আমার শ্বাশুড়ি খুব করে চাইছেন তিনি আমার আবার একটা বিয়ে দিবেন। আমার অজান্তে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছেন। প্রায়ই বিবাহ বিডি ডট কম, সৌলমেট বিভিন্ন ডেটিং সাইডে ঘোরাফেরা করেন পছন্দসই পাত্র পাবার আশায়।আমি হ্যা বা না কিছুই বলিই না। একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত আছে থাকুক। রোজ বিকেলে হাঁটতে বের হন। পাড়ায় তার বয়সী একগাদা বান্ধবী জুটিয়েছেন। তাদের সাথেই গল্প করা হয়। তার সুখ এত ভালো পুত্রবধূ পেয়েছেন দুঃখ এই তার পুত্র জীবিত নেই।
-বুঝলে শামীমা, তৃণার মত মেয়ে হয় না। ভোরে উঠে রান্না শেষ করে অফিসে যায়৷ আমার যাতে কষ্ট না হয় বাড়ির সব কাজ গুছিয়ে রেখে যায়। নাফিস চলে যাবার পর এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করে না। আমি শুধু এই ভাবি তৃণা গোটা জীবন কিভাবে একা পাড় করবে!
-নুহাশ আছে। শামীমা খালার কথায় মা সন্তুষ্ট হতে পারে না।
-তোমার যা কথা এইটুকু ছেলে কবে বড় হবে কবে মায়ের দেখভাল করবে! আর নুহাশেরও তো বাবার ভালোবাসা দরকার। দেখো, যদি কোনো ভালো ছেলের সন্ধান পাও। বাচ্চা রেখে বউ মারা গেছে বা ডির্ভোসী। তৃণাকে একটা শক্ত হাতে গচ্ছিত না রেখে গেলে মরেও শান্তি পাব না।
শ্বাশুড়ি মা আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটা ভাবছেন। অবাক হই। অথচ নাফিসের সাথে তিনি আমার বিয়ে একদমই মেনে নিতে পারেন নাই। এক আমাদের বাড়ি থেকে কোনো দানসামগ্রী দেবার সামর্থ্য ছিল না দ্বিতীয়ত তার লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ ছেলের সামনে ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি আমাকে তার নিতান্তই খাটো মনে হত। নাফিসদের বনেদি পরিবার, ঢাকায় ফ্ল্যাট। কিশোরগঞ্জের পৈত্রিক বাড়িতে জায়গা জমির অভাব নাই। সেদিক থেকে আমার প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার বাবা ছাপোষা নিম্ন আয়ের মানুষ।বড় ঘরে মেয়ে বিয়ে দেবার শখ-সামর্থ্য কিছুই ছিল না তাই স্বল্প রুজিতেই মেয়েকে শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন।সেই সূত্রে ঢাকায় স্নাতক পড়তে আসা।আমি পড়তাম মাইক্রোবায়োলজি, নাফিস ইকোনোমিক্স।ও আমার দু’ব্যাচ সিনিয়র৷ আড্ডাবাজ ছিল আমার ডির্পাটমেন্টের কয়েকজন ছেলেছোকড়ার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলল।
সেই সূত্রে ওদের সাথে আড্ডা দিতে আসা আসল উদ্দেশ্য আমায় এক নজর দেখা। গ্রামের মেয়ে, কথা বলতাম খুব কম। পাছে নেত্রকোণার টান শুনে বন্ধুরা হাসাহাসি করে। তার উপর জামাকাপড়ে আনস্মার্ট। ওদের স্কার্ট, টপস, লেডিস জিন্সের যুগে আমার সুতি ওড়না ছাড়া আড়ষ্ট লাগে। চোখমুখের গড়নও নিশ্চয়ই এখনকার মত সপ্রতিভ ছিল না কিন্তু লম্বা বেণী ছিল। আর বাবা বলতেন, চোখ দু’খানা ডাগর, দীঘির জলের মত শান্ত মুখ। দূর্দান্ত ছেলেদের বোধহয় সহজ মেয়ে পছন্দ। তাই নাফিস টুক করে ভালোবেসে ফেলে। সিনেমার কায়দায় হাঁটু গেড়ে বসে মিনতি করে, Oh sweet Trina, Make me immortal with a kiss তারপর কয়েকবছর লুকোচুরি প্রেম অতঃপর বিয়ে। শ্বাশুড়ি মা আমার ছবি দেখে পছন্দ করেছিলেন কিন্তু বাস্তবে দেখে রিজেক্টেড। গভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-নাফিস, তোর হাইট কত?
-পাঁচ ফুট নয়।
-এর কত? পাঁচ ফুটের কাছাকাছি। এর বলছ কেন মা? ওর নাম তৃণা।
-ওই তৃণা মিনা একটা হলেই হল। ঢাকা আত্মীয়স্বজন আছে নাকি হোস্টেলেই থাক?
-ও হলে থাকে।
-তুই আগবাড়িয়ে কথা বলছিস কেন! তুমি বোবা?
ঘাড় নেড়ে না করলাম। দামী সোফা, টকটকে লাল কার্পেট, টাইলস বাঁধানো মেঝে।এবাড়ির শোকেসে সাজানো শোপিসের তুলনায়ও নিজেকে কমদামী মনে হচ্ছিল। নাফিসের মা আমাকে দেখবেন তাই সুন্দর করে সেজেছিলাম।নীল তাঁতের শাড়ি, চোখভর্তি কাজল। অথচ ভদ্রমহিলার ঘরে পরবার শাড়ির কাছে আমার সাজপোশাক যাচ্ছেতাই। মাথার চুলে মেহেদী রঙ, ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। একসময় বেশ সুন্দরী ছিলেন এই বয়সেও প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব ধরে রেখেছেন। আমি ওর মায়ের সামনে কেঁচোর মত নুইয়ে গেলাম। তারপর বহু ঝড়-ঝাপটার দিন কেটেছে। একমাত্র ছেলের অদম্য ইচ্ছার কাছে ওর মা পরাজিত হল। বিয়ের পর যতটা না আমি ওর বউ তারচেয়ে খানবাড়ির পুত্রবধূর সম্মান আদায় করতে সিরিয়ালের নায়িকাদের মত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আত্মীয়ারা বলেছেন,
-নাহ! নাফিস বউ পেয়েছে লক্ষীমন্ত। হাতের রান্না সাক্ষাৎ দৌপদ্রী। কিন্তু শ্বাশুড়ি মায়ের মন ভিজত না। তরকারিতে লবণ কম হয়েছে বলে কতদিন খাবার ছেড়ে উঠে গেছে। নাফিস ওর জীবিত অবস্থায় দেখে যেতে পারে নাই আমি আর মা বন্ধুর মত মিলেমিশে আছি। তাকে খুশি করতে বিয়ের প্রথম বছর কনসিভ করলাম। দূরে পোস্টিং হবে তাই বিসিএস পরীক্ষায় বসলাম না। নুহাশের মা হবার পর কিছুটা নমনীয় হলেন কিন্তু কথাবার্তায় বুঝিয়ে দিতেন আমি এই বাড়ির বউ হবার যোগ্য নই।
সেই শ্বাশুড়ি আজকাল আমার জন্মদাত্রী মায়ের চেয়েও যত্ন করেন।অফিসে যাবার সময় টিফিন ক্যারিয়ারে লাঞ্চ গুছিয়ে দেন। একগাদা ভাত দেখে বিরক্ত হই আবার তার ভালোবাসা টুকু লক্ষ্য করে খেয়েও ফেলি। রাতে নুহাশের সাথে আমারও একগ্লাস ননী ভাসা দুধ নাক বন্ধ করে খেয়ে ফেলতে হয়। রোগা হয়ে যাচ্ছি।ফ্রীজে কাঁচা হলুদ আর মসুর ডাল ব্লেন্ড করে রেখে দিয়েছে। রোদে পুঁড়ে আমার গায়ের রঙ তামাটে হয়ে যাচ্ছে তাই৷ এক সন্তানের মা অথচ আমাকে তরুণীদের মত রঙবেরঙের থ্রি-পিস পরে ঘুরে বেড়াতে হয় কেননা মা চান আরেকবার আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসি। আসলে ছেলে মারা যাবার পর আমি তার ঘরের বউ থেকে সন্তান হয়ে উঠেছি। তিনি বুঝেও না বুঝার ভান করে আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছেন। শুক্রবার ভেবেছিলাম টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেখতে নিউমার্কেটে যাব কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত একজন আগন্তুক এসে হাজির। সাথে মিষ্টির প্যাকেট,নুহাশের জন্যে দামী খেলনা। ওকে কোলে বসিয়ে আদর করছিল আমি আড়চোখে লোকটাকে দেখছিলাম বসার ভঙ্গী কথা বলার স্টাইল একদম আমার প্রয়াত স্বামীর মত৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে নাফিস ভেবে ভুল হয়। শ্বাশুড়ি মা নিঃশব্দে বিড়ালের মত পাশে এসে দাঁড়ালেন,
-বউমা, ইনি সৈকত হাসান। অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজার। তিন বছর আগে বিপত্নীক হয়েছেন,বাচ্চাকাচ্চা নেই।
আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। ভদ্রলোক একঘণ্টা সময় কাটিয়ে উঠলেন। তার আমাকে অপছন্দ হয় নি, নুহাশের সাথে ভাব জমে গেছে। ও কোল থেকে নামতেই চাইছে না। উনি বিদায় নেবার পর মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ালাম,
-মা, আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছেন?।
-ছি! এটা তোমারও বাড়ি। নুহাশ ছেলেমানুষ, বড় হলে ওর আলাদা পৃথিবী গড়ে উঠবে। তুমি কাকে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটাবে? একা থাকা বড় কষ্টের মা।সৈকত সাহেবের দিকে একটাবার তাকিয়ে দেখেছ? হুবুহু নাফিকের চেহারা! তোমার মায়া হয় নাই?
-মা,হাতজোড় করে মিনতি করছি এই বাড়ি এই সংসারে ওর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ও নেই, আপনি আছেন, নুহাশ আছে আমার আর কিছু চাই না।ভালো আছি, মা।
মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে ছিটকিনি তুলি। পুরানো অ্যালবাম। আমি আর নাফিস জড়াজড়ি হয়ে বসে আছি। ওর কাঁধে আমার মাথা৷ নাফিসের রোড অ্যাক্সিডেন্টের খবর পাবার পর আমি কাঁদতে পারি নাই সবাই বলেছিল অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছি। মা, সেঁজুতি মাসি আরো কয়েকজন বারংবার চেষ্টা করেছিল আমি খুব যেন কাঁদি। কাঁদতে পারি নাই। রুনা ভাবী নাকফুল, হাতের চুড়ি খুলে নিল অসহায়ের মত বসেছিলাম। কষ্ট বা বিষাদবোধে ভেতর খানা আচ্ছন্ন হয় নাই বরং শরীরখানা পাখির পালকের মত হালকা লাগছিল। নুহাশ জন্মের তিন মাস পর নাফিসের ফোন চেক করে একখানা ছবি পেলাম।অল্পবয়সী একটা তরুণীর সাথে আমার স্বামী অন্তরঙ্গভাবে শুয়ে আছে। মা জানে না,
-শোবার ঘরে বিছানা ভাগাভাগি করবার পরও নাফিস বেঁচে থাকতে আমি একাই ছিলাম ও চলে যাবার পর শুধু একা থাকাটা উপভোগ করি।