সমাধি

সমাধি

– আম্মু, আম্মু
– কি হইছে তোহা?
– তোমাকে কে পারমিশন দিছে পাশের বাসা ভাড়া দিতে?
– মানে!
– তুমি ওটা ভাড়া দিছো কেন?
– তাতে কি হইছে?
– আমি এখন আমার বন্ধুদের এনে আড্ডা দিব কই?
– আড্ডা দিতে হবে না, আর আড্ডা দিতে চাইলে কলেজে গিয়ে দিস।
– ইই মাথা গরম করবা না কিন্তু!
– যা যা বসে থাক গিয়ে , আদর দিয়ে বাঁদর তৈরি করে ফেলছি।
– ধ্যাত্,
.
কেমন লাগে এখন, রাগে লুচির মতো ফুলতে শুরু করছি এখন। কখন যে ফেটে গিয়ে বাড়িটাই আচমকা ফিনিশ করে দেই নিজেই বুঝতে পারছি না। দরকার ছিলো কি পাশেরটা ভাড়া দেওয়ার? অবসর সময়ে বান্ধবীদের ডেকে এনে পাশেরটায় আড্ডা দিতাম আর এখন ওখানে নতুন মানুষ গুলো থাকবে আমি আর আড্ডা দিতে পারবো না। উহুঁ উহুঁ, ভাবতেই কান্না পাচ্ছে এখন।
.
পাশে বললে ভুল হবে, সেই বাসাটা এই বাসার সামনে মানে মুখোমুখি। দুইটা বাসাই আমার আব্বুর, দুটোই ছাদওয়ালা একতলা বাসা। ওটা সম্ভবত ভাড়া দেওয়ার জন্যই আব্বু তৈরি করছিল কিন্তু ভাড়াটিয়ার অভাব হওয়ার জন্য আমিই আড্ডা দেওয়ার জন্য ওটা দখল করে নেই কিন্তু আজ সকালে ওটায় নতুন ভাড়াটিয়া এসে জুটেছে। আমার সবকিছু মাটি হয়ে গেল, কি যে করি এখন। এখন বন্ধুদের ডেকে এনে আর আড্ডা দিতে পারবো না, এখন শুধু কলেজে গিয়ে আড্ডা নয়তো বাসায় চুপ করে রিমোট হাতে টিভির সামনে বসে থাকা।
.
আর আজকে শুক্রবার, বেলা বারটা বাজে। এগারটার সময় ঘুম থেকে উঠেছি। ফ্রেস হয়ে খাওয়া শেষ করে ছাদে এসেই দেখি ওই বাসায় মানুষ তাই আমার আর বোঝার বাকি রইলো না ওনারা কে! রাতে কত প্লান করে রাখছি আজ ওদের ডাকবো, নতুন নতুন আইটেম বানাবো তারপর খাব আর হইহুল্লোড় করবো কিন্তু আব্বু এভাবে আমার প্লানে পানি ঢালবে ভাবিনি। এখন আবার সবাইকে ফোন করে বলবো, এই তোরা আসিস না, আর কখনো আমার বাড়িতে আড্ডা হবে না।ওদের এগুলো বলতেও এখন লজ্জা করবে।
.
আমি রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে বসে টিভি দেখতে গেলাম। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর রুমে আর মন টিকলো না তাই আম্মুকে জানিয়ে আমি আমার বন্ধু রুনার বাসায় চলে গেলাম। ওই বাসার দিকে আর তাকাইও নাই, কে না কে আসছে আমি দেখে কি করবো যত্তসব!
.
নামটা তো প্রথমে আপনাদের আম্মুই বলে দিছে, তোহা আর আমি এবার ডিগ্রি ফাস্ট ইয়ারে পড়াশোনা করি। তো চলে গেলাম রুনার বাসায়। সেখানে আমি আর রুনা জমিয়ে আড্ডা দিলাম। উফ রুনার আম্মু যে স্বাদ করে বিরিয়ানি রান্না করে শুধু খেতেই মন চায়। দুপুরের খাবারটা রুনার সাথে ওর বাসায়ই শেষ করলাম।
অতঃপর ৩:৪৫ মিনিটে রওনা দিলাম বাসার দিকে। রিক্সা করে আমার বাসা পর্যন্ত আসলাম তারপর গুটিগুটি পাঁয়ে বাসার দিকে যেতে লাগলাম, আমার বাসায় যেতে আগে সামনের বাসার নীচ দিয়ে আসতে হয় আর সেটার নীচে আসা মাত্রই ঝপাত্,
.
ভাবছেন আমি পরে গেছি, একদমই না। কোন বাঁদর যেন উপর থেকে সাবান লাগানো পানি ফেলে দিছে আর তার পুরোটাই আমার উপর ফেলছে, একেবারে গোসল করিয়ে দিছে রে। কয়েক টন রাগ নিয়ে উপরে তাকালাম, দেখি এক বজ্জাত ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে হরিপদ ব্যান্ডওয়ালা ছবির হরিপদর মতো করে হাসছে। রাগে গা গজগজ করতে লাগলো আমার। তো আমি নীচে থেকেই শুরু করলাম।
.
– ওই চার আনার হরিপদ এটা কি করলি?
– জ্বী কাকে বলছেন?
– আইছে রে ন্যাকা ষষ্ঠী, এখন কিছুই বুঝে না। জল ফেললি কেন আমার উপর?
– আমি আপনার উপর কখন জল ফেললাম, আমি তো নীচে ওই পিচ্চি পিচ্চি চারাগাছ গুলোকে বাঁচানোর জন্য ওদের উপর জল ফেললাম কিন্তু কোথা থেকে যেন আপনি এসে পরলেন নীচে তাই আর কি জলটা আপনাকেই চোখে দেখলো।
– দ্যাখ এখন কিন্তু আমার ঝগড়া করার মোড নাই, ফাজিল কোথাকার! তোর সাথে কথা বলাই আমার ভুল হইছে।
– যান যান ভাগেন, এরপর আমার সামনে আসলে ঝগড়া করার মোড নিয়ে আসবেন তাহলে দেখবেন পরে অনেক মোড পাবেন।
– যত্তসব।
.
ওখানে আর এক মূহুর্ত না দাড়িয়ে দৌড়ে আমার বাসায় এসে বাথরুমে চলে গেলাম। গোসল সেরে এসে ড্রয়িংরুমে বসে পরলাম মুখ ভরা রাগ নিয়ে আর তখনই আম্মু চলে আসলো পাকা ধানে মই দিতে।
– কি হইছে রে তোহা? এতো রেগে আছিস কেন?
– চুপ করবা তুমি? নাহলে কিন্তু সব ভেঙে দিব!
– আচ্ছা, করলাম। কেমনে যে এতো রাগি হইছে কপালে জানে ( বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল ওনার রুমে)
.
টানা পঁয়ত্রিশ মিনিট বসে থাকলাম ওখানে, একটুও এদিক ওদিক নড়াচড়া করিনি, এতক্ষণ পর মাথাটা একটু ঠান্ডা হলো, তাই ভাবলাম একটু ছাদে যাওয়া যাক, বিকেল হইছে ঠান্ডা বাতাস তো থাকবেই ছাদে তাই ওখানে যাওয়ার কথা ভাবলাম। যেই ভাবা সেই কাজ, ছাদের দিকে পাঁ বাড়ালাম।
.
ছাদে আগে থেকেই একটা চেয়ার দেওয়া আছে আমার জন্য, আমি গিয়ে শুধু ওটায় বসে থাকি তাই আজও গিয়ে বসলাম চেয়ারটায় কিন্তু পাশের ছাদে চোখ যেতেই আবার মাথাটা মরিচের মতো জ্বলে উঠলো, সেই বেয়াদব ছেলেটা আমার সামনে, বিপরীত ছাদে দাড়িয়ে আছে তবুও আবার আমার দিকে তাকিয়ে। এর সাহসের প্রশংসা করতে হয়। আবার দেখি হাতে একটা গিটার।
.
– এই এখানে কি করেন? আর আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? মেয়ে দেখলেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তাই না?
– আপনাকে কে বললো আমি আপনার দিকে তাকিয়ে আছি?
– দেখেই বোঝা যায়।
– আন্টি আন্টি দেখেন আপনার মেয়ে আমার দিকে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে আছে।
– আরে এই চুপ চুপ, ফাজিল কোথাকার! কি বলছেন এগুলো?
– ঠিকই বলছি।
– আমি আপনার দিকে তাকালাম কখন?
– আমার দিকে না তাকালে বুঝলেন কেমনে আমি আপনার দিকে তাকিয়ে আছি?
– এখন তো নিজেই ফেসে গেলাম ( মনে মনে বললাম)
– কি হলো কচুপরী? কি বিড়বিড় করেন?
– কিইই, আমি কচুপরী?
– একদম।
– আরেকবার বললে না জুতা খুলে মারবো, আমার সুন্দর একটা নাম আছে তোহা।
– এমন সুন্দর নাম শুনে তো কুত্তাও জ্ঞান হারাইবো।
– আপনার সমস্যা কি?
– আমি তো কোনো সমস্যা দেখছি না।
– তাহলে আমার সাথে এভাবে ঝগড়া করেন কেন?
– আপনিই তো আগে শুরু করছেন মিস কচুপরী।
– আবার?
– স্যরি স্যরি,
– হু, এলাকার সব পোলাপাইন আমার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে আর আপনি ঝগড়া করেন। কি ভাবেন নিজেকে?
– আপনি নিজেকে কি ভাবেন হুম? চেহারা সুন্দর বলে সব পোলাপাইন আপনার দাস হবে?
– এইরে আবার ঠকে গেলাম, ছেলেটা তো খুব শয়তান। যেকোনো সময় আমাকে ফেলুদা বানাই দিব, এখন কেটে পড়াই উওম কাজ হবে ( মনে মনে)
– কি হলো?
– শেট আপ, ( চলে আসলাম ছাদ থেকে)
.
রুমে এসে ভাবতে লাগলাম কি করা যায়! আমার পক্ষে ছেলেটা মোটেও সুবিধার না। যত তাড়াতাড়ি এদের এখান থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
– আম্মু, আম্মু
– কি আম্মু?
– পাশের বাসার ভাড়াটিয়াদের বদলিয়ে অন্য ভাড়াটিয়া আনো।
– পারবো না রে, ৪ মাসের এন্ট্রি করে নিয়েছে। চারমাসের আগে কিছুই করতে পারবো না।
– এই না হলে আমার আম্মু, তোমাকে তো এখন চুমু দিতে ইচ্ছে করছে।
– থাক আম্মু, দরকার নাই।
– ধুর হও আমার চোখের সামনে থেকে।
– যত্তসব,
.
আমি এখন কি করবো? রাগে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো, আমার তো এখন চিৎকার করে কাদতেঁ ইচ্ছে করছে, ও গড এ কোন ঝামেলায় ফেললা আমাকে?
রাতে পড়াশোনা শেষ করে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পরলাম। সকালে উঠে ফ্রেস হয়ে খাওয়া শেষ করে কলেজে চলে গেলাম।
.
বিকেল বেলা,
ড্রয়িংরুমে বসে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতেছি আর তখনই দেখি ওই বাসার পাজি ছেলেটা এসে হাজির। আর কি যেন বকবক করছে হেডফোনের জন্য শুনতে পারিনি। তাই হেডফোন সরালাম কান থেকে,
– কি হইছে এভাবে বকবক করছেন কেন?
– কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছেন?
– শুনতে পেলে তো উওর পেতেন নিশ্চই?
– বয়রা কোথাকার, কানে শুনে না।
– ওই হ্যালো ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলবেন নয়তো ভালো হবে না।
– এই আমি আমার ভদ্রতার সীমার বাইরে গেলাম কি করবেন? ( একটা লাফ দিয়ে আমার কিছুটা সামনে আসলো)
– উফফফ কেন এসেছেন বলেন,
– আপনার আম্মুকে একটু ডেকে দিন প্লিজ।
– যেতে পারবো না এখন, রান্না ঘরে আছে আপনি গিয়ে কথা বলে আমাকে উদ্ধার করুন।
– দেখি দেখি দড়ি কই ( আমার খুব কাছে আসলো)
– এই কি করছেন? দূরে যান,
– আপনিই তো উদ্ধার করতে বললেন, ভাবছি কেউ আপনাকে বেধেঁ রেখেছে।
– ও গড আমারে উঠাইয়া নাও।
– এখনো আপনার সময় হয়নি তো, আপনার বিয়ে হবে, বাচ্চা কাচ্চা হবে, নানী হবেন। কেশ গুলো পেকে যাবে তখন গড আপনার ব্যপারে ভাববে।
– উফফফ, ( রাগে চোখে পানি এসে পরলো)
– আচ্ছা আমি তাহলে দড়ি দিচ্ছি, দড়ি বেয়ে গডের কাছে চলে যান।
– ধ্যাত্ ( রুমে চলে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম)
.
চেনা নাই জানা নাই হুট করে এসেই ঝগড়া শুরু করেছে, কেমন লাগে আপনারাই বলুন। আবার কিছুক্ষণ পর,
– তোহা,
– কি আম্মু?
– দরজা খোল,
– কি বলো ( খুললাম)
– তোর ওই বাসার আন্টি তোকে যেতে বলছে যা।
– আমি পারবো না।
– যা প্লিজ আম্মু, অনেক বড় মুখ করে বলে আসছি তুই যাবি ওনার কাছে। না করিস না প্লিজ,
– উফ্ যাচ্ছি।
.
ওখানে যাওয়া মানে আবার সেই বাঁদরটার সামনে যাওয়া তাই যেতে ইচ্ছে করছিল না তবুও গেলাম। একটু সতর্ক হয়ে ধীরে ধীরে যেতে লাগলাম ওই বাসার ভেতর। গিয়ে দেখি আন্টি ড্রয়িংরুমে বসে আছে, আমি যাওয়া মাত্রই,
– তোহা আম্মু আসো, দাড়িয়ে আছো কেন?
– এইতো আন্টি আসছি,
– হুম, বসো।
– আপনি নাকি আমাকে ডেকেছেন?
– হুম পায়েস রান্না করেছি খাবে?
– ওয়াও আমার অনেক ফেবারিট, তাড়াতাড়ি দেন আন্টি ( জিভে জল চলে আসলো)
– একটু বসো, আনছি।
.
কিছুক্ষণ পর এক প্লেট পায়েস এনে আমার সামনে দিল আর ইচ্ছেমত খেতে লাগলাম।আর একটু পরই সবটুকু খেয়ে নিলাম। কিন্তু ওই বাঁদরটাকে তো দেখছি না, গেল কই?
.
– তুমি বসো আম্মু, আমি ছাদে কাপড় শুকাতে দিছি ওগুলো আনতে যাব।
– আচ্ছা আন্টি,
অতঃপর আন্টি চলে গেল কাপড় আনতে আর আমি এক চেয়ারে বসে রইলাম কিন্তু হটাৎ কার যেন কান্নার ফুপানো শব্দ শুনতে পেলাম। এ বাসায় আবার কাঁদছে কে? কেউ কাঁদার তো কথা নয়, তাই কান্নার আওয়াজ ধরে ভেতরের রুমের দিকে যেতে লাগলাম। তারপর ভেতরে এক রুমের দিকে উকি দিলাম দেখি বাঁদরটা বসে বসে কাঁদছে। আরে আজব, ওর অবস্থা দেখে আমার মাথা ঘুরতেছে, পাঁচ মিনিট হলো না আমার সাথে উড়াধোরা ঝগড়া করলো আর এখন এখানে অসহায়ের মতো কাঁদছে। ব্যপার কি? হটাৎ কি হলো বাঁদরটার? এইরে আমাকে দেখতে পেয়েছে আর ওমনি এক নিমিষে চোখের জল মুছে স্বাভাবিক হয়ে গেল আর আমি দৌড়ে ড্রয়িংরুমে এসে চেয়ারে বসে পরলাম। আর তখনই আন্টি আসলো,
.
– আন্টি
– বলো আম্মু,
– আপনার ছেলের নাম কি?
– নিলয়।
– কোন ক্লাসে পড়ে?
– অনার্স সেকেন্ড ইয়ার,
– ওহ্ আমার অনেক সিনিয়র।
– হুম,
– আন্টি ও কাঁদছে কেন?
– কই কখন কাঁদছে?
– আন্টি আমি লুকিয়ে দেখেছি ও কাঁদছে।
– হয়তো ভুল দেখছো আম্মু।
– না আন্টি সত্যি, আপনি বিশ্বাস করুন আন্টি। আর ওর কান্নার আওয়াজও আমি শুনেছি কিন্তু আমাকে দেখা মাত্রই স্বাভাবিক হয়ে গেল।
– ওই তোমার মনের ভুল হবে হয়তো।
– উফ্ আন্টি আমি আসি এখন।
.
ওখানে আর এক মূহুর্ত না দাড়িয়ে থেকে আমার রুমে চলে আসলাম। মনের ভুল হলেও এতটা ভুল হবে? ভাবা যায় না, না এখানে আর ভালো লাগছে না, ছাদে যাই একটু। ছাদে গিয়ে দেখি আবার ওই বাঁদরটা দাড়িয়ে আছে ওই ছাদে কিন্তু নীচের দিকে তাকিয়ে আছে আজ।
.
– এইযে শুনুন,
– কি?
– সত্যি বলবেন কিন্তু!
– ওকে।
– আপনি রুমে বসে কাঁদলেন কেন?
– আরে পাগল নাকি? আমি কাদতেঁ যাব কোন দুঃখে?
– আমি দেখেছি আর শুনেছি আপনি কাঁদছেন।
– আগে জানতাম আপনার কানে সমস্যা আছে এখন দেখি চোখেও। কবে যে দেখবো আপনি পুরোটাই একটা সমস্যা, এখন সেই দিনের অপেক্ষা।
– এই দেখুন ফালতু কথা বলে আমাকে একদম রাগাবেন না কিন্তু, নয়তো ভালো হবে না।
– কি করবেন শুনি?
– গলা টিপে দিব।
– আপনার হাতের চেয়ে আমার হাত অনেক বড়, আমি আগে নাগাল পাব তাই আমিই আপনার গলা টিপে দিব।
– আপনি একটা,
– কুত্তা, ফাজিল, বদমাশ।
– একদম এগুলোই বলতে চাচ্ছিলাম।
– হেহেহে,
– আপনি সোজা কথার ছেলে না, ওয়েট।
ছাদে কমলা গাছের চারা বুনেছিলাম এখন কমলা ধরেছে তাই ওই কয়েকটা কমলা ছিঁড়েই ঢিল দিলাম।
– ওয়াও কমলা গুলো দেখতে ভালো হলেও খেতে খুব বিশ্রী, একদম আপনার মতো।
– আমাকে বেশি রাগাবেন না কিন্তু।
– কি করবেন?
– আমি কিন্তু এইবার কান্না করবো।
– করেন,
– উহুঁ উহুঁ,
– আরে আরে তোহা কি করছেন? সত্যি সত্যি কাদতেঁছে রে, আরে থামেন।
– না,
– কেন?
– আমি রেগে গেলে আমার কান্না কেউ থামাতে পারে না,
– ওকে ওকে কান্না করেন আমি গেলাম ( ফিরে আসতেই কাপড় শুকাতে দেওয়া দড়ির মাঝে আটকে গিয়ে ধপাস করে ছাদের উপর পরে গেল )
– হাহাহা, হিহিহি।
– হাসেন কেন?
– ব্যথা পাননি তো?
– না।
– এখনই তো কাঁদলেন আবার এখনই দাত বের করে মজা নিচ্ছেন। আজব মেয়ে মানুষ, এই বলে কান্না থামাতে পারবে না কেউ এখন নিজেই হেসে দাত ভাঙছে।
– হিহিহি যান মশাই এবার পেছনে মালিশ করুন।
– ওকে, দেখতেছি কি করা যায়!
– হাহাহা,
.
এভাবে কেটে গেল, চার মাস।
দুপুর বেলা রুমে বসে বসে ক্যাটবেরি খাচ্ছি আর ভাবছি আজকে কি নিয়ে ঝগড়া করবো। হুম আজকে আমাদের বাসার বিড়ালটা নিয়ে ওর সাথে একটা ইয়া বড় ঝগড়া করবো, দরকার হলে মারামারিও করবো, তবুও আজ আমি জিতবো, জিতেই ছাড়বো।
.
চারটা মাস কেটে গেল, এই চার মাসের এমন কোনো দিন নাই যে বাঁদরটা আমার সাথে ঝগড়া করেনি, প্রতিটি দিন আমার সাথে ঝগড়া করেছে, আমি এ ছাদ থেকে আর ওই ও ছাদ থেকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমি এখনো একদিনও বিজয়ী হতে পারলাম না ওর সাথে ঝগড়া করে, প্রতিবার আমিই হেরেছি আর রাগে গজগজ করতে করতে রুমে চলে আসছি।
.
ঝগড়াটা এখন আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে গেছে, ভালই লাগে ঝগড়া করতে। এখন আমরা বন্ধু হয়ে গেছি, আপনি থেকে তুমিতে আসছি, এখন যদিও ঝগড়া লাগে না তেমন কোনো বিষয় নিয়ে কিন্তু আমরা ইচ্ছে করেই কোনো এক বিষয় নিয়ে ঝগড়া করি, কারণ ঝগড়া করতে এখন ভালো লাগে তাই ভুলবশতঃ ঝগড়া না বাজলেও দুজনে জেনে শুনে ইচ্ছে করে ঝগড়া লাগাই তারপর দুজনে ইচ্ছেমত ঝগড়া করি হিহিহি।আর ঝগড়া শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় ছুড়াছুড়ি। কিনে আনা ফল গুলো দিয়ে ছুড়াছুড়ি করি, এতে আমাদের ফল ওদের বাসায় যায় আর ওদের ফল আমাদের বাসায় আসে।
.
আঙ্কেল এসে আমাদের ঝগড়া দেখতে পারে না, কারণ আঙ্কেল আসে রাতে, তাই নিলয়ের আব্বু ছাড়া ফ্রি ভাবে ঝগড়া করতে পারি দুজন দুই ছাদে থেকে। ওদের বাসায় এখন বেশি যাই না, প্রয়োজন ছাড়া। যখন প্রয়োজন পরে তখন শুধু ওদের বাসায় যাই তাছাড়া আর ভেতরে পা রাখি না। কথা বলা, ঝগড়া করা এগুলো শুধু দুজনের দুই ছাদে থেকে হয়, ভেতরে যাওয়ার দরকারই পরে না।
.
কয়েক দিন পর,
আজ রবিবার, কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে খেতে বসলাম, খাওয়া শেষ হলে একটু বিশ্রাম নিলাম তারপর চললাম ছাদে বাঁদরটার সাথে ঝগড়া করার জন্য। ছাদে গিয়ে অনেক সময় বসে রইলাম কিন্তু বাঁদরটা আসলো না। আর অপেক্ষা না করতে পেরে ওকে ফোন দিলাম, ডাক দেওয়া যাবে না তাহলে প্রবলেম হবে, সবাই অন্য কিছু ভাবতে পারে তাই ফোন দিলাম কিন্তু ফোন দিয়ে আজব হয়ে গেলাম, বন্ধ বলছে ফোন। এমন তো কখনো হয়নি, কিন্তু আজ হলো কেন?
.
বিষয়টা ভালভাবে দেখার জন্য ওর বাসায় গেলাম কিন্তু মেইন দরজায় ইয়া বড় এক তালা ঝুলছে, ব্যপার কি? গেল কই সব? হয়তো কোথাও গেছে, তাছাড়া তো এমন হওয়ার কথা নয়। রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম ওদের বাসার সামনে কিন্তু আসলো না। কই যে গেছে বাঁদরটা? খুব টেনশন হচ্ছে ওর জন্য। আর দাড়িয়ে না থাকতে পেরে আমার রুমে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর কার যেন বাইরে উপস্থিতি টের পেলাম। হয়তো বাঁদরটা আসছে, উফ্ এতক্ষণে দেহে প্রাণ পেলাম। এখন নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে। আর কিছু না ভেবে গভীর ঘুমিয়ে তলিয়ে গেলাম।
.
রাত তিনটা,
কি যেন এক খারাপ সপ্ন দেখে হটাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল, কিন্তু বিষয়টা তেমন ভাবে না নিয়ে আবারও ঘুমিয়ে পরলাম।
নিয়ম মতো সকালে উঠে ফ্রেস হয়ে খেয়ে নিয়ে কলেজে চলে গেলাম। কিন্তু রাস্তায় যাওয়ার সময় আন্টিকে দেখলাম কই যেন যাচ্ছে! কাছে ছিলো না বলে জিজ্ঞেস করার উপায় পাইনি।
দুপুরে কলেজ থেকে ফিরে,
আবার সেই কালকের অবস্থা হয়েছে, আজও কেউ বাসায় নেই। বাঁদরটাও ঝগড়া করতে আসলো না আজ, বাসায় তালা ঝুলছে।
.
রাত সাড়ে দশটা, রুমে বসে বসে বাঁদরটার কথা ভাবছি, কই গেছে কেমন আছে কিচ্ছু জানি না, আজ দুদিন ধরে দেখিও না, বাইরে একটা শব্দ হলো, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আন্টি ফিরছে কিন্তু নিলয় সাথে নেই, হয়তো আন্টির আগে আগে ফিরছে, উফ্ শান্তি পেলাম, তবুও মন কেমন যেন খচখচ করতেছে।
.
আরো কয়েকটা দিন পর,
সকাল বেলা, এখনো বিছানা ছাড়িনি। বিছানায় বসে বসে ভাবছি আজ আর কলেজে যাব না, আজ বাঁদরটার সাথে দেখা করেই ছাড়বো। আর আন্টির কাছে জানতে চাইবো আন্টি প্রতিদিন কই যায়? আমি আর পারছি না নিলয়কে না দেখতে পেরে। আমার পক্ষে ওকে না দেখতে পেরে থাকা সম্ভব না। মরে যাব আমি ওকে ছাড়া। কয়েকটা দিন ধরে ওকে দেখছি না, পুরো পৃথিবী কেমন যেন অন্ধকার লাগছে। আমি নিজেও এখন বুঝতে পারছি না ওর প্রতি আমার কেমন ফিলিংস? কিন্তু এতটা বুঝতে পারছি ওকে আমি দেখবই নয়তো মরে যাব আমি। ভালবেসে ফেলছি বাঁদরটাকে এতদিনে। হয়তো আগে বুঝতে পারিনি কিন্তু এখন ওর না থাকাটা আমাকে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে আমি ওকে কতটা মিস করছি আর কতটা ভালবাসি।
.
আমার কথা কি ওর একটুও মনে পরছে না? আমাকে কি ও ভালবাসে না? ভালবাসলে আমাকে ছেড়ে থাকতো পারতো? হয়তো আমার প্রতি ওর কোনো ফিলিংসই নেই, তাই থাকতে পারছে, নয়তো পারতো না। ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে এসে দেখি আম্মু কোরান শরীফ সামনে রেখে কার জন্য জানি দোয়া পরতেছে আর আব্বু তো কই যেন বেড়িয়ে গেল একটু আগে।
.
কিছু বুঝলাম না, আম্মু তো এমন অসময়ে কখনো দোয়া পরেনি কিন্তু আজ কেন? কথাটা জিজ্ঞেস করতে যাব আর তখনই জানালা দিয়ে দেখি আন্টি বের হলো ঘর থেকে, হয়তো কোথাও যাবে, আজ জানতেই হবে আমাকে নিলয় কই? দৌড় দিলাম আন্টির কাছে,
.
– আন্টি কই যাচ্ছেন? নিলয় কই?
– ইয়ে মানে ( কান্না করে দিছে)
– কি হলো আন্টি বলছেন না কেন নিলয় কই?
– আম্মু রে আজ ওর অপারেশন।
– মানে!
– ওর ব্রেইন টিউমার হইছে রে আম্মু অনেক আগে, ডাক্তার চার মাস সময় দিছিলো ওকে, এখন ওর সময় শেষ তাই অপারেশনটা করিয়ে শেষ চেষ্টা করতেছি। দোয়া করিস আম্মু ও যেন ঠিক হয়ে যায়। ব্রেইন টিউমার হলে সম্ভবত রোগীর জীবনের গ্যারান্টি থাকে না, যেকোনো সময় যা খুশি হয়ে যেতে পারে কিন্তু কোন ভাগ্য করে ডাক্তার ওকে চারমাস সময় দিছিল কে জানে!
.
আমার আর তারপর কিছুই মনে নেই, জ্ঞান ফিরলো কয়েক ঘণ্টা পর, জ্ঞান ফিরে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি দুপুর তিনটা বাজে, আমার পাশে শুধু আম্মু বসে আছে চুপ করে আর কেউ নেই, আব্বু, আঙ্কেল, আন্টি হয়তো হাসপাতালে আছে, নিলয়ের কথাটা ভাবতেই মনে হলো চোখ দিয়ে আমার অশ্রু না রক্ত বের হচ্ছে। চিৎকার করে কাদতেঁ লাগলাম বাঁদরটার জন্য।
.
– ও আম্মু, শুনো না, তুমি জানতে ওর এমন হইছে? তোমরা সবাই জানতে ও সুস্থ না? বলছো না কেন? ( চিৎকার দিয়ে)
– আমিও তো জানি না, গতকাল রাতে তোর আন্টি বললো।
– আমাকে কেন বললে না তুমি হ্যাঁ?
– তোকে কয়েক দিন ধরে অস্থির লাগছিল দেখেই বুঝতে পারছি তুই ওকে ভালোবাসিস, তাই আর তোকে বলিনি।
– আম্মু ও আম্মু, বাঁদরটা ঠিক হবে তো?
– হ্যাঁ হবে, চিন্তা করিস না।
.
কি আর করবো? কিচ্ছু করার নাই, এতো বড় একটা কথা এতদিন এর কিছুই জানতে পারিনি, এখন আর কি করবো? আল্লাহর কাছে ওর জীবনটা ভিক্ষা চাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নাই আমার। আম্মুর মতো আমিও বসে বসে প্রার্থনা করতে লাগলাম যাতে ও সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে।
.
সন্ধ্যা সাতটা,
ঘরে বসে বসে কাঁদছি আর ওর কথা ভাবছি, কি হতে চলেছে এরপর। হটাৎ এম্বুলেন্সের শব্দ শুনতে পেলাম বাইরে। বাঁদরটা কি আসছে? সুস্থ হলে তো মানুষ এম্বুলেন্সে আসে না তাহলে কিছু হয়নি তো ওর? দৌড়ে বাইরে চলে গেলাম।
রাত আটটা,
পরিস্থিতি এতো নিষ্ঠুর হবে কখনো কল্পনা করিনি। বাঁদরটা শুয়ে আছে আমার সামনে সাদা কাফনের কাপড় গায় দিয়ে মৃতের খাটিয়ায় আর আমি ওর সামনে বসে আছি এক ব্যর্থ ভালবাসা না পাওয়া অভাগা মেয়ের মতো। হয়তো অপারেশন সাকসেস হয়নি তাই আজ ওকে অকালেই হারাতে হচ্ছে। আমার পাশে কাঁদছে আঙ্কেল, আন্টি আরো অনেকে আছে। আস্তে করে বাঁদরটাকে ডাকলাম,
.
– নিলয়, এই নিলয়

– শুনতে পাচ্ছো তুমি?

– এই দেখো, আমি আছি না, কিচ্ছু হয়নি তোমার, তুমি একদম ঠিক আছো।

– এই চুপ করে আছো কেন হুম? আমার কিন্তু রাগ উঠতেছে, কথা বলবা না?

– এই দেখো রাগাবে না কিন্তু এখন, ঝগড়া করার মোড আছে কিন্তু রাগলে সব চুল ছিঁড়ে দিব।

– উফ্ এখনো চুপ করে আছে, এবার কিন্তু ঝগড়া করবো, অনেক মোড আছে। আর তুমিই কিন্তু বলছিলা তোমার সামনে আসলে ঝগড়া করার মোড নিয়ে আসতে, এখন কিন্তু তাই করেছি।

– এই উঠো তো তাড়াতাড়ি। ছাদে যাব চলো, দুজনে আজ অনেক ঝগড়া করবো।

– এই কুত্তা কথা বলছিস না কেন? ঝগড়া করবি না আমার সাথে? এই কথা বলছিস না কেন? এই দ্যাখ তোর সাথে ঝগড়া করার জন্য আসছি, ঝগড়া করবি না রে তুই?

– এই কমলা ছুড়ে মারবো উঠ, তাড়াতাড়ি উঠ বলছি, এবার কিন্তু বেশি রেগে যাচ্ছি, কান্না করবো এইবার। তাড়াতাড়ি উঠ বলছি,

– এভাবে একা রেখে চলে গেলি? একবারও ভাবলি না আমার কি হবে? আমি কি নিয়ে বাঁচবো? কার সাথে ঝগড়া করবো? কে আমাকে কচুপরী বলে ডাকবে? বলছিস না কেন এগুলো কে করবে?
.
রাত দশটা,
কয়েক জন এসে ওকে খাট শুদ্ধ কাধেঁ নিল, হয়তো দাফন করার সময় হয়ে গেছে, আমি তো ওর পাশেই আছি, কোথাও যেতে দিব না ওকে, আমাকে কেন জানি কয়েক জন ধরে রেখেছে, ছাড়ছে না। ওর কাছে যেতে দিবে না। যেখানেই নিয়ে যাও না কেন আমি ঠিকই চলে যাব ওর কাছে। তারপর দুজন মিলে ঝগড়া করবো। হয়তো এরপর ওর সমাধী দিবে, আমি সেখানেই যাব কিন্তু কই হবে ওর সমাধী?

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত