চেনা কষ্টগুলো

চেনা কষ্টগুলো

একটি শিশু আমার পাশে শুয়ে থাকে। পরম মমতায় আমি ওর গায়ে হাত রাখি, ও ঘুমের মাঝেই কেঁপে কেঁপে ওঠে। বাবা কাঁদছো? শিশুটি ঘুমের মাঝেই মাথা নাড়ে। ওর গাঢ় গোলাপ ঠোঁট একটু শুকিয়ে আছে। আমি হাতে ভেজলিন নিয়ে ওর ঠোঁটে লাগাতে গিয়ে থেমে যাই যদি ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়! আমি আবার কেমন করে ঘুম পাড়াবো? বড় আম্মা ঘুমাতে আসেন মাঝরাত পার করে। বাচ্চাটা ঠোঁট নাড়ায়। হাত বাড়িয়ে কাউকে খোঁজে। আমি আমার মুখটা বাড়িয়ে দেই ও আমার নাকের ফুটো আর চিবুক হাতড়াতে থাকে। আমি হাতড়িয়ে বেড়াই ওর ফিডার।

শিশুটি শিশ করে কাঁথা ভেজায়। আমি আসমাকে ডাকি ‘আসমা আসমা বাবু হিসি করেছে। ‘ দশবার ডাকার পরে আসমা ঘুম চোখ মেলে উঠে বসে। তারপর কাঁথা প্যান্ট বদলে দেয়। ততক্ষণ আমি শিশুটিকে কোলে রাখি।আমি শিশুটির মা নই। এই দেবশিশুর মতো বাচ্চাটির ফুপি আমি। আপন না ওর বাবার চাচাতো বোন। ভাবছেন শিশুটির মা কোথায় ? ওর মা ওর নানার বাড়ির হিজল গাছতলায় ঘুমিয়ে আছে । আর কোনদিন জাগবে না ।

ওর মায়ের নাম ছিলো সাথি। আমার বড় আম্মার ছোট বোনের মেয়ে। আমার সমবয়সী ছিলো সাথি। ওর সাথে একসাথে স্কুলে গিয়েছি। রান্নাবাটি খেলেছি। আমার বাম গালের লম্বা দাগটি সাথির দেয়া খামচির দাগ। ছয় বছর বয়স থেকে সাথির ডান হাতে যে দাগটি আজীবন, ওর চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রঙে আরো সৌন্দর্য বাড়িয়েছে । সেটি আমার দেয়া কামড়ের দাগ। আঠারো বছর বয়সে সাথি যখন বৌ হয়ে এলো। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। গোলাপি সালোয়ার কামিজের উপরে ঘি রঙের বোরকা পরে ও এসেছিলো। আমি ওর হাত ধরে বললাম।’ শাড়ি পড়লেনা যে!’ ও হেসে উত্তর দিয়েছিলো। ‘আসলাম তো খালাম্মার বাসায় শাড়ি পরে কী হবে?’

সাথির বৌভাতের শাড়ি পার্পল কালারের। আমার প্রিয় রঙ। জীবনের প্রথম শাড়ি পরে ও খুব কেঁদেছিলো। আমি বললাম ‘আয়েশা খালার জন্য মন কেমন করছে!’ ও মাথা নেড়ে না বললো। একটু পরে ভাইয়া কী একটা কাজে এ ঘরে আসতেই ভাইয়াকে দেখে ফিক করে হেসে দৌঁড়ে পালালো। আম্মা বলতেন ‘আমাদের বৌটা একটু পাগলা আছে।’ ওর যখন বাবু পেটে হলো। সবাই হাসছে । ও দেখি কাঁদছে । ‘ ও সাথি কাঁদো কেনো! ‘ কলেজে গেলে সবাই আমায় বাচ্চার মা বলবে তাইনা? আরে পাগলি আমি কী তোমায় ভাবি ডাকি! কেউতো জানেই না তোমার বিয়ে হয়েছে।

প্রায় ছয় কেজি ওজনের বেবি জন্ম দিতে গিয়ে সাথি আধমরা হয়ে গেলো। আমরা ওকে নিয়েই ব্যস্ত হঠাৎ বড় আম্মা বললেন। বাচ্চার যেনো কী হয়েছে। ডাক্তার নার্স ছোটাছুটি। বাচ্চা জন্ম থেকে ডায়াবেটিক পেশেন্ট। টাইপ টু ডায়াবেটিস। দ্রুত ওজন কমে যাচ্ছে। সাথি জ্ঞান ফিরে বাচ্চার জন্য কাঁদছে। এদিকে বাচ্চা তখন ডায়াবেটিক হাসপাতালে স্যালাইন চলছে। আমরা পরে গেলাম মহা বিপদে পরদিন এ্যাম্বুলেন্সে করে ওকে ডায়াবেটিস হাসপাতালে নেয়া হলো।এরপরে ওকে কখনো বাবুকে কোল থেকে নামাতে দেখিনি। সারাক্ষণ কোলে নিয়ে থাকতো। বাচ্চার কী যত্নই না নিতো ও অপটু হাতে।

একদিন ছোট আপা আমাদের বাসায় আসলেন নতুন ডিজাইনের একটা বালা হাতে দিয়ে। আব্বু সেদিন বাবুকে দেখতে চেয়েছিলো। সাথি বাবুকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসলো। একবার হৃদি একবার আমায় একবার আম্মাকে জিজ্ঞেস করছিলো স্বর্ণের ভরি কতো। আমি বইয়ের দাম বলতে পারি, হৃদি জামাকাপড়ের দাম নিখুঁত ভাবে বলে দিতে পারে। স্বর্ণ! সে আমাদের সাধ্যের বাইরে। আম্মা বললেন তুমি তনুকে নিয়ে জুয়েলারিতে যাও জানতে পারবে । ‘ আচ্ছা চাচি আমি গেলে বাবুকে কার কাছে রেখে যাবো!’ আম্মা বললেন – আমার কাছে রেখে যেও। আদৃতা দেখবে। ‘উহু, আদৃতা সারাক্ষণ বই পড়ে। আমার ছেলে খিদেয় কাঁদলেও উঠবে না। ‘আম্মা হেসে বললেন, ‘না দেখবে নিজের ভাইয়ের ছেলে ফেলবে কোথায় ! ‘আপনি হৃদির কোলে দিয়েন না ও বাবুকে ফেলে দেবে।’

আচ্ছা যাও দেবোনা। ‘শুধু চাচা আর আপনি রাখবেন। ঠিক আছে রাখবো। আম্মা তাকে অভয় দেন। সাতদিন পরে সোনার বালা পরে আমাদের বাসা থেকে বিদায় নিতে আসে সাথি। কি হাসিখুশি মুখ। কোলে বাবু । আদৃতা আমার বালা সুন্দর না ! হ্যা সুন্দর। আমাকে পরে খুব মানিয়েছে তাইনা? হুম খুব মানিয়েছে। ওর চম্পাকলির মতো আঙুলে একটা আংটি। এই আংটিও কিনলে বুঝি! না এটা বাসর রাতে তোমার ভাইয়া দিয়েছিলো আমাকে। লজ্জা আর খুশিতে ঝলমল করছিলো ওর মুখ।

প্রথমে হৃদি ওর জন্য বাদাম ভাজতে গেলো। হৃৃদির দেরি দেখে আমি গেলাম। হৃদি বাদাম পুড়িয়ে ফেলেছে। সাথি হাসতে হাসতে পোড়া বাদাম খাচ্ছিলো। একসময় সে বলেই ফেললো ‘আমরা কেউ হৃদির বাড়ি যাবোনা। ও পোড়া পোলাউ খাওয়াবে।’ আম্মা গেলেন নুডুলস রাঁধতে,এমন সময়ে দরজায় কে যেন এসেছে। আমাকে বলে গেলেন নুডুলস নামিয়ে রাখতে। আমি দিব্বি ভুলে গেলাম। নুডুলস ও পুড়ে ছাই হলো। পরদিন সাথি খুব ভোরের বাসে চলে গেলো ভাইয়ার কর্মস্থল ময়মনসিংহ। দুপুরে ভাইয়া হোটেল থেকে খাবার কিনে আনলেন। ঠিকা বুয়াকে খবর দিলেন বাসায় আসতে।

রাতে ভাইয়া বাসায় ফিরে দেখেন সাথি বাবুকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। উনিও ওদের পাশে শুয়ে পড়লেন। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো সাথির চিৎকারে ‘বাঁচাও এই বাঁচাও আমায় বাঁচাও।’ ভাইয়া দৌঁড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখলেন। সাথির গায়ে আগুন লেগেছে। উনি হতভম্ব হয়ে রান্নাঘরের পাতিলের পানি ওর গায়ে ঢেলে দিলেন। তারপর হাত ধরে দৌঁড়ে বের হলেন বাসা থেকে। হসপিটালে যখন পৌঁছালেন তখনও সাথি কথা বলছিলো। ডাক্তার ওকে ধমক দিয়ে শুতে বললেন। ও নাকি অনবরত বলছিলো ‘ভাইয়া আপনি বাসায় যান বাবু একা। আমার বাবু ঘুম ভেঙে কাঁদবে আপনি বাসায় যান।

সেদিন সকালেই সাথিকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়। তারপরের নয়দিন ও ভালোই ছিলো। কিন্তু ডাক্তার মাথা নাড়েন। সাথি ভালো নেই। তারপর ও আল্লাহ্‌র কাছে চলে যায়। সেদিন বাবুর বয়স ছিলো একবছর সাত মাস। সাথির হাতের সেই বালা আছে । প্রাণপ্রিয় সন্তান আছে। দুষ্টুমি করে ভাইয়া ডাকা স্বামীও আছে। শুধু এই পৃথিবীতে মুসার কোন মা নেই। এই অকাল মৃত্যুতে কারো ক্ষতি হয়নি। সবাই কিছুদিন কেঁদেছে। কিন্তু আমার পাশে আমায় ছুঁয়ে থাকা শিশুটিই শুধু মা ডাকার অধিকার হারিয়েছে। কী লিখলে ভালো হয় আমি জানিনা। সাথি তুমি পরম করুনাময়ের কাছে ভালো থেকো। উনার অসিম ক্ষমা তোমার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দিক।

সব শিশুরা খেলতে গিয়ে ব্যথা পেলে কাঁদে “মা ‘ বলে। সাথির বাবু হোঁচট খেয়ে কাঁদে দাদু বা ফুপি বলে। আমাদের চোখ দিয়ে আর সাথির জন্য জল পড়েনা। সব নোনাজল আমরা ওর বাবুর জন্য রেখেছি। জ্বরে যখন ও কাতরায় হাত বাড়িয়ে কাউকে খোঁজে ওর শুণ্য হাতে একজন সাথিকে এনে দেয়ার সাধ্য তো আর আমাদের নেই। শুধু পাশে থাকা। মায়ের বুকের ওম তো আমরা কেউ ওকে দিতে পারিনা। চোখ ডলতে ডলতে বাবু মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। পরম মমতায় আমি ওর দিকে আমার হাত বাড়িয়ে দেই ও বলে ‘ফুপি ফিঙ্গার ফুপি ফিঙ্গার হয়্যার আর ইউ।’

হিয়ার আই আ্যাম হিয়ার আই এ্যাম হাউ ডু ইউ ডু! এইতো সাথির ছেলে। আমাদের বংশের একমাত্র প্রদীপ। প্রিয় সন্তান ছেড়ে সাথি চলে গেছে। আমরা সবাই হাত পেতে ওর শিশুকে ধরে রেখেছি। একটা সত্যি আমরা সবাই জানি দুধ আর ঘোলের স্বাদ যেমন এক হয়না। ভাতের খিদে পোলাউ বা বিরিয়ানিতেও যায়না। পানির তৃষ্ণা পানিতেই মেটে কোক পেপসিতে কিছু যায় আসে না।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত