মেঘজুড়ে জল ছিল

মেঘজুড়ে জল ছিল

১। খুব আয়েশ করে রঙ চা খাচ্ছিলাম। ঠিক খাচ্ছিলাম না, গলায় ঢেলে দিচ্ছি। গতকাল বান্ধবীদের সাথে বৃষ্টিতে ভিজে একদম ঠান্ডা কাশি লেগে ধুমধাম অবস্থা। তাই গলাটাকে একটু গরম করছি আরকি। হঠাৎ মিশু এসে হাজির, দিদি এই দেখ, কত সুন্দর কদমফুল!

– কোথায় পেলি ভাইয়া?

– উজ্জ্বল দাদা এনেছে। এই দু’টার মধ্যে একটা আমার আর একটা তোমার। নেবে তুমি, নাকি আবার ফেলে দিবে?

– ফেলে দিব।

– তোমাকে দিবই না তাহলে। দাদা কষ্ট করে এনে দেয় আর তুমি ফেলে দাও কেন? পচা মেয়ে।

দৌড়ে চলে গেল মিশু। বাবারে, খালি দাদা আর দাদা। বাবা ঐ ফর্সা ছেলেটাকে এনে তো সবার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। কোত্থেকে ধরে আনল ভগবানই জানে। সবার তো মাথা খেয়েছেই, এখন আমাকে পটাবার ফন্দিতে আছে। সাহস কত, ভেবেছে আমি দেখতে শ্যামলা বলে তার চাঁদমুখ দেখে একেবারে গলে গলে পড়ব। ইস্, বয়েই গেছে আমার, তার দিকে চেয়ে থাকতে হবে। গত দু’দিন রাস্তায় দাড়িয়ে ওদের সামনে যা ঝাড়ি দিলাম, এরপরও আমার সামনে আসে কিভাবে দেখি। আমাকে চেনে ঐ ছেমড়া! ভদ্রতা দেখানোর মেয়ে আমি না, কাকে কিভাবে পচাতে হয় তাতে আমি সর্বাধিক পিএইচডি প্রাপ্ত। চিন্তা করেছি, এরপর যদি সামনে আসেই, একেবারে গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসিয়ে দেব।

ফোনের রিংটোনে ভাবনায় ছেদ পড়ল। এটা আবার কে?

নাম্বার তো চিনি না, দেখি রিসিভ করে।

– হ্যালো কে বলছেন?

– আমি উজ্জ্বল। আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সাহস পাইনি। আপনার অপমানের ভয়ে না, আপনাকে বিরক্ত করার ভয়ে। আমাকে দেখলে তো খুব বিরক্ত হন, তাই। এমনিই আপনি অসুস্থ, এসময় আপনাকে রাগাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

– তা এই যে ফোন দিয়ে তো ঠিকই। বিরক্ত করলেন।

– আমি দুঃখিত মিতু।

লাইন কেটে গেল। কান্ড কারখানা দেখলে হাসি কান্না কিছুই আসে না। কি যে করে এরা!

২। যাত্রী ছাউনির নিচে আমরা ৪ জন দাড়িয়ে আছি। গল্পটল্প চলছে তবে টেনশনও কম হচ্ছে না। অসময়ে বৃষ্টিটা এসে খুব সমস্যা করে দিল। বাস ধরব কখন, আর ভার্সিটি যাব কখন? ক্লাস মিস্ গেলে মেজাজ গরম হয়ে যায়।

– এক্সকিউজ মি মিতু; আপনি ইচ্ছে করলে আপনার বান্ধবীদের নিয়ে ভার্সিটি যেতে পারেন। আমার গাড়ি দিয়ে।

কথাটা কানে যেতেই পাশে তাকিয়ে দেখি ফর্সাওয়ালা হাজির। গরম মেজাজ আরো গরম হবার আভাস পাচ্ছি ঠিকঠাক মত।

– ইয়ে মানে, ঐ যে আমার গাড়ি। আমি যাব না, আপনারা মিলে উঠুন। ড্রাইভার সুন্দরমত জায়গামত পৌঁছে দিবে।

রাগটাকে আর সামাল দিতে না পেরে বলেই ফেললাম, এই ছেলে এই, আপনার সমস্যাটা কি শুনি? এরকম ডিস্টার্ব শুরু করছেন কেন? অত্যধিক বেয়াদব একটা!

পাশ থেকে ওরা আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। আমি কি আর শান্ত হই। আগুন পুরাই ফুল ভোল্টেজে জ্বলতেছে। হাতটা নিশপিশ করতেছে কষে একটা চড় মারার জন্য থাক, এতে নিজেরও আত্মসম্মানের একটা ব্যাপার আছে।

ডানদিকে ঘুরে দাড়িয়ে আছি। ঐ ছেমড়া আছে না গেছে জানিনা। আমার অত দায় পড়ে নাই জানার, জাহান্নামে যাক!

৩। চুপচাপ পরিবেশটা আমার খুব ভাল লাগে, সেই ছোট থেকেই। এই সুন্দর অভ্যাসটা মায়ের থেকে পাওয়া। বাবা একটু উৎসবমুখর পরিবেশ পছন্দ করে, খেয়াল করে দেখেছি। এখন যেমন রুমটা একদম নীরব, কেবল দুজন মানুষের নিঃশ্বাসের মৃদু আওয়াজ। মা মাথায় আদর করে দিচ্ছে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে আমিই বললাম, আচ্ছা মা, কিডনি ট্রান্সফার হইছে প্রায় ৩ বছর তো হবেই তাই না? তাইলে এখন পর্যন্ত ওষুধ খেতে হবে কেন? ওষুধ খেতে একদম ভাল¬াগে না।

– কিডনীর ব্যাপার তো, বড়ই সাবধানতার বিষয়। হেলাফেলা করা ঠিক না মা। এই ওষুধগুলো সবসময় চালিয়ে গেলে কোন রকম আর সমস্যা হবে না পরে। সেদিনও তোর ডাক্তার কাকা বলে গেল, শুনলি না।

– তার মানে সারা জীবন খেয়েই যেতে হবে?

– হুম, খেলে বিপদমুক্ত থাকবি। ওষুধ খাওয়ায় তোর এত কষ্ট কিসের, মুখে দিবি গিলবি। এত অলস হইতেছিস দিনদিন। ভগবানের দয়া ছিল বুঝলি, এত অল্প বয়সে কিডনীর রোগ বাধাইয়া তবুও তেমন বিপদ হয় নাই বলে রক্ষা।

– মা তুমি যাও, ঘুমাব এখন।

আরেকটু আদর করে মা চলে গেল। বামপাশ ফিরে চোখটা বন্ধ করছি আর অমনি ফোনের রিং টোন। এখন কে ফোন দিবে?

– হ্যালো কে বলছেন?

– আমি উজ্জ্বল। অনেক সাহস করে আপনাকে ফোন দিছি। আর বোধহয় নাও ফোন দিতে পারি। কাল রাতে আমি ইংল্যান্ডে চলে যাচ্ছি। আমার কিডনীতে কি যেন সমস্যা ধরা পড়ছে। এমনিতেই একটা কিডনীই আছে, এখন এটাও যদি অকেজো হয়ে পড়ে তবে তো মরেই যাব। আর আমি মরলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন আপনি জানি। আপনি খুশি হলে বোধহয় আপনাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগে তাই না? জানিনা ওখানে গিয়ে আবার সুস্থ দেহে ফিরতে পারব কিনা? ইস্ যদি একবার আপনার হাসিমাখা মুখটা দেখতে পারতাম। যাই হোক বাদ দেই, আপনি ভীষণ রেগে গেছেন বুঝতে পারছি। আর মিতু, সর্বশেষ আরেকটা কথা বলতে চাই, বলি একটু?

– সর্বশেষ না সর্বশুরু ভগবানই জানে। কি বলবেন বলুন।

– আমার না খুব ইচ্ছে ছিল, আপনার ঘনচুলের সিঁথিতে আমি নিজ হাতে টকটকে রক্তলাল সিঁদুর এঁকে দিব। তারপর অনেকক্ষণ চেয়ে থাকব, দেখব আপনাকে কতটা সুন্দর লাগে। সে ভাগ্য হয়তো আমার জন্য নেই। থাক্, ভালই হয়েছে, আপনি তো তাহলে প্রচন্ড বিরক্ত হতেন। আমার ইচ্ছার জন্য আপনি কেন শুধু শুধু বিরক্ত হবেন। মিতু, ভাল থাকবেন, কেমন। লাইনটা কেটে গেল।

কি বলল এসব? যদি খালি সামনে থাকত এখন, চড় মেরে মেরে মাড়ির সবক’টা দাঁত নড়িয়ে দিতাম। ছেলে তো আচ্ছা ফাজিল, কই থেকে কই নিয়ে গেল কথা। যত্তোসব বদমাইশ!

৪। নাস্তার টেবিলে এসে দেখি মা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার মানে মার মন খারাপ। মার মন তো সহজে খারাপ হয় না। পাশে বসে একটু আস্তে বললাম, ওমা কি হইছে তোমার?

একটা ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে মা বলল, ছেলেটা আজ ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছে। সকালে ফোন করে ইচ্ছেমত কাঁদল জানিস। বারবার বলছিল, মা আমার জন্য একটু প্রার্থনা কইরেন, একটু প্রার্থনা। আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে মা। তুই যদি শুনতি ছেলেটার কথা। একেকবার মা বলে ডাকছিল আর আমার যে তখন কেমন করতেছিল তা তোরে বুঝাতে পারব না মিতু। কত্তো লক্ষ্মী একটা ছেলে। ওই তো তোরে একটা কিডনী দিছে। এতোদিন তোরে বলি নাই, ও না করছিল তাই। তুই নাকি খুব বিরক্ত হবি। কি ভাল চেলে দেখছিস, আর এইরকম একটা মানুষকে ভগবান কেন বিপদ দিল? একটাই কিডনী আছে ওর, এখন এটারও যদি কিছু হয়ে যায়।

– মা, তুমি কি উজ্জ্বলের কথা বলতেছ?

– তা’নাহলে কার কথা?

***

আমি গুটি গুটি পায়ে এখন আমার রুমের মাঝখানে।

হঠাৎ খেয়াল হল, বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

মেঘ করেছিল তাই বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু আমি এখন কি করব, দু’চোখে তো কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। জমাট বাঁধা পানিগুলো টপটপ পড়ার জন্য প্রস্তুত। হ্যাঁ, আমি এখন কাঁদব। আমার প্রচন্ড কাঁদতে ইচ্ছে করছে। যখন ভীষণ কান্না আসে, তখন ইচ্ছেমত কাঁদতে হয়। অন্ততঃ তার জন্য হলেও কাঁদব আমি, যার হাত দিয়ে আমার সিঁথিতে সিঁদুর আঁকিয়ে ছাড়বই। সে মরুক আর বাঁচুক, যাই হোক না কেন।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত