“সে বার বৈশাখী মেলায় অবনীকে নিয়ে গেছিলাম,
মেলায় যাবে বলে খুব করে বায়না ধরেছিলো; নাছোড়
বান্দা “এদিকে ঘরে অসুস্থ কাকি মা পড়ে আছেন। এদিক
ওদিক কিছু হলেই তাকে দেখার কেউ থাকবেনা। অবনীর
রাগ খুব বেশি, ইদানিং অনেক বেড়ে গেছে সেটা আমি
কয়েকদিন হলো লক্ষ্য করছি।
.
একটু কথার এদিক ওদিক হলে রেগে গিয়ে নিজের চুল
ছিঁড়ে। মেয়ে হিসেবে অবনী ওতোটা খারাপ নয়, নিজের
রাগ সব সময় নিজের শরীরের উপরে প্রয়োগ করে।
.
কাকি মা’র একটা মাত্র ছেলে ছিলো শুভ্র সেই কবে
শহরে গেলো আজ অবধি কোনো হদিস মিললো না। প্রথম
প্রথম কাকি মা গভীর রাতে কাঁদতো সবাই ঘুমিয়ে পড়ার
পর, এখন আর কাঁদেন না। হয়তো মেনেই নিয়েছে শুভ্র আর
ফিরবেনা।
.
মাঝে একটা খবর এসেছিলো শুভ্র বেঁচে আছে; কী একটা
সন্ত্রাস দলের সাথে কাজ করে। শুনেছিলাম তাকে পুলিশ
খুঁজে, পেলে হয়তো একটা সত্তর টাকা দামের বুলেট তার
শরীরে ঢুকিয়ে দিবে। অনিশ্চিত জীবন শুভ্রর, বাড়ির
ফেরার কোনো সম্ভাবনাও নেই।
.
শুনেছি গুন্ডা দলে একবার নাম লেখালে নাকি আর ফিরে
আসা যায়না। এদলের মানুষদের একটাই নাকি ভবিষৎ
“জেল অথবা বুলেটের আঘাতে মৃত্যু… কাকি মা’র মায়ের
মন তবুও প্রথম প্রথম ছেলের অপেক্ষা করতেন। বয়স হয়ছে
এই বয়সে শুভ্র’র কাছের থাকার খুব দরকার ছিলো।
.
বিয়ের আগে অবনী সবটা জানতো, কাকি মা’র একটু
মেজাজ গরম হঠাৎ করে যে কারো উপরে রাগ ঝেড়ে দেন।
প্রায় রাতে অবনী ফুঁফিয়ে কাঁদে, কারণটা আমি জানতে
চাইনা, “আমি জানি অবনীর কাঁদার দু’টো কারণ এক আমি
আর দুই কাকিমা। অবনী কাউকে কিছু বলেনা, অভিমান
হলে কেঁদে হালকা হয়ে যায়।
.
“এই দু’বছরে অবনীকে আমার অনেকটা চেনা হয়ে গেছে।
ওর কাঁদার সময় একটু আদর মেখে কথা বললে তার আর
অভিমান বেড়ে যায়, তখন কান্না আর থামেনা। সেই কবে
একটা বইয়ে পড়েছিলাম মেয়েদের কাঁদার সময় কাঁদতে
দেওয়া উচিৎ, এরা নাকি কাঁদতে না পারলে নিজের
অভিমান জমিয়ে রেখে নিজেদের কষ্ট দেয়।
.
লেখক সাহেবের কথা আমি খুব ভালো করে মনে
রেখেছি, সে থেকে আমি আর কাঁদার সময় অবনীকে আদর
করতে যাইনা; কলেজ পড়ার সময় অবনীর সাথে আমার
প্রেম, বন্ধুরা খুব বাজে ভাবে অবনীর স্তনের প্রশংসা
করতো, কিন্তু অবনীর চোখ দু’টো আমাকে খুব টানতো।
.
একবার সাহস করে তার চোখের প্রশংসা করে গেছিলাম।
সেকি মহা কান্ড, প্রশংসা করলে কোনো মেয়ে মানুষ
চটে যায় “আমি কোনো বইতে পড়িনি। অবনী সেদিন
কলেজ ভর্তি সবার সামনে আমার উপর চটেছিলো। দু’রাত
আমার ঘুম হয়নি, ওজন মেপেছিলা “সেকি দু’রাতের ঘুমের
কারণ হিসেবে আমার এক কেজি কমেছিলো।
.
খুব রাগ হয়েছিলো অবনীর উপর “বইতে পড়েছিলাম রাগ
থেকে নাকি ভালোবাসা হয়, আমার আর অবনী সেটা এক
জলন্ত প্রমাণ ছিলো। সে এক মহা কাহিনী, এদিকে
কাকিমার চেঁচামিচি শুরু হলো! এগিয়ে গিয়ে দেখি
অবনীর শখের বিড়ালটা কাকিমা’র খাটে প্রেসাব করে
দিয়েছে। সেকি কান্ড….
.
অনেক দিন পর কাকিমা’র চেঁচামিচি দেখে অবনীকে
হাসতে দেখলাম। অবনী হাসলে মনে হয় আমার চারদিক
কেমন আলোকিত হয়ে যায়, অবনীকে সচারাচার হাসতে
দেখা যায়না। অনেক খুশিতেও অবনী হাসেনা। আজ অবনী
হেসেছে, কিন্তু এই হাসি প্রতিশোধের হাসি। অবনীর
বিড়াল কাকিমা’র উপর প্রতিশোধ নিয়েছে।
.
এই দেখছি অবনী হাসছে “হঠাৎ কেমন করে বলে উঠলো এই
শুনো; “আমার অস্বস্তি লাগছে। বুকে কেমন যেনো একটা
ব্যথা হচ্ছে! ঐদিকে কাকি মা খটকটিয়ে বলছে, ব্যথা
করবেই ত আরেকটু হাসো তোর তো মেলা দেমাক, আমি
চুপ মেরে আছি আর অবনীর যন্ত্রণায় চটপট করা দেখছি
নির্বোধের মতো।
.
ঘরের পাশ দিয়ে অভি’দা ভেড়া নিয়ে যাচ্ছিলো,
অভি’দাকে ডেকে বললাম সামু কাকারে ডেকে আনতে
তার দাওয়াইতে যদি অবনীর ব্যথাটা একটু সারে।
সামু’কাকার দাওয়াই দিয়ে গেছিলো তিন দিন “এদিকে
অবনীর ব্যথা কমার নাম নেই।
.
গঞ্জের হাঁটে বড় একটা ইলিশ দেখে শ’টাকা দিয়ে
কিনেছিলাম। অবনীর মুখের উপর বলে দিয়েছে “আমার
ব্যথার কমার নাম নেই আর তিনি আছেন বড় মাছ নিয়ে।
কাকি মা’র ইলিশ খুব পছন্দ তিনি কোনো মতে ঝাল বেশি
নুন কম দিয়ে রেঁধেছেন। বয়স হয়েছে ঠিক মতো দেখতে
পাননা, যা রেঁধেছেন গলা দিয়ে নামিয়ে নিলাম।
.
দিন যাচ্ছে এদিকে অবনীর বুকের ব্যথাও বাড়ছে,
সামুকাকার দাওয়াই কোনো কাজ হচ্ছিলো না। ঐদিকে
শশুর মশাই বড় গলাই আমাকে শাসাচ্ছেন। “আমার একটা
মেয়ে যদি কিছু হয় তোমায় আমি ছাড়বোনা।
.
মেলা থেকে অবনীর জন্য তার পছন্দের একজোড়া কাঁচের
চুড়ি কিনেছিলাম, তাকে দেখাইনি বাড়ি এসে চমকে
দেবার জন্য। আমি আবার মন ভুলো, ভুলে গেছিলাম
অবনীকে দিতে, এই অসুখের সময় অবনীকে চুড়ি দিয়ে খুশি
করা যাবেনা। গঞ্জের ভালো কবিরাজ দেখাতে হবে।
এদিকে হাতে টাকা কড়ির অভাব।
.
অভি’দার গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, কিসব যেনো
বলছে… “গরীবেদের এই জগতে কেউ নেই ইশ্বরও তাদের
নেই, জোর যার মুল্লক তার। “কি হলো গো অভিদা? কারে
বিচার দিচ্ছো? আর বলিস না! আমার অবলা ভেড়া
চেয়ারম্যানের শাক ক্ষেতে ঢুকে কয়টা শাক খেয়েছে,
এই জন্যি আমার নামে শালিস ডেকেছে।
.
ভেড়ার জন্য অভিদার অন্য রকম একটা মায়া কাজ করে,
সারদিন ভেড়া নিয়েই থাকে অভিদা! হয়তো একটু
অমনোযোগী হতেই ভেড়া বেচারা ক্ষমতাশীন
চেয়ারম্যানের ক্ষেতে ঢুকে পড়েছে। এতেই আবার
শালিস ডাকার কি আছে আমি বুঝিনা।
.
গরীবদের ছোট ভুল গুলোও বড়কর্তারা বড় করে দেখেন।
অভিদাকে একটু শান্তনা দিয়ে বললাম; “ও অভিদা তুমি
চিন্তা কইরোনা! ভেড়াতো আর জানতো না সে কার
ক্ষেতে ঢুকেছে, জানলে ত আর ঢুকতোনা। শালিসন হোক
দেখিনা কী বিচার হয়।
.
অভিদার সাথে কথা বলছি, হঠাৎ কাকিমার চিৎকার…
“দেবা ও দেবা… ওহ আমার নামাই তো বলা হয়নি, “আমি
দেবা” নামটা কাকিমা রেখেছিলো। কলেজের বন্ধুরা
আদর “দেবু” ডাকতো। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম কাকিমা
কাঁদছে, কিছুই বুঝতে পারলাম না! কপাটের আড়াল থেকে
অবনী বলে উঠলো, কাকিমার পোড়া কপাল গো, শুভ্রটা
বুঝি আর বেঁচে নেই। পুলিশ নাকি মেরে ফেলেছে।
.
এখুনি পিয়ন এসে একটা চিঠি দিয়ে গেলো। কাকিমার
আর কেউ বুঝি রইলো না গো। লাশটা বলেছে হাজার
টাকা পাঠালে তারপর দিবে, এতো টাকা কই পাবো
আমরা। “আমি চুপ মেরে আছি, চাকরীটাও নেই। থাকলে
হয়তো কিছু টাকা ধারদেনা করেও হলে শুভ্র’র মুখ খানা
কাকি মারে দেখাতাম।
.
গত এক সপ্তাহ ইশ্বরও আমাদের দলে নেই; অভিদার
ভেড়ার জন্য কাঁদছে অভিদা, আর কাকিমা তার ছেলের
জন্য। “কি অদ্ভুত! “দেবারে, আমার বুঝি আর কেউ
রইলোনারে, মুখে আগুন দেবার মতো একটা সন্তানও যে
আমার নেই। “আহ্ কাকিমা, আমরা কি তোমার সন্তান নই?
আমি তোমার মুখে আগুন দিবো।
.
শালিসে অভিদার ৬টাকা জরিমানা করেছে; এই ছ’টাকা
অভিদাকে কর্জা করতে হবে। বেচারার ভেড়াটাকে
এখনো বেঁধে রেখে ক্ষমতাশীনরা, টাকা পেলেই ছেড়ে
দিবে। “অবনীর ব্যথাটা আজ আবার খুব বেড়েছে। ইশ্বরকে
কিচ্ছুক্ষণ কটু কথা বলেছি….
.
একটা চাকুরী হবার কথা ছিলো, তারা ডেকেছে
“দু’দিনের জন্য মফস্বল গিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি অবনী…..
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক