একটি ভুল খবর

একটি ভুল খবর

দুই বোনকে পৈশাচিক কায়দায় ধর্ষণ, বড় বোন নিহত, ছোট বোন বাকরুদ্ধ।’ পত্রিকার শিরোনাম দেখে আঁতকে উঠলেন ওসি সাহেব। তার এলাকায় এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, অথচ তিনি কিছুই জানেন না! এসপি সাহেবের কাছে ফোনে পরামর্শ চাইলেন। তার নির্দেশনা মোতাবেক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন থানার অফিসার ইন চার্জ ইন্সপেক্টর মোবারক হোসেন। হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে আসা হয়েছে অনেক আগে। স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। ওসি মোবারক সাহেব লাশের কাছে যাবার চেষ্টা করছেন।

এদিকে ‘সেকেন্ড অফিসার’ এসআই আবিদ এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে ঘটনা জানার চেষ্টা করলেন। প্রতিবেশিদের কেউই কোন চিৎকার-চেঁচামেচী শুনেনি। কেউ কেউ বলাবলি করছে- চোর এসেছিল। বাঁধা দেয়ায় আঘাত করে পালিয়েছে। নিহতের বাবা-মা বলছে ভিন্ন কথা। তাদের ধারণা অসাবধানতা বশত হোঁচট খেয়ে মাথায় আঘাত পায় বড় মেয়ে। এতেই মৃত্যু হয়েছে। আর ছোট মেয়ে এখনো হতভম্ব, নির্বাক। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে লাশের দিকে। কিছুক্ষণ পর পর ঢুকরে কেঁদে উঠছে। ওসি মোবারক সাহেব এসআই আবিদকে সাথে নিয়ে একটু দূরে সরে এলেন।

“কি বুঝছ, আবিদ?”
“কিছুই স্পষ্ট না স্যার। নানারকম কথা শোনা যাচ্ছে।”
“রেপের ব্যাপারটা গুজব মনে হচ্ছে আমার।”
“আমারও তাই ধারণা। চোরের ব্যাপারটাই সঠিক মনে হচ্ছে। কিন্তু পরিবার সেটা মানতে চাইছে না।”
“হয়ত আইনী ঝামেলা এড়াতে চাইছে। চল, আরেকবার জেরা করা যাক।” নিহতের বাবার নাম নূর মোহাম্মদ। এলাকায় মুদির দোকান আছে তার। স্ত্রী, দু’ মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তার সংসার।

“সে যখন আঘাত পায়, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন?”
“আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম। এসে দেখি এই অবস্থা।”
“ঘরে আর কেউ ছিল না?”
“ছোট মেয়ে ছিল।”
“সে কি করছিল তখন?”
“সে শকড হয়ে পাশে বসেছিল।”
“কিছু বলেনি?”
“এখন পর্যন্ত কোন কথা বলেনি।”
“তাহলে কিভাবে বুঝলেন- আপনার মেয়ে হোঁচট খেয়ে আঘাত পেয়েছে?” নূর মোহাম্মদ আমতা আমতা করে বললেন- “না মানে, মানে, ধারণা করলাম।”
“আপনার মেয়ে মারা গেছেন। আর আপনি আছেন ধারণা নিয়ে!” এসআই আবিদ বললেন, “বয়স কত আপনার মেয়ের?”

“ছাব্বিশ।”
“বিয়ে হয়নি নাকি দেন নাই?”
“দিয়েছি বছর দেড়েক আগে।”
“আগে বলেন নাই কেন? স্বামী কোথায়? ছাড়াছাড়ি হল কেন?”
“ছাড়াছাড়ি হয় নাই স্যার। জামাই বিদেশ থাকে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নেই। তাই মেয়ে আমাদের সাথেই থাকে।”
“সে দেশে আসলে কোথায় থাকে?
“আমাদের সাথেই থাকে।”
“তাদের দু’জনের মধ্যে কোন সমস্যা ছিল?
“আমাদের চোখে পড়েনি। ভালই ছিল সব।”
“জামাইকে খবর দিয়েছেন?”
“হ্যা। চলে আসবে কালকের মধ্যে।” মোবারক হোসেন বললেন, “আমরা লাশ দেখব।”

“স্যার, কেউ মারেনি আমার মেয়েকে। এটা একটা এক্সিডেন্ট।”
“ভয়ের কিছু নেই নূর মোহাম্মদ সাহেব। আমরা জাস্ট দেখে রিপোর্ট লিখে দেব। আপনাকে কোন ঝামেলায় পড়তে হবে না।”
“ঠিক আছে স্যার, আসুন।” লাশের মাথা বাম দিকে কাত করে চমকে গেলেন ওসি মোবারক। গলার ডান দিকে নখের আঁচড় রয়েছে।

“আবিদ, লাশের পোস্ট মর্টেম করতে হবে।” নূর মোহাম্মদ বললেন, “স্যার, আপনি তো বললেন কোন ঝামেলা হবে না।”
“স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি। ঝামেলা করতেই হবে।”
“না। আমার মেয়ের লাশ কাঁটাছেঁড়া করতে দেব না।”
“এখন আর আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কিছু যায় আসে না।”
“আমার মেয়ে, আমার ইচ্ছা।”
“আপনারাই তাকে খুন করেননি তো? না হয় বাঁধা দিচ্ছেন কেন?”

এ কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন নূর মোহাম্মদ। ইতোমধ্যে লাশ বহনের জন্য গাড়ি ও লোকজন চলে এসেছে। সবাই পুলিশকে গালাগালি করছে- “শালা ঘুষখোরের দল। টাকা খাওয়ার ফন্দী। লাশকেও ছাড়ল না। গজব পড়বে এদের উপর।” উষ্কানি চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে। লোকজন ক্ষেপে গেছে। রাস্তা অবরোধ করে আগুন জ্বালানো হয়েছে। থানার সামনে বিক্ষোভ চলছে। ওসির অপসারণ চেয়ে থানার সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করছে সাধারণ জনগণ। স্লোগানে মুখর রাজপথ- “লাশ নিয়ে ব্যবসা, চলবে না, চলবে না।”

এসপি বাবুল ওসি মোবারকের সাথে যোগাযোগ করে বিস্তারিত জেনে নিলেন। এরপর নিজে থানায় উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের বললেন, “আমরা খুনের আলামত পেয়েছি। এখানে আন্দোলনের সুযোগ নেই। পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।” এর মধ্যেই সারাদেশের অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো যাচ্ছেতাই লিখা শুরু করে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সমালোচনার শিকার হচ্ছে পুলিশ। বিষয়টা আইজি সাহেবের নজরে এলে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।কিন্তু মোবারক সাহেব অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। তিনি কিছুতেই হাল ছাড়বেন না। তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ে বললেন, “আমি প্রমাণ করেই ছাড়ব।”

এদিকে পুলিশের সমালোচনা চলছেই। এমনকী সুশীল সমাজ পর্যন্ত বলছে- ওসি গোয়ার্তুমি করছেন। তার বিরুদ্ধে মামলার পরামর্শও দিচ্ছেন অনেকে। সপ্তাহখানেক বাদে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে- মাথায় আঘাতে নয়, মহিলা মারা গেছেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে! মোবারক সাহেব এবার একা নন। বেশ কয়েকজন মহিলা পুলিশ সাথে নিয়ে গেলেন নিহতের বাড়ি। উদ্দেশ্য তার ছোট বোনকে গ্রেফতার করা। পুলিশের গাড়ি দেখেই নূর মোহাম্মদ সাহেব বেরিয়ে আসেন।

“স্যার বাড়িতে অনুষ্টান। দয়া করে ঝামেলা করবেন না।”
“মেয়ে মরল এক সপ্তাহ হল। এর মধ্যেই অনুষ্ঠান! কিসের অনুষ্ঠান শুনি?”
“ছোট মেয়ের বিয়ে।”
“সুস্থ হয়ে গেছে? ভালই হল। তাকেই দরকার আমাদের।”
“বিয়ের পাত্রীকেও ছাড়বেন না? লাশ নিয়েও তো কম করলেন না।”
“কিছু করার নেই। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে খুনের প্রমাণ মিলেছে।”
“এসব আপনাদের বানানো রিপোর্ট। আমি মানি না।”

“তা আপনাদের ছোট মেয়ের হবু জামাই কি জানেন, এ বাড়িতে একটা খুন হয়েছে?” “আমাদের মেয়ে খুন হয়নি। আর বড় মেয়ের জামাইর সাথেই ছোট মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি।” “কিহ!” “ঘরের ছেলে ঘরেই থাকবে। তাছাড়া সে নিজেই ছোট মেয়েকে বিয়ের ইচ্ছা পোষণ করেছে।” “তাই নাকি! তা কোথায় আপনার সেই গুণধর জামাই?” উত্তরের অপেক্ষা না করেই ঘরে ঢুকে গেলেন ওসি মোবারক সাহেব। অপরিচিত এক লোককে ইংগিত করে বললেন, “ইনিই বুঝি আপনার সেই জামাই?”

“জ্বী আমিই উনাদের জামাই।”
“আপনার স্ত্রী খুন হয়েছে। আর আপনি শ্যালিকাকে বিয়ে করতে ব্যস্ত।”
“খুন কেন হবে। দূর্ঘটনা ছিল ওটা। শ্যালিকাকে বিয়ে করা বেআইনী নাকি?
“মোটেই না। তবে একবার থানায় যাবার প্রয়োজন বোধ করলেন না?”
“আমার ছুটি কম তাই তাড়াতাড়ি সেরে নিচ্ছি।”
“কবে এলেন বাড়িতে?”
“ও মারা যাবার দুই দিন পর।” কথাটা বলেই লোকটা চোখ সরিয়ে নিল।
“কোন দেশে থাকেন আপনি?”
“ওমান।”

“আপনার পাসপোর্ট দেখান তো।”
“পাসপোর্ট দেখে কি করবেন?”
“দেখাতে বলছি, দেখান।”
“আমাদের রেমিটেন্সে দেশ চলে। অথচ নিজের দেশের পুলিশ হ্যারাজ করছে।”
“হ্যারাজ করছি না। আমরা শুধু তদন্ত করছি।”
“আপনার নামে মামলা করতে পারি কিন্তু।”
“চুপ শালা।” বলেই কষে একটা চড় মারলেন মোবারক সাহেব।

নূর মোহাম্মদ সাহেব অবাক। পাসপোর্টে দেখা যাচ্ছে- তাদের জামাই এসেছে মেয়ে মারা যাবার একদিন আগে। তিনি বুঝতে পারছেন না কেন সে মিথ্যা বলল। পুলিশকে আর বাঁধা দেবার সাহস হল না তার। বড় মেয়ের জামাই ও ছোট মেয়েকে পুলিশ নিয়ে গেল। ঘটনার একদিন আগে দেশে আসেন নূর মোহাম্মদের নিহত বড় মেয়ের স্বামী রফিক উল্লাহ। আত্মীয়ের বাড়িতে অনুষ্ঠানের কথা আগেই জানত সে। গোপনে শ্যালিকার সাথে দেখা করে পুরো পরিকল্পনা জানিয়ে দেয়।

সেই রাতে হঠাৎ বাড়িতে আসে রফিক। সন্ধ্যাবেলা আয়নার সামনে বসে সাজগোজ করছিলেন তার স্ত্রী শাহানা। আয়নায় স্বামীকে ঢুকতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সে। দাঁড়িয়ে পেছন ফিরতেই হাতে থাকা লোহার দন্ড দিয়ে তাকে আঘাত করে রফিক। বিছানায় পড়ে কাতরাতে থাকে শাহানা। তখনই তার ছ’ বছরের ছোট বোন পাখি এসে বুকের উপর বসে পড়ে। সে গলা চেপে ধরতে চাইলে রফিক বাঁধা দেয়। পাখির হাত ধরে টান দেয় সে। তখনই শাহানার গলায় পাখির নখের আঁচড় বসে যায়। শেষমেশ মুখে বালিশ চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করে পাখি। রফিক পা চেপে ধরে রাখে তখন।

ধুমধাম করে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল রফিক-শাহানার। কিন্তু কয়েকমাস পরই শ্যালিকার সাথে পরকিয়ায় জড়িয়ে পড়ে রফিক। অল্প বয়সী পাখি আবেগের বশবর্তী হয়ে সম্পর্কটাকে শুধু মন দেয়া-নেয়াতে সীমাবদ্ধ রাখেনি। যার চূড়ান্ত ফল এই নৃশংস হত্যাকান্ড।

কিছু কিছু অনলাইন নিউজ, স্থানীয় পত্রিকা ও ব্যক্তিগত প্রোফাইল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে- কিভাবে পুলিশের ‘গোয়ার্তুমি’তে একটি ভয়ানক অপরাধ প্রকাশ পায়। যাকে দেখতে নারি, তার প্রশংসা এদেশের মানুষ নিতে পারে না। তাই যেভাবে সমালোচনা হয়েছিল, সেভাবে প্রশংসা পাননি ওসি মোবারক হোসেন। তবে পুরষ্কার স্বরূপ পদোন্নতি পেয়েছেন তিনি। ‘বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম)’ পদকের জন্য তার নাম সুপারিশ করা হয়েছে। আসামীরা পুলিশ হেফাজতে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। বিজ্ঞ আদালত তাদের জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। মামলা চলমান রয়েছে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত