রুমটা খাতার ছেঁড়া পাতায় ভরে গেছে পা রাখার জায়গা নাই। ফাহিম দরজাটা পিন পতন আওয়াজে খুলে নিলো। তারপর আস্তে আস্তে ফেলে দেওয়া মোচড় মারা ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো একটা একটা করে চেক করে দেখলো। কোন পৃষ্ঠায় একটা অক্ষর, কোন পৃষ্ঠা সাদা, কোন পৃষ্ঠায় প্রিয় শব্দটি লেখা। না, ফাহিম রক্তিমের পৃষ্ঠা ছেঁড়ার পুরোপুরি রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। তবে নতুন কিছু একটা আবিষ্কার হতে যাচ্ছে তা অন্তত ফাহিম বুঝতে পেরেছে। তাই কোন সাড়া শব্দ না করে পা টিপে টিপে রক্তিমের মুড লক্ষ্য করলো কিছু বুঝা যায় কিনা সেজন্য। দেখলো রক্তিম ঘেমে যাচ্ছে অনবরত। এবং গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে। এতটাই ভাবছে যে কখন ফাহিম তার পাশে গিয়ে বসেছে খেয়াল নেই। এমন অন্য মনস্ক তাকে পূর্বে কখনোই দেখা যায়নি। এতটা শান্ত-ক্লান্ত হয়ে বসে থাকার ছেলে রক্তিম নয়। যে ছেলে মশার হাল মাছির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় সেই ছেলে এতটা মন ভোলা হয়ে আছে। যার ভয়ে রুমের পাশ দিয়ে কুকুর হাটেনা কারন কুকুর দেখতে পেলে পানি খাইয়ে ছাড়ে। সেই রক্তিমের রুমে জলজ্যান্ত একজন মানুষ ঘুরাফেরা করছে কিন্তু তার খবর নেই। কি সেই জিনিস? কতটা দামী যার জন্য রক্তিম এতটা আত্মভোলা।
–
ফাহিম অনেক্ষন পাশে বসে নিঃশব্দে রক্তিমের ভাবুক চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলো। রক্তিমকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছে যেনো নতুন কিছু একটা পাওয়ার হতাশা। যেনো কিভাবে পাবে, নিজের করে নিবে তার পূর্ব পরিকল্পনার গভীর অভ্যন্তরীন নকশা আঁকার ধ্যান। চেয়ারে বসা তবে এক পা উঠানো, বাম হাতের কনুই খাড়া করে মাথায় হাত চেপে ডান হাতে কলম ধরে খাতা নিয়েই ধ্যান।
.
ফাহিম নিচের দিকে তাকিয়ে খক খক করে কাশির আওয়াজ দিলো রক্তিমের মনযোগ আকর্ষণের জন্য। তখনো রক্তিমের মন অজানায় হারানো। ফাহিম হাতের কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে বলে উঠলো “এই হ্যালো, কোথায় আপনি “? এবার নেশা কাটলো রক্তিমের। যেনো শেষ রাতে ঘুমের ঘরে কেউ এসে ঘুম ভাঙ্গালো। হঠাৎ শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে “আরে তুই কতক্ষণ “? “আমি অনেক্ষন ” বলে ফাহিম জবাব দিলো।
–রুমের এই হাল কেনো? কি হয়েছে তোর?
–(হেসে দিয়ে) কই নাতো, আমার আবার কি হবে!
–চুপচাপ ধ্যানমগ্ন! কোন সাড়া নেই, দেশ দুনিয়ার খবর নেই। কাগজ ছিঁড়ে পুরো রুমের এই কি অবস্থা করেছিস?
–এমনিতেই তেমন কিছু না।
–লুকাচ্ছিস নাতো কিছু।
–আরে না, তোর কাছে লুকানোর কি আছে।
রক্তিম কিছুই প্রকাশ করলোনা ফাহিমের কাছে। ফাহিমও তেমন জোরাজুরি করলোনা। তবে নিশ্চিত যে রক্তিমের কিছু একটা হয়েছে।
.
রক্তিম উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। শুরু থেকেই ফাহিমের সাথে ঘনিষ্ঠতা। দুজন ভালো বন্ধু। ফাহিম যেমন কথার পোকা তেমনি রক্তিমও। দুজন যেখানে বসে সেখানকার মাটি পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে যায়। সেই রক্তিম এখন নিশ্চুপ এটাতো কল্পনা করা যায়না। ফাহিমের মাথায় বিষয়টা ঘুরপাক খেতে লাগলো। তাই সে নিরবেই ফলো করতে লাগলো রক্তিমের গতিপথ। বেশকিছু দিন পর ফাহিম পেয়ে গেলো রক্তিমের কাগজ ছেঁড়ার রহস্য। রক্তিম প্রেমে পড়েছে। যদিও কথাটা ভাবতেই কেমন জানি অবাস্তব মনে হয়, অবাক লাগে ‘রক্তিম প্রেমে পড়েছে ‘! যেই ছেলেটা মেয়েদের বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারতোনা, মেয়েরা ছিলো তার চোখের কাঁটা, আজ সেই মেয়ের প্রেমে রক্তিম! অসম্ভব। যেই ছেলে সবাইকে জ্ঞান দিতো যে কখনো মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করোনা, এরা রংধনু। একবার এই ভুল করছো তো মরছো। সে ফাহিমকে দেয়নি কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক করতে। আজ সে-ই মেয়ের প্রেমে আত্মভোলা!
.
মেয়েটির নাম তৃপ্তি কলেজে নতুন এসেছে অন্য কলেজ থেকে ট্রান্সপার হয়ে। তৃপ্তিকে বিধাতা এমন করে সাজিয়েছেন যেনো আর কিছু তার মধ্যে অপূর্ন রাখেননি। বর্ননাতীত সুন্দুরী। যার প্রেমে পুরো কলেজ পাগল হয়ে আছে। সবার মুখে মুখে তৃপ্তির সৌন্দর্যের গুঞ্জন। প্রেমপত্র দেয়নি এমন ছেলের সংখ্যা নগন্য। স্বয়ং প্রফেসর তৃপ্তির প্রেমে মশগুল কিন্তু তৃপ্তির কোন রিপ্লাই নাই। কেউ সাড়া পায়নি। সেখানেই রক্তিমের ভয়। “যেখানে কারো চান্স নেই সেখানে আমিতো কিছুই না ” ভেবে ভেবে লেখা সহস্র চিঠি রক্তিমের ডায়রির পাতায় পড়ে রয়েছে, দেওয়ার সাহস পায়নি কখনো। বহুবার এগিয়ে গেছে কিছু বলার জন্য কিন্তু পারেনি, বারবারই ফিরে এসেছে শূন্যতায়। পিছু নেমে গেছে খালি হাতে। তৃপ্তির জন্য লেখা চিঠি রক্তিমের পকেটে ছিলো, দিবে বলে বলে দেওয়া হয়নি ভয়ে। সেই চিঠি ঘটনাক্রমে ফাহিমের হাতে গিয়ে পৌছালো। চিঠিটা পড়েই ফাহিম ওভার সিউর হলো। 4R সাইজের সাদা কাগজে লেখা মাত্র চার লাইন। চিঠিটা এভাবে লেখাঃ
প্রিয়ো,
তোমাকে ভালো লাগার বর্ণনা আমার কাছে নাই।
এই প্রথম কোনো মেয়েকে (তোমাকে) আমার ভালো লেগেছে।
ভয় লাগছে খুব তোমাকে কথাটা বলতে যদি শুনে চিরতরে আঁড়াল হয়ে যাও!
প্লিজ ফিরিয়ে দিওনা।
রক্তিমের লেখা কথাগুলোতে কি যে মায়া জড়িয়ে রয়েছে, পড়া মাত্রই যে কোন মেয়ে প্রেমে পড়ে যাবে।
.
রক্তিম চুপেচুপে চিঠিটা খুঁজছিলো প্রকাশ করেনি। ফাহিম বুঝতে পেরেছে বিষয়টা কিন্তু চুপ রইলো। এই পকেট সেই পকেট, ড্রয়ার, ডায়রির পাতা, বইয়ের পৃৃষ্ঠা কোথাও নাই। খুব টেনশন করছিলো কোথায় রাখলো? না জানি পথে পড়ে গেলো। এবার ফাহিম বলে উঠলো– রক্তিম একটা সত্য কথা বলবি আমাক?
–কি কথা বল না আগে।
–আগে কথা দে লুকাবি না?
–কি এমন কথা যে ওয়াদা করাচ্ছিস? ঠিক আছে বলবো, বল কি কথা?
–তুই কি তৃপ্তিকে খুব পছন্দ করিস?
–মানে কি বলছিস তুই? (হেসে দিয়ে) কোথায় তৃপ্তি আর কোথায় আমি!
–যা জিজ্ঞেস করেছি তার জবাব দে আগে?
রক্তিম না বলে লুকাতে চাইলো, কথা কেটে অন্য প্রসংঙ্গ টানতে চাইলো কিন্তু পারলো না এড়িয়ে যেতে। ফাহিম চিঠিটা বের করে দেখালো–এটা কার জন্য লেখা?
এবার রক্তিমের কণ্ঠ ছোট হয়ে গেলো।
–তুই এটা কিভাবে পেলি? চিঠিটা দিয়ে দে প্লিজ ভাই।
— দেবো তবে তোকে নয়, যার চিঠি তাকে দেবো।
–এই, কার চিঠি এটা, কাকে দিবি তুই? পাগলমি করিস না ভাই দিয়ে দে।
–কার চিঠি মানে, ভেবেছিস আমি কিছুই জানি না। এটা তৃপ্তির জন্য লেখা, আমি তৃপ্তিকে দেবো।
–এই,একদম একাজ করবিনা বলে দিলাম।
–কেনো দেবোনা। তুই তাকে ভালোবেসে নিরবে ঝরে যাবি আর সে সুখে থাকবে।
–ওর কাছে আমি কিছুই না। অনেকেই ব্যর্থ হয়েছে।
–না বললে তুই বুঝবি কি করে যে সে তোকে পছন্দ করে কি করেনা?
–বলবো তবে এখন না, পরে বলবো।
ফাহিম বলে দিবে বলাতে রক্তিম আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলো। তার ভয়ের কারন হলো, না জানি কোনো ঝামেলা হয়ে যায়। বিষয়টার সূত্র ধরে যদি তৃপ্তির কোনো ক্ষতি হয়। অথবা যদি তাকে (রক্তিমকে) তিরস্কার করে। তাই ফাহিমের হাত চেপে ধরে নিষেধ করলো কথাটা যেনো কাউকে না বলে। তৃপ্তি পর্যন্ত যেনো কোন ভাবেই না পৌছে।
.
কলেজের সবচেয়ে বাচাল, ইডিয়েট খ্যাত ছেলেটি হয়ে গেলো সকলের আলোচনার পাত্র। কারো কারো প্রলাপ ” ওকি রক্তিম নাকি তার কপি কেউ “? কেউ বলে “মনে হয় কেউ তাবিজ করেছে ওরে “। হঠাৎ এই ছেলে এরকম হয়ে গেলো কেনো? রক্তিমের মত ভদ্র ছেলে যেনো আর হয়না। বাজে আড্ডা নাই, বাজে কথা নাই, ক্লাস মিস নাই, রেজাল্টেও ভালো সবই ফার্স্ট। এভাবেই চলছিলো। আর মনে মনে ভালোবাসার গান গাইতে থাকলো। কিছুদিন পর ফাহিমের সাহসে, তার জোরাজুরিতে তৃপ্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো চিঠিটা হাতে নিয়ে।
–এক্সকিউজ মি।(রক্তিম)
–আমাকে বলছেন? (তৃপ্তি)
–না আপনাকে না (যদিও সেখানে আর কেউ নেই)।
–তৃপ্তি চারিপাশে চেয়ে হাটতে লাগলো। রক্তিমের শরীর কাঁপছে। আঁড়াল থেকে ফাহিম ঈশারা করে সাহস দিচ্ছে।
–এই যে হ্যালো, আপনাকেই বলছি (আবার ডাক দিলো)।
–জি বলুন।
–আপনার নামতো তৃপ্তি তাই না?
–জি। আর কিছু বলবেন?
–আর কি বলবো, কি বলবো…. ? না আর কি বলবো আপনাকে?
তৃপ্তি চলে যেতে চাইলে আবার ডাক দিলো –এই যে আরো অনেক কিছু বলার আছে দাঁড়ান। (ফাহিম ঈশারা করলো চিঠিটা দেওয়ার জন্য। রক্তিমের হাতে চিঠি দিতে সাহস পাচ্ছে না)।
–জি বলুন। (তৃপ্তির শোনার আগ্রহ আছে তাই রক্তিম সাহস পাচ্ছে)।
–আপনাকে একটা কথা বলবো যদি কথা দেন রাগ করবেন না?
–কথা দিলাম রাগ করবো না, বলুন।
এবার তৃপ্তির অনুমতিতে রক্তিমের ভয় কেটে গেলো। তৃপ্তির সাথে নির্ভয়ে কথা বলার সাহস হয়ে গেলো। কিন্তু ভালোবাসি বলাটা দুরুহ ব্যাপার। সেটা হারিয়ে যাওয়ার ভয়, তৃপ্তিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। যদি এই কথার প্রেক্ষিতে দূরে সরে যায়, আর কথাই না বলে, আর দেখাই না হয়? সেই ভয়ে রক্তিম জবাব দিলো “এখন না পরে বলবো “।
তৃপ্তি চলে গেলে ফাহিম আঁড়াল থেকে বেরিয়ে এসে শুরু করে দিলো যাচ্ছে-তাই গালাগাল।
–নারে দোস্ত আমার দ্বারা হবে না, ভয় লাগে যদি …. (রক্তিম)।
–ভয় লাগলে ভালোবাসতে গেলি কেনো তবে? শালা একটা মেয়েকে এত ভয়! আমার ভাবতে কেমন কেমন লাগছে বেশ কিছুদিন ধরে। দেখি তোকে একটু ছুঁয়ে (চিমটি কেটে) আসলে তোর মধ্যে তুই আছিস নাকি অন্য কেউ।
–উহঃ লেগেছে খুব!
–তুইতো ঠিকই আছস দেখছি কিন্তু এমন হচ্ছে কেনো? যে তুই বাঘের পিছনে ছুটতি ধরার জন্য, সেই তুই একটা মেয়েকে ভয় পাচ্ছিস। নাহ, আমার মাথায় কিছু কাজ করছেনা।
–বাদ দেতো, তোর মাথায় কাজ করার দরকার নাই চল এখন।
.
রুমানা বিষয়টা ফাহিমের কাছ থেকে জানতে পারলো। রুমানাও একই বর্ষে পড়ে, ফাহিমের সাথে কথা হয় বেশ। ফাহিমের প্লান হলো রুমানাকে দিয়ে তৃপ্তিকে বাজিয়ে দেখবে কেমন রেসপন্স পাওয়া যায়। রুমানা অন্য গ্রুপের তাই তৃপ্তির সাথে ভালো পরিচয় নাই। ফাহিমের পরিকল্পনা মতে রুমানা তৃপ্তির সাথে দেখা করলো, পরিচিত হলো, গল্প করতে করতে ক্লোজ হয়ে গেলো। এক পর্যায়ে ভালো লাগার কথা উঠলে রুমানা জিজ্ঞেস করে বসলো ভালো লাগার কেউ আছে কিনা। কাউকে এখন পর্যন্ত পায়নি মনের মত করে, তবে অনেকেই অফার করেছে বলে তৃপ্তি জবাব দিলো। এই ফাঁকে রুমানা বলে বসলো
— অনেকের অফারের মধ্যে একটা অপ্রকাশ্য অফার রয়েছে যা হয়তো কখনোই বলা হবে না।
–কে সেই ভদ্র লোক যে ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতে পারছেনা?
–আমি নাম বলবো তবে তুমি মাইন্ড করবেনা তো?
–এমন লোককে দেখার ওতো সাধ জাগে নাকি? বল বল কে সেই প্রেমিক।
— রক্তিমকে তোমার কেমন লাগে?
— তাহলে সেই ভদ্র লোক রক্তিম।
–হ্যাঁ রক্তিম।
তৃপ্তি চুপ হয়ে গেলো, রক্তিমের নাম শুনে আর কোন শব্দ করলো না। বসা থেকে উঠে গেলো, আমাকে যেতে হবে বলে দুজনে হাটতে লাগলো। রক্তিমের নাম শুনে হঠাৎ তৃপ্তির এমন মুড দেখে রুমানাও আর কোন প্রশ্ন করলো না। দুজন দুদিকে চেয়ে হাটছিলো। রুমানা তৃপ্তিকে বিদায় দিয়ে তার রাস্তায় বিপরীত দিকে কয়েক কদম হাটার পর তৃপ্তি ডাক দিলো। রুমানা দাঁড়ালে তৃপ্তি হাটার মধ্যেই বললো “রক্তিমকে দেখতে কিন্তু খারাপ না, ভালো লাগার মত একটা ছেলে” বলেই হাসতে হাসতে চলে গেলো। কথাটা বুঝিয়ে দিলো তৃপ্তির মনের মত কিছু একটা রক্তিমের ভিতর আছে। রুমানা নিশ্চিত হলো যে তৃপ্তি রক্তিমের অফার এক্সেপ্ট করবে। কথাটা শুনেতো ফাহিম মহা খুশি। রক্তিমকে জানালে বিশ্বাস করেনি, তৃপ্তির এমন নমনীয়তা রক্তিম বিশ্বাসই করতে পারলোনা। তবে মনে মনে ভাবতে লাগলো যে এমন একটি মেয়ের মুখে তার প্রসংশা সত্যিই অন্য রকম অনুভূতি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আরো বেশি হিরো ভাবতে শুরু করলো। সেদিন থেকেই শুরু হলো রক্তিমের প্রেম প্রস্তাবের প্রস্তুতি। কিভাবে তৃপ্তির সামনে দাঁড়াবে, কিভাবে শুরু করবে, কেমন ডায়ালগে কথা বলবে, কেমন সাজে নিজেকে সাজাবে? ইত্যাদি প্রেক্টিস করতে থাকলো। তারপরও তৃপ্তির সামনে গিয়ে না বলে বারবার ফিরে এসেছে।
.
কলেজে যায় কিন্তু তৃপ্তির সামনে পড়েনা লজ্জা লাগে। তবে আঁড়ালে দেখে তৃপ্তির মুক্তা ঝরা হাসি। কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে কি কথা বলছে, কেমন করে হাটছে, কি খাচ্ছে? সবই লক্ষ্য করছে। এতকিছুতেও তৃপ্তি স্বাভাবিক। তবে মনে মনে রক্তিমকে পছন্দের স্থানে রেখেছে নিরবে। যদিও তার মনে কোন উন্মাদনা নেই। সে চাচ্ছে রক্তিম বলুক মনের কথাটা। তৃপ্তির নমনীয়তা রক্তিমের বুঝে উঠার কোন সাধ্য নেই। অতঃপর অনেকদিন পার হয়ে গেলো সমধান হয়নি দুজনের মন-সমস্যা। রক্তিমের আর ধৈর্য সইলো না। ফাহিমকে ডেকে এনে চুপেচুপে একটা ওয়াদা করালো।
–একটা কথা বলবো রেগে যাবিনাতো (রক্তিম)।
–বল কি কথা? (মনে মনে ভাবছে “তুই তৃপ্তির কথা ছাড়া আর কি বলবি আমার জানা আছে “)(ফাহিম)
–(হাত চেপে ধরে) তুই কথা দে রাখবি তো?
–ওকে কথা দিলাম বল।
–তৃপ্তির নাম্বারটা ম্যানেজ করে দেনা ভাই?
–(ফাহিম অন্যদিকে ফিরে হাসলো) এতদিন পর বুদ্ধি মাথায় আসলো। আমি আগে বলেছিলাম তখনতো শুনলিনা। তোর ভয় লাগে।
–সরি বন্ধু এবার ফোনেই কথাটা বলবো।
তারপর ফাহিম নাম্বারটা সংগ্রহ দিলো। নাম্বার নিয়েও বহুবার ট্রাই করে কল ব্যাক করতে পারলোনা। বারবার মিস কল গেলো। সেদিকে তৃপ্তিও বুঝতে পেরেছে বিষয়টা। ফাহিমের কাছ থেকে আরো আগেই তৃপ্তি নাম্বার নিয়েছিলো তাই রক্তিমের নাম্বার তার জানা আছে। এদিকে ফাহিম দুজনেরই খবর রাখছে তৃপ্তিকে জিজ্ঞেস করছে রক্তিম ফোন দিছে কিনা আবার রক্তিমকে জিজ্ঞেস করছে কথা হলো কি না? যখন শুনছে রক্তিম কথা বলেনি তখনই শুরু করে তিরস্কারের নানা ভাষা। ফাহিম এমন সব কথা বলে যেনো রক্তিমের গায়ে লাগে, যেনো তার কথার আঘাতে আরো একটু তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। কিন্তু না রক্তিম তার স্থানেই।
.
কিছুদিন পর তৃপ্তি নিজেই কল দিলো। রক্তিমতো দেখেই হতভম্ব, আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো রিসিভ করবে নাকি কেটে দিবে ভাবতে ভাবতে কলটা শেষ হয়ে গেলো। অপেক্ষা করতে লাগলো দ্বিতীয়বার কলের একবার কল করেছে যেহেতু আবার করবে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে চিন্তা করতে থাকলো কি বলবে? অনেক্ষন হয়ে গেলো কল আসছেনা দেখে তৃপ্তির নাম্বারটা ডায়ালে এনে ব্যাক করবে ভাবলো কিন্তু পারলোনা ডায়াল করেই কেটে দিলো। এভাবে কয়েকবার করার পর তৃপ্তি আবার ব্যাক করলো। রক্তিম রিসিভ করে চুপ কথা বললোনা তৃপ্তি হ্যালো হ্যালো করেই গেলো। পরে তৃপ্তি ম্যাসেজ করলো কল ধরে কথা বলছেনা কেনো তার জন্য। সেই ম্যাসেজ থেকেই শুরু হলো দুজনের আলাপচারিতা। দুজনেরই সংশয় কেটে গেলো।তবে তৃপ্তির একটাই কথা রক্তিম এতদিন কি বলতে চেয়েছে তা বলতে। যদিও কি বলবে সব জানে আগে থেকেই ফাহিমের কাছ থেকে। রক্তিমও জানে যে তৃপ্তি তাকে পছন্দ করে। শুধু কেউ কাকে সরাসরি বলেনি। দুজনই চায় সরাসরি বলুক। রক্তিম পরে বলবে বলে বলে পিছিয়ে গেলো। অবশেষে তৃপ্তির মান অভিমান পাগলামির কাছে হেরে গিয়ে রক্তিম তাকে কথা দিলো নিউ ইয়ারের প্রথম দিনে বলবে। তৃপ্তি নিউ ইয়ারের অপেক্ষায় রইলো। অতঃপর আসলো সেই আকাঙ্খিত নিউ ইয়ারের প্রথম দিন। রাতে কথা হলো সকালে দেখা করবে, নির্দিষ্ট স্থানের নাম বলে দিলো।
.
রক্তিম মহা আনন্দে তৃপ্তির পছন্দের ড্রেস পর নতুন বছেরর প্রথম প্রহরেই বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো ফুলের দোকানে। সবচেয়ে দামী ফুলের তোড়াটা নিলো তৃপ্তির জন্য। প্রতিটা ক্ষনেই ফোনে কথা হলো তৃপ্তির সাথে, কোথায় আছে? কতটুকু সময় লাগবে? আবার সবকিছু ফাহিমও জানে, রক্তিম বলেছে তাকে। সে আবার তৃপ্তির কাছ থেকেও জেনেছে। তৃপ্তি রক্তিমের প্রায় আধ ঘন্টা আগে গিয়ে উপস্থিত। কিন্তু রক্তিম তখনো ফোনে আসছি আসছি বললো। ফুলের দোকান থেকে হাই স্পীডে ছুটলো তৃপ্তির দিকে। দেরি হতে দেখে তৃপ্তি রেগেই গেলো। এর মধ্যে হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো, ফোনে কল গেলো না, বন্ধ বন্ধ বললো। “চার্জ শেষ নাকি বন্ধ করে রাখলো তাও বুঝতেছিনা ” বললো ফাহিমকে। ফাহিমও সাথে সাথে ট্রাই করলো না ফোন বন্ধ। অনেক্ষন হয়ে গেলো ফোন বন্ধ হলে এতক্ষনেতো চলে আসার কথা নাকি ধোকাবাজি করলো তৃপ্তির ভাবনা। ফাহিম বারবার ট্রাই করে প্রচন্ড রাগে গালাগাল দিতে থাকলো। সেতো রক্তিমকে ভালো করে জানে হয়তো ফোন অফ করে রুমে শুয়ে আছে। না কোন খবর নাই বিশ মিনিটের রাস্তারপ্রায় দুই ঘন্টা হয়ে গেলো। তৃপ্তি রেগে ফাহিমকে ফোন করে চলে গেলো বাসায়। ফাহিম মাথা গরম করে রুমে গেলো কিন্তু রুমে রক্তিম নাই। কয়েকজনকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো কেউ জানেনা। না, এবার ফাহিমের টেনশন লেগে উঠলো। বের হয়েছে তৃপ্তির সাথে দেখা করতে, সারাক্ষণ কথা হলো, ফুল কিনেছে বললো হঠাৎ ফোন অফ কি হলো, কোথায় গেলো? বিকেল হয়ে গেলো খবর নাই দেখে ফাহিম তাকে খুঁজতে বের হলো। ফাঁকে ফাঁকে তৃপ্তিকেও ফোন করার চেষ্টা করলো খোঁজ মিললো কিনা জানার জন্য কিন্তু তৃপ্তির ফোন বন্ধ। রাগ করে ফোন বন্ধ করে রাখলো। এখন কি করবে, কোথায় খুঁজবে? ভাবতে ভাবতে খবর এলো রক্তিম হাসপাতালের মর্গে, বাইক দূর্ঘটনায় রক্তিম নিহত। ফাহিম খবরটা শুনেই পাগলের মত দৌঁড়ে গেলো হাসপাতালে। চোখের সামনে প্রানের বন্ধুর বিক্ষত লাশ দেখে ফাহিম সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে গেলো।
রক্তিমের সারা শরীর অক্ষত থাকলেও মাথা পুরো থেতলে গেছে। চেহারা চেনার কোনো উপায় নাই। দানবিক লরির পিষ্টতলে রক্তিমের মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। দুই দিন পর ফাহিমের জ্ঞান ফিরলে বন্ধুকে খুঁজতে লাগলো। ততক্ষণে বন্ধু সাড়ে তিন হাত মাটির বিছানায় চলে গেছে। ফাহিম অনেক কাঁদলো বন্ধুর জন্য। তৃপ্তি তখনো রক্তিমের উপর রেগে ছিলো, ফোন খোলেনি। ফাহিম ট্রাই করলো খবরটা তৃপ্তিকে জানানোর জন্য কিন্তু তখনো তার ফোন অফ। প্রায় সাতদিন পর তৃপ্তি ফোন খুলে জানতে পারলো যে সেদিন রক্তিম ধোকাবাজি করেনি। রক্তিম তাকে বাস্তবেই অনেক ভালোবাসতো। তৃপ্তি বড় দেরি করে ফেলেছে তাকে চিনতে। কাঁদতে কাঁদতে রক্তিমের পছন্দের রজনীগন্ধা ফুলের তোড়া নিয়ে সমাধীতে রেখে তৃপ্তি লিখে দিলো “বন্ধু হ্যাপী নিউ ইয়ার “।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক