অপেক্ষার_শেষ_প্রহর

অপেক্ষার_শেষ_প্রহর

রাবেয়া বাগানে প্রবেশ করলো।
ঐ তো কবরটা, এগিয়ে গিয়ে কবরের মাটি সরাতে লাগলো।
মাটি সরানো সেসেই, রাকিবের দেহটি বেরিয়ে আসলো। রাবেয়া কবরের ভেতরে নেমে, হাটু ভাজ করে বসে, রাকিবের মাথা কোলে রেখে, নাকে হাত দিয়ে দেখলো।—

—নিশ্বাস চলছে কিনা। নাহ, নিশ্বাস চলছে না। রাবেয়া ফুপিয়ে কেদে উঠলো। পৃথিবীর সমস্ত ব্যাথা এসে রাবেয়ার কলিজায় চেপে বসেছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সব আসা ভালোবাসা মূহুর্তেই শেষ। রাকিব যে রাবেয়ার বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

ভালোবাসার দায়ে, রাবেয়ার বাবা রাকিবকে লোকজন দিয়ে জ্যান্ত মাটিচাপা দিয়েছে। আর রাবেয়াকে বেধে রাখা হয়েছিলো সক্ত শেকলের বাধনে। রাবেয়ার চোখের জলে, মাটি ভিজে গলে গেলেও, রাবেয়ার বাবার হৃদয় একটুও গলেনি।
রাবেয়ার পাহারাদার, রাবেয়ার চোখের জলে ভেজা নরম মাটিতে আছাড় খেয়ে জ্ঞান হারালে। রাবেয়া অনেক কষ্টে নিজেকে বাধন মুক্ত করে, এখানে ছুটে এসেছে।

ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। রাবেয়া উঠে, ফজরের নামাজ পড়লো।
তারপর আবার কবরের ভেতরে নেমে, রাকিবকে উপরে তোলার চেষ্টা করতে লাগলো। হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঝাকুনিতে, রাকিবের মুখ থেকে গোঙ্গানির সব্দ বেরিয়ে এলো।
রাবেয়া রাকিবের বুকে কান পেতে শুনলো, রাকিবের হৃদস্পন্দন চলতে শুরু করেছে।
কোনো মতে রাকিবকে টেনে উপরে তুলতে সক্ষম হয়েছে রাবেয়া। এবার যতটা সম্ভব রাকিবকে নিয়ে দ্রুত এখান থেকে চলে যেতে হবে।
কারণ যেকোনো মূহুর্তে রাবেয়ার বাবা তার দলবল নিয়ে চলে আসতে পারে।

রাবেয়া অনেক কষ্টে, রাকিবকে ওর কাধে ভর করিয়ে, একটু একটু করে দূরে সরিয়ে নিয়ে জাচ্ছে। রাকিবের শরীরের ভার বইতে গিয়ে, ঝোপের ভেতরে পরে থাকা কাটার আঘাতে, রাবেয়ার পা থেকে রক্ত ঝরতে লাগলো।

হঠাৎ রাবেয়া খেয়াল করলো, তার বাবা দলবল নিয়ে এদিকেই ছুটে আসছে। রাবেয়া ততক্ষণাত রাকিবকে নিয়ে একটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। রাবেয়ার বাবার লোকজন এদিক সেদিক খুজে বেড়াচ্ছে তাদের।

হঠাৎ রাকিবের জ্ঞান ফিরলো। প্রচণ্ড পানির পিপাশায় রাকিব ছটফট করছে। এই অবস্থায় রাবেয়া ঝোপের আড়াল থেকে বের হতেও পারছেনা। কারণ বের হলেই, লোকজনের হাতে ধরা পরে যাবে।

রাকিবের ব্যাথিত, তৃষ্ণার্থ মুখটা দেখে, রাবেয়ার চোখ থেকে অঝোরে জল ঝরতে লাগলো। রাকিবের কপালে একটি চুমু খাওয়ার জন্য মুখ বাড়াতেই, রাবেয়ার চোখ থেকে ঝরে পরা কয়েক ফোটা জল, রাকিবের মুখে পরলো।
সেই জলেই রাকিবের গলা ভিজলো, আবার রাকিবের নিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলো।

চোখ মেলে রাবেয়াকে দেখে, বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেদে উঠতেই, রাবেয়া তার হাত দিয়ে রাকিবের মুখ চেপে ধরে; রাকিবের বুকে বুক মিলিয়ে চুপ হয়ে, নিরবে কাদতে লাগলো।

একটু পরেই রাবেয়ার বাবা তার দলবল নিয়ে চলে গেল। রাকিব ধীরে-ধীরে উঠে বসলো। রাবেয়ার ক্লান্ত দেহটি ধীরে-ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছে। রাকিবের কোলে মাথা রেখে রাবেয়া বললো, ” এবার মরণ এলেও আমি হাসিমুখে তোমার কোলে মাথা রেখে মরতে পারি”। রাকিব রাবেয়ার মুখ চেপেধরে বললো, ” না, না, তোমার মুখে এই কথা শোনার আগে, আমার জ্যান্ত মরা অনেক ভালোছিলো।

— সত্যি রাকিব, এক পলকের জন্য তুমি আমার চোখের আড়াল হলে, আমার হৃদয়ের স্পন্দন থেমে জায়। বুকফাটা কান্নায় পাগল হয়ে জাই, মনে হয় আমি নিশ্ব।

— আমাকে যখন জ্যান্ত মাটি দেয়া হয়েছিলো, আমার নিজের জন্যে আমার একটুও কষ্ট হয়নি রাবেয়া। সুধু আমাকে হারিয়ে তুমি দিনরাত কাদবে, পাগল হয়ে যাবে, কে তোমাকে আমার মতো এতটা ভালোবাসবে, এসব ভেবে চোখের জল বাধা মানেনি তখন। আমি তো এসব ভেবে, দিশাহারা হয়ে, মরণের আগেই মরেছিলাম।

— এই জীবন তোমার জন্যে। তাই মরণ তোমার জন্যই যেন হয়। তা না হলে ভালোবাসা, ভালোবাসা’ই নয়।

কথা শেষে রাবেয়া কেদে উঠলো। রাকিব রাবেয়াকে সক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে, গালে, ঠোঁটে, কপালে, অনেকগুলো চুমু খেয়ে বললো, ” কে দেখেছে হাজার জনম, কে বলেছে আছে ?, লক্ষ জনম আমরা’ই দুজন, ছিলাম যেন কাছে। বুকের ভেতর প্রেমের শত চিহ্ন যেন রয়, – তা না হলে ভালোবাসা, ভালোবাসাই নয়”।

রাবেয়া রাকিবের কপালে চুমু খেয়ে বললো, ” চলো, এই বলেশ্বর নদী পার হয়ে, ওপারে গিয়ে, দুজনে পাড়ি দেবো অচেনা কোনো যায়গায়, যেখানে আমাদের পবিত্র ভালোবাসাকে কেউ মাটিচাপা দিতে আসবে’না। দুজন দুজনকে ভালোবেশেই প্রকৃতির নিয়মে তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাবো। তাহলে মরেও সান্তি পাবো”।

দুজনে নদীর চরে হাটতে হাটতে, গাবতলা এসে একটি নৌকায় উঠে, ওপারের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। নদীর মাঝখানে এসে দেখলো, নদীর এপারে, ওপারে, দুই পারেই রাবেয়ার বাবার লোকজন এসে হাজির। রাকিবের মুখ সুকিয়ে গেল, ” এবার কি হবে “?।
রাবেয়ার বুকের ভেতর হাহাকার, আর ব্যাথার ঝড় বইতে লাগলো।
রাকিবের অসহায় দুটি চোখ তাকিয়ে আছে রাবেয়ার দিকে। তাই দেখে রাবেয়ার চোখের জল টলমল করে উঠলো। রাকিবের চোখে চোখ রেখে, কান্না জড়িতো কন্ঠে রাবেয়া বললো, ” নিষ্ঠুর ঐ লোকগুলো কিছুতেই আমাদের এই নিস্পাপ ভালোবাসাকে বেচে থাকতে দেবেনা”।

” তাহলে এখন কী হবে ” রাকিব বললো।
রাবেয়া মুচকি হেসে, উঠে দাড়িয়ে, নৌকার বৈঠা দিয়ে নৌকার মেঝেতে জোরে আঘাত করতেই। নৌকার তলা ফুটো হয়ে গলগল করে পানি উঠতে লাগলো।

রাকিব বললো, ” এটা কী করলে ?

— আমার বাবার লোকজন তোমাকে মেরেফেলবে রাকিব, আর আমি সেই দৃশ্য সইতে পারবোনা। তুমি ছাড়া আমি বাচতে চাইনা। তাই নৌকা ফুটো করলাম, বাচতে হলে একসাথে বাচবো, আর মরতে যখন হবে, দুজনে একসাথে ডুবে মরবো।

রাকিব এগিয়ে এসে রাবেয়াকে সক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, ” এভাবেই একজন আর একজনকে আকড়ে ধরে যেন মরতে পারি। রাবেয়া রাকিবকে সক্ত করে জড়িয়ে ধরে, মুচকি হেসে, রাকিবের কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো, ” পাগলা আমার “।
রাকিব রাবেয়ার কপালে চুমু খেয়ে, মুচকি হেসে বললো, ” তার জন্যই তো তোমার সঙ্গে হাসিমুখে মরতে রাজি।
দুজনের চোখের জল অঝোরে ঝরছে।

নৌকা পানির নিচে ডুবে গেলো। সেই সাথে ডুবলো দুটি হৃদয়ের নিস্পাপ, পবিত্র ভালোবাসা।

পরদিন ওদের লাশ পাওয়া গেল নদীর তিরে। সেভাবেই জড়িয়ে ধরে আছে একে অপরকে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত