ফিরে এসো মরিয়ম

ফিরে এসো মরিয়ম

দুইবার হজ্ব করে নামের আগে আলহাজ্ব বসিয়েছেন লোকটা। অথচ তার একমাত্র মেয়ে মৌমিতা হল একটা এক নাম্বারের নষ্টা! ছয় মাস পর পর মৌমিতার জীবনে Real Love আসে! প্রতিটা রিয়েল লাভের সঙ্গে দিনভর চুমু খায়, ইতিউতি ঘুরতে যায়, ফেসবুকে ছবি ট্যাগায়! ছবির ক্যাপশন অতি রহস্যময়। ক্যাপশন দেখে একবার মনে হবে, ছবিতে ওর পাশে বসা মানুষটা নিতান্তই বন্ধুজন। ক্ষণিক বাদেই মনে হবে, নাহ! কোথায় কি যেন একটা খটকা লাগছে। হারামজাদী নিশ্চয়ই নতুন পার্টি ভাগাইছে। এইটা নির্ঘাত ওর বয়ফ্রেন্ড!

অনেকেই অতি উৎসাহে জানতে চায়,”আপু আপনার না আগে একটা প্রেম ছিল? সেই ভাইয়াটা কই?” মৌমিতা রাগ করে না। বিষণ্ণ ইমুজি সহ উত্তর দেয়,”কোথাও কেউ নি। বস্তুত কখনো কেউ ছিল না!” ছেলেরা পাল্টা কমেন্টে মজা নেয়,”আমি ভাবছি আপনার বয়ফ্রেন্ড!” মৌমিতা নিজেও তখন মজাক দেয়,”আহা তাই যদি হতো, জীবন আমার বয়ফ্রেন্ডের দোকান হইয়া যাইত!” এই হল মৌমিতা। নষ্ট মেয়ে মৌমিতা। একশটা নষ্টামি করেও সে হয়ত ভালোই আছে। ভালো থাকার বয়স চলছে ওর৷ বিপাকে পড়েছে বৃদ্ধ বাবা খাদেম আলী। মৌমিতার বাবা আলহাজ্ব খাদেম আলী সত্যিকারেই ভদ্রলোক। মেয়ে তার দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এই খবর কানে পৌঁছায়। তিনি বিষণ্ণ বোধ করেন। কিন্তু এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পান না।

সেদিন রাতে ঘুমের আগে খাদেম আলী তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন,”মৌমিতা কই? আজ সকাল থেকে ওর দেখা পাচ্ছি না!” সুফিয়া উদাস কণ্ঠে উত্তর দেন,”বন্ধুদের সঙ্গে ট্যুরে গেছে৷ কক্সবাজার।””মেয়ে তোমার দুই দিন পর পর কক্সবাজার যায়, নিষেধ করতে পার না?” সুফিয়া ভ্রুকুঁচকে ফিরে তাকান। বিরস গলায় বলেন,”রাত অনেক হইছে। ঘুমাও।” খাদেম আলী মুখে তালা এটে পাশ ফিরে শুয়ে থাকেন। তার বুকের ভিতরে আপনা থেকেই একটা নিবিড় প্রার্থনা উঠে আসে,”ফিরে এসো মরিয়ম। ফিরে এসো মা আমার!”

মৌমিতা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোর্থ ইয়ারের ছাত্রী। বাপের চেয়েও বেশি শিক্ষিত বলেই হয়ত বাপ-মায়ের আবেগকে তেলাপোকার মতো তাচ্ছিল্য করে বেড়ায়। বাবা তার সামান্য এক পেয়াজ-রসুনের দোকানদার। সারাজীবন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে শেষ বয়সে টাকার মুখ দেখেছেন। সদরঘাটে বিশাল এক আড়ৎদারি দোকান খুলেছেন। আদাবরে জায়গা কিনে সাড়ে তিনতলা বাড়ি করেছেন। দেশগ্রামে জমি ছিল, সেই জমি বিক্রি করে হালাল টাকায় হজ্ব করেছেন। বাইরে থেকে তিনি একজন দুর্দান্ত সফল মানুষ। লঞ্চঘাটার সামান্য বাদাম বিক্রেতা ছিলেন, এখন ডাকসাইটে আড়ৎদার। গাড়ি হয়েছে, বাড়ি হয়েছে, মসজিদ-মাদ্রাসায় দান-খয়রাতের সুবাদে ইদানীং মহল্লাতেও নাম ছড়াচ্ছে। সকলেই তাকে হাজীসাব বলে সম্মান করে আগ-বাড়িয়ে সালাম দেয়। এত সুখ জীবনেও কল্পনা করেন নি খাদেম আলী৷ এসে গেছে। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হচ্ছে সুখ-পাখি একা আসে নি। সঙ্গে করে গ্লানি নিয়ে এসেছে। গ্লানির নাম মৌমিতা।

জন্মের সময় খুব আদর করে এই মেয়ের নাম রেখেছিলেন মরিয়ম। ক্লাস এইট অবধি এই ছিল ওর ডাকনাম। স্কুলেও এই নামে ভর্তি করানো হয়েছিল৷ কিন্তু নাইনে উঠে এসএসসি রেজিষ্ট্রেশন করার সময় মেয়ে তার পাকনামি করে পিতৃপ্রদত্ত নাম বয়কট করেছে। মোছা. মরিয়ম আক্তার নামটা ওর পছন্দ হয় নি। পুরনো নাম বাতিল করে নাম দিয়েছে- মৌমিতা ইসলাম মারিয়া! তিনি রাগ করেন নি। মায়ের নামে কন্যার নাম রেখেছিলেন, মরিয়ম। সেই মরিয়ম যদি স্বেচ্ছায় নাম বদল করে, তার কিছু বলার থাকে না। তিনি কিছুই বলেন নি।

কন্যাকে ভালো তিনি প্রাণের চাইতে বেশিই বাসতেন। কিন্তু প্রকাশ করেন নি কখনো। সেবার জৈষ্ঠ্যমাসে মরিয়মের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হল। মেয়ে তার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। অপরিমেয় গর্বে খাদেম আলীর বুকের সীনা ফুলে উঠল। সামান্য এক পেয়াজ-রসুনের দোকানীর মেয়ে- গোল্ডেন প্লাস পেয়েছে। পত্রিকার পাতায় বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে উচ্ছ্বসিত ছবি ছাপা হয়েছে। সেই পত্রিকা দেখে ওর আশপাশের দোকানীরা তব্ধা খেয়ে গেল। মিষ্টি খাওয়ার বায়না ধরল।

পুরান ঢাকার মরণচাঁদ মিষ্টান্ন থেকে তিনি দেড় মণ কাঁচাগোল্লা কিনে নিয়ে আসলেন। আড়তের বন্ধুরা, বাসাবাড়ির প্রতিবেশীরা- সকলেরই ঘরে ঘরে থরে থরে মিষ্টি পাঠানো হল। অনেকেই উপদেশ দিচ্ছিল,”মেয়ে তোমার একটা রত্ন। ওকে ডাক্তারী পড়াও!” সত্যি বলতে কি, মেয়ে ডাক্তার হবে নাকি ইঞ্জিনিয়ার হবে, এই ভাবনা তার মাথায় কখনো ছিল না। কিন্তু এসএসসির রেজাল্টের পর মেয়ের নামযশ দেখে তিনি স্বপ্ন বুনতে শুরু করলেন। এই মেয়ে একদিন দেশের সবকটা ডিগ্রী নিয়ে ইউরোপ-আম্রিকায় পড়তে যাবে। ফিরে এসে উঁচু- উঁচু চাকুরী করবে। বংশের মুখে প্রদীপ দেবে।

কিন্তু হায়, নিয়তির চাকা কাকে যে কোনদিকে নিয়ে যায়, বলা মুশকিল। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় নেভির এক পদস্থ অফিসারের ছেলের সঙ্গে মৌমিতার প্রেম হল। প্রথম প্রেম। ছেলেটা ভালোই ছিল। কিন্তু বেশি স্মার্ট। চুটিয়ে প্রেম করেছে। সপ্তাহে একবার রুম ডেট করেছে। বড় হয়ে দুজনেই একসঙ্গে একটা আস্ত জীবন এক সঙ্গে কাটিয়ে দেবে বলে দিবসরজনী স্বপ্ন দেখেছে, আর সেক্স করেছে আর স্বপ্ন দেখেছে দুই বছরের মাথা ওরা নিজেরাই টের পায় বলার মত কথা আর স্টকে নাই দেবার মতো কোন রহস্যও আর কারও শরীরে অবশিষ্ট নাই।

এইবার একটা বিয়ে করা যায়, যদি একটা বাচ্চা হয়, ভালোবাসাটা ঠিকে যাবে হয়ত। হয়ত মৌমিতা খুব করে চাইছিল। কিন্তু ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে বিতৃষ্ণ গলায় বলে উঠেছিল,”বস্তি টাইপ কথা বলবা না। জীবন তো এখনো শুরুই হয় নি, এখনই করব বিয়ে? ব্লাডি বস্তি!” মৌমিতাকে বস্তি বলে ছেলেটা চলে গেল। মৌমিতার মা একদিন জানতে চাইল,”সামিকে দেখি না অনেক দিন, আসে না কেন বাসায়?” মৌমিতা উত্তর দিতে পারে না। বোকাসোকা মা-জননীর গলায় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্না করেছে, আর বলেছে- পুরুষ মানুষ এত খারাপ কেন আম্মু? পুরুষের মতো বেইমান প্রাণ জগতে দ্বিতীয় নাই! সুফিয়ার যা বুঝার বোঝ হয়ে গেছে। সামি ছেলেটাকে তিনি মনে মনে পছন্দই করতেন। সুন্দর চেহারা। উচ্চবিত্ত ফ্যামিলি।

এই রকম একটা ছেলেকে মেয়ের জামাই হিসেবে দেখতে পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু নাহ, হল না। প্রথম প্রেমে ব্যর্থ হবার পর কয়েকমাস মৌমিতা ঝিমিয়ে রইল। এরই মধ্যে ইন্টারমিডিয়েট রেজাল্ট হয়েছে।গোল্ডেন আসে নাই, প্লাসও আসে নাই। ফোর পয়েন্ট সিক্স নাইন। পাবলিকে পড়ার স্বপ্ন ছিল মৌমিতার। স্বপ্ন উবে গেল। বাপের টাকা ছিল। টাকার দাপটেই হয়ত ঢাকার একটা ডাকসাইটে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাই-প্রোফাইল বন্ধু-বান্ধবের সংস্পর্শে এসে মৌমিতা প্রথম টের পেল- সে একটা বোকাচন্ডাল! প্রেমে ব্যর্থ সে শুধু একাই হয় নি। অনেকেরই এমন গল্প আছে। তারচেয়েও বড় কথা, সেক্স! এইরকম লজ্জাজনক একটা বিষয় নিয়াও যে ধুমায়া ফ্যান্টাসি করা যায় এই খবর সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েই প্রথম টের পায়।

কলেজে রাখডাক ছিল। ফিসফাস গল্প ছিল। কিন্তু এখানকার পরিবেশ পুরাই অন্য। সেক্স জিনিসটাকে এরা সবাই এডভেঞ্চার হিসাবে দেখে! এই ‘এরা’ আসলে কারা? অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মৌমিতার বন্ধু-চক্রটা সুস্থ ছিল না। শহরে কিছু বিকারগ্রস্ত ছেলেমেয়ে থাকে। এরা এক অন্যের চোখের দিকে একবার তাকিয়ে ইঙ্গিতে চিনে নিতে পারে,”তুমি আমাদেরই লোক! চল ওয়ান-টু- ওয়ান-টু খেলি এরা প্রায় সবাই অবাধ যৌনসুখের তাড়ানাতে লুটোপুটি খেলত, অথচ বোকাসোকা মৌমিতা তখনও খুঁজে ফিরছিল একফালি ভালোবাসা! সত্যিকারের একটা ভালোবাসা!

এর ফলে যখনই যার সঙ্গে দেখা হয়েছে, অল্প একটু ঘনিষ্ঠটা হয়েছে, মনে মনে স্বপ্ন দেখেছে মৌমিতা… এই ছেলেটার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে! সমস্ত জীবন ভরে একই সঙ্গে, একই শয্যায় জড়াজড়ি হয়ে পড়ে থাকব আমরা… অতলান্ত ভালোবাসায়… প্রেমে ও সঙ্গমে ওতপ্রোত… জনমও জনম একে অন্যের তরে কাঁদিব কিন্তু কই? একশত কোটি চুম্বন হয়েছে, নির্বিবাদে যৌন-সঙ্গম হয়েছে… একই হাতে হাতে রেখে কারও সঙ্গে তিনমাসের বেশি হাঁটতে পারে নি মৌমিতা শাপভ্রষ্টা দেবী আমাদের মৌমিতা! দুই মাস পর পর ওর জীবনে রিয়েল লাভ এসেছে কিন্তু একটাও টিকে নাই এই তো সপ্তাহ দুয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ফাংশনে এলামনাই এসোসিয়েশনের সদস্য হিসেবে একজন খুব বড় মাপের মানুষ হাজির হয়েছিল। লোকটার বয়স চল্লিশের ঘরে। নিজে একটা বায়িং হাউজের মালিক। একটা টিভি চ্যানেলের শেয়ার হোল্ডার। নাম তার আতা চৌধুরী। সেধে এসে মৌমিতার সঙ্গে আলাপ করল। নাম্বার নিয়ে গেল।

মৌমিতা ছিল সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। আলাপের সূত্র সেখান থেকেই তৈরি হয়। লোকটা তাকে কল দেয়। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে,”তোমার গলায় একটা বিষাদমাখা ঢেউ আছে। এইটা আমি কাজে লাগাতে চাই। চ্যানেলে কাজ করবা? উপস্থাপনা? ব্যবস্থা করে দেই?” লোকটা ব্যবস্থা করে দিল। মৌমিতার চাকুরি হয়ে গেল। চাকুরী হবার পনের দিনের মাথায় সে তার দক্ষিণা দাবী করে বসে। মৌমিতাকে ভোগ করতে চায়। মৌমিতআর বুকের খাড়াই দেখে লোকটার নাকি মাথা আউলায়ে গেছে। ওর বুকেচুম্বন না করে মারা গেলে একটা জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে শালা শুয়ার বৎসের!

জীবন এই প্রথম কেউ শুধুমাত্র ওর শরীরের দিকে তাকিয়ে শরীরী স্বাদ নেওয়ার প্রস্তাব করল৷ এর আগেও ছেলেরা এসেছে। ন্যাকী গলায় মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কথা বলে ওর সাথে শুয়েছে। কিন্তু এতটা নগ্নভাবে কেউই ওকে ভোগ করার প্রস্তাব করে নি। এই লোকটা মৌমিতাকে জাস্ট একটা পণ্য ভেবে ভোগ করতে চাইছে। মৌমিতা তব্ধা খেয়ে যায়। লোকটা ভারিক্কি কণ্ঠে বলে,”Don’t worry, i must pay you enough… ” আজ রাত আটটা থেকে নটা অবধি একটা টক-শোর উপস্থাপনা করার কথা মৌমিতার। দশটার দিকে আতা চৌধুরী ওর অফিসে এসে মৌমিতাকে গাড়িতে তোলে নিয়ে যাবে, এই ছিল প্রস্তাবনা। মৌমিতা হ্যা বলে নি, নাও বলে নি। সে শুধু অফিসে দেওয়া মোবাইল ফোনের নাম্বারটা বন্ধ করে পালিয়ে এসেছে।

রাত এখন সাড়ে নটা। মৌমিতা বসে আছে টিএসসির সামনে সড়ক দ্বীপে। ডাসের পাশে ছোট্ট একটা মঞ্চ সাজিয়ে কারা যেন লোকজ গানের আয়োজন করেছে। ছাড়া ছাড়া গানের লাইন ওর কানে আসছে। ইতিউতি প্রচুর মানুষ, তবুও কোথাও ভিড় নেই। এতটুকু জটলা নেই। মৌমিতার শান্তি শান্তি লাগছে। এই শান্তি শান্তি ভাবের উৎস কি? মৌমিতা ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু ওর ভালো লাগছে। একটু পর পর জঘন্যতম পাতলা লিকারে বানানো রঙ চা খাচ্ছে, সিগারেট টানছে। আর ঝিমুচ্ছে। এই ঝিমুনির মধ্যেও মৃদ্যু সুখ টের পাওয়া যাচ্ছে। এই সুখের উৎস কি মুরগী জামাল? অসম্ভব কিছু নয়..! মুরগী জামাল হচ্ছে মৌমিতার দূর সম্পর্কের এক ভাই। কিশোরগঞ্জ হাওর অঞ্চলের ছেলে। অত্যন্ত হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে। ঢাবিতে পড়ছে। হিস্ট্রিতে অনার্স করেছে বা করছে।

এই ছেমড়া প্রতি সপ্তাহে একবার গ্রামের বাড়ি যায়, খাঁচা ভরে দেশী মুরগী নিয়ে এসে ঢাকার হাঁটে বিক্রি করে।
দেশী মুরগীর প্রতি মৌমিতার বাবার খুব নেশা। এর কাছ থেকে প্রায়ই তিনি মুরগী সংগ্রহ করেন। এই ছেলেটাকে বাবা খুব পছন্দ করেন। মনে মনে ওর সঙ্গে মৌমিতার বিয়েও বোধহয় ঠিক করে রেখেছেন। মৌমিতা কখনো পাত্তা দেয় নি। ওর জাস্ট বমি আসত। হিস্ট্রির মতো ভাতে মরা সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করছে একটা ছেলে তার উপর দরিদ্র ব্যবসা একটা যাও করে- তাও কিনা মুরগীর ব্যবসা এই ছেলে তো মৌমিতার পায়ের নখেরও যোগ্য না! এরে করবে বিয়া? হলি ফাক!!!

কথা প্রসঙ্গে জামাল ছেলেটার কথা যখনই উঠে এসেছে মৌমিতা তাকে তাচ্ছিল্য করে মুরগী জামাল বলে তাচ্ছিল্য করেছে। বাবা রাগ করেন। কিন্তু বাড়ন করতে পারেন না। মৌমিতার বোকাসোকা বাবা কেন জানি মৌমিতাকে খুব ভয় পায়… ভয় নাকি অন্য কিছু?মৌমিতা জানে নামৌমিতার বাবা একদিন খাবার টেবিলে মার সঙ্গে আলাপ করছিলেন,”জামাল ছেলেটাকে আমার বেশ লাগে। পরিশ্রমী। জীবনে উন্নতি করবে। তাছাড়া নিপাট ভালো ছেলে! ওর চেহারা মধ্যে কী ভীষণ মায়া, আর নিষ্পাপ একটা ভাব আছে..!”মা বলেন,”হু।”

ওপাশ থেকে মৌমিতা বিরক্ত স্বরে প্রতিবাদ করে,”হু না লাড্ডু। ঢাকা শহরের যত রিকশাওয়ালা আর কাজের বুয়া আছে সবারই চেহারা এমন।এরা ইচ্ছে করেই মুখের মধ্যে একটা মায়ার প্রলেপ মাখিয়ে রাখে, যাতে সবাই করুণার চোখে তাকায়… বকশিস হিসাবে দুইটা টাকা বেশি দেয় মৌমিতার বাবা ওর কথার তেজ দেখেই মাথা নুইয়ে ফেলেন। মা বলেন,”তোর শুধু দেমাগের কথা। এত্ত দেমাগ ভালো নয় না!” মৌমিতা বিবাদ করে না। তাচ্ছিল্যের একটা ভঙ্গি করে খাবার টেবিল থেকে উঠে যায়। বেসিনে হাত ধুইতে ধুইতে আপন মনেই হেসে উঠে,

“তোমরা কি জানো, ঢাকা শহরের আশিরভাগ রিকশাওয়ালা আর কাজের বুয়ার বাড়ি হচ্ছে তোমাদের ঐ কিশোরগঞ্জ। কেউ যখন আমার কাছে দেশ-গ্রামের কথা জিজ্ঞেস করে, কিশোরগঞ্জের কথা বলতে লজ্জা হয় গ্রামের কথা বলতে পারি না শালার কাজের বুয়া আর রিকশাওয়ালা টাইপ ট্যাগ খাওয়ার ভয়ে?!” ওর কথা শুনে বাবা-মা দুজনেই হয়ত গ্লানিতে ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু সে নিজেই ছিল নেশার ঘোরে। এইসব সস্তা আবেগকে পাত্তা দেওয়া জরুরি মনে করে নি। মৌমিতা ভাবছিল, আর ঝিমুচ্ছিল, আর অপেক্ষা করছিল… জামালের জন্য। জামাল ওদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। খুবই দরিদ্র ঘরের ছেলে। দরিদ্র হলেও ছেলে ভালো। মৌমিতা জানে… কিন্তু স্বীকার করে নি কখনো!

মৌমিতার সঙ্গে জামালের দেখা হল রাত পৌনে দশটায়। সস্তায় কেনা একটা টিশার্ট এবং রঙচটা জিন্স পরনে। অযত্নে ফেলে রাখা চুলের রাশ কপালের একপাশ ঢেকে রাখে। রুগণ দেহের প্রেক্ষিতে ওর চোখজোড়া সর্বদাই অন্য রকম দেখায়। অজানা ব্যথা ও ক্রোধের দহে যেন ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। মৌমিতার সামনে দাঁড়িয়ে সে অকৃত্রিম হাসির সঙ্গে জানতে চাইল,”কেমন আছো মরিময়?” মৌমিতা চমকে ফিরে তাকাল। বহুকাল পরে কেউ তাকে এই নামে ডাকল, মরিয়ম! মরিয়ম কী ভীষণ মিষ্টি আর নিষ্পাপ একটা নাম! ওর এত্ত ভালো লাগল। সে নরম গলায় উত্তর দিল,”ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ! আপনার কি খবর জামাল ভাই? কেমন আছেন?”

“এই তো, বেশ। ভালো। আমি খুবই স্যরি, অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি তোমাকে!”

“ইট’স ওকে। জায়গাটা সুন্দর। আমি বেশ এনজয় করেছি।”

“তারপর, কি খবর? কি জন্যে ডেকেছ বল? তোমার ফোন পেয়ে আমি প্রায় সপ্ত আকাশ থেকে পতিত হয়েছি। কোনদিন ভাবি নাই..”

“কি ভাবেন নাই?”

“কিচ্ছু না। বাদ দাও। নিজের কথা বল..” “বলার কিছু নেই। আজ শুধু শুধুই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। অনেক দিন যান না আমাদের বাসায়। মুরগির ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন!” মৌমিতা হাসছিল। কিন্তু সেই হাসিতে কিছু একটা লুকিয়ে ছিল, খুব বিষাদমাখা কোন ইঙ্গিত? হাসি মুখে সায় দেয় জামাল,”হ্যা, ছেড়ে দিয়েছি!”

“আহা ছাড়লেন কেন? কাজটা তো খারাপ কিছু নয়।”

“হুম। এখন এরচেয়েও ভালো একটা কাজ করছি, তাই ছেড়ে দেওয়া..!”

“কি কাজ?”

“বৃক্ষ বিপণন। একটা পেইজের মাধ্যমে অনলাইনে ফুল-ফলের গাছের অর্ডার নিচ্ছি। নিজস্ব লোক মারফত মানুষের বাড়ি বাড়ি ফুলের গাছ পৌঁছে দিচ্ছি। বৃক্ষ সহযোগে ইনটেরিয়র ডেকোরেশনের কাজ করে দেই..”

“বাহ, আপনার দিন তাহলে বদলায়ে গেছে?!”

“হ্যা। কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলা যায়!”

“ট্রিট দেন, ট্রিট চাই!”

“আরেব্বাস, তোমাকে ট্রিট দেব আমি? আল্লাহ মাফ করো!”

“কেন, কেন? দিবেন না কেন?”

“এত টাকা আমি পাব কই মরিয়ম? এককাপ কফি খাও তুমি সত্তুর দিয়ে..!”

“আমি কি আপনার কাছে সত্তুর টাকার চা চেয়েছি। ভালোবেসে পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি খাওয়ান, এতেই খুশি!” ওর শেষ কথাটা খুব ভালো লাগল জামালের। আন্তরিক কণ্ঠে বলল,”আচ্ছা বেশ, চল তাহলে-” সড়কদ্বীপ থেকে প্রথমে চানখারপুলের দিকে গেল ওরা। সেখানে খানাপিনা করে চারুকলায় এসে বসল। চারুকলা থেকে ডাকসু হয়ে, মলচত্বরের দিকে হাঁটাহাঁটি করল। এরপর ভিসি চত্বরের সামনে বসে সস্তায় আইক্রিম খেল। পলাশীর দিকে গিয়ে ভরা পেটে আবারও দুইজনে পাল্লা দিয়ে তেলেভাজা পরটা ও ডিমের ওমলেট খেল। রাত সাড়ে বারোটার দিকে রিকশায় করে নীলক্ষেত থেকে আদাবরের দিকে রওনা দিল ওরা। ফেরার পথে মৌমিতা জানতে চাইল,”অনেকটুকু সময় নষ্ট করে দিলাম আপনার, রাগ করেছেন নিশ্চয়ই?” জামালের দেহ কাঁপছিল। কাঁপা কণ্ঠে বলল,”আজকের দিনটার কথা আমি জীবনে ভুলব না!”

মৌমিতা অবাক বিস্ময়ে ওর ঘোর লাগা মুখের দিকে ফিরে তাকাল। সে বলল,”আপনি এত দূরে সরে যাচ্ছেন কেন? এইদিকে আসুন, চেপে বসুন আমার দিকে… অবশ্যি যদি আমাকে ঘেন্না না করেন!”জামালের চোখেমুখে কেউ যেন অকস্মাৎ একটা চাবুক কষে মারল। সে হতচকিত কণ্ঠে জানতে চাইল,”ঘেন্না? তোমাকে? ইয়া খোদা!” “আপনি আমার সম্পর্কে কিচ্ছু জানেন না জামাল ভাই। আমি একটা নষ্টা টাইপ মেয়ে!” “আচ্ছা বেশ, আমি কী এই নষ্টা টাইপ মেয়েটার হাতটা ধরে খানিকটা সময় বসে থাকতে পারি? যদি এই অধম ছেলেটাকে সে করুণা করে হলেও এতটুকু সহ্য করিতে পারে..!”

মৌমিতা নিজের সুঢৌল ও লতানো একটা হাত জামালের পিটের উপর দিয়ে পেটের কাছে প্রবেশ করিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসে। এমনিতেই একে অন্যের গা ঘেঁষে ছিল। রিকশার ঝাঁকুনিতে ওরা একেবারে ওতপ্রোত হয়ে গেল। ওরা বাড়ি ফিরছিল। বাড়ির ভেতরে থেকে আয়ুষ্ক এক পিতা তখনও ঘুমের ভেতরে মনে মনে প্রার্থনা করছিল,”ফিরে এসো মরিয়ম, ফিরে এসো মা আমার!”

এই বৃদ্ধপিতার নাম খাদেম আলী। তিনি হালাল টাকায় হজ্ব করে নামের আগে আলহাজ্ব বসিয়েছেন। দয়াময় স্রষ্টা উনার হজ্ব কতটা কবুল করেছেন, তার প্রতিদানে কবে কি দেবেন জানি না… কিন্তু দশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া একমাত্র কন্যা মরিয়মকে যে ফিরিয়ে দিয়েছেন, এই সংবাদ আমরা পেয়ে গেছি সেদিনের পর থেকেই মৌমিতা ইসলাম মারিয়া নামের সেলেব্রিটি আপুটি তার প্রোফাইল নাম চেঞ্জ করে ‘মরিয়ম আক্তার’ লিখে রেখেছে পুরাকালের সব ছবি সরিয়ে ফেলেছে সে। পুরনো ফ্যান-ফলোয়ারগণ আগের মত বিনোদন না পেয়ে মরিয়মকে আন-ফলো করে চলে গেছে জামাল এবং মরিয়মের বিয়ের দুই বছর পর এই আইডিতে প্রথম একটা ছবি পোস্ট হল…

সদ্য জন্ম নেওয়া ফুটফুটে সুন্দর একটা কন্যা সন্তানের ছবি। জামাল ও মরিয়মের কন্যা। এই ছবি নিয়ে কোন কাব্য করতে হয় না। বারেবারে ঘুরেফিরে শুধু একটা কথাই বলতে হয়,”আলহামদুলিল্লাহ!” মরিয়মও তাই লিখল,”আলহামদুলিল্লাহ। দয়াময় আল্লাহ আমাদের সন্তানকে নেক হায়াত দান করুন!” মরিয়মের এই পোস্টে হয়ত একটাও কমেন্ট আসবে না.. তবুও যদি আসে, ঘুরেফিরে একটা কথাই আসতে পারে আসা উচিত আর সেইটা হল-

“আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ কবুল করুন!” যদিও আমরা জানি, মানুষের পৃথিবীটা সুস্থ-সুন্দর মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য একেবারেই যোগ্য নয়। তবুও আমরা নিরন্তর ভালো থাকার চেষ্টা করেছি  করিতেছি  করিতে থাকিব এই হল আমাদের নিয়তি আমাদের একমাত্র গ্লামার…

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত