ঘরের সাদা বেসিন টা পরিষ্কার করতে গিয়ে সুরাইয়া বেগম বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে বললেন “একবার খারাপ হয়ে গেলে যত ধোয়াই হোক তা আর আগের মত হয়না।” মেয়ের বইখাতা গুছিয়ে দিতে দিতে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রুবি উত্তর দেয়,
-” তবে কেনো মা আমায় তার কাছেই আবার ফেরত দিতে চাও যে একবার খারাপ হয়ে গেছে?” রুবির এমন অদ্ভুত যৌক্তিক প্রশ্নে ক্ষানিক টা নড়েচড়ে দাঁড়ালেন তার মা সুরাইয়া বেগম । আসলেই এর কোন যথার্থ উত্তর নেই তার কাছে, কিন্তু তবুও তিনি চান তার মেয়ে স্বামী সংসারে ফিরে যাক। লোকের মুখ বন্ধ হোক।
পরিবারের মতেই রুবি আর ইমরানের বিয়েটা হয় গত পনের বছর আগে। রুবি তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুনী। বিয়ের পরের বছরেই রুবি সন্তান সম্ভাবা হয়। বিষাদে, সহ্যে,আনন্দে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এবার আর ধৈর্য্যের কাঁটা এক দাগ ও নড়েনা রুবির। সহ্যের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়ে ১৫ বছরের সংসার জীবনে ইতি টেনে বাবার বাড়িতে ঠাঁই নেয় রুবি। রুবির একমাত্র সন্তান অরুনি নবম শ্রেণীর ছাত্রী, খুব বুঝদার না হলেও অবুঝ সে কখনোই ছিলো না। বাবাকে তিল থেকে তাল হলেই অথবা তার করা কোন কাজের কৈফিয়ত চাইলেই মায়ের গায়ে হাত তুলতে দেখেছে সে সহস্রবার। মায়ের পক্ষ হয়ে কখনো মুখ ফুটে প্রতিবাদ টুকুও করতে পারেনি অরুনি। তবে মাস তিনেক আগে নিজের শিক্ষিকার সাথে বাবা কে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে বাবার সাথে ডিভোর্সের দাবী নিয়ে মায়ের পায়ে পরে অরুনি । ঘটনার পানি ইমরানের হাত ধরে অনেক দূর গড়ালেও শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি, গ্রামের পঞ্চায়েত বসে রুবি আর ইমরানের সংসার জীবনের ফয়সালা করার তারিখ জানিয়েছে।
রুবির বাবা মারা যাওয়ার আগে তার উপার্জিত টাকার ৮০% ব্যয় করে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলেন শহরের এক নামকরা পরিবারে। বাবা মায়ের বিশ্বাস ছিলো বংশে মানুষের পরিচয়, কিন্তু সে বিশ্বাস টা ভেঙ্গে নেশা আর নারীতে মত্ত হওয়া পুরুষ নামের জীবটা বিয়ের প্রথম মাসেই মেয়েটাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো বংশ নয় রূপ বদলেই মানুষের পরিচয়। পনের বছর টিকে থাকার যুদ্ধ করে এবার হেরে গেলো রুবি, তার বিশ্বাস অনেক টা দেরীতে করলেও সিদ্ধান্ত টা সে ভুল নেয়নি কোনো কালেও। এদিকে তার মা সুরাইয়া বেগমের ভাবনার অন্ত নেই তাকে নিয়ে, তিনি আবারও তাকে স্বামীর হাতে সোপর্দ করে লোকের কু-কথার মুখে কুলুপ এঁটে দিতে চান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর পড়ালেখার সুযোগ পায়নি রুবি, নিজের এ থেমে যাওয়া নিয়ে তার দীর্ঘশ্বাস গত পনের বছরে একবারও থেমেছে কিনা তা নিয়ে সংশয় হয় তার।
আজ ৩ মাস হলো বাবার বাড়িতে এসে বসেছে রুবি। এরমাঝে একটা চাকরি ও জোগাড় করে নিয়েছে সে, মেয়ের লেখাপড়ার খরচ, নিজের খরচ এসব মা, ভাইয়ের উপর ফেলে রাখতে নারাজ রুবি। ছোট ভাইয়ের বউটা ইশারা ইঙ্গিত দিতে দিতে গত রাতে বলেই ফেললো “আপা নিজের সংসারে ফিরে যান, এ বয়সে সংসার ছাড়লে লোকে তো মন্দ বলবেই! শত হলেও ভাই পুরুষ মানুষ, একটু আধটু এরকম করেই ছেলেরা!” সে কথা টা শেষ করার আগেই অরুনি তার মুখ থেকে কথাটা প্রায় কেড়ে নিয়েই বললো, “মামি, মামা বাহিরে মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করলে, আপনাকে মারধর করলে আপনি নিশ্চয় কিছুই করবেন না? আপনাদের কষ্ট হলে আমরা এখান থেকেও চলে যাবো সমস্যা নেই”! রুবি অবাক হয়ে চেয়ে ছিলো অরুনির দিকে, প্রতিবাদী একটা ঝলক ওর চেহারা টা কে পাল্টে দিচ্ছিলো যেন মুহুর্তেই।
গ্রামে প্রায় মাস তিনেক ধরেই কানাঘুষা চলছে রুবিকে নিয়ে, প্রতিদিন বিকাল করে দু’য়েক জন এসে ঘুরে যায় তাদের বাড়ি থেকে। কেউ আবার সব জানা সত্বেও আরেকটু রস মাখাতে রুবির মাকে জিজ্ঞেস করে ” খালা রুবি আর যাবেনা জামাই বাড়ি?” কেউ আবার যাওয়ার কালে রুবির গায়ে হাত বুলিয়ে বলে যায় ” কি আর করবি বল, তোর কপাল ভালো না সংসার টিকলোনা ” তারা এমন ভাবে বলে যেন ডিভোর্স নিলে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় নারী হবে সে। বয়সে বড় কেউ আবার তাচ্ছিল্যের স্বরে উপদেশ দিয়ে বলে “বিয়ার লায়েক মেয়ে রাইখা জামাই রে তালাক দিতে চাইতাছো? ছিঃ ছিঃ মাইয়াটার কি গতি হইবো, বিয়া দিতে পারবা জনমে?” তার উপরে চাকরি নেওয়ায় পাড়ার মুরুব্বীরা বলেন “এই বয়সে কিসের আশায় জামাই ছাড়লো, আজকাল কার মাইয়ারা এমনই, জামাই টোকা দিলেও কয় ভাত খামুনা। আরও কত কি দেখমু কালে কালে!” শুনতে শুনতে এসব আর গায়ে মাখায় না রুবি, তবে মাঝে মাঝে ধৈর্য্যশক্তি হারিয়ে ভীষণ কান্না পায় তার। ঘরের দরজা আটকে চিৎকার করে কেঁদে নিজের সান্ত্বনা নিজের মাঝেই খুঁজে নেয় সে।
রুবির অফিস সহকর্মিদের প্রায় সবাই ই জানে ওর জীবনের ট্রাজেডি টার কথা। কেউ সান্ত্বনা দেয়, কেউ বা সাহস যোগায় খারাপ কাটেনা সময় টা এখানে তার। প্রতিদিনের মত আজও অফিসের কাগজ গুলো গুছিয়ে বসের রুমে দিয়ে আসার আগে বড্ড ইতস্তত করছে রুবি৷ বসের কথা বার্তা তেমন ভালো লাগেনা রুবির কাছে, মনেমনে ঠিক করে রেখেছে একটা ভালো চাকরি হলে ছেড়ে দিবে এটা৷ দ্বিধা করতে করতে বাধ্য হয়ে চলেই গেলো কাগজ গুলো নিয়ে। রুবির বস মাহবুব রহমান অফিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বয়স ৪৮ কিংবা তারও বেশি। ৩ সন্তানের জনক তিনি । মেয়ে সহকারীদের সাথে স্বভাবতই রসিয়ে আলাপ করতে পছন্দ করেন মাহবুব। যা রুবির অপছন্দ। রুবিকে বসতে বলে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন মাহবুব রহমান। প্রাসঙ্গিক কথা বার্তা বাদ দিয়ে তিনি রুবিকে নিয়ে কিছুটা আফসোস করে বললেন,
– “এমন সুন্দরী স্ত্রী থাকতেও যে পরকীয়া করে সে নির্ঘাত মূর্খ!” রুবি চুপ করে থাকে, মাহবুব চেয়ারের পেছন থেকে এসে রুবির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
– ১৫ হাজারে পোষায় রুবি? হাত টা শুধু ধরে দেখো ৩০ এ প্রমোশন করিয়ে দিবো।
রুবি চেয়ার ছেড়ে উঠে কষিয়ে থাপ্পড় বসায় মাহবুব রহমানের গালে, ছিহ বলে তার মুখে থু ছুঁড়ে মেরে হনহন করে বেড়িয়ে যায় রুবি। অফিসের সব কর্মিরা হা করে চেয়ে থাকে রুবির দিকে, রুবির দুচোখ ভর্তি জল!
দুপুরের কড়া রোদে হাইওয়েতে হাঁটছে রুবি, চুলের গোড়া থেকে ঘাম বেয়ে পরছে মুখে। ওড়নায় বারবার মুখ মুছে নিয়ে আনমনে হাঁটছে সে, পুরো জগৎ টা যেন সামনে ভাসছে তার। মাহবুব রহমান, ইমরান এসব লোক দের সামাজিক ভাষায় ভদ্রলোক বলা হয়, মুখাবয়বে এরা সত্যিই ভদ্র! দিনের পর দিন পরিবারের মানুষ গুলো কে ঠকিয়ে অশ্লীলতার পাহাড় গড়ে টাকা দিয়ে সমাজ টার চোখ কতো নিপুণ ভাবে ঢেকে রেখেছে এসব মানুষ! পুরো সমাজ টাতে তাদের কতো সম্মান! কতো তোয়াজ! সমাজ এসব লোকগুলোর দিকে কখনো আঙুল তুলে না, বরং আঙুল তোলে সমাজ দ্বারা ধর্ষিত একজন ধর্ষিতার দিকে, একজন বয়স বেড়ে যাওয়া অবিবাহিতা মেয়ের দিকে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে চলে আসা ডিভোর্সি নারীর দিকে, সন্তান নিয়ে বাস্তবতায় যুদ্ধকরা সিংগেল মায়ের দিকে, পরিবারের হাল ধরে চাকরি করে রাতে ঘরে ফেরা মেয়েটার দিকে!!
ছিঃ আমি থুতু নিক্ষেপ করি এই অন্ধ সমাজে গর্ব করে কথা বলা এসব সামাজিক প্রাণীদের মুখে! এ নোংরা সমাজ নীতিতে বাস না করলে যদি তাকে পশু বলা হয় তবে আমি পশুই হবো”। ভাবতে ভাবতে রুবির চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে, এবার আর অসহায় লাগছেনা তার নিজের কাছে নিজেকে। ভেতর থেকে কেউ বলছে “শিরদাঁড়া সোজা করে বাঁচো,অপসংস্কৃতিকে গুড়িয়ে দাও” কবি নজরুলের একটা লাইন খুব মনে পরছে তার, হয়তো নজরুল তার মতো মানুষ গুলো কে জাগাতেই লিখেছিলেন “আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার ছিঁড়িয়া গিয়াছে সব বাঁধ!”