চরিত্রহীনা

চরিত্রহীনা

রাত দুটো বেজে ১৫ মিনিট । স্ত্রীর মোবাইলে অপিরিচিত নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এলো । আগে এমন হতো না । গত দুই মাস ধরে প্রায়ই আসে । ওকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে বান্ধবীর মেসেজ । যদিও আমার সামনে কখনো সেই মেসেজের রিপ্লাই করতে দেখিনি আমি ।

একদিন কল করেছিলাম সেই নাম্বারে । ওপাশ থেকে কেউ কথা বলেনি । আমার ভরাট পুরুষালী কন্ঠটা ওপাশের মানুষটাকে থামিয়ে দিয়েছে । উনি যে আমার স্ত্রীর বান্ধবী নন সেটা আমি নিশ্চিত । হয়তো কোন বন্ধু হবে । তবে কেমন বন্ধু সেটা জানার দরকার । আমাদের বিয়ে হয়েছে দেড় বছর । লাভ ম্যারেজ ছিল । দুই বছর প্রেম করে এরপর পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে । আমার সাথে এফেয়ারের আগেও আমার স্ত্রীর আগে একটা এফেয়ার ছিল । সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই । এরকম কতোজনেরই তো থাকে । আবার মিটেও যায় । বর্তমানই হলো আসল ।

আমি আমার বর্তমান নিয়েই থাকতে চেয়েছিলাম । তবে সেটা মনে হয় আর পারলাম না । আমার স্ত্রী জানে না গত দুই মাস ধরেই আমি তাকে ফলো করি । আমি জানি আমার অনুপুস্থিতিতে সে শাফিন নামে একটা ছেলের সাথে বের হয় । ধানমন্ডিতে যায় । একসাথে বসে । আড্ডা দেয় । ইদানীং বাচ্চা নেয়ার কথা বললেও কেমন জানি খেপে যায় ও । অথচ আমাদের দুজনের পরিবারই চায় নতুন কেউ আসুক আমাদের জীবনে । শুধু চায় না আমার স্ত্রী । একটা অদৃশ্য অজুহাত সব সময় ঝুলিয়ে রাখবে সে ।

অবশ্য সেই অদৃশ্য অজুহাত দৃশ্যমান হতেও সময় লাগে নি । হাতে নাতেই ধরেছিলাম । শুনলে হয়তো অনেকেই হাসবে । তারপরেও বলি । সে আলাদা একটা ফেইক আইডি খুলে রেখেছে শাফিনের সাথে কথা বলার জন্য । সেখানে তাদের চ্যাটও হয় । তবে কি ধরনের চ্যাট হয় সেটা দেখার রুচি আমার হয় নি । প্রাক্তনের সাথে ফেইক আইডি খুলে কি ধরনের চ্যাট করবে এটা ক্লাস ফাইভের একটা বাচ্চাও বুঝবে । রাগে দুঃখে সেদিন তুলিকে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসেছিলাম । কেন জানি মনে হয়েছিল তখনই ডিভোর্স দিয়ে ফেলি । কিন্তু কেন জানি পারলাম না । আসলে বিচ্ছেদে যাওয়া এতো সহজ না ।

সময় গড়ায় । তিক্ততা বাড়তে থাকে আমাদের মধ্যে । ঘরে এলে তো আর শান্তি নেই । কেমন যেন অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকায় সে । সেদিনের থাপ্পড় মারার পর থেকে সব কিছুই কেমন জানি ঠান্ডা হয়ে গেছে । কিছু বলতে চাইলে এড়িয়ে যায় । কোন রকমে উত্তর দিয়ে ঘুমোতে যায় । আমি জানি তুলি ( আমার স্ত্রী ) আজকেও রেসটুরেন্টে গেছে । আগের মতো কেন জানি আর কোন দুঃখ লাগে না । এই যে মাসে মাসে দেড় লাখ টাকা ইনকাম করি , দেখতে যথেষ্ট স্মার্ট , এরপরেও স্ত্রীকে ধরে রাখতে পারলাম না । এখন আর ওর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না । রাতের বেলা একসাথে শুলে মনে হয় আমার পাশে একটা মাংশের দলা পড়ে আছে । আদর করতে আর ইচ্ছে করে না তখন । আচ্ছা জীবনটা এমন কেন ? মানুষ কেন একজনে খুশি হয় না ?

২৯ তারিখ সকাল ৬ টা রোজকার মতো ঘুম থেকে উঠে হালকা কিছু খেয়েই জিম করতে যাচ্ছি । আমার স্ত্রী কেমন জানি হয়ে গেছে । সকাল থেকেই আমার কেয়ার নিচ্ছে খুব । এক রাতের মধ্যে আচমকা এই পরিবর্তনটা আমি বুঝে উঠতে পারলাম না । গতরাতেও সে আমার সাথে ভালো করে কথা বলে নি । আর আজ কিনা নিজ হাতে কফি বানিয়ে দিচ্ছে । হাসি মুখে কথা বলছে ।

ঘটনা কি ? সব কিছু ঠিক হয়ে গেলো নাকি ? কি করে সম্ভব ? সেই অপরিচিত নাম্বারে কল দিলাম । সকাল থেকেই বন্ধ । আমি এখন জিম করতে যাবো সামনের জিমনেশিয়ামে । আমার বাসার ঠিক কিছু সামনে একটা কালো পাজেরো দাঁড়িয়ে আছে । সচিবের গাড়ি হবে আর কি । কারন ওটা তো ভিআইপিদের এরিয়া । তবে গাড়িটাকে আগে কোনদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না । আজকে আমার সাথে তুলিও জগিং করতে যাবে । আমি জোর করিনি । সে নিজে থেকেই যেতে চায় আমার সাথে । অনেক দিন পর আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা একটু স্বাভাবিক হলো ।

তুলি আমার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে জগিং করছে । কারনটা বুঝলাম না । তবে খুব একটা মাথাও ঘামালাম না । অনেকদিন পর আমরা একসাথে জগিং করছি এইটাই বা কম কি !! আমার অজান্তে কালো পাজেরোটা যে কখন চলতে আরাম্ভ করেছে খেয়াল করিনি । হাতের ডান পাশের রাস্তায় কন্সট্রাকশনেরকাজ চলছে । আর বা দিক ধরে সোজা আ,মাদের দিকে ধেয়ে আসছে গাড়িটা । ব্যাপারটা যখন টের পেলাম তখন আর কিচ্ছু করার নেই ।

পরিস্কার বুঝতে পারলাম গাড়িটা আমার উপর দিয়েই চলে যাবে । ঠিক এমন সময় এক জোড়া হাত ধাক্কা মেরে আমাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলো । জ্ঞান হারাতে হারাতে দেখলাম গাড়িটা পাশের কন্সট্রাকশন বিল্ডিং এর জঞ্জালের মধ্যে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে সশব্দে ঢুকে পড়ছে । এরপর আর কিছু মনে নেই । হাসপাতালে পাশাপাশি দুটো বেড । একটাতে আমি শুয়ে আছি । পাশের বেডে শুয়ে আছে আগাগোড়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো একটা শরীর । বুঝতে পারলাম ওটা তুলি । কালো পাজেরোটা সম্ভবত ওর উপর দিয়েই গেছে । ঘৃনায় মনটা তিক্ত হয়ে উঠলো ।

“” তোর প্রাক্তনকে দিয়ে আমায় খুন করতে চেয়েছিলি ? আমি মরলে এরপর তোদের প্রেমের পথে কোন বাধা থাকতো না ,তাই না ? “” আমার মাথায় কথাগুলো বেজে চলছিল । কাকে ভালোবেসে বিয়ে করলাম যে কিনা নিজের প্রাক্তনের জন্য আমাকেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল ? এতো ঘটনার মধ্যে আমি টেরও পেলাম না আমাকে ফলো করছে এক জোড়া চোখ । জায়গা মতো তাকাতেই দেখতে পেলাম ছেলেটাকে । পরনে কালো শার্ট , সাদা মোবাইল প্যান্ট । সুঠাম শরীর । চোখ দুটোতে বুদ্ধির ঝিলিক ।

“”হ্যালো তন্ময় আমি পুলক  আমিই আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি “” ধন্যবাদ দেয়ার সময় এটা নয় । আমার মাথায় আগুন জ্বলছে । আমি কেন হাসপাতালে তা হয়তো এই ব্যাক্তি জানে না । আমার মাথায় কি চলছে পুলক সেটা কিভাবে যেন টের পেয়ে গেলেন । মৃদু হেসে বললেন , তন্ময় আপনি খুব ভাগ্যবান , তুলির মতো একটা মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে পেয়ছেন । লোকটা মশকরা করছে । হয়তো কোনভাবে আমাদের ব্যাপারে অনেক কিছু জানে সে । পুলক আবারো বললেন , আমি মোটেই মশকরা করছি না । সত্যি করেই বলছি তুলির মতো স্ত্রী পেয়েছেন বলে আপনি ভাগ্যবান । কপট হাসি ঝুলিয়ে রাখলাম মুখে । এখন আর চাপ নিতে চাইছি না । এইসব গরু ছাগলের কথায় কান দেয়ার সময় নেই ।

বলতে শুরু করলেন পুলক , ঘটনার শুরু দুই মাস আগে । আপনি তখন অফিসে । আপনার স্ত্রীর ম্যাসেঞ্জারে শাফিন নামের ছেলেটা অনেক গুলো ছবি পাঠায় । তুলির সাথে রিলেশনের সময়কার ছবি তাদের । এগুলো ব্যাপার ছিল না । তবে শেষ বার সে তাদের সেই সময়কার অন্তরঙ্গ মূহুর্তের একটা ভিডিও পাঠায় । বুঝতেই পারছেন ,ব্ল্যাকমেইল । যে কোন মেয়েই ঘাবড়ে যাবে এতে । তুলিও ঘাবড়ে গেলো । চাইলেও সে আপনার সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করতে পারলো না । তবে ঠান্ডা মাথার মেয়ে সে । শাফিন আগাগোড়া লম্পট । এটা নিয়ে যেন আপনাকে সামাজিকভাবে কোন হ্যারাসমেন্টের মধ্যে পড়তে না হয় সেজন্য আপনার স্ত্রী তুলি ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে শুরু করলেন ।

প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও তুলি এইবার ছেলেটার থেকে ভিডিওটা বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো । ফেইক আইডিতে কি চ্যাট করতো সেটা আপনি দেখেন নি । দেখলে হয়তো বুঝতে পারতেন মেয়েটা ওখানে কন নোংরামি করেনি । সে একটা দফারফায় আসতে চেয়েছিল । মেয়েটাকে হয়তো না জেনেই আপনি চরিত্রহীনার কাতারে ফেলে দিয়েছেন । জীবনে হয়তো একটা ভুল করেছিল সে । তবে সে ভুলটা সে বর্তমানে টেনে আনতে চায় নি । আপনার উপর কোন প্রভাব পড়ুক তাও চায় নি । কিন্তু কোন ভাবেই দফারফা করা গেলো না শাফিনের সাথে । এদিকে ভিডিওর ভয় দেখিয়ে শাফিনের কুপ্রস্তাব চলতেই থাকলো । শেষ পর্যন্ত আপনাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মারার হুমকি দিলো সে ।

কথাটা মুখে মুখে বললেও তুলি এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় নি । সে আপনাকে ফলো করতে শুরু করলো । আপনি জানতেও পারলেন না । আজ সকালে কালো গাড়িটা দেখেই আপনার স্ত্রী বুঝে ফেলে ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে । আর তাই আপনার সাথে সাথেই সে জগিং করতে ফের হয় । আপনি ভেবে নিলেন সে আপনাকে খুন করতে এতো প্ল্যান করছে । কিন্তু গল্পটা এমন নয় । গাড়িটা যখন আপনাকে মারতে এলো তখন তুলিই আপনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় । গাড়িটা চলে যায় তার উপর দিয়ে ।

সত্যি ঘটনা জানতে হলে তার চ্যাট বক্স দেখবেন । শাফিন গাড়িতে ছিল । সে পরপারে চলে গেছে । তার মোবাইলের কল রেকর্ড পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে । সেখান থেকেও প্রমান পেতে পারেন । কে কখন কিভাবে এই কাজ করলো তা জানতে চাইবেন না । দুনিয়াতে সব কিছু জানতে হয় না । কথা গুলো বলেই একটা রহস্যময় হাসি দিলেন পুলক । আর হ্যা কথায় কথায় স্ত্রীকে সন্দেহ করতে যাবেন না । এই যাত্রায় হয়তো সে বেঁচে যাবে । কিন্তু পরেরবার ভালোবাসার অভাবে মেয়েটা ঠিকই মারা যাবে । তাকে ভালোবাসুন । যে আপনার জন্য জীবন দিতে পারে তাকে খারাপ ভাবতে যাবেন না ।

আমি কিছু বললাম না । তবে কেমন যেন বুকটা ফাকা ফাকা লাগছে । না চাইলেও গল্পটা আর চালাতে পারছি না । এখন সময় তুলির সাথে থাকার । জীবনের সব থেকে বড় সত্যিটা আমাদের অদেখা গল্পগুলোর মধ্যেই রয়ে গেছে । আমরা সব সময় যা দেখি তা সত্য নয় । আবার সব সময় যা দেখি না তাও মিথ্যে নয় । সত্যার মিথ্যের প্রভেদটা মাঝে মাঝে এতোটাই অস্পষ্ট থাকে যে নেহায়েত কিছু ঘটনা না ঘটলে আমরা হয়তো সেগুলোবুঝতেই পারতাম না ।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত