আমার এই চিঠিটা তোমার কাছে পৌঁছার আগেই নিশ্চয়ই জেনে গেছ সবকিছু। কষ্ট পেয়েছ? এরকম একটা ঘটনায় সবাই যেখানে কষ্ট পাচ্ছে, তোমার পাওয়াটাও অস্বাভাবিক না। আর এ ঘটনাটা ঘটানো, তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্যই। আমি চাই তুমি কষ্ট পাও। আজীবন কষ্ট পেয়ে যাও। আমি যে কষ্টটুকু তোমার কাছে পেয়েছি তার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। জানি, তুমি হয়তোবা ইচ্ছে করে আমাকে কষ্ট দাওনি। তুমি হয়তো বুঝই না কিসে কষ্ট হয় আর কিসে হয় না। তবু আমি চাই তুমি কষ্ট পাও। আমি শোধ নিতে চাই, শোধ।
মানলাম আমরা দু’জন মানুষ। দুজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, চাওয়া-পাওয়া দু’রকম হতেই পারে। কিন্তু আমরা যে একে অন্যকে ভালবাসি। শুনেছি, এটা এমন এক সম্পর্ক যেখানে পৌঁছালে দু’জনার সব চাওয়া-পাওয়া এক হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কেন হল না? তবে কি আমাদের ভালবাসায় কোন খাত ছিল? কই? আমি তো আমার নিজের মধ্যে সেটা কখনো ফিল করিনি। আমি তো সবসময় তোমার জন্য কিছু করতে প্রস্তুত ছিলাম। আমি তো সব সময় নানাভাবে বুঝাতে চেয়েছি যে, তোমাকে ছাড়া আমার কিছুই আর চাওয়ার নেই। আমার একদিকে পৃথিবীর সব ধন-দৌলত, আনন্দ, স্ফুর্তি, আর অন্যদিকে, তোমাকে রেখে যদি বিধাতা বাছাই করতে বলতেন, তোমাকে চেয়ে নিতে তো আমার এক দন্ডও লাগতো না। আমার একটাই চাওয়া ছিল। সে তুমি। শুধু তোমাকেই চাইতাম। কিন্তু তুমি তো কখনো এমনটা বলতে পারনি। মিথ্যে করেও পারনি। অর্থূ, বিত্ত, মর্যাদা, বন্ধু-বান্ধব, বাবা-মা, ভাই-বোন কোন কিছুই ছাড়তে চাওনি তুমি। সব কিছুর সাথেই তুমি আমাকে চাইতে। তুমি বলতে, আমার প্রতি তোমার যে অনুভূতি আর সবার প্রতিও তোমার সমান অনুভূতি। অনুভূতির ধরণটাই যা ভিন্ন। কিন্তু আমার মধ্যে তো এমনটা ঘটেনি। তোমার মাঝেই তো আমি সবকিছু খুঁজে পেয়েছিলাম। না কি, এরকম সম্পর্ক নিয়ে আমার ধারণাগুলোই ভুল ছিল। আমি যেভাবে আচরণ করেছি তোমার সাথে, তবে কি সেটা দোষের পর্যায়ে পড়ে? আমার দশটা মিসড কলের উত্তরে একটি পেলে কি মন খারাপ করা উচিত না? কল করে যখন ওয়েইটিঙে থাকতে হতো মিনিটের পর মিনিট তখন কি খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক না? তোমার কথায় ফারাক পেলে প্রশ্ন করাটা কি অন্যায়? কি জানি? আমি ওতোসব বুঝতে পারতাম না। মন খারাপ হলে আমি শুধু সেটা প্রকাশ না করে থাকতে পারতাম না। আর সেটাই বোধ হয় ভুল ছিল।
তোমার এসব ছোটখাটো কিছু কথাবার্তায়, কিছু কেয়ারলেস আচরণে, আমার মন খারাপ হয়ে যেতো মূহুর্তে মূহুর্তে। কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি কষ্ট পেয়ে। না খেয়ে কাটানো তো নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিল। অথচ তুমি দিব্যি হেসে খেলে কাটাচ্ছিলে সময়টা। আমি যখন গভীর রাতে একটা মোবাইল কার্ডের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতাম সারাটা শহর, তুমি তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে। আমি যখন তোমার গায়ের গন্ধ পাবার লোভে তোমার ব্যবহৃত অধোঁয়া একটা জামা চাইতাম তুমি হেসে বলতে, ঘামের গন্ধ না নিলেই কি না! এসব তোমার কাছে পাগলামি মনে হতো। আমি সত্যি আর পারছিলাম না। তাইতো আমার এই সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তটা, জানি, তোমার দৃষ্টিতে বাড়াবাড়ি। সবার দৃষ্টি তো আর এক হয় না। তোমার মতো অতোটা প্র্যাকটিক্যাল আমি কখনো হতে পারবো না। কত চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি ব্যর্থ। সম্পূর্ন ব্যর্থ। আমাকে ক্ষমা করো তুমি। তোমার মতো সহজ-সরল চোখে কোনকিছু দেখা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না কখনো। আমার মনটা যে ভীষণ ছোট (তোমার মতে)! তাই তো আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে সুখী থাকতে দেব না কখনো। সে জন্যই আমার এ ব্যবস্থা।
তোমার বয়েস এখন বিশ। ধরে নিচ্ছি, তুমি আরো পঞ্ছাশ বছর বাঁচবে। সে হিসেবে আমি পঞ্ছাশ টা চিঠি ইতোমধ্যেই লিখে ফেলেছি। আমার বন্ধুদেরকে নির্দিষ্ট সময়ে জানিয়ে দেব তারা যাতে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে একটি করে চিঠি তোমার ঠিকানায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে। তুমি যেখানেই যাও, এ ব্যবস্থা থেকে
মুক্তি পাবে না। প্রতি বছর ওই দিনটিতে তুমি একটি করে চিঠি পেতে থাকবে, যা তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেবে এ পৃথিবীতে এমন কেউ একজন ছিল সে সবকিছুর উর্ধ্বে তোমাকে ভালবাসতো। তোমার ভালবাসার জন্য আর সবকিছুকেই সে অগ্রাহ্য করতে পারতো। তুমি তখন চাইলেও আর তাকে পাবে না ; সে যে এ দিনেই আত্মহত্যা করেছিল।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক