টাকার মোহ

টাকার মোহ

সামেয়াকে দেখেই ট্যাক্সিটা থামিয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে রঞ্জু। বলার মতো কোনো কথা আর খুঁজে পেল না। সাহসও হলো না। তারপর মনে কৃত্রিম সাহস তৈরি করে কাছে গিয়ে বলল, সামেয়া, কি করো এখানে?

চোখ ঘুরিয়ে রঞ্জুর দিকে হালকা একটু দৃষ্টি দিয়ে বেশ স্বাভাবিকভাবেই সায়েমা বসে রইল। বলল না কিছুই।
বেলা সাড়ে তিনটা। সামেয়া তার বান্ধবী নিতুর সঙ্গে রোজবেরি পার্কে একটা বেঞ্চিতে বসে গল্প করছে। অদূরে ঘাসের ওপর ছোট্ট একটি বল নিয়ে খেলা করছে নিতুর চার বছরের মেয়েটি। এ সময় রঞ্জু ট্যাক্সি নিয়ে রোথস চাইল্ড অ্যাভিনিউ ধরে যাচ্ছিল বিমানবন্দরের দিকে।
সামেয়ার এই উদাসীনতায় রঞ্জু ট্যাক্সি থেকে নেমে কাছে এসে বলল, এভাবে দূরে দূরে থাকা। পরের মতো আচরণ। এসব করে কি হবে বল? তোমারও কষ্ট, আমারও কষ্ট। তুমি বুঝি আর…।
রঞ্জুর কথা শেষ না হতেই সামেয়া শান্ত ও সহজভাবে বলল, ড্রাইভার সাব, আপনে এখানে দাঁড়িয়ে মূল্যবান সময়টা কেন নষ্ট করছেন? তাড়াতাড়ি ডমিস্টিক এয়ারপোর্টে গিয়ে সিরিয়াল দেন। প্লিজ।
সামেয়ার শক্ত মনোভাব টের পেয়ে রঞ্জুর মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হলো না। আস্তে করে ট্যাক্সিতে এসে ছুটে চলল বিমানবন্দরের দিকে।
রঞ্জু চলে গেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে সামেয়া নিতুকে বলল, দেখলি নিতু, নির্লজ্জ কারে কয়।
নিতু কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল, তোদের স্বামী-স্ত্রীর মান-অভিমান। এখানে লজ্জার কী আছে?
—স্বামী-স্ত্রী!
নিতু হাসি চেপে বলল, নয়তো কি?
—চুপ থাক। আর একটা কথাও না। এই লোকটারে দেখলেই আমি অসুস্থ হয়ে যাই। তুই তো সবই জানিস।
অনুতপ্ত হয়ে নিতু তখনই প্রসঙ্গটার ইতি টানে। এতক্ষণ দুজনে নানা বিষয়ে গল্প চলছিল। হঠাৎ করে রঞ্জু উদয় হওয়ায় পরিবেশটাই কেমন যেন সুর হারিয়ে ফেলে। চোখের দিকে একঝলক তাকিয়ে নিতু দেখল সামেয়ার আনমনা চোখ দুটো ভেজা।
মাসখানেক আগের কথা। দেশ থেকে একদিন খবর এল সামেয়ার বাবা হঠাৎ স্ট্রোক করে হাসপাতালে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে। সঙ্গে সঙ্গেই সামেয়া ছোট ভাই শুভর সঙ্গে স্কাইপেতে কথা বলে দেখতে পেল তার বাবা হাসপাতালের বিছানায়। মুখটা বাঁকা হয়ে গেছে। জিহ্বাতেও আড়ষ্টতা দেখা দিয়েছে। এক-আধটু কথা বলতে পারলেও বোঝা যাচ্ছে না কিছুই। ওদিকে ইংল্যান্ডের অভিবাসী সামেয়ার মেজ ভাই অপুর সঙ্গেও কথা হয়। বাবার অসুখের কথা শুনেই সে টিকিট কনফার্ম করে ফেলে। অপু পরদিন সকালে ঢাকার উদ্দেশে ফ্লাই করবে।
স্কাইপেতে বাবার অবস্থা দেখে সামেয়ার বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। তার ইচ্ছে করছিল তখনই পাখির মতো উড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। তার আজীবনের এত কাছের, এত আপনজন। এত হাসিখুশি বাবা আজ কেন এমন! এই বাস্তবতা সে কিছুতেই মানতে পারছিল না। থেমে থেমে কেবল কান্না আসছে। দুপুরের আগে আগে রঞ্জু ঘুম থেকে উঠলে সামেয়া তাকে বাবার অবস্থা খুলে বলে। অবশেষে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে। মিনতিভরা কণ্ঠে শেষবারের মতো বাবাকে একটু দেখতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ জানায়।
রঞ্জু বলল, এখন কি করি বলো। এক বছরও হয়নি ফ্ল্যাট কিনেছি। সেভিংস দূরে থাক, ক্রেডিট কার্ডও মাইনাস হয়ে আছে। এ সময় দেশে যাওয়ার চিন্তা করাও তো বোকামি।
সামেয়া রঞ্জুকে আশ্বস্ত করে বলল, গত সপ্তায় আমি ট্যাক্স রিটার্ন করেছি। প্রায় তিন হাজার ডলারের মতো পাব। আশা করি দু-এক দিনের মধ্যেই অ্যাকাউন্টে এসে পড়বে। এই টাকাটা দিয়ে অন্তত বাবাকে একটু দেখে আসি। কি বলো?
রঞ্জু এবার বেশ বিরক্তি নিয়েই বলল, এত আবেগপ্রবণ হলে কী করে চলবে? তিনটা বিল আটকে আছে—কাউন্সিল বিল, গ্যাস-ইলেকট্রিসিটি বিল বাকি, আবার কাল এল ওয়াটার বিল। টাকা নেই, তাই দিতে পারছি না। বিদেশে বসবাসের এই কঠিন বাস্তবতা কে আর বোঝে, বল।
পরের দিনই যৌথ অ্যাকাউন্টে প্রায় তিন হাজার ডলার জমা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাকাউন্ট আবার শূন্য হয়ে গেল। আইফোনে ব্যালেন্স দেখে সামেয়া ফোন করলে রঞ্জু জবাব দেয়, এই টাকায় সব বিল পে করা হয়েছে।
এদিকে সামেয়া কোনো কিছুতেই মন দিতে পারছে না। কেমন এক অস্থিরতার ভেতর সময় কাটছে। খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ছটফট করছে। একা ঘরে সোফায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বেশ কিছুক্ষণ ডুকরিয়ে কাঁদল সামেয়া। বাবা ভালো হবে তো? দেশে গিয়ে বাবাকে আবার দেখব তো? বাবার কাছে আমার চাওয়া-পাওয়ার কোনো বাধানিষেধ ছিল না কখনো। বিয়ের পরই তো মনের পায়ে লাগল শেকল। এসব ভাবতে গিয়ে বুকটা যেন তার ভেঙে যাচ্ছে।
অফিসে ম্যানেজারকে ফোন দিয়ে চাকরি থেকে ছুটি নেয় সামেয়া। তারপর শুভর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়। বাবার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই ডাক্তারের পরামর্শে রোগীকে বাড়িতে নেওয়া হয়েছে। যথাসম্ভব সেবাযত্ন করার পাশাপাশি ভালো খাবার যা খেতে চায় দেওয়া হচ্ছে। আপনজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ চলছে। বাসা যেহেতু হাসপাতালের পাশেই, কোনো জরুরি প্রয়োজনে ডাক্তার কাছে পেতে সমস্যা হবে না। এই পর্যায়ে রোগীকে হাসপাতালে রাখার কোনো মানে হয় না। আবার সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে হলে কত অসম্ভবই তো সম্ভব হয়। তাই গতকাল সন্ধ্যায় বাবাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
শুভর সঙ্গে কথা শেষ করে কেঁদে বুক ভাসিয়ে সামেয়া আবার রঞ্জুকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করে, আমার এই কথাটা শুধু একবার ভেবে দেখো। এ দেশে যখন আছি, চাকরি তো সারা জীবনই করব। আজ টাকাপয়সার টানাটানি চলছে, একদিন হয়তো থাকবে না। বাবা এখন শুধু আঙুর আর কমলার রস একটু একটু খেতে পারে। তুমি আমাকে একটা টিকিট করে দাও। বাবাকে একটু দেখে আসি। মনটাকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছি না। প্লিজ রঞ্জু, প্লিজ। আমাকে একটু বুঝতে চেষ্টা কর। আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
রঞ্জু কথার কোনো জবাব দিচ্ছে না দেখে সামেয়া বলল, নিজে যেতে না পারি, শুভকে কিছু টাকা পাঠাই। আমার পক্ষ থেকে সে কিছু আঙুর আর কমলা আব্বার জন্য…। আমি তো কিছুই করতে পারছি না।
কান্নায় সামেয়া আর কোনো কথাই বলতে পারল না।

 

স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে রঞ্জু বলল, আহা, এমন করছ কেন? বাবার বয়স হয়েছে। দুদিন আগে আর পরে সবারইকে তো যেতে হবে। টাকা পাঠাতে চাও? আমার মনে হয় তোমাকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তোমার এক ভাই নেত্রকোনার ডিসি। বাংলাদেশে একজন ডিসি কি তা বোঝো? তার টাকার অভাব নেই। আরেকজন আছে লন্ডনে। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের বিরাট ব্যবসা তার। তোমার এই কয়টা টাকার জন্য কি তারা বসে আছে? সবার সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে। বাবার যত্নআত্তি কোনো দিকেই কম হচ্ছে না।
রঞ্জুর সঙ্গে কথা আর না বাড়িয়ে ফোনটা রাখতেই সামেয়ার মনে পড়ে অতীতের কিছু কথা। বিয়ের পর যত দিন সে দেশে ছিল, শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে রঞ্জু কিছুতেই চাইত না। এমনকি রঞ্জু একটি টাকাও তাকে দিত না। বারবার বলত, তোমার বাবার এত এত টাকা। ভাইয়েরা টাকার পাহাড়ে ঘুমায়। বাধ্য হয়ে সামেয়া বাবার কাছে চেয়ে নিত খরচের টাকা। শেষ পর্যন্ত সামেয়ার বাবাকেই দিতে হয়েছিল তার স্পাউজ ভিসার অ্যাপ্লিকেশন ফি। বিমান ভাড়াসহ দিতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছা পর্যন্ত যাবতীয় খরচ। রঞ্জুদের বাড়ি থেকে কেউ একটা ফোন পর্যন্ত করেনি। শ্বশুরকুলের লোকজনের এমন আচরণে পরিবারের সবার কাছে লজ্জায় চুপসে যায় সদ্য বিবাহিত সামেয়া।
স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়ায় নিজে ঠকে শাস্তিটুকু ধরে রাখার চেষ্টায় সামেয়া কখনো কোনো ত্রুটি করত না। নতুন বাসা কিনে সচ্ছলতার মুখ দেখতে হয়তো আরও বছর দুই-তিন লেগে যাবে। অ্যাকাউন্টে বেতন জমা হওয়ার পরদিনই মর্টগেজ রিপ্লেসমেন্ট আর কত রকমের বিল। সব টাকা শেষ হয়ে যায়। সব খরচের পর এক ডলার সেভিংসের কথা চিন্তাও করা যাচ্ছে না। এদিকে নেক্সট পেমেন্ট আসতে আরও দশ দিন বাকি। নিতুর কাছে কিছু টাকা ধার করে পাঠানো যেতে পারে। কথাটা এভাবে ভাবতেই লজ্জায় ঘৃণায় সামেয়ার মরে যেতে ইচ্ছে হলো। এমন ভালো বেতনে আজ আট বছর ধরে চাকরি করছে সে। অসুস্থ বাবার জন্য আজ কেন তাকে এত লুকোচুরি করতে হবে। কেন পরের কাছে হাত পাততে হবে।
এমন আরও নানান কথা ভাবতে ভাবতে পরদিন মুমূর্ষু বাবার চেহারাটা স্কাইপেতে দেখে সামেয়া স্থির করেছিল অপুর কাছে কিছু টাকা ধার করবে। অথবা বুকিং কনফার্ম করে একটা টিকিট পাঠিয়ে দিতে বলবে। পরক্ষণেই সামেয়ার মনটা দমে যায়। অপু ভাই যদি বলে বসে, এত বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ায় আছিস। একটা টিকিট করে দেশে আসতে পারিস না? তারপরও অপুর স্ত্রীর কথা মনে পড়ে সামেয়ার মনটা আরও দমে যায়। মনে মনে বলে, মাগো! ভাবি যে দজ্জাল। তার জন্যই অসময়ে আমার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হলো। হাওয়া থেকে এক অপবাদ রটিয়ে আমাদের পারিবারিক এত সুন্দর বন্ডিংসটা নষ্ট করে দিয়েছে। নষ্ট করে দিয়েছে আমার জীবনটা। নইলে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে আমি বিয়ের নামটাও মুখে আনতাম না।
এমন বিভিন্ন টানাপোড়েনের ভেতর দিন পার হচ্ছে। পাঁচ দিন পর একদিন ভোরে সামেয়ার মোবাইলে শুভর নম্বর থেকে একটা সংক্ষিপ্ত মেসেজ আসে, ‘আপা, বাবা আর নাই।’
বাবার স্বাস্থ্যের খুবই অবনতি জানতে পেরে সামেয়া তখন ড্রয়িংয়ে বসে দেশে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করছিল। কেউই উত্তর করছিল না। একটু পরই জীবনের সবচেয়ে নির্মম খুদেবার্তাটি এল সামেয়ার মোবাইলে। মেসেজটি পড়ার পর মনের অজান্তেই মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে যায়। রঞ্জুকে কী যেন বলতে বেডরুমে এসে দেখে সে তখন গভীর ঘুমে। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ সামেয়ার নিজের কাছেই নিজেকে পর মনে হতে লাগল। সমস্ত মোহের পেছনে যে এক বিরাট মিথ্যা লুকিয়ে আছে, কোনো এক অদৃশ্য ইঙ্গিত তার চোখের ওপর থেকে ওই পর্দা টেনে সরিয়ে সংসারের আসল রূপটা দেখিয়ে দেয়।
তার কী এখন খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে?
না।
বিলাপ করে বুক চাপড়াতে ইচ্ছে করছে?
কই? না তো।
নিজেকেই যেখানে অচেনা মনে হচ্ছে, সেখানে এই ফ্ল্যাটবাড়ি, রঞ্জু? একবার ঘুমন্ত রঞ্জুর দিকে, আবার বাসাময় চোখ বুলিয়ে সামেয়ার কেমন যেন ভয় করতে লাগল। এমন এক ভয়, পিস্তল তাক করে মৃত্যুর হুমকিদাতা ডাকাতকেও মানুষ হয়তো এত ভয় করে না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রয়োজনীয় কিছু কাপড় একটা ব্যাগে পুরে সামেয়া নিতুর বাসায় চলে আসে।
এসেই তাকে বলল, এই, তোরা সাবলেট খুঁজছিস, তাই না?
অপ্রস্তুত নিতু বলল, হ্যাঁ, খুঁজছি তো।
—আজ থেকে আমি তোদের সঙ্গে থাকব। মাসখানেক পরে দেশে যাব। বাবাকে তো দেখতে পেলাম না। অন্তত বাবার কবরে লুটিয়ে পড়ে কিছুক্ষণ কাঁদব। তাও যদি মনটা হালকা হয়।
—কি, আংকেল মারা গেছেন?
সামেয়া বলল, হু।

পরদিনই সায়েমা-রঞ্জুর যৌথ অ্যাকাউন্ট আলাদা হলো। সায়েমা তার মোবাইলে রঞ্জুর নম্বর ব্লক করল। ব্লক করল ফেসবুক আর ইমেইল। বাবার মৃত্যুতে শোকাহত মনটা ধীরে ধীরে কালবৈশাখীর তাণ্ডব পর্যায় পার হয়ে শান্ত হতে লাগল। তবে মনের আকাশে ভারী মেঘ ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য গতি নিয়ে আরও ভারী হতে থাকে। কেউ সান্ত্বনা দিতে এলে সামেয়া রেগে যায়। দেশে মায়ের সঙ্গেই মাঝে মাঝে কথা হয়। কারও সঙ্গে যোগাযোগ আর তেমন নেই।
বাবার অবর্তমানে মায়ের মানসিক অবস্থার অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারপরও গত সপ্তায় অপুকে চলে যেতে হয়েছে। ওদিকে ব্যবসায় ক্ষতি তো হচ্ছেই। ছোট দুটি ছেলে নিয়ে তার স্ত্রী আর সামাল দিয়ে উঠতে পারছে না। মাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে এমন ইচ্ছে থাকলেও ভিসার অ্যাপ্লাই করতে কাগজপত্র রেডি করতে সময় যা লাগার লাগবেই। তবে সমস্যা অন্যখানে। অপুর এ প্রস্তাবে কী এক অজ্ঞাত কারণে মা বরাবরই ‘না’। নিজ বাড়ি ছেড়ে মা কোথাও যাবেন না। অনেক অনুরোধের পরও মা ভিসা ফরমে সই পর্যন্ত করেননি।
সেদিন পার্কে রঞ্জুর সঙ্গে দেখা হয়ে সামেয়ার মনের অবস্থা কী তা বোঝা গেলেও ওদিকে রঞ্জু ডমিস্টিকে যেতে গিয়েও আর পারল না। ঝড়ের কবলে পড়া পাখির মতো অতি চেনা পথও সে ভুলে যাচ্ছে। গাড়ির স্টিয়ারিং ডানে ঘোরাতে গিয়ে ঘুরছে বামে। মাসকট শপের কাছে গিয়ে ট্যাক্সিটা পার্ক করে উদভ্রান্তের মতো ঘোরাঘুরি শুরু করে দেয়। বাংলা দোকান থেকে এটা-ওটা কেনে। ড্যাপল ফ্যাশনে গিয়ে বেশ কয়টা দামি থ্রি পিস আর শাড়ি কেনে। সব মিলিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় দেড় হাজার ডলারের শপিং করে ফেলল সে। নিতুর বাসার সামনে এসে কলবেল টিপলে সামেয়া দরজা খুলে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ কারও কোনো কথা নেই।
আশা জড়ানো হাসিতে রঞ্জু বলল, সামেয়া, প্লিজ বাসায় চল। আজ এক মাস হয়ে গেল তুমি নেই। অ্যাকাউন্ট আলাদা…। আমি একা। কী করে সম্ভব?
রঞ্জুর কথা শেষ না হতেই সামেয়া বলল, এই যে ড্রাইভার সাব, আজ আমরা কেউ ট্যাক্সি কল করিনি। আপনি এখন যান।
বলেই ধড়াম করে দরজা লক করে দেয়। সামেয়ার আচরণে রঞ্জুর আর বুঝতে বাকি রইল না, সময় তার আপন গতিপথ ধরে কোথায় কোন নিরুদ্দেশে হারিয়ে গেছে। পরদিন শনিবার। সামেয়ার ছুটির দিন। কাল সকালে আবার এলে সামেয়ার মনটা হয়তো একটু সহজ হতে পারে। এই ভেবে রঞ্জু চলে গেল।
পরদিন বেলা এগারোটার দিকে রঞ্জু এসে কলবেল টিপলে নিতু বলল, রঞ্জু ভাই, কেমন আছেন?
—জি, কেমন আর থাকি। ভাবি, সামেয়া কি করে?
—এই দশ মিনিট আগে বের হয়ে গেছে। দেশে যাচ্ছে।
—বলেন কি!
—আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার। আমার আর বলার কী আছে ভাই।
সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত ড্রাইভ করে রঞ্জু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে চলে এল। সামেয়া তখন চেক-ইন পার হয়ে ইমিগ্রেশনে প্রবেশের পথে। নিরাপত্তাকর্মীরা তার টিকিট-পাসপোর্ট দেখছে।
রঞ্জু চিৎকার করে বলে, সায়েমা!
সামেয়া ততক্ষণে কয়েক কদম ভেতরে চলে গেছে। রঞ্জুর ডাক শুনে ফিরে তাকিয়ে বলল, দেশে গিয়ে মাকে নিয়ে বাকি জীবন যদি একাও থাকি, তাও মনে কোনো দুঃখ থাকবে না। সুন্দর মনের একজন মানুষের চেয়ে বড় সম্পদ আর নেই। অস্ট্রেলিয়ায় আর ফিরব না। এখানেই শেষ। তুমি ডলারের বস্তায় মাথা রেখে ঘুমাও।
মনে মনে সামেয়া বলল, বিয়ে হলো আজ নয় বছর। মা ডাক শোনার ভাগ্য আজও আমার হলো না। সন্তান কোলে নিয়ে মমতার জড়াড়ড়ি আমার আর হলো কই। অর্থের পেছনে বিলীন হয়ে যাওয়া জীবন আমি চাই না, চাই না।
আঁচলে চোখ মুছে সামেয়া দ্রুত ভেতরে চলে যায়। এতক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জুর হঠাৎ বিকার দেখা দেয়।
সামেয়া! সামেয়া! বলে চিৎকার করতে করতে নিরাপত্তাকর্মীদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রঞ্জু ভেতরে ঢুকে পড়লে প্রবেশপথে পরিস্থিতি অস্থির হয়ে পড়ে। সামেয়া ইমিগ্রেশন লাইন থেকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে প্রবেশপথে রঞ্জুর সঙ্গে তিনজন নিরাপত্তাকর্মীর প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি চলছে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত