অবিশ্বাস

অবিশ্বাস

রাত দুইটার সময় দরজায় কড়া নাড়লাম।আমার স্ত্রী ঝুমু উৎসাহী মুখ নিয়ে দরজা খুললো।নিমিষেই ঝুমুর মুখখানা কালো হয়ে গেল।তার কারণটা হল শশী।এতো রাতে শশীকে নিয়ে বাড়ি ফিরবো এমনটা বাড়ির কেউই প্রত্যাশা করেনি।ঝুমু আমার হাতে থাকা ব্যাগটা নিয়ে পাশের রুমে চলে যাচ্ছিলো,এরইমধ্যে আমি শশীর ব্যাগটা হাতে নিলাম। বিষয়টা ঝুমুর খুব একটা পছন্দ হলো না।একটু পেছন ফিরে আবার পাশের রুমের দিকে হাঁটলো।শশী একটু ইতস্তত বোধ করেছিল সেসময়।

আমার পৌঁছানোর কথা ছিল রাত আটটায়।সেই কথা ভেবে ঝুমু রাতের খাবারের আয়োজন করেছিল।এতক্ষণ না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করেছে,তার উপর শশীকে আমার সাথে দেখতে পেল,সবমিলিয়ে ঝুমুর মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক।ভাবলাম সকালে সবটা বুঝিয়ে বলবো ঝুমুকে।খাবার টেবিলে আমাকে আর শশীকে খাবার দেওয়ার সময় একটাও কথা বললো না ঝুমু।শশী ঝুমুকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলে শুধু হু-হ্যাঁ করছিল ঝুমু।শশীকে পাশের রুমে শুতে বললাম।আর আমি চুপটি করে আমার বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

ঝুমু মনে হয় ঘুমের ভান করে ছিল।মাঝখানে আমাদের মেয়ে মেঘলা ঘুমিয়ে আছে।সকালবেলা বাবা-মা শশীর কথা শুনে খুশিই হয়েছিল।শশী বড়লোক বাড়ির মেয়ে ছিল।পাঁচ বছর আগে শশীর সাথে আমার বিয়ের কথা হয়েছিল।শশী আর আমার মধ্যে দেড় বছরের একটা রিলেশন ছিল।কিন্তু শশী যখন জানতে পারলো সত্যি সত্যি আমি ওকে বিয়ে করতে চাই তখন বেগড়া দিয়েছিল।বাবা-মা আজও ভাবে বিয়েটা ভাঙার পেছনে আমিই বেশি দায়ী।শশীর কোন দোষ ছিলনা।

ঝুমু আমাকে চা দেওয়ার সময় বলছিল,শশী যে তোমার সাথে একই অফিসে চাকুরী করে সেটা আমাকে জানাওনি কেন?শশী তখন রুমে ঘুমাচ্ছিল।যাক,ঝুমুর মুখে কথা ফুটলো অবশেষে!!!আমি বললাম,শশীর কথা জানতে পারলে তুমি কষ্ট পেতে পারো তাই বলিনি।তাছাড়া শশী এমন কি ইম্পরট্যান্ট পার্সোন যাকে নিয়ে আলোচনা করতে হবে!এই কথা বলে ঝুমুকে আমার পাশে বসালাম।

আমি আর শশী কালকে একই বাসে বাড়ি ফিরছিলাম।রাস্তায় হরতাল-অবরোধের কারণে এতোটা দেরী হল।তাছাড়া শশীর আমার আগে নেমে যাওয়ার কথা।কিন্তু দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।ঘুম ভেঙে দেখি শশীর বাড়ি ক্রস করে চলে এসেছি।তাই বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছি।এতো রাতে একটা মেয়েকে একা ছাড়া ঠিক হতো কি তুমিই বলো ঝুমু?ঝুমুর মনটা একটু নরম হল বুঝতে পারলাম।

বিয়ের পরপরই শশীর ব্যাপারে আমি ঝুমুকে সবটা জানিয়ে দিয়েছিলাম।মাঝে মাঝে বাড়িতে শশীর কথা উঠলে ঝুমুর মন খারাপ হতো।ঝুমু বেশী ধনী বাড়ির মেয়ে নয়।কোনসময় ঝুমুর কোন কাজ অপছন্দ হলে মা শশীর কথা বলে ঝুমুকে অপমান করতো।কারণ মা মনে-প্রাণে চেয়েছিল শশী এই বাড়ির বউ হোক।আগে মাঝে মাঝে শশী এই বাড়িতে আসতো।তখন আমাদের নতুন নতুন সম্পর্ক হয়েছিল।শশী বাড়ির সবার মন জয় করে নিয়েছিল।

শশী আরও তিনদিন আমাদের বাড়িতে থাকবে।কারণ হরতাল-অবরোধের জন্য কোন গাড়ি পাওয়া যাবেনা।আমি একটু বিরক্তই হয়েছিলাম।আমি চাইনা শশী আর একদিনও এই বাড়িতে থাকুক।শশী এই বাড়িতে এসে বাবা-মা আর বড় আপু টুম্পার সাথে ঠিক আগের মত মিশে গেল।মেঘলাকেও নিজের মেয়ের মত আদর করা শুরু করলো।

আর ঐদিকে ঝুমু সারাদিন রান্নাঘরে কাজ করতো।চোখের সামনে এসব দেখে ঝুমুর খারাপ লাগতো।তাই আমি ঝুমুকে খুশি রাখার জন্য ওকে একটু বেশি সময় দিতাম।শশী আমাদের এসব দেখে মনে মনে হিংসেও করতো কিছুটা।হয়তো ভাবতো ঝুমুর জায়গায় আজকে আমি থাকতে পারতাম।শশী অনেকসময় ইচ্ছে করে ঝুমুকে বুঝাতে চাইতো তার দাম এই বাড়িতে ঝুমুর চেয়ে বেশী।এমনকি এটাও বুঝাতে চায় যে আমি আজও শশীকে ভুলতে পারিনি।

ঝুমু লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো।রাতে বারান্দায় শশী আকারে-ইঙ্গিতে বুঝাতে চায়ছিল সে আমাকে খুব ভালোবাসে,সে তার কাজের জন্য লজ্জিত।কিন্তু আমি জানি শশী একটা স্বার্থপর মেয়ে।আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলাম।স্বার্থের জন্য আমাকে ছেড়ে অন্য সম্পর্কে জড়িয়েছিল।বিয়েটা ভেঙেছে শুধুমাত্র শশীর জন্য,যা আজও কাউকে বলিনি।

কারণ আমি শশীকে সেদিন দয়া করেছিলাম।সে আমার কাছে করুণার পাত্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।মাঝখানে ওর সাথে কোন যোগাযোগ ছিলনা।অফিসে আবার দেখা হল।সেখানে আমাকে তার দুঃখের কাহিনি শুনাতো।তখনও আমি তাকে দয়া করতাম।আজও দয়া করে বাড়িতে এনেছি।ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে তাই করতাম।শশী তুমি আমার কাছে স্পেশাল কেউ না।ঝুমুই আমার জীবনের স্পেশাল মানুষ!!!

সবকিছু স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়ার পর শশী পরেরদিন বাড়ি ছেড়েছিল যদিও তখন হরতাল চলছিল।কারণ শশীকে আমি কোন সুযোগ দেইনি,তার ফেরার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। রাতে ঝুমু আমার হাত ধরে কাঁদছিল আর বলছিল আমাকে মাফ করে দিও আরমান।আমি তোমাকে অবিশ্বাস করেছিলাম। বুঝেছি গতরাতে ঝুমু আমার আর শশীর সব কথা তাহলে শুনতে পেয়েছে।ভালোই হয়েছে শুনে।কারণ ঝুমু যে আমার জীবনের একমাত্র পরম কাছের মানুষ এরচেয়ে ভালোভাবে বুঝাতে পারতাম না।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত