কে যেন দরজায় অনবরত টোকা দিয়ে যাচ্ছে। উঠতে ইচ্ছা করছে না। সারাদিন অফিস করে এখন ভীষণ ক্লান্তি লাগছে। থাক টোকা দিতে থাকুক। দরজা না খুললে হয়তো চলে যাবে। টোকার মাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেলাম দরজা খুলতে। বাসার মালিক আর তার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। আমি দরজা খুলে সালাম দিলাম। বাড়িওয়ালা বললেন
ঃ বাবা তুমি ঠিক আছো তো? দরজা খুলতে এত দেরি হল যে?
ঃ না না আংকেল আমি ভালো আছি। আসলে ঘুমিয়ে পরেছিলাম তো তাই।
ঃ এই অবেলায় ঘুম? তোমার স্বাস্থ্য ভালো আছে তো।
ঃ আসলে অফিস থেকে এসেছি তো তাই একটু ক্লান্ত। আমি ভালো আছি।
ঃ আচ্ছা বাবা তাহলে তুমি রেস্ট নাও আমরা আসি।
ঃ জি আচ্ছা।
বাড়ি ওয়ালা প্রতিদিন এসে আমার খবর নিয়ে যান। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এই বাসায় কোন সমস্যা আছে। না হয় উনি প্রতি দিন আসবে কেন? এই বাসাটায় উঠেছি মাত্র কয়েক দিন হল। এখনো কোন সমস্যা চোখে পরেনি। শুধু রাত হলে মনে হয় ঘরের তাপমাত্রা যেন একটু বেশিই কমে যায়। এছাড়া কোন সমস্যা নেই। আসলে আমার জন্য এমন বাসা পাওয়াটা নেহাৎ ভাগ্যের ব্যাপার । এমনি ব্যাচেলরদের কাছে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। তার উপর ফ্ল্যাট বাসাতো নয়ই। কিন্তু এই বাসার মালিক আমাকে বাসা ভাড়াতো দিল তার উপর প্রতিদিন আমার খোজ- খবর নিয়ে যায়। আমার আবার কোন কিছু গোছানোর স্বভাব নেই। তাই এতো বড় বাসা সব সময় এলোমেলো থাকে। তবে আজ বাসায় ফিরে আমার কিছুটা অবাক হতেই হল। সকালে যাবার সময় আমার কাল রাতে পরা টি-শার্টটা
টেবিলের উপর ফেলে গিয়ে ছিলাম। ওটা এখন ওখানে নেই। বেডরুমে গিয়ে দেখি আমার বিছানা গুছিয়ে রাখা আছে। এবার আমি সত্যিকার ভাবেই অবাক হলাম। আমি ছাড়া এই ফ্যাটে আর কেউ থাকে না। আমি তো এগুলো গুছাই নি। তাহলে কে?
কাল রাতে পরা টি-শার্টটাও টেবিলের উপর ভাজ করে রাখা আছে। কি হচ্ছে এসব? আজ রাতের খাবার খেতে হোটেলে যেতে ইচ্ছা করছে না। আমি আবার রান্নাবান্না করতে তেমন একটা পারি না। শুধু ভাত আর ডাল রান্না করতে পারি। এগুলো কি আর সবসময় খেতে ভালো লাগে। তাই নিচে এলাম সামান্য খাবার আর বেনসন কিনতে। মজিব স্টোর থেকে কয়েকটা কলা আর পাউরুটি কিনলাম। এক প্যাকেট বেনসন এন্ড হ্যযস ও কিনলাম। টাকা দিচ্ছি দোকানদার আমাকে দেখে বলল
ঃ ভাই কি এখানে নতুন আসছেন? আর তো দেখি নাই?
ঃ হা। এই তো প্রায় তিন চার দিন হলো।
ঃ ও। কোন বিল্ডিং এ উঠছেন ভাই?
ঃ ওই তো ছায়া নীড়ে।
ঃ ঐডা হারুন মিয়ার বাসা না?
ঃ হা।
ঃ ওই বাসাতো খালি আছিলো না।
ঃ ছিল তো তিন তালা খালি ছিল। এইবার সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলা। কয়েক মুহূর্ত কিছুই বলল না। হঠাৎ সে বলল
ঃ ওই বাসার তিন তালায় তো কেউ উঠে না।
ঃ কেন? কি সমস্যা? বাসাতো ভালোই।
ঃ কয়েক মাস আগে ওই ফ্যাটে একটা মাইয়া গলায় দড়ি দিয়ে মরছিল।।
ঃ হা হা হা। ওই বাসায় মানুষ তাহলে ভূতের ভয়ে থাকে না?
ঃ ভাই আপনে আমার কথা বিশ্বাস করলেন না? এই বাসায় কোন ভাড়াটিয়া দুই দিনের চেয়ে বেশি থাকতে পারে নাই।
ঃ হা হা হা। আমি তো কয়েকদিন আছি। আর ভাই শোনেন আমি এগুলো বিশ্বাস করি না।
ঃ আরে ভাই….
ঃ আচ্ছা ভাই আমি আসি।
আমি দোকানদার কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে আসলাম। বসার ঘরে এসে টিভিটা ছাড়লাম। দেখার মতো কিছুই নেই। রিমোট দিয়ে চ্যানেল ঘুরাচ্ছি। একটা সিগারেট জ্বালালাম। সুরকা গুলো ফেলার কিছু না পেয়ে সামনের টি টেবিলের উপরই ফেলতে লাগলাম।
মনে হল ঘর ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। ঘড়িতে দেখালাম ১১ টা বাজে। গত কয়েকদিন ধরে দেখছি ঠিক এ সময় ঘরের তাপমাত্রা কমে যায়। আমার দোকানদারের কথা বার বার মনে হতে লাগলো। আমি মনে মনে বললামঃ এগুলো বাজে কথা। ভুত বলতে কিছু নেই। আমি টিভি দেখতে দেখতে সোফায় ঘুমিয়ে গেলাম।
সকালে ঘুম ভেঙ্গে আবিষ্কার করলাম আমি সোফায় ঘুমিয়ে আছি। কিন্তু আমার গায়ে কাথা মোড়া। এটা এলো কি করে। আমি এবার সামান্য ভয় পেতে শুরু করলাম। আবার মনে হল রাতে হয়ত শীত লেগে ছিল তাই কাথা এনে গায়ে দিয়েছি। কিন্তু মনের মধ্যে খটকা লেগেই রইল।কারণ আমি রাতে ঘুমালে আর উঠি না। তাই একটা চিরকুট লিখলামঃ
ধন্যবাদ। তুমি যেই হও আমি তোমাকে দেখতে চাই। অফিসে এসে নিজেকে খানিকটা বোকাই মনে হলো। বিজ্ঞানের এই যুগে আমি ভূতের কাছে চিঠি লিখে এসেছি? মনে মনে হাসলাম নিজের বোকামির উপর। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরলাম। টেবিলে দেখলাম চিরকুটটা আগের মতই আছে। কিছুটা মন খারাপ ও হল। কেন জানি না। কাপড় বদলে খাটের উপর রাখলাম মাত্র মনে হল কেউ খুব কাছ থেকে বলে উঠল
ঃআপনি খুব অগোছালো।
আমার মেরুদণ্ড দিয়ে হিমপ্রবাহ বয়ে গেল। আমি কিছু বলতে পারলাম না। ভয়ে মনে হল অজ্ঞান হয়ে যাব। মনে মনে বললামঃ কেউ কিছু বলেনি। এগুলো আমার মনের ভয়। টেবিলের দিকে পা বাড়ালাম। তখন আরো কাছ থেকে কেউ বলে উঠল
ঃ কি ব্যাপার ভয় পেলেন নাকি?
এবার অনেক স্পঠ ভাবে শুনলাম। মনে হল অনেক কাছে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে আমার সাথে কথা বলছে। এবার অনেক সাহস সঞ্চয় করে বললাম
ঃ তুমি যেই হও আমার সামনে এসো।
মনে হল কেউ একজন আমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। এতোটা কাছে যে আমি তার নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারছি। কেমন যেন লাগছে আমার। তবে আর ভয় পাচ্ছি না।
আমি বললামঃ
ঃ তুমি কে?
ঃ আমি নিশি।
ঃ আমি তোমাকে দেখতে চাই।
ঃ (হাল্কা হাসির শব্দ) আমকে দেখতে চান?
ঃ হা
ঃ আপনি মনে হয় অনেক সাহসী। সবাই আমাকে ভয় পায়।
ঃ আমি পাব না।
ঃ কেন?
ঃ আমি জানি তুমি প্রতিদিন এখানে এসো। আমি প্রতিদিন অফিস থেকে এসে দেখি আমার জামা কাপড় গুলো গুছালো। কাল রাতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম, সকালে দেখলাম আমার গায়ে কাথা দেওয়া। এগুলো নিশ্চই তুমি করেছ। যে আমার এত যত্ন করে সে নিশ্চই আমার কোন ক্ষতি করবে না।
ঃ আচ্ছা তাই নাকি? যদি করি?
ঃ করলে আর কি করা, ভেবে নিব যে যত্ন করে তার নিশ্চই ক্ষতি করার অধিকার টুকুও আছে।
ঃ তাই? আপনি তো দেখছি অনেক কাব্যিক কথা বার্তা বলেন।
ঃ বলি নাকি জানতাম না তো। তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
ঃ আমাকে দেখতে হবে না। আমি চলে যাই। অনেক রাত হয়েছে। কাল তো আপনার অফিস আছে। আপনার ঘুমানো দরকার।
ঃ এই শোন যেও না। এই নিশি। এই তুমি কোথায়?
কোন শব্দ আসছে না। চারদিকে নিস্তব্ধতা। মনে হলো নিশি চলে গেছে আমাকে মায়ার জালে ফেলে। আমি আর ঘুমাতে পারলাম না। সারা রাত বসে রইলাম নিশির অপেক্ষায়। সে আসলো না। আজ মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলাম। অফিসে কাজের চাপ তার উপর বসের চড়াও মেজাজ। ঘরে এসেই সারা ঘর কেমন যেন গুছানো মনে হল। তার মানে সে এসেছিল। মনটা ভালো হতে লাগলো। আমি ডাকলাম
ঃ নিশি এসেছো? খুব কাছ থেকে হাল্কা হাসির শব্দ শুনলাম।
ঃ কি ভাবে বুঝলেন আমি এসেছি?
ঃ জানি না। কিন্তু এখন মনে হয় তোমার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি।
ঃ তাই না কি মিঃ?
ঃ হুম তাই। আচ্ছা নিশি, একটা কথা বলি?
ঃ বলুন।
ঃ তুমি আমার জন্য ঘরে গুছিয়ে রাখ কেন?
ঃ জানি না। আমার ভালো লাগে।
ঃ তাই।
ঃ হুম।
ঃ নিশি।
ঃ বলুন।
ঃ তুমি কি চাও না আমি তোমাকে দেখি?
ঃ চাই।
ঃ তাহলে সামনে আসো না কেন?
ঃ আমার লাজ্জা লাগে।
ঃ কিন্তু আমি তোমাকে দেখতে চাই।
একটা ফুটফুটে মেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এতো সুন্দরও কি মানুষ হয়? নিশি বলল
ঃ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
ঃ জানি না।
ঃ আমার লজ্জা লাগছে তো।
ঃ তুমি এত সুন্দর কেন?
ঃ আমি সুন্দর না ছাই।
এর পর থেকে নিশির এখানে আসা বাড়তে লাগলো। আমি যখন ঘরে থাকি প্রায় সারাক্ষণই আমার সাথে থাকে। আমি অফিসে গেলে সে আমার ঘর গুছিয়ে রাখে। আমার ভালোই লাগে। আমি বুঝতে পারছি আমি নিশির প্রতি দুর্বল হয়ে পরছি। দুর্বলতা বাড়তেই থাকল। আজ অফিস থেকে ফিরেই দেখি দরজার সামনে বাড়িওয়ালার মেয়ে ইমা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বলল
ঃ কেমন আছেন?
ঃ এইতো ভাল।
ঃ আপনি কেমন আছেন?
ঃ ভাল। আপনার এখানে কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?
ঃ নাতো।
ঃ ও আচ্ছা।
ঃ ভেতরে আসুন না।
ঃ না না আজ একটু বের হচ্ছিলাম। পরে আসব। আর আপনার কোন সমস্যা হলে আমাকে বলবেন।
ঃ আচ্ছা।
ঃ আমার নাম্বার টা রাখুন।
ঃ আচ্ছা।
ইমা আমাকে নাম্বার টা দিয়ে চলে গেল। আমি ঘরে ঢুকলাম। কাপড় বদলাচ্ছিলাম। মনে হল আমার পেছনে কেউজন এসে দাড়িয়েছে। আমি জানি নিশি। এখন আমি ওর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। আমি না তাকিয়েই বললাম
ঃ কেমন আছ নিশি?
ঃ তুমি ওই মেয়ের সাথে কথা বলেছ কেন?
ঃ আমি কি করব ওইতো কথা বলতে আসলে তাই।
ঃ ওর সাথে আর কথা বলবা না।
ঃ কিন্তু কেন?
ঃ আমার ভালো লাগে না। তুমি শুধু আমার সাথেই কথা বলবে।
ঃ আচ্ছা ঠিক আছে।
আমি সোফায় বসলাম। নিশি আমার পাশে বসলো। আমার হাত আলতো করে স্পর্শ করল। আমি ওর দিকে তাকালাম। ওর চোখে পানি। আমি আদুরে গলায় বাললাম
ঃ নিশি কাঁদছ কেন?
ঃ আমি তোমাকে ভালোবাসি।
ঃ আমি জানি।
ঃ তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না কখনো। আমি নিশির হাত ধরলাম। বললাম
ঃ আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না নিশি। আমি তোমার কাছে আসতে চাই।
আমি ছাদে দারিয়ে আছি। আজ আমি অনেক খুশি। আজ আমি আমার নিশির কাছে যাব। আকাশে অনেক সুন্দর চাঁদ উঠেছে। জোছনা ভাসিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীকে। আমি রেলিং এ উঠে দাড়ালাম। কোথা থেকে যেন এক ঝাপটা বাতাস এল। আমি পরে যাচ্ছি। নিচে নিশি দাঁড়িয়ে আছে। আমি যাচ্ছি আমার নিশির কাছে। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন আমায় ধরে ফেলল। ইমা আমাকে ধরে রেখেছে।
ঃ কি করছেন আপনি। নেমে আসুন। আসুন বলছি। আমি নেমে আসলাম। ইমা আমাকে ধরে রেখেছে। ভীষন শক্ত করে যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাব আমি। কাঁদছে মেয়েটা। কেন জানি না। হয়তো সব কিছু জানতে নেই। আমার টেবিলের উপর একটা চিরকুট ভাজ করে রাখা। আমি খুললাম,
‘ আমি তোমাকে চেয়েছি। হয়তো কিছুটা অন্যায় ভাবেই চেয়েছি। তবে এভাবে তো চাইনি। আমি না হয় অপেক্ষায় থাকলাম তোমার অন্য কোথাও। ভালো থাকো তুমি।’ বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায়। সামান্য বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে আমার গায়ে। আমার কয়েক ফোটা চোখের জল বৃষ্টির ফোটার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। আমি আছি অপেক্ষায়। তোমার অপেক্ষায়..