গ্রামের একদম পশ্চিমে এই দিঘীর পাড়টা আমার খুব পছন্দের । এখনে এলে আমার কেমন শান্তি শান্তি লাগে । এমন না যে আমি এখানে প্রায়ই আসি । কি করে আসব , গ্রামেই যে আসা হয়না ! শেষ বার এসেছিলাম বছর পাঁচেক আগে ।
আজ অবশ্য একটা বিশেষ কাজে এসেছি ! আজ রাহার বিয়ে । রাহার কথা বলা হয় নি ? আচ্ছা বলছি , শুনুন !
অনেক বছর আগের কথা ! আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি । লেখাপড়ায় ভাল ছাত্রী হিসেবে শিক্ষক-মহলে বেশ আদুরে ছিলাম । সেই আদরের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে একদিন প্রধান শিক্ষক লম্বা এক লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন তোমায় বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে । আমার বাবাটাও ছিল পাগলাটে ধরনের ।
হুট-হাট একদিন বাসায় এসে বললেন
– তোমাকে গ্রামের স্কুল থেকে বৃত্তি দেওয়াবো । ঢাকায় প্রশ্ন কঠিন হয় ! সব ঠিক ঠাক করে এসেছি । তুমি সেখানকার হেডমাস্টার এর বাড়িতে থাকবে । উনি আমার বন্ধু মানুষ ।
আমি তখন এইটুকু বাচ্চা একটা ! আম্মু তো শুনেই কেঁদে কেটে শেষ । কিন্তু আব্বুর মুখের উপর কথা বলার সাহস কারো নেই । অনেক ঝগড়া ঝাটি , কান্না কাটি শেষে অতঃপর সেই শুভক্ষণ এল ! যে আমি কখনো তিন ঘন্টা বাবা মা কে ছেড়ে কারো বাড়িতে থাকিনি সেই আমি চলে গেলাম তিন মাসের জন্য অচেনা একটা ফ্যামিলিতে ! আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই চড়ুই ভাতি লাগছিল ! গ্রামের উনুনে রান্না দেখব ! নদীর পানি ছুয়ে দেখতে পারব , ইচ্ছে হলে দোলনায় চড়া যাবে আরও কত কি ! প্রথম ডানা মেলার সুখ সুখ আনন্দে রাতে গাড়িতে আমার ঘুমই আসছিল না ! আমরা ভোরের দিকে পৌঁছলাম গ্রামের অনেক ভেতরে ছোট্ট একটা মাটির ঘরওয়ালা বাড়িতে ।
বাবা আমাকে হেড মাস্টারের বাড়িতে রেখে থাকা খাওয়ার সব খরচ দিয়ে সেদিনই ঢাকায় চলে এলেন । ঘন্টা খানেক একা ঘরে বসে থেকে যখনই একটু ঝিমুনি পেয়েছে ঠিক তখনই দরজার আড়াল থেকে ছোট্ট একটা পরী পরী টাইপ চেহারার মেয়ে মাথা বের করে বলল
– এই মেয়ে তোমার নাম কি ?
– ঐন্দ্রিলা । তুমি আমাকে ইন্দু বলে ডাকতে পারো । তোমার ?
– ইন্দুর কারো নাম হয় নাকি ? আমার নাম পরী । তবে তুমি আমাকে এই নামে ডাকতে পারবা না । এটা আমার আব্বা ডাকে ।
এই টুকু বলেই মেয়েটা পালিয়ে গেল । সারাদিন আর তার দেখা পাইনি । রাতে যখন খেতে বসেছি , তখন আবার সে হাজির । জানলাম ওর নাম ভাল নাম রাহা । স্যার আদর করে পরী ডাকেন । স্যারের একমাত্র মেয়ে । বলা হয়নি , আমি যে পরিবার টির সাথে আছি ওরা যশোরের একটা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে যার অর্ধেক আমি বুঝি , বাকি টুকু অনুমান করে নেই । কথায় কথায় স্যার বললেন
– মামুনি , আমি তো সারাদিন স্কুলে থাকি , তাই তুমি এখানে থাকলে আমি তোমার পড়া ঠিকমত দেখাতে পারব না । তার চেয়ে তুমি কাল থেকে আমাদের স্কুলের আবাসিক ব্যাচ এর সাথে ক্লাস করো , রাতে ওরা স্কুলেই থাকে । তুমি ওদের সাথে থাকলে অনেক প্র্যাকটিস করতে পারবে ।
–
আমার তখন অতশত মাথায় ঢোকেনি । বরং আমার মনে হচ্ছিল এবার চড়ুই ভাতিটা আরেকটু জমবে ! একদল ছেলে মেয়ের সাথে রান্না করে খাওয়া, একসাথে খেলতে যাওয়া, ঘুমানো , পুরোটা একটা বিশাল ক্যাম্প ক্যাম্প অনুভূতি !
তো , পরদিনই আমি কাঁথা বালিশ নিয়ে স্কুলে উঠে গেলাম । দিনের বেলা সেখানে কোচিং হয়, বিকেল এর ঘণ্টা খানেক ছুটি তারপর আবার রাত পর্যন্ত চলে সুর করে পড়া , ঘুম ভাব এলে সবাই মিলে চক ছোড়াছুড়ি খেলা আর আধা রাতে হাড় কাঁপানো শীতে লোয়ার ব্যাঞ্চ একসাথে করে কাঁথা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়া ! এই ছিল আমার চড়ুইভাতি !
ওরা প্রত্যেকেই আমার চেয়ে চার পাঁচ বছরের বড় ছিল ! ওদের কাছে আমি একটা পুতুল পুতুল বাবু ছিলাম । যাকে দিয়ে ইচ্ছে করলেই ভূতের ভয় দেখিয়ে সব হোম ওয়ার্ক করিয়ে নেয়া যায়, সাইডে ঘুমানোর ভয় দেখিয়ে রাতের বেলা খাবার খাওয়ানো যায় , কিংবা ইন্দুর বলে খেপালেই সুইচ টিপ দেয়া পুতুলের মত কান্না শোনা যায় । শুধু একজন ছিল আলাদা । অন্য রকম । ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল বলেই হয়ত সারাদিন আতেল এর মত পড়ত । প্রথমে ভেবেছিলাম বেশ অহংকারী । অবশ্য ভুল টা ভাংতে সময় লাগেনি ।
একদিন খুব সকালে চ্যচামেচি শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার । দুইটা সোয়েটার আর কম্বল গায়ে দিয়েও হুহু করে কাঁপতে কাঁপতে বাইরে বের হয়ে দেখি সবাই স্কুলের মাঠে জড় হয়ে চিল্লাপাল্লা করছে । মাঝখানে অপরাধীর মত মুখ নিচু করে দাড়িয়ে আছে সেই ছেলেটি । রফিক । স্যার আসতেই ছেলেটি প্রায় কেঁদে ফেলে বলল
– স্যার আমার গায়ে দেয়ার কাঁথাটি কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে!
অনেক খুঁজেও সেদিন আর রফিক এর কাঁথাটি পাওয়া গেল না । পাওয়া গিয়েছিল পরের দিন । স্কুলের কাছেই একটা কবর ছিল , ওখানে প্রায়ই একটা পাগল কে দেখা জেত । রমজা পাগলা নাম । কবর টা নাকি ওর মেয়ের । সেখানেই রফিকের কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়েছিল পাগলটা । স্যার সহ সবাই মিলে যখন পাগল টাকে বলল কাঁথা টা ফেরত দেয়ার জন্য তখন পাগল টা বলল
– ক্যান ? আমার কি শীত লাগে না?
তখন রফিক কাচু মাচু করে বলল – স্যার আমার কাঁথা লাগবে না !
কিজানি কি হল , হটাত করে পাগল টা কাঁথা টা ছুড়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল ।
আমার তখন খুব ইচ্ছে করছিল এক ছুটে ঢাকায় চলে আসি আর বাসার সব কম্বল , কাঁথা নিয়ে পাগল টা কে দিয়ে দেই ! এরপর অনেক গুলো রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে জেত , এর পর আর ঘুমাতে পারতাম না । আমার মনে হত বাইরে কেউ সুর করে কাঁদছে আর বলছে – আমার কি শীত লাগেনা ?
সেদিনের পর আমি আর কখনও রমজা পাগল কে খুঁজে পাইনি… কখনও না !
( ২)
সেই তিন মাসের এত এত স্মৃতি আজ মনের জানালায় উঁকি মারছে কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব বুঝতে পারছি না ।
সেসব আরেকদিনের জন্য তোলা থাকল ! পরীক্ষা শেষ করে ঢাকায় আসার পর আমি আর গ্রামে যাইনি অনেক বছর । গিয়েছিলাম এইচ এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট পেয়ে , বাবার সাথে । আমি তখনও জানতে পারিনি সাত বছর আগে এই গ্রামেই আমি আমার শহুরে মন টা কে ফেলে গেছি ! জানতে পেরেছিলাম রাহার সাথে দেখা হবার পর ! সাত বছরের জমানো গল্প , কত এলোমেলো আড্ডা শেষে আমি নিজের অজান্তেই জিগ্যেস করে বসলাম
– রফিক কেমন আছে ? ওর সাথে কি যোগাযোগ আছে তোমার ?
– কি বলো , যোগাযোগ থাকবেনা কেন ? রফিক ভাইয়া তো আমাকে ম্যাথ পড়ায় । তুমি আজ বিকেল পর্যন্ত থাকো তাহলেই দেখা হয়ে যাবে !
আমার হতচ্ছাড়া মনে তখন দুনিয়ার উদ্ভট চিন্তা ঘুরপাক করা শুরু করেছে ! আচ্ছা রফিক আমাকে চিনতে পারবে তো ? না চিনলেই বা কি ! আমি কেন ওর জন্য ভাবব ! ও তো মনে রাখেনি আমাকে! আচ্ছা মনে রাখার সুযোগ কি এসেছিল কখনও ?
আমার ছোট্ট জীবনের সবচেয়ে সুখময় সন্ধ্যা টা বুঝি সেদিন ছিল । আমরা গ্রাম থেকে অনেক পশ্চিমে এই দীঘির পাড় টা তে এসে বসেছিলাম । নৌকায় উঠতে গিয়ে পা ছিলে ফেলা , বাচ্চাদের মত শিম ফুল থেকে মধু খাওয়া , জংলি ফুল খোঁপায় পরে গুনগুন করে গান গাওয়া সব কিছুর মধ্যে একটা অযথা ভাল লাগা ভর করেছিল ।
সন্ধ্যার অনেক টা পরে বাড়ি ফিরতে গিয়ে তিন জনই হটাত চুপ হয়ে গিয়েছিলাম । রাহা কে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে পিচ্ছিল রাস্তায় খুব সাবধানে হাঁটছিলাম আমি ।
পুরো রাস্তায় রফিক একটা কথাও বলেনি ।
যখন বাড়িতে ঢুকতে যাব তখন ডেকেছিল একবার !
– ঐন্দ্রিলা !
– বলো !
– কাল কখন চলে যাবে?
– সকাল আট টায় গাড়ি ! এখান থেকে পাশের বাড়ির জমীর চাচার অটো তে যাব স্টেশন পর্যন্ত !
– হুম । ভাল থেকো !
আমি ভেবেছিলাম হুম কুমার কাল সিনেমার নায়কদের মত আমার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করবে ! চশমার আড়ালে তার ধূসর চোখদুটো কে লুকিয়ে রাখার ভান করে বলবে
“ ঐন্দ্রিলা , আমি অনেক গুলো সন্ধ্যায় তোমার চোখে সূর্য ডোবা দেখতে চাই! তুমি আমার বিষণ্ণতা হবে ? ”
তার কিছুই হয়নি । অটো তে চড়ে স্টেশন পর্যন্ত আসতে আসতে কয়েক হাজার বার পোড়া চোখ বিটরে করেছে আমার সাথে । খুঁজবনা খুঁজবনা করেও খুঁজেছে । আমার পূর্ণ অনুভবের টুকরো মৃত্যু হয়েছিল সে ষ্টেশনেই ।
( ৩ )
উড়ো খবরে শুনেছিলাম , রফিক ঢাকায় এসেছে । কোণ এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে । মাঝে মাঝে মনে হত জীবন টা গল্প হলে বেশ হত ! কোন এক রোদ জলা দুপুরে দেখা হয়ে জেত ওর সাথে কোন ব্যস্ত রাস্তায় অথবা চায়ের দোকানের ঝড়-তোলা আলাপের মাঝে আমি খুঁজে নিতাম সেই পরিচিত ডাক ঐন্দ্রিলা ! মাঝে মাঝে আমি খুব চাইতাম !
ভাগ্য আমার উপর অতটা প্রসন্ন হয়নি । কিংবা হয়েছিল! তবে গল্পের চেয়েও অদ্ভুত কিছু ঘটেছিল আমার সাথে । প্রায় ১ বছর ২ মাস পর গ্রাম থেকে একটা ফোন এসেছিল বাবার নাম্বারে । তখন গ্রামের বাজারে নতুন নতুন ফোন পৌঁছেছে । ফোন ধরার পর জানতে পারলাম , দাদুর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে জমির চাচা ফোন দিয়েছে । সেদিন রফিক একটা প্যাকেট দিয়েছিল চাচা কে , চাচা সেটা অটো তে রেখেছিলেন , আর মনেছিল না আমাকে দিতে ! সেটা এখন দাদুর কাছে আছে ।
ওহে আশা জাগানিয়া পাখি ! আমি তো বেশ ছিলাম এক সন্ধ্যার টুকরো স্মৃতি নিয়ে ! কি প্রয়োজন ছিল অবেলায় আমাকে আরেকবার ডেকে যাবার ! বিশ্বাস করুন পাঠক , পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার দোয়া করা ছাড়া আমি কখনই এত তীব্র ভাবে কিছু চাইনি ! আমি শুধু প্রার্থনা করছিলাম বিধাতা আমাকে শুধু একবার গ্রামে যাবার সুযোগ করে দাও !
ফেসবুক , টুইটার কোন কিছুই পারেনি আমাকে সেই ধূসর চোখ দুটি খুঁজে দিতে ! অনেক গুলো একলা বিকেল শেষে আমিও ব্যস্ত হয়ে পরেছিলাম ক্যারিয়ার গোছাতে । ব্যর্থতায় কেটে গেছে চার বছর । এর মাঝে যে কেউ আসেনি জীবনে তা বললে মিথ্যে বলা হবে । কেউ একজন খুব ভালবেসে শহরের বিলাসী ফুল দিয়ে বলেছিল
– ইন্দু , বাধা পড়তে চাই এক সুতোয় ! তুমি আমার বাগান বিলাস হবে ?
আমি পারিনি , আমার সমস্ত সুখ সেই জংলি ফুলে হারিয়ে ফেলেছি। আমার মন কৌটা বন্ধক রেখেছি সেই না দেখা ছোট্ট প্যাকেট টা তে , ঐন্দ্রিলা বলে কেউ ডাকবে বলে!
অবশেষে বিধাতা সত্যিই একদিন প্রসন্ন হয়েছিল আমার উপর ! হেডস্যার ঢাকায় এসেছিলেন রাহার বিয়ের দাওয়াত দিতে । বাবাও নিষেধ করেনি । স্যারের সাথেই রাতের গাড়িতে রওনা হয়েছিলাম । ওদের বাড়িতে পৌঁছানর পর রাহা কিছুতেই আমাকে ছাড় ছিলনা । অথচ আমার মন পরে আছে দাদুর বাড়িতে , পুরনো আলমিরা টায় ! রাহা কে মেহেদি পরানো , বধূ সাজানোর পর একটু ছুটি পেয়েছিলাম । এক দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে প্যাকেট টা হাতে নেয়ার পর থেকে আমার মনে হচ্ছিল ঠিক এই অনুভূতিটা থেকেই অপু বলেছিল – আমি পাইলাম! ইহাকে পাইলাম! কাহাকে পাইলাম!
সে মুহূর্তে পাশের বাড়ি থেকে বেশ বাদ্য বাজনার আওয়াজ শুনে বুঝলাম বর এসে গেছে । প্যাকেট হাতে নিয়েই আবার ছুটলাম রাহা দের বাড়িতে ।
জীবন টা গল্প হলে ক্ষতি ছিল না , তবে এত টা নাটকীয় না হলেই কি হত না ? বিয়ের কার্ড দেখে আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি , রফিকের ভাল নাম তানভীর হোসেন ! জানলেই বা কি হত ? আরও কিছু টুকরো মৃত্যু ? আমি তো সেই কবেই ভুলে গিয়েছিলাম ! কেউ ছিল… কত টুকু জুড়ে ছিল ! আমি তো কখনও তার ছিলাম না কিছুই, আমার হয়নি সেও … তবু কেন মনে হচ্ছে আজ আবার হারালাম হারানো সেই সন্ধ্যা টাকেই !
( ৪)
গ্রামের একদম পশ্চিমে এই দিঘীর পাড়টা আমার খুব পছন্দের । এখনে এলে আমার কেমন শান্তি শান্তি লাগে । আজকে আমার মন টা ভয়ঙ্কর রকম শান্ত । আজকে আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে থাকব । শেষ আলো টুকু নিভে জাওয়ার আগ পর্যন্ত আরও অনেক বার পড়ব ছোট্ট প্যাকেটের ডাইরির ভেতরে নীল কালিতে লেখা চিরকুট টা…
“ ঐন্দ্রিলা , আমি একজোড়া বিষণ্ণ সুন্দর চোখের মায়ায় পড়েছি,
তুমি আমাকে সে সন্ধ্যা টা আরেকবার উপহার দেবে ? ”