নিয়তি

নিয়তি

– অনেক রাত হয়ে গেল শ্যামল, এবার আমাকে উঠতে হবে।
– ইয়ে মানে বলছিলাম কি, আজকের রাত টা থেকে গেলে হতোনা? গল্প গুজব করে কাটানো যেত আরকি।

আমার কথায় ভদ্রলোক একটু কিছু চিন্তা করে নিলেন মনে হলো। তারপর বললেন – অভ্যাস করো; এবার থেকে একা পথ চলতে শিখতে হবে তো।

এই বলে উঠে পড়লেন। চলে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো একবার পিছন ফিরে হাসি মুখে ঘাড় নেড়ে বিদায় জানালেন। তারপর তড়িঘড়ি গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। এতক্ষন বেশ ভালোই খোশ গল্প জমে উঠেছিল। কিন্তু কি আর করা যাবে। ওনার সংসার আছে, যেতে তো হবেই। তাই মন খারাপ করা বৃথা ভেবে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলাম।

আমি শ্যামল হালদার। পড়াশোনা শেষে চাকরির খোঁজে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোই এখন আমার মুখ্য কাজ। বাড়ি মুর্শিদাবাদের এক গ্রামে। একদম গণ্ডগ্রাম বলতে যা বোঝায়। মাস্টার্স করে এখন মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে লেগে পড়েছি। আগামীকাল সকালে কলকাতায় একটা ইন্টারভিউ থাকায় আজ সন্ধেতেই বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে কলকাতায় এসে পৌঁছেছি। এখন আমি ধর্মতলায় বসে আছি। এতটা পথ আসার ধকল থেকে নিজেকে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। কিন্তু বাড়ির আর্থিক অসচ্ছলতা আর একমাত্র ছেলে হওয়ার সুবাদে মা বাবার দায়িত্ব পালন করা এই দুইয়ের চাপে পরে শরীরের ক্লান্তি টের পাওয়ার শৌখিনতা আমার সাজেনা। তাই অগত্যা পথশ্রম ভোলার চেষ্টা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার নেই।

কিছুক্ষন আগে যার সাথে কথা হচ্ছিল তার সাথে আলাপও আমার এখানে এসেই। ভদ্রলোকের নাম নির্মাল্য চ্যাটার্জী। কলকাতাতেই থাকেন। একসময় খুব বড় নাম করা একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চ পদে ছিলেন। আপাতত সে চাকরি আর নেই। আমাকে একা বসে থাকতে দেখে নিজে থেকেই এসে আলাপ করলেন। কথা বললেই বোঝা যায় ভদ্রলোক বেশ মিশুকে এবং সহানুভূতিশীল। তাঁর দুই মেয়ে দুজনেই বিবাহিতা এবং দুজনের স্বামীই বিদেশে কর্মরত হওয়ায় মেয়েদের সাথে বহুবছর দেখা সাক্ষাৎ হয়ই না বলতে গেলে। কাছের বলতে এখন শুধু ওনার স্ত্রী আছেন বাড়িতে। অনেকটা রাত হয়ে গেছে তাই ওনাকে চলে যেতে হলো।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ২ টো বেজে ১৫ মিনিট। এখনো ভোরের আলো ফুটতে প্রায় ৩ ঘন্টা বাকি। কাল সকালে ইন্টারভিউ ৯ টা থেকে শুরু। সল্টলেক সেক্টর ফাইভ যাওয়ার বাস ধরতে হবে। কিন্তু তার আগে আরো একটা কাজ আছে। একটা অপ্রত্যাশিত কাজ যেটা আমি স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি। কলকাতা শহরের বুকে রাস্তার ধারে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। আর দুর্ভাগ্যবশত আজকের আবহাওয়াও অত্যন্ত খারাপ। মাঝে মাঝেই প্রবল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে আর সাথে ঝোড়ো হাওয়া।

আমি এখানে একেবারে একা বসে আছি। আসে পাশে কয়েকটা কুকুর ছাড়া কোনো প্রাণী চোখে পড়ছেনা। কেইবা এই দুর্যোগের রাতে নিজের বাড়ির গরম বিছানা ছেড়ে স্বেচ্ছায় রাস্তার ধারে বসে থাকবে! আমিও হয়তো বসে থাকতাম না, কোন হোটেলে উঠতাম। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব না। শুধু ভাবছি কখন সকাল হবে। সকালে বাবা আসবে। জানিনা কিকরে আসবে, কার সাথেই বা আসবে! গ্রামের মানুষ শহরের কিছু চিনবেওনা। চিন্তা হচ্ছে খুব বাবার জন্য। ধর্মতলাতেই এসে নামবে। এখানে এলে তারপর আমি বাবার সাথেই যাবো সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা মেটাতে। এবারের মতো ইন্টারভিউটা আর দেওয়া হবেনা। বাবা এলে আমরা দুজনে মিলে যাবো মেডিকেল কলেজ হসপিটালে। ওখানেই মর্গে আমার ডেড বডি টা রাখা আছে।

হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। আমি আর জীবিত নেই। মুর্শিদাবাদ থেকে এসে ধর্মতলায় নেমে রাস্তা পার করতে গিয়েই আমি উল্টো দিক দিয়ে আসা বাসের তলায় পিষে গিয়েছিলাম। যখন চোখ খুললাম দেখলাম আমি রাস্তার উপর শুয়ে আছি, শরীরে কোনো চেতনা নেই। আমার সারা জামাকাপড় রক্তে ভেসে যাচ্ছে আর আমাকে ঘিরে বেশ কিছু অচেনা মুখের ভিড়। তাদের মধ্যে থেকেই কিছু লোক আমাকে হসপিটালে নিয়ে গেল, আমার প্যান্টের পকেটের প্রায় ভেঙে যাওয়া ফোন থেকে অনেক কষ্টে বাড়ির নম্বর জোগাড় করে বাবাকে ফোনে খবরটা দিলো। সবেতেই আমি নীরব দর্শকের ভূমিকায়।

তবে ওদের সাথে গিয়ে হসপিটালের রাস্তা টা চিনে এসেছি। আবার ধর্মতলাতেই ফিরে বসে আছি বাবার অপেক্ষায়। ওই যে ভদ্রলোক আমাকে এতক্ষন সঙ্গ দিলেন, নির্মাল্য চ্যাটার্জী, উনিও বেশ কিছু বছর আগে এখানেই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। ওনার সাথে আলাপের পর ওনার জীবনের কাহিনীই শুনছিলাম বসে। কিন্তু ওনার জীবিত স্ত্রী বাড়িতে একা থাকায় পাহারা দিতে ওনাকেও বাড়ি চলে যেতে হলো। থাকলে আমার একাকীত্ব টা কাটতো। সে যাই হোক। ভোরের আলো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুটবে। বাবা দেখি কোন বাসে আসে। তারপর আবার বাবার সাথে হসপিটাল ঘুরে বাড়ি যেতে হবে। মা কে শেষ দেখা দেখার জন্য।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত