গরীবের বাস্তবতা

গরীবের বাস্তবতা

—ভাত কয়টা খাইয়া তারপর পড়।
—না, মা। আমার অনেক পড়া, খাওনের সময় নাই।
—না খাইয়া পড়তে মেলা কষ্ট অইতাছে, খাইয়া তারপর পড়।
—তুমি খাইছো মা?
—আরে হ খাইছি, তুই জলদি খাইয়া নে। আমি যাই।

বলেই মা বা চোখের কিনারায় কি যেন আড়াল করতে করতে চলে গেল। আমি ভাত গুলোর দিকে চেয়ে আছি। কাল থেকে ঘরে চাল নেই। বাবা সেই ভোর সকালেই রিক্সা চালাতে বেরিয়ে গেছে। গলির মাথায় একটা সাত তলা বাড়ি। ওখানে মা থালাবাসন ধুয়ে দেয়া, ঘর মুছা, কাপড় ধুয়ে দেয়ার কাজ নিয়েছে। মা ওখান থেকেই তাদের বাসি ভাত গুলো নিয়ে এসেছে। সাথে তরকারির ঝোল ও আছে। আমি তারাতারি খেতে বসে পরলাম। তরকারির ঝোলটা টক টক লাগছে। খুব তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া শেষ করে জোরে জোরে পড়তে লাগলাম।

আমি সজীব, অষ্টম শ্রেনীতে পড়ি। গত মাসে বাবা মায়ের সাথে ঢাকায় এসেছি। ছোট থেকে স্বপ্ন দেখতাম পড়ালেখা করে অনেক বড় হব, তারপর ঢাকায় এসে সাহেবদের মতো পোশাক পরে গাড়িতে চড়ব। আমাদের গ্রামের রাশিদা খালার দুই ছেলে ঢাকায় থাকে। কতো গাড়ি, ঘোড়া,মস্ত বড় বড় দালান, সাহেবদের গল্প শুনেছি তাদের থেকে। গ্রামে নদী ভাঙ্গনে আমাদের বাড়িঘর, সবকিছু নদীতে ভেসে গেছে। মা পুতুলদের উঠানে দাপিয়ে কান্না করেছে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি মা আমাকে ছেড়ে চলে গেল।

তারপরই বাবা আমাদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় আসার পর আকবর চাচা আমাদের ছোট একটা রুম ভাড়া করে দিল। আর আমাকে এখানের একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিল। স্কুলে সবাই সাদা ধবধবে শার্ট আর নীল প্যান্ট পরে যায়। আর আমি পুরোনো জামা পড়ে যাই বলে স্যার রা খুব মারে আমাকে।

সেদিন বাবাকে বললাম-
—আব্বা আমারে একটা সাদা ধবধবা শার্ট আইনা দিবা?
—দিমুরে বাপজান কালকেই দিমু।

বাবার কালকে টা আর আসেনা। মা একটা পুরোনো সাদা শার্ট আর সাদা জুতা এনে দিয়েছে। তারপর থেকে স্যার আর আমাকে মারে না।
কিন্তু ক্লাসের কেউ আমার সাথে মিশে না। পড়াশুনায় আমি খুব ভালো। প্রতিবারই পরীক্ষায় ফাস্ট হই। এসএসসি তে গোল্ডেন এপ্লাস পাওয়ার পর প্রিন্সিপাল স্যার বাবাকে বলেছিল – “তোমার ছেলে অনেক বড় হবে।”

বাবা সেদিন আমাকে একটা সুন্দর ঘড়ি কিনে দিয়ে বলেছিল,
—আমি জীবনও এরম সুন্দর ঘড়ি পরি নাই। বড় বড় সাহেবগো আতে এইরম ঘড়ি দেহি। তোর আতে ঘড়িটা অনেক সুন্দর লাগতাছে। তুই অনেক বড় সাহেব অবি একদিন।

আমি শুধু বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কত স্বপ্ন আমার বাবার চোখে। চোখ দুটোতে জল চিকচিক করছে। হঠাৎ এক ফোটা জল টুপ করে বাবার গাল বেয়ে পরল। বাবা সাথে সাথে হাত দিয়ে মুছে আড়াল করতে চাইল। সেদিন বুকটা ফেটে যাচ্ছিল কান্নায়। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাদঁছিলাম। সারারাতেও সেদিন কান্না থামাতে পারিনি।

একটা দোকানে চাকরি নিলাম। মালিকের ছেলেটা প্রতিদিনই দোকান থেকে হিসেব ছাড়া টাকা নিয়ে নেশা করে। দোকানে একদিন হিসেব গড়মিল হওয়ায় মালিকের ছেলে আমাকে চোরের অপবাদ দিল। আমি বারবার “চুরি করিনি ” বলার পরও তারা আমাকে খুব মেরেছে সেদিন।
কিছুই বলতে পারেনি আমার বাবা মা। সেদিন বুজেছিলাম গরীবের জন্য বিচার মানায় না। নীরবে সহ্য করে নিতে হয়।

পড়ালেখাটা আর হবে না। বাবা মায়ের স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পারলাম না। হন্য হয়ে কাজ খুজছিলাম। কিন্তু না, বাবা টাকা যোগার করে দিল, কলেজে ভর্তি হলাম।

সেদিন বাবা অজ্ঞান হয়ে গেল হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, জানতে পারলাম বাবা রক্ত দিয়েছে। শরীর খুব দুর্বল। ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলল। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদলাম। বাবা বলল,
–“আমি রক্ত বেইচা অইলেও তোরে মানুষ করমু, তোরে অনেক বড় অইতে অইব” আমি সেদিন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলাম, আমাকে বড় হতে হবে, অনেক বড়।

কিছুদিন ধরে মার শরীরটাও অনেক অসুস্থ যাচ্ছে। একদিন কলেজ থেকে এসে দেখি মার নাক মুখ দিয়ে ব্লিডিং হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল মার অনেক বড় একটা রোগ হয়েছে। মা কোনোদিন আমাদের বুঝতে দেয়নি।

—“সজীব, বাবা তুই কবে বড় হবি? আরো কি মেলা দিন লাগবো রে? বাজান আজকে আমার অনেক কষ্ট অইতাসে, তুই কবে বড় অবি বাজান? আমারে ভালা হাসপাতালে চিগিস্যা করাবি? ”

বাবার রিক্সায় করে মাকে হাসপাতালে নিয়ে এলাম। ডাক্তার বলল মার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। চিকিৎসা করতে অনেক টাকা লাগবে। বাবা পাগলের মতো করতে লাগলো। রাস্তায় নেমে গেলাম আমি। ভিক্ষুকের মতো সবার কাছে হাত পেতে সাহায্য চেয়েছি। দেখেছি দুনিয়ার রুপ।
দেখেছি নিষ্ঠুর মানুষগুলোর তামাশা। চোখের সামনে দিন দিন মার মৃত্যর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে দেখি।

সেদিন বাবা রিক্সায় যাত্রীকে নামিয়ে দেয়ার পর বলল,
—“ভাইসাব আমার বউডার কেন্সার অইসে, চিগিস্যা করতে অনেক টাকা লাগবো। কিছু সাহায্য করেন ভাইসাব। আমার বউডারে বাঁচান। ”
লোকটা “ধান্দামি” আরো কি যেন বলে একটা চড় বসিয়ে দিল বাবার গালে। আমি নিজেকে আড়াল করতে পারিনি, ঝরঝর করে জলশ্রোত
বয়ে যাচ্ছিল আমাদের চোখে। পৃথিবী আমাদের বুঝিয়ে দিল গরীবরা এ স্বার্থপর পৃথিবীতে কতোটা অসহায়, তাদের জীবনের মূল্য কতোটা তুচ্ছ। পারলাম না বাঁচাতে আমার মাকে। এই স্বার্থপর, নিষ্ঠুর পৃথিবীতে গরীবের বেচেঁ থাকার ইচ্ছাটাও তুচ্ছ।

এইচএসসি পরীক্ষায়ও গোল্ডেন এপ্লাস পেলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ও প্রথম হলাম। আমার বাবা খুব খুশি। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছে। আমার সাথে বাবার ছবিও পত্রিকায় ছাপা হলো।

“রিক্সাচালকের ছেলে ১ম হয়েছে ”

আমিও বাবাকে ধরে খুব কাঁদছিলাম। মার কথা খুব মনে পড়ছিল। ও মা আমি ফাস্ট হয়েছি, সাংবাদিকরা কতো ছবি তুলছে তোমার ছেলের। মা আমি বড় হবো, অনেক বড়… কিন্ত তোমাকে ভালো চিকিৎসা করাতে পারবো না আর। পারবো না তোমার সেই মৃত্য যন্ত্রনা গুলো থেকে বাঁচাতে।

চোখ খুলে দেখলাম রাকিব ছেলেটা নির্বাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কোন আওয়াজ হচ্ছে না, শুধু চোখের জল গাল বেয়ে পরেই যাচ্ছে। তার মাও একজন ক্যান্সারের পেশেন্ট। আমি ওকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। ও জোরে জোরে কাঁদতে থাকল। আজ আমি অনেক বড় নামকরা ডাক্তার। আজ আমার বাড়ি, গাড়ি, টাকা পয়সা সব আছে। শুধু নেই আমার মা।

আমিতো জানি গরীবের যন্ত্রনা। চোখের সামনে একটু একটু করে শেষ হতে দেখেছি আমার মাকে, দেখেছি এই স্বার্থপর পৃথিবীতে গরীবের জীবনের মূল্য কতোটা তুচ্ছ। আজ আমি গরীবদের পাশে দাঁড়াই।
আমার মাকে খুজে বেড়াই রাকিবদের মা দের মাঝে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত