সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সিলেটে লম্বা ট্যুর দিয়ে নিজের পরিবারকে নিয়ে ফিরছে আনিস। সে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে, তার পাশে সোমা; তার স্ত্রী। পেছনের সিটে বসে আছে অন্তু আর রুনু। কে গাড়ির বামদিকের সিটে বসবে তা নিয়ে তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। গাড়ির বাম দিকে বসা তাদের কাছে রাজ্য জয় করার মত একটা ব্যাপার।
“আব্বু… অন্তুকে এদিকে আসতে বলো প্লিজ!” রুনু চিৎকার করে বলে।
“এই, তোমরা চুপ করবে?” সোমা ধমকে ওঠে।
“দেখোনা আম্মু, ও আমাকে টানছে!” অন্তু বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলে। ছোট বোনের আচরনে সে ক্ষুব্ধ।
“টানবো না? আগের বার তুই এই দিকে বসেছিলি। এবার আমার বসার কথা! আম্মু ওকে সরতে বলো।” রুনু তার ভাইয়ের গেঞ্জির কলার ধরে টানতে টানতে বলে। চিৎকার চেচামেচিতে আনিসের মাথা ধরে গেছে। এই কয়েকদিনের বিরামহীন ঘুরোঘুরিতে এবং বাচ্চাদের অত্যাচারে সে ক্লান্ত। আগে বিস্রাম নিতে সে ট্যুরে যেতো; এখন মনে হয় সপরিবারে ট্যুর দেয়ার পর তার বিস্রাম প্রয়োজন। তার ইচ্ছে করছে গাড়ি থামিয়ে সবাইকে গাড়িতে রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে। নিরুদ্দেশ হয়ে হয়তো সে এখানকারই কোন এক গ্রামে চেম্বার খুলে বসবে, তবে অবশ্যই ছদ্দনামে। এরকম ইচ্ছে তার মাঝে মাঝেই করে। সংসারের এতো চাপের বোঝা তার মাঝে মাঝেই অসহনীয় লাগে। এবং এই বোঝা মাথা থেকে এক মুহূর্তের জন্যে নামিয়ে রেখে বিশ্রাম করারও কোন সুযোগ নেই।
“এই তোরা সবাই চুপ কর বলছি! একদম চুপ!” আনিস পেছনের দিকে ফিরে ধমক দেয়। ওর ধমক খেয়ে রুনু এবার গাড়ির সিটে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে হাত পা ছুড়তে ছুড়তে কান্না করে বলতে শুরু করে, “ও আগের বার বাম দিকে বসছে! উউউ… এইবার আমার টার্ন! উউউ… এইবার আমার টার্ন!” উইইই! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি! আনিস মনে মনে বলে।
“আনিস পেছনের দিকে ফিরে অন্তুর দিকে চোখ লাল ধমকে ওঠে, “অন্তু, ওইদিকে যাও বলছি। এক্ষুনি!”
“আহা! এভাবে বকো না তো!” সোমা বলে। বাবার ঝাড়ি খেয়ে অন্তুও এবার ছোটবোন রুনুর সাথে কোরাসে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। এতক্ষন তাও গাড়িতে টেকা যাচ্ছিল, এখন কান ফেটে যাবার উপক্রম হচ্ছে। “চোপ! দুজনেই চোপ! নইলে দুটাকেই ধরে থাপড়িয়ে কান লাল করে দেব!” আনিস পেছনের দিকে ফিরে গর্জন করে ওঠে। এবারে দুজনেই থেমে যায়, এক সাথে। বাবাকে আর ঘাটানোর সাহস হয়না তাদের। ছেলে মেয়েদের শাসন করে গাড়ির জানালা দিয়ে সামনে তাকিয়েই আনিস হার্ড ব্রেক চেপে ধরে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দেয়। গাড়ির টায়ার আর্তনাদ করতে করতে সাপের মত এঁকে বেঁকে কিছুদুর এগিয়ে থেমে যায়। একটা মেয়ে হুট করে বেরিয়ে তাদের গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল। একটুর জন্যে গাড়ি চাপা পড়ে নি মেয়েটা। এরকম স্টুপিডের মত কেউ রাস্তায় বেরোয়?
রাগে দাত কিড়মিড় করতে থাকে আনিস। ড্রাইভিং সিটের জানালা দিয়ে মাথা বের করে আনিস। মেয়েটা গাড়ির দিকেই হেটে হেটে আসছে। চারদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে। কিন্তু যেটুকু আলো আছে তাতেই বোঝা গেল মেয়েটার চুল উষ্কোখুষ্কো, গায়ে একটা লাল জামা। মেয়েটার চোখে মুখে ভীতি। মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে কেঁদে দিবে। এমনিতেই আনিসের মেজাজ খারাপ হয়ে ছিল, তার ওপর আবার এই মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে আরেকটু হলে ওরা সবাই মারা পরতে পারতো গাড়ি আক্সিডেন্ট করে। আনিসের মনে আশঙ্কা হয় মেয়েটা কোন ডাকাত দলের সাথে যুক্ত নাতো? এখন সে প্রায়ই শুনতে পায় রাস্তা ঘাটে কৌশলে গাড়ি থামিয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়ে যায়, এমনকি গায়ের জামা কাপড়ও। ওরই এক বন্ধু রফিককে মানিকগঞ্জে এভাবে আটকে ছিল ডাকাতেরা।
রফিকের গাড়ির সামনের কাঁচের ওপর নাকি গোবর ছুড়ে ফেলেছিল ডাকাতেরা। সেই গোবর সরাতে বোকার মত উয়িন্ডস্ক্রিন ওয়াইপার চালু করে দিলে পুরো কাঁচে গোবর লেপ্টে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা হয় এবং কাচ দিয়ে রাস্তার কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তাতে বাধ্য হয়েই গাড়ি থামাতে হয় রফিকের। আর রফিক রগচাটা মানুষ, যে অস্রের মুখেও ডাকাতদের সাথে কথা কাটা-কাটি করে এবং এর ফলস্রুতিতে ডাকাতেরা সবার কাছ থেকে সোনা-দানা, টাকা পয়সা সব নিয়ে শুধু ওকে নেংটো করে রেখে যায়। গাড়িতে রফিকের শ্বশুর-শ্বাশুরি ছিল; সে এক কেলেঙ্কারি। হতে পারে এই মেয়েটিও ওই রকমই কোন ডাকাত দলেরই সদস্য; যে কোন মুহূর্তেই হয়তো তাহারা পাশের ঝোপ থেকে সদলবলে রামদা হাতে বেরিয়ে আসবে।
“এই ফাজিল মেয়ে! রাস্তার মধ্যে কি!” মেয়েটা গাড়ির কাছে এগিয়ে আসলে আনিস ধমকে ওঠে। আনিসের ধমক খেয়ে মেয়েটা চমকে উঠে দাড়িয়ে যায়। আনিসের ধমক খেয়ে মেয়েটা একদম হতভম্ব হয়ে গেছে।
“রাস্তার ওপর থেকে সরো, নইলে এক থাপ্পর দিয়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দিবো!” আনিস আবারো ধমকে ওঠে।
“আহা, মেয়েটাকে বকছো কেন? ও কি কিছু বোঝে নাকি?” পাশ থেকে সোমা বলে। আবার ধমক খেয়ে মেয়েটির চেহারা আতঙ্কে নীল হয়ে যায়। সে প্রায় কাদো কাদো হয়ে হাইওয়ের পাশের একটা মাটির রাস্তায় ঢুকে যায়। “না বুঝলে হাই-ওয়েতে নামে কেন? চিন্তা কর বাপ-মা কেমন আহাম্মক হলে এইটুকু বাচ্চাকে এরকম ডেঞ্জারাস রাস্তায় আসতে দেয়।” আনিস গজগজ করতে করতে বলে।
আনিস গাড়ি স্টার্ট দেয়। মেজাজটাই খিচড়ে গেছে একদম। ধেত! স্টুপিডের দল সব আমার সাথেই এসে পড়ে, আনিস ড্রাইভ করতে করতে মনে মনে ভাবে। মিনিট খানেক পরেই এক লোক রাস্তার পাশ থেকে হাত নাড়িয়ে আনিসকে থামতে ইশারা দেয়। স্যূট-কোট পড়া লোকটা একটা রেঞ্জ রোভার গাড়ির পাশে দাড়িয়ে আছেন, গাড়িটার দাম প্রায় কোটি টাকা। আনিস গাড়িটা থামায়। লোকটাকে দেখে শিক্ষিত ভদ্রলোকই মনে হচ্ছে আনিসের; অন্তত ডাকাত মনে হচ্ছে না। কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে নিশ্চই কেউ রাস্তায় ডাকাতি করতে আসবে না।
“হাই!” আনিস ড্রাইভিং সিটের পাশের জানালা নামিয়ে মাথা বের করে বলে। “হাই! আপনাদের থামতে বলার জন্যে আমি এক্সট্রিমলি সরি। হয়েছে কি আমার গাড়িটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি একটু সামনে এগিয়েছিলাম। আর এই ফাকে আমার মেয়েও গাড়ি থেকে নেমে যে কোন দিকে চলে গেছে। আপনারা কি আসার পথে ওকে দেখতে পেয়েছেন? ওর গায়ে একটা লাল জামা পড়া।” আনিস লজ্জা পেয়ে যায়। পাশ থেকে সোমাও ওকে খোচা দেয়ার জন্যে কাশি দেয়।
“দেখেছি তো আঙ্কেল!” পেছন থেকে রুনু প্রায় চিৎকার করে বলে।
“তাই? কোথায় দেখলে মামনি?” লোকটা আদুরে গলায় বলে।
“ওইতো মিনিট খানেক আগেই। আব্বু আরেকটু হলেই ওকে চাপা দিতে নিচ্ছিলো!” রুনু অভিযোগের সুরে বলে।
“তাই নাকি?” লোকটা কিছুটা ভীত গলায় বলে।
“না তেমন কিছু না। ও ছুটে আমার গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল কিনা। আমি হার্ড ব্রেক করায় রক্ষা।”
“না, আঙ্কেল,” পেছন থেকে রুনু প্রতিবাদের কন্ঠে বলে। “আব্বু রাস্তার দিকে না তাকিয়ে আমাদের বকছিলো তো তাই দেখতে পায়নি। আপনার মেয়েও আপনার মত হাত নেড়ে গাড়ি থামাতে বলছিল। বাবা দেখতে পায়নি। বাবা ওকে বলেছে থাপড়িয়ে ওর বাপের নাম ভুলিয়ে দিবে। আচ্ছা আঙ্কেল আপনার নাম কি?” “আহা। তাহলে তো আমার দ্রুত যাওয়া দরকার ওদিকে।”
“হ্যা।” আনিস অনেকটা বিব্রত কন্ঠে বলে। ” ১ মিনিটের মত পথ গিয়ে হাতের ডানে একটা মাটির রাস্তা দেখবেন। ওই দিকেই গেছে আপনার মেয়ে।” “হুম, থাঙ্ক ইউ এন্ড বাই।” বলেই লোকটা রাস্তা দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে এগিয়ে যায়। “এই! মেয়েটা কি আসলেই হাত নাড়ছিল?” আনিস রুনুকে জিজ্ঞেস করে। “হ্যা। আসলেই নাড়োছিল।” সোমা পাশ থেকে বলে। “আমিও দেখেছি। কিন্তু তোমার মেজাজ খারাপ ছিল বলে কিছু বলার সাহস পাইনি।” “হুম।” আনিস বলে। “সব দোষ আমার।”
সেরাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে ওদের প্রায় রাত ১টা বেজে যায়। বাসায় ফিরেই রুনু আর অন্তু টিভিটা চালিয়ে দিয়ে রিমোট নিয়ে মারামারি লাগিয়ে দেয়। “আম্মু! গতবার রিমোট অন্তু নিয়েছে! এবার আমার টার্ন” রুনু আর্তনাদ করতে করতে বলে। “না, হোটেলে শেষবার তুই রিমোট নিয়েছিলি।” অন্তু বোনের কাছ থেকে রিমোট ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বলে। “হোটেলেরটা কাউন্ট হবে না!” রুনু প্রতিবাদ করতে করতে বলে। “এই চোপ! এতো রাতে কিসের টিভি!” আনিস হাত উচিয়ে মারমুখী ভঙ্গিতে এগুতে এগুতে বলে।
বাচ্চারা বাবাকে দেখতে পেয়ে যে যরযার মত করে নিজের কেস উত্থাপন করতে লাগে। কিন্তু আনিসের মনোযোগ সেদিকে নেই। সে টিভির খবরের দিকে তাকিয়ে আছে। টিভিতে রাস্তার সেই মেয়েটি এবং মেয়েটির বাবার ছবি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু খবরে দেখানো হচ্ছে লোকটি মেয়েটীর বাবা নয় লোকটি মেয়েটির ধর্ষক এবং খুনী। কিছুক্ষন আগে লোকটিকে মেয়েটির লাশ সহ আটক করা হয়েছে।
আনিস ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। তাহলে কি মেয়েটি এই খুনীর কাছ থেকে বাঁচার জন্যেই তার গাড়ি থামাতে চেয়েছিল? আর আনিস মেয়েটিকে বকে তাড়িয়ে দিয়েই শুধু ক্ষান্ত হয়নি, খুনিকেও ওর অবস্থান চিনিয়ে দিয়েছে। ওর কারনেই কি তাহলে মেয়েটা… আনিসের বুক দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চায়। এ কি ভুল করলো সে? তার চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসে।