বাড়ি থেকে কিছু দূরে প্রাইমারি স্কুল।সেই স্কুলের ক্লাস রুমে ছেলেমেয়েরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শতকিয়া মুখস্ত করছে।
নয় দশ সাত সাতানব্বই, নয় দশ আট আটানব্বই, নয় দশ নয় নিরানব্বই, দশ দশে একশ। ঘন্টা বাজতেই ছুটি হয়ে গেল।
ছেলেমেয়েরা অনেক আনন্দে বই খাতা শ্লেট বুকে চেপে একজনের স্যান্ডেল আরেক জনে পায়ে দিয়ে,কাঠ পেন্সিল,বই, চক হারিয়ে ঘোড়ার মতো দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটছে।
দু’জন ছেলে দৌড়াতে গিয়ে এক জনের ধাক্কায় আরেক জন পড়ে ব্যাথা পায় সে আজুহাতে মারামারি শুরু করে দিল।
একজন স্যার এসে ক’টা বেত মেরে দু’জনকেই বাড়ির দিকে পাঠিয়ে দিলেন।
.
এখনও ঘন্টার ঢং ঢং শব্দটা মিনার কানে মধুর মতো মিষ্টি লাগছে।
চমৎকার ভাবে ঘন্টাটি দুলছে আর যেন বলছে, “আজ আমাদের ছুটিও ভাই আজ আমাদের ছুটি”।
ছুটিতে যেনো মহা আনন্দ তা মিনা প্রতিদিন প্রার ভরে উপভোগ করে।
প্রতিদিনই মিনা সমস্ত কাজ ফেলে রেখে চির পরিচিত ছুটির দৃশ্য দেখার জন্য বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই স্কুলে মিনা ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছে,তাই স্কুলটির জন্য তার অনেক মমতা।স্কুলটি তাদের দুঃখ সুখের সাথী।
এই স্কুল মাঠে, এই গাছতলার নিচেই মিনার বাবার জানাজা পড়ানো হয়েছিলো।
সেদিন তার ভীষণ কান্না পেয়েছিল।মিনা এই প্রথম প্রচন্ড ব্যাথা পেল।তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল,জোরে জোরে কেঁদে জ্ঞান হারিয়েছিল ।
সেই থেকে তাদের সংসারে অভাব এসে জুড়ে বসল,স্থায়ী ভাবে শিকড় ফেলল।চার বোন এক ভাই এর মাঝে মা-ই এখন অভিভাবক।মিনা বড় সন্তান উপার্জেনের কেউ নেই।
.
দুঃখের মাঝে মিনা সুখ খোঁজে। সে ভীষণ ভালো বৌচি খেলতে পারে।
বোল দেয়—:- চি-চি কানাইয়া নৌকা দেব বানাইয়া নৌকা যদি উড়ে বিয়া দেবো দূরে।নতুন ছুটি পেয়েছি রুটি খেয়েছি বাড়ি এসে ভাত,এসে দেখি দেখি হাঁড়ি খালি কপালে হাত।
.
এদিকে খেলা শেষে বাড়ি এসেও কপালেই হাত। ঠিকমত ভাত জোটেনি।মিনা অভাব বুঝে কাজ খোঁজে।
তাদের গ্রামের মুহিত সাহেব টাকা থাকেন।তার একজন কাজের মেয়ে প্রয়োজন।
গ্রামে বেড়াতে এসে মিসেস মুহিত মিনাকে নির্বাচিত করলেন।
অভাবের চাপে মিনার মা ও রাজি হন।গ্রামকে পিচে ফেলে মিনা এখন রাজধানী বাসিন্দা।
.
সকাল সাতটায় নাস্তা সেরে মুহিত সাহেব এবং তার স্ত্রী অফিসে চলে যায়। তাই কাকা ডাকা ভোরে মিনাকে ঘুম থেকে জেগে হাতমুখ ধুয়ে কাজে লেগে যেতে হয়।
রুটি বানাতে হয়, বাসার ফ্লোর মুছকে হয়,বাথরুম পরিস্কার করতে হয়।
সকাল বেলা মিসেস মুহিত মিনাকে সাহায্য করার সময় পান না।তারা অফিসে যাবার সময় বারান্দা এবং কিচেন খোলা রেখে সবকটা রুম তালাবন্ধ করে বাইরের গেটেও তালা ঝুলিয়ে যায়।ওরা চলে যাবার পর অবশিষ্ট খাদ্য খেয়ে মিনাকে দুপুরের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হতে হয়।
হাঁড়ি-পাতিল পরিস্কার করে সব কাজ সেরে চুলায় আগুন জ্বালায়। রান্না সেরে বারান্দা কিচেন মুছতে মুছতে উভয় এসে হাজির হয়।ওরা দুপুরের খাবার খেয়ে কতক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার বাইরে যান।
.
একান্ত অবসর মূহর্ত গুলো মিনাকে ভীসন হতাশ করে।
মিনা তালাবন্ধ খাঁচায় নিজেকে পরাধীন পাখির মতো মনে করে।যারা পাখিকে বন্ধী করে তারা তার যত্ন নেয়।
তারা সহানুভূতিশীলও কিন্তু আমি কেনো খাঁচার পাখিটির চেয়েও অসহায় ! ওরা আমাকে বিস্বাস করতেও পারেনা।
পালিয়ে যাবো কিংবা চুরি করবো ভেবে আসামির মতো তালাবন্ধ ঘরে বন্ধী করে রাখে।
কিন্তু কেনো? এমন ভাবে অসংখ্য ভাবনা তাকে আক্রন্ত করে।
ঢাকা শহরে এই বন্দিজীবন তার একেবারে অসহ্য।
ওরা অফিস সেরে আসার পর বৈকালিক চা নাস্তা করে দিতে হয়।রাতে ওরা টেলিভিশনে মন দেয়।
মিনাকে রাতের খবার বানাতে হয় একা হাতে।রান্না ভালো হয়নি বলে মিসেস মুহিত কড়া দমকও শুনতে হয়।
তখন মিনার মুখটা মলিন হয়ে যায়।
মিসেস মুহিত বলেন:-কাজের মেয়ে নবাবজাদী হলে চলে না।
এত বড় লোকি দেখালে কাজের মেয়ে হলে কেন?
মিনা প্রতি-উত্তর ছাড়াই কাজে লেগে যায়।
.
খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমাতে সাড়ে ১২টা বেজে যায়। গ্রামের মেয়ে মিনার চোখে সেই সন্ধ্যা বেলায় ঘুম এসে ভিড় করে কিন্তু বিছানায় যেতে যেতে ঘুম আবার পালিয়ে যায়। বারান্দায় একটা মাদুর পেতে পুরানো পত্রিকা মাথার নিচে রেখে শুতে হয়।মশারি নেই,ঝাঁকে ঝাঁকে পিঁপড়ার মতো মশারর মিছিল। চারদিক থেকে মশা হামলা চালায়,মশার ভোঁ ভোঁ শব্দ মিনার ভিষণ বিরক্তি লাগে।
একেবারে অসহ্য হয়ে কয়েল খঁজতে গিয়ে তার চোখে পানি ঝরে।ভীষণ জোরে কাঁদতে ইচ্ছা করে।কখনো কখনো অনেক্ষণ কেঁদে মিনা নিজেকে হালকা করে। এক সময় মশার কামড়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে।
.
মিনার এখানে মন বসে না।যেখানে স্বাধীনতা নেই মানুষের অধিকার নেই,খাঁচার ভিতর অবহেলিত ভাবে মানুষ বন্ধী থাকে সেখানে সে থাকবেনা।মায়ের কাছে গ্রামে চলে যাবে।
গ্রামের লোকেদের বাড়িতে কাজ করবে। সবাই তাকে চিনে সে সবাইকে চেনে,কোন অসুবিধা হবে না।
তাই মিনা মিসেস মুহিত কে বলে আমি এখানে আর থাকবো না,বাড়িতে চলে যাবো।
তিনি বললেন, খেয়ে শরীরে তেল হয়েছে—ছোট লোক গুলা এমনই হয়।আশ্রয় না পেলে দু’পা চেপে ধরে–সুযোগ পেলে ফুড়ুৎ।
এসব হবে না, এখানে তোমাকে কাজ করতে হবে।তুমি চলে গেলে কি মানুষ হঠাৎ করে আকাশ থেকে পাবো??
মিনার প্রতি মিসেস মুহিতের এখন কড়া দৃষ্টি। কথার সুঁইতে তাকে বারবার গেঁথে ফেলে। সে যেন পালিয়ে না যেতে পারে তার জন্য কড়্কড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সবখানেই এখন তালা ঝুলছে।
.
.মিনা মুক্তি চায়,স্বাধীনতা চায়,আপনজনদের মাঝে ফিরে আসতে চায়।
তার বুকের গভীর থেকে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে–
আমি মুক্তি চাই।
……………………………………(সমাপ্ত)……………………………..