কি এটা? আমি কি কাইন্ডলি দেখতে পারি?”
.
ভয়ার্ত কন্ঠে ঈশিতা তার সামনে থাকা পুলিশ ইন্সপেক্টরকে প্রশ্ন করল। লোকটার হাতে ডায়রি টাইপ কিছু একটা,আনিসার তোষকের নিচে পাওয়া গেছে। পুলিশ গুলো পুরো বাসা উল্টেপাল্টে দেখছে কোনো ক্লু পাওয়া যায় কিনা। ওদিকে আনিসার মা বিলাপ করে কাঁদছে, “কেন তুই এমন করলি রে মা, তোর কিসের অভাব ছিল? আমি এখন কারে নিয়া বাঁচব রে, একবার আমারে বলতে পারতি তোর কি চাই,কেন আমারে ছেড়ে গেলি মা……”
মহিলার অভিনয় দেখে ঈশিতার গা জ্বলে যাচ্ছে। তাকে আনিসার সাথে কখনো হাসিমুখে একটা কথা বলতেও দেখেনি,সে আবার এখন জানতে চাচ্ছে আনিসার কি চাওয়া ছিল? ভ্রু কুঁচকাতে গিয়েও নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পেল সে। আনিসাকে হয়তো তিনি কখনো সময় দেননি, তবুও তিনি তো একজন মা! একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে মায়ের মন কিভাবে আর শান্ত থাকবে?
ভাবনা বাদ দিয়ে ঈশিতা ডায়রিটার পাতা উল্টালো। ডায়রির মলাটটা হাতে বানানো, বেশ সুন্দর। আনিসা হাতের কাজ করতে পছন্দ করত। ডায়রিতে কোনো তারিখ দেয়া নেই, এলোমেলো লেখা।
“ইদানিং কিছু অদ্ভুত ইচ্ছা হয় আমার। হাসান স্যারের ক্লাসগুলো টু মাচ বোরিং। উনি বেশ ট্যালেন্টেড কিন্তু সেটা বোঝানোর ক্ষমতা নেই তার। আমার খুব ইচ্ছা করে উনার লেকচারের সময় সামনে গিয়ে বলি, আপনি কি একটা বলদ? মাথায় তো মনে হয় গোবর ছাড়া কিচ্ছু নাই। এসব কি কচু পড়ান? বের হয়ে যান ক্লাস থেকে, আর কোনদিন আমাদের ক্লাস নিতে আসবেন না। খুব বেশি ইচ্ছা করে কথাগুলা শোনার পর ওনার হতভম্ভ হওয়া মুখটা দেখতে। নিজেকে কন্ট্রোল করা খুব কষ্টকর হয় তখন……”
.
“আজ যখন আলিফ এসে বলল, আনিসা তুমি কি জানো,তুমি পুরাই সিক?শুনে আমার খুব হাসি পেল। এটাই তো শুনতে চাচ্ছিলাম!উফ এর জন্য আলিফের বন্ধুদের কাছে কত মিথ্যা যে বলতে হয়েছে! আলিফ নেশা করে, ওর আরো ছয়টা গার্লফ্রেন্ড আছে, বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফুর্তি করে, আরো কত কি! আলিফ ক্যাম্পাসের বেস্ট বয়দের মধ্যে একজন। সেদিন পিয়া বলল,আমার নাকি সাত জনমের ভাগ্য যে আলিফের মত ছেলে আমাকে ভালোবাসে। তখন কেন জানি সবার সামনে ওকে খুব খারাপ বানাতে মন চাইলো। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না কিছুতেই। জানি আলিফ এখন আমাকে ঘৃণা করে। হোয়াটেভার, আই ডোন্ট কেয়ার।“
এতটুকু পড়ে ঈশিতার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল।ক্যাম্পাসে আলিফের এ অবস্থার জন্য পেছনে তাহলে আনিসাই…!!
আর ভাবতে পারছেনা সে। আনিসা ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সেই কলেজ লাইফ থেকে। প্রাণবন্ত, মিষ্টিভাষী, সুন্দরী, বন্ধু অন্তপ্রাণ। অথচ ডায়রির পাতা এসব কি বলছে! হাতের লেখাও আনিসার। ঈশিতা পৃষ্ঠা উল্টালো।
.
“আজ হঠাত করে খুব ইচ্ছা হল রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাই। কি হবে এরপর? মরে যাব? কেউ কি কাঁদবে আমার জন্য? কে বেশি কাঁদবে,বাবা নাকি মা? রহমান স্যারের ক্লাসে মনটা কেমন যেন করতে লাগল। ইচ্ছে করছিল স্যারকে দাঁড়িয়ে বলি, ইউ আর অ্যা সিক। ডু ইউ নো দ্যাট? নয়তো বলি, ইউ আর লুকিং সো হ্যান্ডসাম স্যার!এজ লাইক শাকিব খান। আপনার অপু বিশ্বাস কই স্যার? এরপর কি হবে? ক্লাসের সবাই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাবে। এটাই আমার দেখতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এরপর কেউ আর আমার সাথে কথা বলবে না!না বলুক গে,পেইন একেকটা! আমার একা থাকতেই ভালো লাগে।”
“আজ ইচ্ছা করেই হাতে ছুড়ি চালালাম। কেন জানি নিজের রক্ত দেখতে মন চাচ্ছিল খুব। বাবার চিল্লানি শুনতে মজাই লাগছিল!লোকটা আমাকে সত্যিই ভালোবাসে, কিন্তু সময়ের অভাবে বোঝাতে পারেনা, বেচারা! এখন আমার বাবার হাতটাও কেটে দিতে ইচ্ছা করছে! আমি কি স্যতিই সিক? পাগল হয়ে গেছি আমি? নয়তো কেন এসব ইচ্ছা হচ্ছে আমার? সেদিন ঈশিতা আর বয়ফ্রেন্ডকে দেখে এত রাগ লাগছিলো, ইচ্ছা হচ্ছিল এখানেই ওদের ব্রেকআপ করিয়ে দেই। আরাফের হাতটা ধরে বলি, উইল ইউ ম্যারি মি? যদিও আমি ওকে বিয়ে করবোনা! মানুষের সুখ সহ্য হয়না একদমই, পাগল হয়ে গেছি আমি।“
ঈশিতা ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে।কয়েকদিন আগে ক্যাম্পাসে সবার সামনে আনিসা আরাফকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে,”কেন তুমি আমার সাথে চিট করলে?ঈশি কি আমার চেয়েও সুন্দর?প্লিজ আমার কাছে ফিরে এসো। আই মিস ইউ আরাফ।“ ঈশিতার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল, সেদিনই সম্পর্ক ছিন্ন করে আরাফের সাথে। আরাফ অনেক বুঝিয়েও ওকে টলাতে পারেনি। সেদিনের পর ঈশিতা ক্যাম্পাসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, আনিসার সাথেও আর যোগাযোগ রাখেনি। সে ভেবেই পাচ্ছিল না এত ভালো, হাসিখুশি মেয়েটার কেন এই পরিবর্তন। আজ সকালে হঠাত ওর বাবার ফোন,”আনিসা সুইসাইড করেছে।“ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না ঈশিতা। এই আনিসা সবাইকে ইন্সপিরেশনাল গল্প শোনাতো, মোটিভেট করতো হতাশা কাটিয়ে উঠতে, সেই আনিসাই সুইসাইড কিভাবে করতে পারে!কাঁপা হাতে শেষ লেখাটা উল্টালো সে।
.
“আজ রিকশায় উঠতেই চাকা পাংচার হয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিল আমি একটা কুফা। মা এটা প্রায়ই বলে। আজ বলছিল আমাকে নাকি সাইকোলজিস্ট দেখাবে।কত্ত বড় সাহস তার,আমাকে সে পাগল ভাবে?শেষ কবে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়েছিল ভুলে গেছি, সে আবার আমাকে নিয়ে ভাবতে বসেছে। শো অফ না করলে তাদের চলেনা।
আমার কি আসলেই কোনো অসুখ হয়েছে?কেন এসব অদ্ভুত ইচ্ছা হয় আমার? আজ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে নাচতে ইচ্ছা করছিল। বাসে সামনের লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল শুধু শুধুই। এই লোকটা মরে গেলে তার পরিবার কিভাবে কাঁদবে?দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে! আমি কি দিনদিন খুনি হয়ে যাচ্ছি? যাই হোক, আমার এখন ইচ্ছা করছে স্লিপিং পিল খেতে। আমার অবশ্য ভালোই ঘুম হয়, তবু এক্সপেরিমেন্ট আর কি। ১০টা ট্যাবলেট যথেষ্ট নিশ্চয়ই এক্সপেরিমেন্টের জন্য!এর আগে আমার হিয়ার মাঝে গানটা শুনে নিলে কেমন হয়? হতে পারে এটাই আমার শেষ গান শোনা!”
উদ্ভ্রান্তের মত পুলিশের হাত থেকে আনিসার ফোনটা কেড়ে নিয়ে সে মিউজিক প্লেয়ারে ঢুকলো, লাস্ট প্লেইড সং “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে……”
.
“আনিসা সুইসাইড করেনি, ওর উদ্দেশ্য সুইসাইড ছিলনা, এটা একটা এক্সিডেন্ট”-চেঁ
চিয়ে উঠল ঈশিতা। “ও মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল,নিশ্চয়ই সে অসুস্থ ছিল….ও সবার মন বুঝতো, কিন্তু কেউ ওকে বোঝেনি। শেষ মুহূর্তগুলোতে কেউ ছিলনা ওর পাশে, আমিও না……ক্ষমা করে দিস বন্ধু……”
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক