ঝটপট হাতের কাজগুলো সেরে ফেলে তিতলি। মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। শাশুড়ির ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ,দরজাটা বাইরে থেকে টেনে দেয় তিতলি। এটা তার রাত্রের শেষ কাজ। নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে বসে নাইট ক্রিমটা মেখে নেয় হাল্কা করে। দু’বছরের ছোট্ট তিন্নি গভীর ঘুমে মগ্ন। মেয়ের পাশে ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দেয় তিতলি। দীর্ঘক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসেনা তার । বেড সাইড টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে সময়টা দেখে নেয় সে। ১১টা ৩০ বেজে গিয়েছে কখন । তিন্নির জন্মের পর থেকেই আবির অন্য ঘরে থাকে। সম্পর্কের মিষ্টতা কখনোই গড়ে ওঠেনি তিতলি আর আবিরের মধ্যে। সকাল সকাল উঠতে হবে তাকে , কাজের মেয়েটা বেল বাজিয়ে না পেলে আবার অন্য বাড়ির কাজে পালাবে । এমন করেওছে সে কয়েকবার। বিকেলে এসে আবার কতরকমের কথা শোনাবে মহারানী। নাহ্ বিদ্রুপ করে নয় ভালোবেসেই বছর কুড়ির মেয়েটিকে তিতলি মহারানী বলে ডাকে।
নাহ্ কিছুতেই ঘুমটা আসছেনা আজ । বিছানা ছেড়ে গুটিগুটি পায়ে ঘর লাগোয়া ঝুলন্ত বারান্দায় এসে দাঁড়ায় তিতলি। এখান থেকে রাতের শহরটাকে কেমন মায়াবী লাগে তার । পাঁচতলা এই ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটে বড্ড মন কেমন করে তার। দীর্ঘ সাত বছর পর মৃণালকে দেখার পর থেকেই মনটা উতলা হয়ে আছে তিতলির। সেদিন স্কুলে ঢোকার মুখেই দেখা হয় তার সাথে । গার্লস স্কুলের ঠিক পাশেই বয়েজ স্কুলে নতুন জয়েন করেছে মৃণাল।
এক্কেবারে ছোটবেলা থেকেই মৃণাল আর তিতলির একসাথে বেড়ে ওঠা। একই স্কুল টিউশন। লাজুক মৃণালের মনের কথা যখন জানলো তিতলি, তখন ক্লাস টুয়েলভ্। প্রজাপ্রতির ন্যায় সদ্য রঙিন পাখনা গজানোর সময় । দুজনের বন্ধুত্ব গভীর থাকলেও প্রেমটা ঠিক আসেনি তিতলির। সুন্দরী তিতলির কলেজ জীবনে নিত্য নতুন প্রেমের স্বাদ। গগনচুম্বী স্বপ্নের আনাগোনা রঙিন চোখে। কতদিন মৃণাল এসে দাঁড়িয়েছে তিতলির কলেজের গেটে ,একসাথে ঘরে ফেরার আশায়। সে তখন বুঝতেও পারেনি আসলে মৃণাল তাকে দেখার বাহানায় এসেছে। অবাক হয়ে তিতলি বলেছে- কীরে এখানে কেন?
-এইখানে কাজে এসেছিলাম। তাই এলাম একটু।
লাজুক মৃণালের উত্তর শুনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি তার। কতদিন অনেক রাত্রে ফোন করেছে সে। তিতলি বিরক্ত হতো খুব। বন্ধুদের কাছে মৃণালের তাকে নিয়ে পাগলামির কথা শুনেছে কতো। মায়া হয়েছে তিতলির দু’দিন পর পর কথা বলে আবার এড়িয়ে গিয়েছে। মৃণালের প্রতি প্রেমে পড়া যায় এমন সমস্ত কারণ উপস্থিত থাকলেও ,তিতলির ভালো লাগেনি কখনও। কলেজ শেষে বিয়ের দিন ঠিক হতেই একদিন অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। নাহ্ নাহ্ করেও কলটা রিসিভ করে তিতলি। তারপর সবটুকু চমক।
-তুই ভালো থাকবি বিয়েতে? মৃণালের আওয়াজ চিনতে সময় লাগেনা তিতলির।
-হ্যাঁ। কেন বলতো?
-তুই কী কখনোই আমাকে ভালোবাসিসনি?
-দেখ মৃণাল তোকে আমি ভীষণ পছন্দ করি ,কিন্তু প্রেমটা ঠিক আসেনা রে। কিছু মনে করিসনা । আসবি বিয়েতে কেমন।
ফোনের ওপারে মৃণালের হৃদয় কুঁকড়ে গুমরে মরেছে। ভালোবাসার মানুষটিকে বোঝাতেও পারেনি। বিয়েটা হয়ে গিয়েছে তিতলির। নিজেকে চিনতে অনেক দেরী হয়েছে তিতলির। কালের ঢেউ বয়ে গিয়েছে দুটি জীবনে। অভিমানে দূরে সরে গিয়েছে মৃণাল। ফোন নাম্বার সহ প্রোফাইলটাও বদলে ফেলে। হারানোর পরেই প্রেমটা বুঝেছে তিতলি। তার সমস্তটা জুড়ে শুধুই মৃণাল। মনখারাপীর মেঘলা দিনে হৃদয় যখন স্তব্ধ হতে চেয়েছে, মৃণালকে খুঁজেছে দু’নয়ন। আশ্রয় খুঁজেছে মন্দলাগাগুলো মৃণালের পুরুষ্ঠ বুকের খাঁজে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে তিতলি। কোথাও পায়নি তাকে। বিবেকের খচখচানী থেকেই গিয়েছে। সেদিন বাসে ওঠার সময় মৃণাল এসে দাঁড়িয়েছিল পাশে। ভীড় বাসে মানুষের ধাক্কা থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতেই ম্যানেজ করেছিল বসার জায়গা। তারপর লাজুক অভিমানী মুখে বলেছিল,
-ভালো আছিস? কেমন চলছে সংসার ! কতো খুঁজেছি তোকে, পাইনি আর! কথা বলারও চেষ্টা করেছি ,হয়ে ওঠেনি।
-অভিমানে আমিও বদলেছি সব কিছু। আমি বড়ো ভালো আছি। আর তুই? কী খবর তোর? বিয়ে করেছিস?
-হ্যাঁ। ভীষণ অভিমানে বিয়ে করেছি। ইতস্ততঃ করে বলে মৃণাল।
বিয়ের কথা শুনে বুকের ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হলেও বুঝতে দেয়নি তিতলি। যাকে প্রতিটি পদক্ষেপে শুধু এড়িয়ে গিয়েছে একসময় ,বিয়ের পরেই তাকে অনুভব করেছে তিতলি।ফোন নাম্বার বিনিময় করে করে নেমেছে আপন গন্তব্যে। ইচ্ছেগুলোকে সময়ে বুঝতে পারলে আজ হয়তো সবটাই অন্যরকম হতো। মৃণালকে সে ভীষণ ভালোবাসে। আটপৌরে জীবনের প্রতি ছন্দে সেটি বুঝেছে তিতলি।
অনেক ঘাটাঘাটি করে তৃপ্তির বর্ণনা অনুযায়ী মৃণালের প্রোফাইলটা খুঁজে পেল তিতলি। মুঠোফোনের স্ক্রিন জুড়ে মৃণাল ,তার অন্তর,শৈশব, যৌবন,বাল্যকালের আবেগ, গোপন প্রেম। পুরো প্রোফাইল ঘেঁটে প্রতিটি ছবির সাথে সাথেই আভ্যন্তরীন অনুভূতি গুলো বহিঃপ্রকাশ ঘটে, দুচোখ ছাপিয়ে অশ্রুধারা। আজ খুব ইচ্ছে করছে মৃণালের সাথে কথা বলতে। ইচ্ছে করছে আবেগগুলো ঢেলে দিতে। অপ্রকাশিত মনের অনুভূতিগুলোয় ভরিয়ে দিতে। অনেকগুলো দিন শুধু কষ্টই দিয়েছে সে মৃণালকে,আর আজ যখন সবটুকু জানা তখন মুক্তির পথগুলো বন্ধ। কিন্তু কথাগুলো বলতেই হবে তাকে। নিজেকে সংযত করতে পারেনা তিতলি। মধ্যরাত্রি হলেও একটা জেদ চেপে বসলো মাথায়। দেখতে দেখতেই কল করলো মৃণালের নতুন নাম্বারে। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হলো কলটা।
-কী হয়েছে তিতলি? কোনো সমস্যা? তিতলি নীরব ।
-তোর সংসার ভাঙতে আসিনি আমি। আমি মিউচুয়াল টান্সফারের ব্যবস্থা করবো। চিন্তা করিসনা।
-খুব মহান সাজছিস আজ। কেন সেদিন জোর করলিনা আমাকে! সারাটা জীবন এভাবেই কষ্ট পাবো আমি? আমি তোকে ভালোবাসিরে,বুঝতে পারিনি শুধু! সবটা আবার বদলে গেলে কেমন হয়! দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার, সব জেনেও শুধুই কর্তব্য পালন করে চলেছি।
-যেটা হওয়ার ছিলোনা সেটা আর কখনও হবেনা। তার চেয়ে থাকনা তুই অন্তরে, যেখানে আর সবার প্রবেশ নিষেধ। ভেবে নে কাল বৈশাখী আমি ,না বুঝেই তচনছ করে দিলাম সব কিছু। আবার নতুন করে গুছিয়ে নে সংসারটা। আর কখনও কল করিসনা আমায়। হৃৎপিণ্ডটা অবুঝ বড্ড!! কেটে গিয়েছে ফোন অনেকক্ষণ । নীরবে মৃণালের ছবির দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিতলি। ভাঙ্গা গড়ার জীবনে,তার শুধুই ভাঙন।
-মা,আঙ্কেলটা কষ্ট দিয়েছে তোমায়?
তিন্নি কখন এসে দাঁড়িয়েছে পাশে সে বুঝতেও পারেনি। ফোনটা আফ করে তিন্নিকে বুকে টেনে নেয় তিতলি। ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে আজ তার। মনটাকে বুঝিয়ে নিলো সে খানিক। যার উপস্থিতি হৃদয়ে সে থাকনা মনের গহীনে! তিন্নির জন্যই না হয় কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হবে আবার। বাঁচবে শুধু ওর জন্যই। কত মানুষই তো বাঁচে দিনের শেষে স্বপ্নে আমি তোর কাছেতেই আসবো জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে আবির আবার মাখবো। নিঠুর জীবন পথটা বাঁকা, ভেকধারী সব ,হৃদয় ফাঁকা, কল্পলোকে হারিয়ে আবার আদরখানি মাখবো।