মফিজ মিয়া পকেটে ৩০০ টাকা আর মনে ১ পোয়া মাংসের আসায় সেই তখন থেকে চোখ মেলে চেয়ে আছে কসাইয়ের দিকে। ওদিকে কসাই ঠকর ঠকর শব্দে হাত চালিয়েই যাচ্ছে।পাশে থাকা তার সহযোগী ক্রেতাদের কাছে মাংস বিক্রির কাজে নিয়জিত আছে। মফিজ মিয়া গুটিগুটি পায়ে যিনি মাংস বিক্রি করছে তার কাছে খানিক টা এগিয়ে গিয়ে বলল,
—ভাই,, শুনছেন নি? ব্যাস্ত কর্মচারী ব্যাস্ত ভাবেই জিজ্ঞেস করল, কিতা হইছে?? কইয়া হালান তাত্তারি। মফিজ কয়েকবার ঢক গিলে বলল, ইয়ে না মানে, আমারে ১ পোয়া মাংস দিবেন??
—কিহ?? কত খানি??
—এ, এক পোয়া, মিয়া ভাই। মফিজ কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল।
—আন্নের কি মনে হয় আমি ইহানে মজা করার লাইগা বইসা আছি?? আমারে কি জোকার লাগতেয়াছে আন্নের কাছে??
–না ভাই সিডা না।
—তাইলে আপনে কেমন কইরা কইতেয়াছেন ১ পোয়া মাংস দিবার?? ইয়ে না মানে আমার কাছে তো ১ কেজি কিনার টাহা নাই। বাড়িত অসুস্থ মাইয়াডা মেলাদিন ধইরা খাইতে চায়ছে। দিবার পারতেছি না টাহার অভাবে। তাই
—টাহা নাই তো মাংস খাওয়ার অত শখ জাগছে কেন মিয়া হুম?? মফিজ চুপ করে থাকে।
—যান যান ভিড় ছাড়েন। লোক আইতে পারতেছে না আপনের লাইগা।
মফিজ সড়ে গিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুসময় পরে মফিজ দেখে এক লোক ওর মতোই মাত্র এক পোয়া মাংস নিয়ে গেল কিন্তু এই সময় বিক্রেতা খুব হাসিমুখেই ওনাকে মাংস দিলো। মফিজ ক্রেতার গেটাপ দেখে ভাবল ওনার টাকা পয়সার কোন অভাব নাই। একটা সাহেব সাহেব ভাব। হয়তো এ জন্যিই উনি অতটুকু মাংস দিতে পারল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধার লালাভ আলো চোখে এসে পড়ছে মফিজের। একটু পর রাতের নিকষ কালো আঁধার রঙ চারিদিকে ছেঁয়ে যাবে। মাংস বিক্রেতার বিক্রয় করা প্রায় শেষের দিকে। মাত্র কয়েক পিস মাংস বেঁচে গিয়েছে। সেটুকু একটা প্যাকেটে করে নিলো সে। তারপর কসাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
—মিয়া ভাই জানেন নি আজ কিতা হয়ছে??
—না কইলে জানবো কেমতে??
–তা তো ঠিক কইছেন। আরে ভাই হোনেন, মুই কয়তেয়াছি, ওই যে দেহেন ওই লোকডা বইসা আছে(মফিজ কে দেখিয়ে)।এক পোয়া মাংস লইতে আয়ছিল বোজ্জেন। দিছি একখানা ধাক্কা মাইরা। ফাইজলামি করতে আহে এগুলো বুচ্চেন নি।
কসাই বিক্রেতার দিকে চোখ রাঙা করে বলল, ক্রেতা যেটুকু লিবার আহুক। তাতে তোর কি?? তার হয়তো টাহা নাই জন্যি আইছিল ওইটুকু মাংস নিতে। কাম ডা ঠিক করোস নাই। বিক্রেতা চুপ করে রইলো কসাইয়ের কথা শুনে। কসাই বিক্রেতার হাত থেকে প্যাকেটে টা নিয়ে দেখল মাত্র কয়েক পিস মাংসই পড়ে আছে সেখানে। বিক্রেতার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে মফিজ মিয়ার কাছে এসে বলল,
—মিয়া ভাই। মফিজ বসে থাকতে থাকতে ঘুমে ঢুলে পড়ছিল। কারোর ডাকে সামনে তাকিয়ে দেখে কসাই দাঁড়িয়ে আছে।
—জি ভাই। বলে চোখ টা মুছে উঠে দাঁড়ায়।
—এই লন ভাই। এর চাইতে বেশি আইজকা বাঁচে নাই। আমি আগে জানলে আপনের লাইগা কিছু রাইখা দিতাম। কসাই মাংসের প্যাকেট টা মফিজ মিয়ার দিকে দিতে দিতে বলল।
মফিজ মিয়া প্যাকেটের ভেতরে কয়েক পিস মাংস দেখেই খুশি হয়ে গেল। সামনের দাঁত গুলো বের করে এক গাল হেসে কসাইয়ের হাতের মধ্যে ৩০০ টা টাকা দিয়ে বলল,
–ধন্যবাদ ভাই। মেলা উপকার করলেন ভাই। বলেই মফিজ কসাইয়ের প্রতিউত্তর না নিয়েই চলে আসছিল।
মাংস পাওয়ার আনন্দে মফিজের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুদূর এগুতেই মনে হলো শুধু মাংস কিভাবে রান্না করবে?? এর জন্য তো মসলা লাগবে। আর মসলা কেনার টাকা তো ওর কাছে নাই।
জোগানের(ইট,বালু) কাজ করে মফিজ মিয়া। কাজের দিন গড়ে ৩০০ টাকা করে পায় পারিশ্রমিক হিসেবে। কাজের দিন বলছি এই জন্য যে, প্রতিদিন তো আর কাজ থাকে না। তাই কাজের টাকা টা অল্প করে খরচ করে বাকিটা জমিয়ে রাখে অন্য সব দিনের জন্য। মফিজ মিয়া তাড়াতাড়ি করে ঘুরে চলে আসে কসাইয়ের কাছে। চোখে পানি টলমল করছে ওনার,
–ভ, ভাই। কসাই পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে মফিজ।
—আরে ভাই আইছেন আপনে??
—ভাই, যদি কিছু মনে না লেন,, তয় একটা কথা কমু??
–হ ভাই, কন।
—ইয়ে মানে, আমায় ওখান থাইকা ১০০ টাহা দেতে পারবেন?? আসলে আইজ কা কাজ ছিল জন্যি টাহা টা পাইছিলাম। কাল তো কাজ নাও থাকতি পারে আর মাংস ডা রান্না করতে যেই মসলা পাতি লাগে আমার ঘরে তো সেই মসলা পাতি গুলান নাই ভাই। কসাই কিছুসময় মফিজের দিকে তাকিয়ে ছিল তারপর নিজের পকেট থেকে ৩০০ টাকা বের করে ১০০ টাকা দিতে গিয়ে পুনরায় মফিজের দিকে তাকিয়ে পুরো ৩০০ টাকাটাই দিয়ে দিলো।
—এ, এইডা কি করেন মিয়া ভাই?? আমিতো ১০০ টাহা চাইতেছি। আপনে পুরো টাহা দিতাছেন ক্যা??
–রাখেন ভাই। মনে করেন আপনার ভাই আপনেরে দিছে হু।
মফিজ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেলে। শুধু কিছু সময় কসাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে কয়েক ফোঁটা জল ফেলে ওখান থেকে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে মসলা টা নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। হাঁটতে থাকে মফিজ মিয়া। আর সকালে মেয়ে নুরির বলা কথাগুলো ভাবতে থাকে।
—বাজান, আমার না খুব মাংস খাইবার মুন চাইতেছে।
মফিজ কোন উত্তর দিতে পারে না। মা মরা মেয়েটার হাঁপানির রোগ টা ঔষধবিহীন আরো ভালোমতো পেয়ে বসেছে। এরপর আবার পাশের বাসার বড় লোক বাবুদের বাসায় প্রতিদিন ই মাংস পোলাও রান্নার গন্ধ বেরোয়। নুরি জানলাটা খুলে শুধু ওই গন্ধ মন ভরে নেওয়ার চেষ্টা করে। হয়তো আগেই মফিজ কে এই কথাগুলো বলে দিতো নুরি কিন্তু বাবার আর্থিক অবস্থার কথা এই ছোট্ট মেয়েটার মনে থাকে সবসময় জন্য চায়লেও বলতে পারে না। আজ মনে হয় মন টা একটু বেশিই গিয়েছিল মাংসের ভেতর আর যার জন্য সকাল বেলাতেই বাবা মফিজ কে মনের কথা টা বলে দিয়েছে। মফিজ মিয়া নুরির মাথায় হাত দিয়ে আসাভরা কন্ঠে বলেছিল আমি আনুম মা আইজকা। ছোট্ট নুরির মুখে হাটি ফুটে উঠে। সারাদিন কাজ শেষে ৩০০ টাকা নিজের সম্বল করে মাংসের দোকানের কাহিনী তে এতক্ষণ লিপ্ত ছিল সে।
বাড়িতেঃ মাংস দেখে নুরি তো খুশিতে আত্মহারা। বার বার শুধু মাংসের দিকেই চোখ দিয়ে দেখছে। তবে সেটা শুধু ভাঙা চৌকিটার উপর থেকেই। শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে জ্বর বয়ছে সাথে তো হাঁপানির টান টা আছেই। মায়ের রোগ টা পেয়ে বসেছে মেয়েটাকে। মা কে তো নিয়েই গেল। না জানি কবে আমার এই ছোট্ট মেয়েটাকেও নিয়ে যায় ভাবতেই মফিজের চোখে পানি চলে আসে।
মফিজ মাংস রান্না করে ঘরেতে একটা বাটিতে মাংস টা রেখে, পাতলা সরপোস দিয়ে হালকা ঢেকে, নুরিকে বলে যায়– মা তুমি জেগে থাইকো। আমি গোসল টা সেড়ে আইতেছি। আইসা বাপ বেডি এক লগে ভাত খামু হুম। নুরি এতক্ষণ বাবার কথামতো চোখ মেলে তাকিয়ে পাহারা দিচ্ছিল রান্না করা মাংসটুকু। কিন্তু জ্বর আর অসুস্থ শরীর ছোট্ট নুরীর চোখে ঘুম নিয়ে আসে। আর এর ফাঁকেই যা সর্বনাশ সেটা হয়ে যায়।
মফিজ মিয়া পাশের পুকুর থাইকা গোসল সেড়ে ঘরে ঢুকেই চিল্লায়ে ওঠে। হাতের পাশে থাকা পিড়িটা বিড়াল টার দিকে ছুড়ে দিতেই বিড়াল টা ম্যাও ম্যাও আওয়াজ করতে করতে ঘর ছাড়ে। ততক্ষণে নুরি জেগে গিয়েছে।
বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নুরি। মফিজ গিয়ে মাংসের বাটি টা উল্টায়ে দেখে ওখানে ছিন্নভিন্ন কিছুটা মাংস ছাড়া বাকিটুকু মাংস বিড়ালের পেটে চলে গিয়েছে। নুরি চৌকির উপর থেকেই কান্না করে দেয়। মফিজ মিয়ার চোখেতেও পানি।