দু বছর আগে, এই দিনে আমার প্রেমিকা ভয়ানক দুর্ঘটনায় ওপাড়ে চলে যায়। তাই হয়তো খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে আজ। প্রচণ্ড কুয়াশা পড়েছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটা ঢেকে আছে কুয়াশায়। গায়ে চাদর মুড়িয়ে নির্জন রাস্তায় হাঁটছি। চারপাশটা স্তব্ধ। যেদিকেই তাকাই, ধোঁয়াটে দৃশ্য। সাময়িক সময়ের জন্যে হলেও উপলব্ধি করতে পারছি এই পৃথিবীটা জনমানবশূন্য। অথবা সকলের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছি, কেউ দেখছে না আমায়। এমন কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে আবার শীতল বাতাস বইছে। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ভাবছি, কিছুক্ষণ পর কুয়াশা ধ্বংস করার জন্য তাড়াহুড়ো করে সূর্য উঁকি দেবে। অতঃপর আরেকটা বার সূর্যের উদয়ে কুয়াশার মৃত্যু। যেমন দুঃখের আগমনে সুখের বিলোপসাধন।
বাসায় ফিরে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে তাকিয়ে আছি। গরম চায়ে একটা পিঁপড়ের লড়াই দেখছি। বেঁচে যাওয়ার লড়াই। আচ্ছা, পিঁপড়েটার কি অনুভূতি আছে? হৃদয় আছে? দুঃখ আছে রাশি রাশি মানুষের মতো? চায়ের কাপে কি সে আত্মহত্যা করতে এসেছে? মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার তো বলেছিলেন, পিঁপড়েরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী, তাহলে এমন মহাপাপ করতে এলো কেনো? চোখ ঘুরিয়ে আনমনা হয়ে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছি। অবিরাম চলছে, ক্লান্তি নেই। ঠিক আমার কিছু স্মৃতির মতো। কবেকার স্মৃতি! প্রতিনিয়ত মস্তিষ্কে আনাগোনা করে। তাদেরও ক্লান্তি নেই। মস্তিষ্কে অবুঝ কিশোরীর কান্না পাওয়া চোখের মতো ছলছল করছে, অত্যন্ত স্পষ্ট।
সেদিন চুমকির মৃত্যুর খবর শুনে কিছুক্ষণের জন্য আমি চেতনা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি তাকে দেখতে যাওয়ার সাহস করতে পারছিলাম না। আমি গায়ে একটুও বল পাচ্ছিলাম না। আমার স্পষ্ট মনে আছে, দুপুরবেলায় রোদের মধ্যে রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চে বসে খুব কাঁদছি। বারবার ঠোঁট কামড়ে যন্ত্রণা লুকাবার চেষ্টা করছি। অথচ পারছি না। তখন খুব শান্তনা পেতে ইচ্ছে করছিলো আমার। কিন্তু পৃথিবীর কেউই আমাকে শান্তনা দিতে আসে নি। আর এসেও কি আমাকে শান্তনা দিতে পারতো? শান্ত হতাম আমি? চুমকির মৃত্যুর কয়েকদিন পর বন্ধুরা জোরজবরদস্তি করে কক্সবাজার নিয়ে গেলো। পড়ন্ত বিকেলে সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে সূর্যডুবা দেখছি। খানিক পরপর খুব দূর থেকে ঢেউ ছুটে আসছে, আমার পা ভিজিয়ে দিয়ে আবার ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে। ঢেউ পালিয়ে গেলেও কিছুক্ষণ পর আবার সমান গতিতে ছুটে আসে, কিন্তু কিছু মানুষ পালিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না। খুব কষ্টকর।
সাগর পাড়ে মন খারাপ করে উদ্দেশ্যহীন এদিকওদিক হাঁটছি। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেনো ডেকে উঠলো, এই যে শুনছেন? আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। প্রবল বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে, চুল উড়ছে। তারমুখে একরাশ হাসি, চুম্বকের মতো আকর্ষণ ক্ষমতা। মেয়েটাকে দেখে আমার বাস্তব মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ছুঁয়ে দিলেই মিলিয়ে যাবে। আমি গম্ভীর গলায় উত্তর দিলাম, জ্বি বলুন। আপনার নাম কি? সে চিৎকার করে প্রশ্ন করলো। বাতাসের শব্দে কথার স্পষ্টতা হারিয়ে যাচ্ছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ইলিয়াস। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে আমার পাশাপাশি এসে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কি মন খারাপ? না।
তাহলে এমন চুপচাপ গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছেন কেনো? অনেকক্ষণ যাবৎ খেয়াল করছি আমি। আমি মেয়েটার দিকে একবার তাকালাম কিন্তু কোনো উত্তর দিই নি। সে আবার জোরকন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কিছু বলছেন না যে? আমি একগালে মুচকি হেসে বললাম, কে আপনি? আমার নাম মাহিসা। ঢাকা থেকে এসেছি। আপু-দুলাভাইয়ের সাথে। মেয়েটা আগ্রহ নিয়ে বললো। আমি বিরক্তি ভাব নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করলাম, ও আচ্ছা। আপনার মন খারাপ, আমি বুঝতে পারছি। তাই নয় কি? আমার মন খারাপ থাকলে আপনি মন ভালো করে দিতে পারবেন? তা জানি না। তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেনো? কি করবেন আমার মনের অবস্থা জেনে? আপনার যদি সত্যি সত্যি মন খারাপ থাকে, তাহলে মন খারাপের কারণটা জানতে চাইবো।
সাগর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, একজন অপরিচিতাকে মন খারাপের গল্প বলবো, এটাও মন্দ নয়। ইনিয়েবিনিয়ে চুমকির কথা বললাম। মাহিসা আমার গল্প শুনে থমকে দাঁড়ালো। আমি হেঁটে অনেকটা এগিয়ে গেলাম। সে আর পিছু পিছু আসে নি। বোধয় গল্পটা শুনে তার খুব খারাপ অনুভূতি হচ্ছে। হয়তো মেয়েটার অত্যন্ত মন খারাপ হয়েছে। মন খারাপের ব্যাপারটা আসলে ছোঁয়াচে, এক জনের মন খারাপের প্রচারে অন্য জনেরও মন খারাপ হয়। কিন্তু অন্যের খুশিতে মানুষ নিজে খুশি হতে পারে না, উল্টো হিংসে করে। অদ্ভুত।
নাটকীয় হলেও সত্য, এই মাহিসাকেই আমি বিয়ে করেছি ছ মাস হলো। সেদিন সাগর পাড়ে প্রথম দর্শনের এক সপ্তাহ পর আমার ফেসবুক একাউন্টে ‘মাহিসা রহমান’ নামের একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। প্রোফাইল চেক করে নিশ্চিত হলাম এটা সেই মাহিসা। তার প্রোফাইল ফটো টা দেখে অবাক হলাম। প্রোফাইলে আমার ফটো দেয়া। সেদিন পেছন থেকে মাহিসা আমার হেটে যাওয়ার ফটো তুলেছিলো। তারপর দীর্ঘদিন কথোপকথন হলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার ভালোবাসায় আমি যথেষ্ট নরম হয়ে গিয়েছিলাম।
ধুর, চা টা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। চায়ের কাপে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখি পিঁপড়েটার লাশ। তবে সে আত্মহত্যাই করলো। বাঁচতে পারলো না। আঙুল দিয়ে পিঁপড়েটা সরিয়ে ঠাণ্ডা চা টাই খাচ্ছি। মাহিসা বাসায় থাকলে আরেক কাপ চা করে দিতে বলতাম। সে পরশু বাবার বাসায় গিয়েছে। আজকেই ফেরার কথা। টেবিলের ওপর আমার ফোনটা ভাইব্রেট হচ্ছে। অলসতা ভেঙে ফোনটা তুললাম। মাহিসার ফোনে এক পুরুষ কন্ঠ। বলছে, মাফিসা এক্সিডেন্ট করেছে। মাত্রই তাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালাম। উনার অবস্থা তেমন ভালো নয়। আপনি তাড়াতাড়ি পপুলার হাসপাতালে চলে আসুন।
আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। এটা ঠিক কষ্ট নয়, মনে হচ্ছে মৃত্যু যন্ত্রণা। আমি দৌড়ে সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে উল্টে পড়ে গেলাম। আবার উঠে পা টেনে টেনে দৌড়াচ্ছি। বাসার গেইট পর্যন্ত গিয়ে আমি থমকে গেলাম। হাটু ভেঙে ফ্লোরে বসে পরলাম। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত ক্লান্তি আমার উপর ভর করেছে। গেইটের বাইরে মাহিসা আর তার বাবার ড্রাইভার ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মাহিসা আমাকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলো। তার সহাস্যমুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেলো। কাতর কন্ঠে বলতে লাগলো, ইলিয়াস, আমি সরি। প্লিজ গেইটটা খুলো। প্লিজ তাড়াতাড়ি খুলো। বলতে বলতে মাহিসা কান্না করে দিলো। আমি গেইটটা খুলে দিতেই সে শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, আমার এমন করা মোটেও উচিৎ হয় নি। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ।
আমি পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছি। ধীরে ধীরে বললাম, এমন কেনো করলে মাহিসা? আর কখনো এমন করো না। এটা কোনো মজার বিষয় না। মাহিসা চোখ মুছতে মুছতে বললো, আমি মজা করি নি। আজ তোমার প্রেমিকা চুমকির মৃত্যুবার্ষিকী। আমি চাই আজ সারাদিন তুমি কষ্ট পাও। কষ্ট পেলে ভালোবাসার তীব্রতা বাড়ে। জানো তো, কষ্ট দু ধরণের। একটা শৈল্পিক, আরেকটা ধ্বংসাত্মক। তোমার কষ্টগুলো শৈল্পিক। কষ্টগুলোই তোমাকে একদিন শিল্পী বানাবে।