ট্রেনে উঠেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। দেখলাম আমার সিটে আমার সমবয়সী একটা অপরিচিত মেয়ে বসে আছে। বসে আছে বললে ভুল হবে ঘুমিয়ে আছে। এত কষ্ট করে সিরিয়ালে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে টিকিট কেটে মানুষের ঠেলাঠেলি সহ্য করে এ পর্যন্ত আসার পর মানবিকতা আর কতটুকুই বা থাকতে পারে? ঢাকা থেকে যাচ্ছি কিশোরগঞ্জ। এরপর তাড়াইল যাবো। কি করবো বুঝতে পারছিনা। আর ঘুমন্ত একটা মানুষকে ডাক দিতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। তাছাড়া মেয়ে মানুষ। পাশে বসে থাকা লোকটার সাথে মেয়েটার চেহারার মিল আছে বলে অনুমানের উপর ভিত্তি করে জিজ্ঞেস করলাম “ভাই উনি কি আপনার কেউ হয়?” তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “জ্বী আমার ছোট বোন।” ও, আসলে সিটটা আমার ছিল।”
উনি তাড়াহুড়ো করে উঠে বললেন, “ভাই দুঃখিত কিছু মনে করবেন না। আপনি আমার সিটে বসুন। আসলে ও ঘুমোচ্ছে তো আর কিছুটা অসুস্থও বটে।” আমি বললাম “আপনার উঠতে হবে না কিছুটা চেপে বসলে চলে যাওয়া যাবে। ” উনি কৃতজ্ঞতামূলক হাসি দিয়ে চেপে বসলেন। ট্রেনে প্রচন্ড ভিড়। আশেপাশের মানুষজনের হাউকাউ শুনে মেজাজ আরো খারাপ হচ্ছে। এত ভিড়ের মধ্যে কারো কষ্ট বুঝার সময় কারো নেই। সবাই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
সামনের সিটে বেশ কয়েকটা অল্প বয়সী ছেলে-মেয়ে কারণে-অকারণে হাহাহা করে উচ্চশব্দে হেসে যাচ্ছে। অদ্ভূত এক যন্ত্রনা। পাশে একটা লোককে দেখলাম অবাক হয়ে একটা ছোট্ট মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটার গোঁফ গুলো অনেক লম্বা লম্বা। উনাকে দেখেই মনে হবে কোন এককালের নামকরা ডাকাতদের বংশধর উনি। মানুষের চেহারা দেখে রাগ করা ঠিক না। এটা একটা মন্দ কাজ। কিন্তু আমি খুবই দুঃখিত এই লোকটার চেহারা দেখে আমার কেন যেন রাগ হচ্ছিল। লোকটার থেকে আরও দুটো সিট সামনে একটা ৫-৬ বছরের বাচ্চা মেয়ের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছা হচ্ছিল জিজ্ঞেস করি, “আপনার সমস্যা কী? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
কিন্তু জিজ্ঞেস করলাম না। ট্রেনে যাত্রীদের অদরকারী কথাগুলো এদিক থেকে সেদিকে মোড় নিচ্ছে কিন্তু শেষ আর হচ্ছে না।
বিরতি নিয়ে অনেকক্ষণ পর আবার তাকিয়ে দেখলাম লোকটি এখনো তাকিয়েই আছে বাচ্চাটির দিকে। বাচ্চাটার আত্মীয় হতেই পারেনা এই লোক। ছদ্দবেশী ছিনতাইকারী কিনা সন্দেহ হচ্ছে। মেয়েটাকে নিতেই হয়তো উঠেছে এই কামড়াতে। এসব ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকলো। আমি অবশ্য একটু অতিরিক্ত ও অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা করাতেও পটু।
আমি একটু পর পর খেয়াল করলাম, ছোট্ট মেয়েটাও লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা হাসলে লোকটাও হাসে। অবাক করা ব্যাপার। তখন একটা ঘটনা ঘটলো। ওই ছোট্ট মেয়েটার বাবা এসে গোঁফওয়ালা লোকটাকে ধমকের সুরে বলল, ” আপনার সমস্যা কী? বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখলাম আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন, সেটা ভালো কথা। কিন্তু এবার দেখলাম হাতে কি একটা ইশারা দিচ্ছেন। আপনার আসলে সমস্যা কি? আপনাকে দেখে তো সন্দেহ হচ্ছে। মেয়েটার বাবা একটু জোরে কথাগুলা বলছিল। আর এইসব শুনে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আশেপাশের লোকজন এসে ঘিরে ধরল। কেউ কেউ বলতে লাগলো ” ওকে দেখেই মনে হচ্ছে কোন একটা ধান্দাবাজ। ওর সমস্যা আছে ওকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। ”
আবার পিছন থেকে আরেকটা কমবয়সী ছেলে বলল ” ছেলে ধরা লোক ও। দেখেননা কেমন বিদঘুটে। ” আমিও বুঝতে ছিলাম যে খুব জঘন্য কিছু হতে যাবে। শিক্ষা পেয়ে যাবে এই লোক। কিন্তু কে জানত এটার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। তখন গোঁফওয়ালা লোকটা করুণ সুরে ছোট্ট মেয়েটার বাবাকে বললো, “ভাইজান গো আমার মাইয়াডা ঠিক আপনার মাইয়ার বয়সি আছিল।
ঠিক এমন কইরা আমারে আব্বা আব্বা ডাকতো। ডাইকা ডাইকা ঘর বাড়ি মাথায় তুলতো। মা হারা এই মাইয়ার দিকে তাকাইয় আর কোনো বিবাহ করি নাই জীবনে। নিজে খায়া না খায়া ওরে পালছি। আমার মাইয়াডা জানেন, কি একটা অভিমান ছোট্ট বুকটার মধ্যে লইয়া চইলা গেল। কত হাসপাতালে দৌড়ালাম। পেটের ব্যাথা আর আমার মাইয়ার কমলো না। সেদিন রাতে আমারে কইল আব্বা আমার কাছে একটু শুইবা। আমি আমার মায়ের কাছে শুয়ে মাথায় হাত বুলাইয়া বুলাইয়া কইলাম, ” মারে তোর কি কষ্ট লাগে? ” আমার মাইয়া কইলো, ” আব্বা আমারে সেই রাজার গল্পটা কইবা।” আমি আরম্ভ করলাম সেই রাজার গল্প। ভাইজানগো রাজার গল্প শেষ না হইতেই আমার মাইয়াডা এই দুনিয়া ছাইড়া চইলা গেল।” এসব বলে লোকটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। উনার কান্না দেখে আমার পাষাণ হৃদয় পাশাপাশি আরও যাদের পাষাণ হৃদয় ছিল সব মনে হয় বরফের মতো গলে গেলো।
মূহুর্তে বগির সব মানুষ যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। কয়েকটা বৃদ্ধা মহিলা চোখ মুছতেছে শাড়ির আঁচল দিয়ে। সামনে থাকা কমবয়সী ছেলে মেয়েগুলা হা করে তাকিয়ে আছে এদিকে। সবাই নিশ্চুপ হয়ে এই সন্তানহারা পিতার চোখের অশ্রুতে নিজেদের ভুলগুলো দেখতে পেয়ে যেন লজ্জা পেয়ে গেল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওই ছোট্ট মেয়েটা এই অচেনা অপরিচিত সন্তানহারা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। ছোট্ট মেয়েটার বাবাকে দেখলাম নিজের মেয়ের এই কান্ড দেখে কেঁদে দিয়েছে। করুন সুরে উনাকে বললেন, ” ভাইয়া কিছু মনে করবেন না। আমি আপনাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমায় ক্ষমা করুন। আমার এই একটা মেয়ে। আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন।”
লোকটা মেয়েটার মাথায় হাত রেখে চোখ মুছতে মুছতে বললো, “দোয়া করি মা বেঁচে থাকো, সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকো। অনেক দিন বেঁচে থাকো।”
পরের স্টেশনে যখন লোকটি নেমে গেল আমি খুব সূক্ষ্মভাবে উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দেখলাম যাওয়ার সময় ছোট্ট মেয়েটার মুখটার দিকে কিভাবে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লোকটার চোখ গুলো টলমল করছে। হয়তো এই মেয়েটার মাঝেই তার হারানো মেয়েটাকে খুঁজে পেয়েছিল। ট্রেন থেকে নেমে ধীর পায়ে সামনের রোদ্রভরা রাস্তাটার দিকে হাঁটতে লাগলেন। আর বারবার ফিরে ফিরে জানালার একটু ফাঁক দিয়ে মেয়েটাকে দেখতে চাচ্ছিলেন। হয়তো দেখতে পারেননি আর। তবে আমি দেখেছিলাম ওই লোকটিকে, একটা সন্তান হারা পিতাকে, এক পাহাড়সম কষ্টের চাপে বের হওয়া অশ্রুকে।