যানবাহন পাওয়া
যাবে না!
আমরা যখন রওনা দিয়েছি,তখনো গাড়িতে বসে রায়না
কাঁদছিল।ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কি
করব,বুঝতে পারছিলাম না।
হঠাৎ খেয়াল করে দেখি,গাড়ির ড্রাইভার স্টিয়ারিং এ হাত
রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে!আমি সাবধান করে
দেওয়ার আগেই সে গাড়িটাকে রাস্তার পাশের একটা
উঁচু আইল্যান্ডে উঠিয়ে দিয়েছে।আমি রায়নার মাথার
দিকটা দুই হাতে ধরে রাখতে রাখতেই দেখলাম,গাড়িটা
কাত হয়ে গেল রায়না যেদিকে
বসেছে,সেদিকে!হঠাৎ করে মনে হল,আমার
নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই।কিন্তু আমি একটু সাহায্য
করলেই তো রায়না বের হতে পারবে!তাই আমি
অনেক কষ্ট করে যেদিকে বসে ছিলাম,সেদিক
দিয়ে রায়নাকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করলাম।
কিন্তু যখন আমি নামতে যাব,তখন টের পেলাম,আমার
ডান হাতে কোনো শক্তি নেই!বুঝলাম,হাতটা
ভেঙে গেছে হয়ত!যখন রায়নাকে ধরে
রেখেছিলাম,তখনই ভেঙেছে।
আমি নামতে পারছি না দেখে রায়না আমাকে টেনে
নামানোর চেষ্টা করতে লাগল,কিন্তু ওর একার
পক্ষে তো এটা সম্ভব না।আর ড্রাইভারের যখন হুশ
এল,তখন আমাদের দুজনকে এই বিপদের মাঝে
ফেলেই সে পালিয়ে গেল!
আমি যখন নামতে চেষ্টা করছি,তখন হঠাৎ দেখি উলটা
দিক থেকে একটা ট্রাক ছুটে আসছে!আমি বুঝতে
পারলাম,এটাই হয়ত আমার জীবনের শেষ সময়!
মরে যাচ্ছি,এতে এতটুকু চিন্তা হচ্ছে না,কিন্তু বারবার
মনে হচ্ছে,রায়নাকে আমার আর মনের কথাগুলো
বলা হল না!
পরিশেষ:
চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায়ই অনুভব করলাম,কেউ খুব
সযত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,চুলে বিলি
কেটে দিচ্ছে।কারো হাতের পরশে আরামে
আমার ঘুম চলে আসছে!আমি ভাবতে লাগলাম,এটা
নিশ্চয়ই মৃত্যুর পরের জীবন!
কিন্তু যখন চোখ খুললাম,তখন দেখি আমি
হাসপাতালে।রায়না আমার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর
আমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে!আমি চোখ খুলে
ওর দিকে তাকিয়ে প্রথম যে কথাটা বললাম,সেটা হল,
–আমি তোমাকে খুব ভালবাসি,রায়না!
রায়না কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।
ভাবছে,এক্সিডেন্টে আবার আমার মাথার গোলমাল
হয়ে গেল নাতো?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললাম,
–আমি ভেবেছিলাম,এটা বলতে আমার আরো দুইদিন
লাগবে,কিন্তু এক্সিডেন্টের পর আমার সাহস কত
বেড়ে গেছে দেখেছ?আমি এখনই এই কথা
তোমাকে বলে দিতে পেরেছি!
রায়না মুখ ভেংচে বলল,
–সাহস না ছাই!তুমি আসলেই একটা পাগল।কেন তুমি
আমাকে ওভাবে কাল ধরে রেখেছিলে?সেজন্য
ই তো তোমার হাতটা এভাবে ভাঙল!যদিও ডাক্তার
বলেছে মারাত্মক কিছু না।তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।
তারপরেও তো..আর ট্রাকটাও সেসময়..
–কি হয়েছিল বল তো?আমি তো ভেবেছিলাম
মরেই গেছি!কিন্তু ট্রাকটা সেসময় থামল কিভাবে?
–আমি ট্রাকটা দূরে থাকতেই ট্রাকের সামনে
দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিলাম!
–কি বলছ তুমি?তোমার যদি কিছু হয়ে যেত তাহলে
আমার বেঁচে থাকা আর না থাকা তো একই হত!
–আর তোমার কিছু হলে?আমি এতদিন পরে
একজনকে বিশ্বাস করলাম,তাকে আমি আবার হারিয়ে
যেতে দেই কিভাবে?
যাক,শেষ পর্যন্ত আমার মিশন সাকসেসফুল হল!রায়নার
অবিশ্বাসের অগোচরে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাসকে আমি ঠিকই বের করে আনতে পেরেছি!
সেই আনন্দে হেসে ফেলে রায়নার দিকে তাকিয়ে বললাম,
–বাদ দাও তো।বাবা কেমন আছেন?
–বাবার প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল।এখন সব কন্ট্রোলে আছে।
শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।তারপর হঠাৎ
মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে ভুরু নাচিয়ে বললাম,
–আমার প্রপোজের উত্তর কিন্তু আমি পাইনি!
দেখি,রায়না লজ্জায় লাল হয়ে গেছে!আমাকে হালকা
ধমক দিয়ে বলল,
–উফ্ যাও তো,কিছু বলতে পারব না এখন!
তারপরেই আমার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
–আমাদের সাতদিন তো এখনো শেষ হয়নি।তুমি
আগে সুস্থ হয়ে সাতদিনের কাজ কম্পলিট
কর,তারপর আমার মত জানাব!
রায়না অবশ্য সাতদিনের কাজ কম্পলিট হওয়ার জন্য
অপেক্ষা করে নি।তার আগেই আমাকে ভালবাসার
কথা বলে ফেলেছিল!এত দেরিতে বলা নাকি ওর
সহ্য হচ্ছিল না,তাই!
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক