রাগে গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকল বীথি । সবেমাত্র স্কুল থেকে ফিরেছে ও , এর মধ্যেই মায়ের ঘ্যানঘ্যানানি শুরু হয়ে গেল ক্যারাটে ক্লাসে যা ক্যারাটে ক্লাসে যা । বীথি বুঝে পায় না তার মাকেই কেন সবার মায়েদের থেকে আলাদা হতে হল ? এই তো সেদিন ঋতিকার মাকে বীথি যখন বলল ও ক্যারাটে শেখে তখন তখন ওর মা কেমন একটা মুখ ঘুরিয়ে বলল ” কি দরকার বাপু মেয়েদের এসব ।
ঋতিকা যদিও একটু উৎসাহ দেখিয়েছিল কিন্তু ওর মা তো এক কথায় না করে বললেন ” শুধু পড়াশোনায় ফাঁকিবাজির ধান্দা । এবারে কিন্তু প্রথম পাঁচের মধ্যে রেজাল্টটি চাই , মনে থাকে যেন । ” বিথী হাঁ করে দেখল ওর স্কুলের প্রায় সব বান্ধবীদের মায়েদেরই এক বক্তব্য । কিন্তু ওর মায়েরই ওই এক কথা ” সময়ে নিজের শক্তির স্বরূপ জানতে পারবে , অসময়ে অন্যের ভরসার ভিক্ষা করতে হবে না । বীথি এত কিছু বোঝে না , শুধু ওর নাচের ক্লাসটাই ভালো লাগে । নাচে কত তাল , লয় , ছন্দ এসবে পা মিলিয়ে নানান মুদ্রা শেখা খুব ভালো লাগে বীথির । কিন্তু ওই ক্যারাটে ক্লাস!! ওতো সব মারকুটে মারপ্যাঁচের খেলা একেবারেই ভালো লাগে না ওর । ছোটোবেলা থেকেই বীথির অপছন্দের কাজ করতে একদম ইচ্ছে না , কিন্তু এই ব্যাপারে মায়ের অসম্ভব জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে ও ।
হ্যাঁ ও শুনেছে বটে , আজকের যুগের নানান ঘটনা , সেল্ফ ডিফেন্স , ইত্যাদি ইত্যাদি । তবে ও বুঝে পায় না ওর সেল্ফ ডিফেন্স এর কি প্রয়োজন , ও তো সব সময়ই সুরক্ষিত । বাবা -দাদু সকলে আছে ওর সুরক্ষার জন্য , এই তো যেদিন যেদিন টিউশনি থেকে ফিরতে রাত হয় বা সন্ধ্যেতে তে নাচের ক্লাস থাকে সেদিন বাবা ঠিক চলে যায় ওকে আনতে । স্কুল থেকে ফেরার সময় দাদুর সাথে প্রায় দেখা হয়ে যায় মোড়ের মাথার চা দোকানে । ওর সব আপন জনরা আছে ওকে রক্ষা করতে তবে এতো কষ্ট করে এতো মারপ্যাঁচের কৌশল কেন শিখতে হবে ও বুঝে উঠতে পারে না । এমনিই পড়াশোনা আর ওর প্রিয় নাচ নিয়ে বেশ ব্যস্তই থাকে ও , তার মাঝে আবার উটকো এই ঝামেলা । এই ক্যারাটে ক্লাসের সময়টা এলেই চোখে জল আসে ওর । ” কি রে , দেরি হয়ে যাচ্ছে তো , এখনও গেলি না ।” মায়ের ডাকে কাঁদোকাঁদো মুখ করে চেয়ার থেকে উঠে মায়ের গলা জড়িয়ে বলল ” ওমা বলছি আজ থেকে ওই ক্লাসটা অফ করি না । দেখো ম্যাম আজ বলছিলো এবারের সিলেবাস খুব চাপ আছে , ওই ক্যারাটে ক্লাস ছাড়িয়ে দাও না ।”
” শোনো বীথি , তোমার এখনও অনেক শিখতে বাকি ।”
” কিন্তু মা আমার ভালো যে লাগে না ।”
– ” যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি । তুমি এখনও নিজের ভালোটা বুঝতে শেখোনি তাই সৌভাগ্যকে দুর্ভাগ্য ভাবছো । আমি তোমার মা , তোমার ভালো টা আমাকে ভাবতে দাও। যাও এখন ক্লাসে দেরী হয়ে যাচ্ছে ।” বীথি গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল ” ঠাম্মা ঠিকই বলে , মায়ের মাথা খারাপ । যত্তসব উটকো ঝামেলা ।”
” বলি বউমা , মেয়েটা যখন চাইছিলো না তখন ওকে জোর না করলেই কি হচ্ছিল না তোমার!! , তোমার যতসব বাড়াবাড়ি বাপু ।”
” ও এখনও নিজের ভালোটা বুঝতে শেখেনি মা , তাই ওর ইচ্ছে করছে না । যেদিন ও নিজের ভালোটা বুঝতে শিখবে সেদিন ওর এই অনিচ্ছা বদলে যাবে ।”
-“কিন্তু মেয়েটা সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে বৌমা । ও তো এখনও ছোটো ।”
” ছোটো থেকেই শক্ত হতে হয় মা ।”
” তোমার যতসব বিদঘুটে বুদ্ধি । মেয়ে হয়ে কিনা ছেলেদের মতো মারপিট করবে । বলি লোকে কি বলবে না বলবে সে ব্যাপারে ভেবেছো ?”
– ” লোকে আমাদের খাওয়াতে পড়াতে আসে না মা । তাছাড়া কাল যদি আমার মেয়ের সাথে খারাপ কিছু ঘটে তাহলে এই লোকজন তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না । তাই নিজেরটা নিজেরাই যখন বুঝে নিচ্ছি তখন এই লোকে কি বলল তাতে কি আসে যায় বলুন তো ?” ” কি জানি বাবা , তোমার যুক্তি তর্ক কিছুই বুঝিনা বাপু ।”
” বুঝুন মা , আপনি তো আর বীথির মতো ছোটো নন , বোঝার চেষ্টা করুন তাহলেই বুঝবেন ।” অনিমা দেবী বিড়বিড় করে বলেন ” আমাদের কালে এসব ছিল না , তাবলে কি আমরা মানুষ হইনি!! বউমার যতসব বাড়াবাড়ি !!” উনি জানেন কথা গুলো বলে তেমন লাভ হবে না । ওনার বউমা যে খুব একটি বাধ্য নয় তা উনি ভালো মতোই বুঝেছেন । সেই যখন বীথি জন্মেছিল তখন ওর মুখে ভাতের সময় আত্মীয়রা যখন কটাক্ষে বলেছিল ” মেয়ে হয়েছে , বেশি করে টাকা জমানো শুরু করো এখন থেকেই , মেয়েকে পার করতে হবে তো !” তখনই বীথির মা দৃঢ় স্বরে বলে উঠেছিল ” আমরা অবশ্যই টাকার চিন্তাটা মাথায় রাখব আমাদের সন্তানের জন্য তবে ওর বিয়ের জন্য নয় , ওকে মানুষ করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখার জন্য । ” পাড়া প্রতিবেশীরা যখন নাক কুঁচকে বলেছিল ,” প্রথম সন্তানই মেয়ে , তা এবার একটা বংশধর আনো , ছেলে ছাড়া তো বংশ চলে না ” তখন আবার বীথির মায়ের প্রতিবাদী কন্ঠ শোনা গেল ” কেন বলুন তো , আমার একটাই সন্তান , হ্যাঁ কন্যাসন্তান , আর এই কন্যাই আমাদের বংশপ্রদীপ । আর আমার কোনো অপূর্ণতার ক্ষেদ নেই তাহলে আপনাদের এতো দুশ্চিন্তা কিসের অন্যের পরিবারের জন্য !!?
সেদিনও তো বীথিটা একটু বড়ো হতেই কেমন প্রজাপতির মতো নেচে নেচে বেড়ায় দেখে ওর বাবা বলল ” ভাবছি ওকে নাচের ক্লাসে ভর্তি করবো , তুমি কি বলো!!” বীথির মা গম্ভীর মুখে বলেছিল মা হিসাবে আমি চাই ও ক্যারাটে ক্লাসে যাক । শুনেই বীথির বাবা একটু অবাক হয়েছিল , ঠাকুমা হা হা করে চেঁচিয়ে বলেছিল ” মেয়ে হয়ে অমন মার দাঙ্গা শিখবে। ” ওর মা কড়া স্বরে বলেছিল ” শিখবে , প্রয়োজন তাই মার দাঙ্গাই শিখবে ।”
কয়েক মাস আগে একমনে পেপার পড়তে পড়তে হঠাৎই বীথির মা অবিচল সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেছিল ” আজ থেকেই বীথি ক্যারাটে শিখবে । ” নিজে গিয়ে ভর্তি করে এসেছিল মেয়েকে। বাড়ির প্রায় সবার অমতেই কারণ প্রথম প্রথম বীথি আরোও বায়না করত না যাওয়ার । কিন্তু উনি সেই একই রকম দৃঢ় স্বরে বললেন ” মেয়ের মায়ের অনেক দায়িত্ব , যেমন মেয়েকে আখলে রাখার দায়িত্ব তেমনি মেরুদন্ডটা সবল করে দেওয়াও মারই দায়িত্ব । পৃথিবীতে কোনো কিছুরই সর্বদা প্রয়োজন হয় না তবে সব কিছুই কখনও না কখনও প্রয়োজন হয় । ”
রাস্তায় যেতে বীথি মনে মনে ঠিক করে নিল আজ কোনো ভাবেই মনোযোগ দেবে না ওই ক্যারাটে ক্লাসে । মন না দিলে নাকি কিছুই হয়না তেমনি হবে না , তো কি হয়েছে ওর দরকার নেই ওই মারপিটের । আজ ও বাড়িও ফিরবে না ঠিক সময়ে , মা যেমন জোর করে পাঠিয়েছে তেমনি মা ও একটু ভুগে দেখুক । কতদিন আর সহ্য করে মানুষ একটা অপছন্দের জিনিস করতে । যখন সময়ে ফিরছে না দেখে মা অস্থির হবে , যখন সকলে বকুনি দেবে মাকে তখন মা বুঝবে , আফশোস করে বলবে কেন পাঠিয়েছিলাম ? কষ্ট পাক একটু মা , যেমন পাঠিয়েছে তেমন সহ্য করুক । মনে মনে জেদ ধরল বীথি । ক্লাসে গিয়ে এমন উদাসীন ভাবে শক্তিহীনের মতো হাত পা চালালো যেন ও খুবই অসুস্থ অথবা একেবারেই অনীহা গ্ৰাস করেছে ওকে ।
শক্তি ছাড়া হাত গুলো যেন এলেমেলো ভাবে উদ্দেশ্যহীন হয়ে গেছে । ওকে ক্লাস থেকে বাড়ি যেতে বলল । এমন আনমনা ভাবে এতো অনীহা নিয়ে কোনো কাজ হয় না । বীথি নিজের ইচ্ছে মতো সোজা চলে গেল কাজরী ম্যামের ক্লাসে। কাজরী ম্যাম ওর নাচের ম্যাম । বেশ কিছুক্ষণ খোলা মনে ময়ূরের মতো পেখম ছড়িয়ে নাচ শেষ করতেই মনটা বেশ খোলামেলা হয়ে গেল । কাজরী ম্যাম জিজ্ঞেস করলেন ” কি ব্যাপার বীথি , আজ ক্যারাটে ক্লাসে যাওনি এতো তাড়াতাড়ি এলে যে ।”
– ” আমার একদম ভালো লাগে না ম্যাম । ওসব আমার জাস্ট অসহ্য লাগে ।”
– ” তুমি এখন অনেক অবুঝ বীথি তাই এমন বলছো । ”
– ” আচ্ছা ম্যাম আপনিই বলুন আমার এতো প্রটেকশনের কি দরকার । আমার বাবা তো সবসময়ই আমার সাথে থাকেন ।”
– ” আচ্ছা মেনে নিলাম তোমার প্রয়োজন নেই , কিন্তু নিজের প্রয়োজনে না হোক অন্যের প্রয়োজনেই না হয় শেখো।”
– ” বুঝলাম না ম্যাম। ”
– ” বড়ো হলেই সব বুঝবে ।”
সেদিন নাচের ক্লাস থেকে বেরিয়েই অপেক্ষা না করেই সটান ঘুর পথে চলে গেল বীথি । আজ একটু মাকে শিক্ষা দেওয়া দরকার । ঘুর পথের রাস্তাটায় একটু সময় লাগবে বাড়ি পৌঁছাতে । বাবা নিতে এসে বীথি বেরিয়ে গেছে শুনে বাড়িতে নিশ্চয়ই ফোন করবে । ব্যাস তাহলেই মা বকা খাবে ঠাম্মির কাছে । কেন জোর করে প্রতিদিন ?” ভাবতে ভাবতে আস্তে আস্তে পা চালাচ্ছিল বীথি । যাতে কুড়ি মিনিটের রাস্তাটা আধ ঘন্টার বেশি হয় । সবে আট টা ঘড়িতে । তবে এই দিকের রাস্তাটা একটু অন্ধকারই । নিজের মনে হাঁটছিল বীথি । বাবা কি এতোক্ষণে বাড়িতে ফোন করবে , মা কি এবার দুশ্চিন্তার বারবার ঘর বার করবে আর ঠাম্মা !!
ঠাম্মা এতোক্ষণে বকা দিতে শুরু করেছে মাকে ? অন্যমনস্ক বীথির চিন্তা গুলো হঠাৎ মাথা থেকে সরে গেল একটা চিৎকারে । ভাবনা গুলো যেন সটান মাথা থেকে বেরিয়ে গেল কাছাকাছিতে চিৎকার শুনে ওর মস্তিষ্ক সচকিত হওয়ার সাথে সাথে । সামনের দিকে একটু দ্রুতপদেই এগিয়ে গেল বীথি । দৃশ্যটা চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ও , অস্ফুটে বলল ” ঋতিকা !!” ছেলেগুলো পশুর মতো টানা হ্যাঁচড়া করছে ঋতিকা কে নিয়ে । কিছুটা দূরে পড়ে আছে ঋতিকা স্কুলের ব্যাগটা । এক টানে ঋতিকার ওড়না খুলে নিল ওরা । কিছু বুঝে উঠতে না পেরে হতভম্বের মতো ছুটে গেল ও ঋতিকার দিকে । ঋতিকা চেঁচিয়ে উঠল ” বীথি বাঁচা !!”
মানুষের মতো দেখতে জন্তুগুলো একটু সচকিত হয়ে দেখল বীথিকে । একলা একটা মেয়ে । উল্লাসে ফেটে পড়ে দাঁত কিড়মিড় করে লালসা জীব বের করে বলল ” আরেব্বাস , ছিল এক হয়ে গেল দুই । আজ তো দারুণ রাত রে ।” ঋতিকা তখন বীথিকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছে । জ্ঞানশূন্য হয়ে বীথি ভাবছে কি করবে ও । কি করবে । চিৎকার করবে ?? কেউ কি আসবে তাদের ডাকে । তাহলে কি করবে । প্রাণভিক্ষা চাইবে , এই পশুগুলোর কাছে ভিক্ষা চাইবে নিজের জীবন , সম্মান , বন্ধুর জীবন । জোড়হাত করে অসহায় অপরাধীর মতো পায়ে পরবে । কি অপরাধ করেছে ওরা ।
মেয়ে হয়ে জন্মেছে তাই সেটাই অপরাধ নাকি রাতে একা রাস্তায় বেরিয়েছে তাই , সেটাই অপরাধ । নাকি এই নারী শরীর পেয়েছে জন্ম থেকে সেটা অপরাধ । কোন অপরাধে পশুদের পায়ে ধরবে , অমানুষের কাছে ভিক্ষা চাইবে ?? নাহ্ !! কক্ষনো না । কিন্তু কি করবে। এতদিন ক্যারাটের প্রতি অনীহাতে ও তো ঠিক করে শিখতেই চায়নি , ভালোবাসা ছিল না বলে, প্রয়োজন পড়েনি বলে দায়সারা ক্লাসে গেছে আর মাথা থেকে বের করেছে সব কিছু । এখন তো প্রয়োজন, ভীষণ প্রয়োজন । হতবুদ্ধির মতো আবোল তাবোল ভাবছে বীথি । পশুগুলোর লালসা এগিয়ে আসছে ওদের দিকে । তবে কি ভিক্ষা চাইবে , তবে যে মা বলতো সময়ে নিজের শক্তি বুঝবে ও , ভিক্ষা চাইবে না কিছুতেই । নাহ্ কিছুতেই না ।
চোখের পলকে বীথি দুটো আঙুল গিয়ে ঢুকল একদম সামনে থাকা পশুটার দুচোখে । সাথে সাথে কনুই বলিষ্ঠ একটা আঘাত পাশের জনের পেট-পাঁজর ঝাঁঝড়া করে দিল । বীথির বাম হাতের একটা শক্ত ঘুঁসি ঘাড়ে লাগতেই ধরাশায়ী হল আরেকজন । সাথে সাথে উল্টোদিকের আর একজনের পেটে একটা হাঁটুর ভীষণ ঘা । ঘুরপ্যাঁচে দুহাতের তালুর শক্ত আঘাতে মেরুদন্ডে বোধহয় চির ধরেছে আর একজনের । সবকটাই ধরশায়ী । বীথির রাগ তখনও কমেনি, আরোও কয়েকটা ঘায়ে দুজনের চেতনা হারিয়েছে । ততক্ষণে ঋতিকা ওর জ্যামিতি বক্স থেকে বের করে ফেলেছে কাঁটাটা । বিথী সজোড়ে বসিয়ে দিল আর একজনের হাতের তালুতে । দুজন ওঠার ক্ষমতা হারিয়ে ক্ষমা চাইছে । বীথি বলে উঠল ” নে ঋতিকা , দেখে নে তোর অপরাধী কে, তুইই শাস্তিটা দে । ওরা ভুলে গেছিল যন্ত্রণা নারী -পুরুষ ভেদাভেদ করে না । যন্ত্রণা সবার হয় ।” ঋতিকা বলে উঠল ” আজ যদি এইভাবে হাতজোর করতাম তুই ছাড়তিস আমাদের !!! লালসায় যেমন দয়া থাকেনা তেমনা লালসার ক্ষমা হয় না ।” বীথিই পাহাড়ায় থেকে ঋতিকা বাড়ি পাঠালো । তারপর বাড়ির লোক আর পুলিশ সাথে নিয়ে এল ।
বাড়ি ফিরে বীথিকে যথেষ্ট বকাবকি খেতে হল ঘুর পথে বাড়ি ফেরার জন্য , সবাই কে থামিয়ে মা বলে উঠল ” আমি গর্বিত আমার মেয়েকে নিয়ে । আমার মেয়ের সাহস আছে তাই একা একা ঘুর পথে গেছে । আজ যদি ও না যেত তাহলে হয়তো কাল আমার মেয়ের মতো আর একটা মেয়ের আত্মার শান্তি কামনা করতে হত ।” বীথির মাথায় হাত রেখে মা বলল ” এবার বুঝলি তো , কেন বলেছিলাম সময়ে নিজের শক্তির সন্ধান পাবি ।” রাতে মায়ের কোলে মাথা রেখে বীথি বলল ” মা তুমি আমাকে ক্ষমা করবে তো ? তুমি জানলে খুব কষ্ট পাবে আসলে তোমার উপর খুব রাগ হয়েছিল তাই যাতে তুমি একটু বকা খাও তাই আমি ইচ্ছে করেই দেরী করার জন্য ঘুর পথ ধরেছিলাম ।”
– ” সন্তানেরা অনেক ভুল করে তাই বলে মা কি বদলে যায়?? মা তো মা ই থাকে রে পাগলী । তোর এই ভুলের জন্যই তো একটা জীবন বাঁচল সেই গর্বের কাছের তোর ভুল মাফ হয়ে গেছে । আর আমি আমার মেয়েকে চিনি , সে কোনো কি করে ভুল শুধরে নিতে হয় জানে ।”
– “কিন্তু মা , আমি তো বুঝলাম না আমি এতো সহজে ফাইটা করলাম কি করে । আর আমার হাতে এতো জোর?? আর তাছাড়া এতদিন তো ক্লাসে ভালো করে মনোযোগই দিইনি তাহলে এই অসম্ভব কিকরে হল ?? মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বীথি ।
আসলে তুই চাসনি তো কি , আর অভ্যাসগুলো সব রপ্ত করে নিয়েছিল , সঠিক সময়ে তোর জেদটা তোর অভ্যেসটাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে । আর বলছিস জোরের কথা , ওরে এই কথাই তো আমি বলে এসেছি , মেয়েরা নির্বল নয় বরং শক্তির উৎস । আজ ঋতিকা অসহায় হয়ে পড়েছিল কিন্তু কি জানিসা ঋতিকার মধ্যেই এই শক্তি আছে শুধু ও তার সন্ধান পায়নি , সঠিক চর্চার অভাবে তা জাগেনি । ওর মনের মধ্যে বদ্ধ ধারণা ও অসহায় তাই অসহায়ের মতো চিৎকার করেছে অথচ তুই যখন সহায় হয়েছিস তখনই ওরও মনে হয়েছে ওও হয়তো পারত , হয়তো ওও পারে ।
সেদিন সারা রাত ঘুমোতে পারেনি বীথি । পরের দিন পাড়ার মহিলা মহলে গল্পের আসরে শোনা গেল ” এই হয়েছে আজকের সমাজ , ভয় ডর নাই , দুপুর রাতের বালাই নাই , কেন বাপু । ওতো মেয়েদের সর্বক্ষণ বাইরে থাকার কি দরকার । রাত পর্যন্ত বাইরে ।পড়াশোনা করে কোন দেশ জয় করবে ?রাতের আগে বাড়ি এলেই তো পারে।”
কথাটা কানে যেতেই ঘুরে দাঁড়াল বীথি , জানেন তো জেঠিমা পশুদের পাশবিকতার নির্দিষ্ট সময় বা স্হান হয় না , তাই অবান্তর দাবী না করে দয়া করে বাড়ির মেয়েদের আত্মরক্ষার শিক্ষা দিন । মার্শাল আর্ট বা ক্যারাটের ট্রেনিং দিন , কে বলতে পারে কাল ওরা জোর করে বাড়ি ঢুকে আসবে না !! রাস্তায় ওরা , এটা ভেবে নিশ্চিন্ত হওয়ার কাছু নেই মনে রাখবেন পাশবিকতার সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে । আর দয়া করে মেয়েদের সময় জ্ঞান বিচার না করে ছেলেদের সঠিক শিক্ষার কথা ভাবুন । বলা তো যায় না অপরের দোষ বিচার করতে করতে নিজের টা ভুলে গেলেন ।
একরাতেই বীথিটা যেন অনেক বড়ো হয়ে গেছে ।
সেদিন স্কুলে ঋতিকার মা জানাল আজ থেকে সে ও ক্যারাটে তে যাবে , আরোও সহপাঠীর মায়ের বীথি বুঝিয়ে ছিল , শিক্ষার সর্বোচ্চ নম্বর তোলার থেকে আত্মরক্ষা শেখা বেশি জরুরি , নিজের জন্য আপনজনদের জন্য সবার জন্য। আর শিক্ষা , গান , নাচ বা আঁকার থেকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখা কোনো অংশে কম নয় ।।
আশা করি সমাজের দিকে দিকে ছড়িয়ে থাকা বীথিরা দশের মাঝে একা হলেও সংখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে হাল ছাড়বে না , কয়েকজনেই বার্তার সীমাবদ্ধতা আনবে না , জেদ সাহস আর বিশ্বাসে ভর করে বার্তা ছড়িয়ে দিক লাখে নয় কোটিতে । জয়ী হোক তারা ।