আত্নহত্যা

আত্নহত্যা

সাইকেলের বেল বাঁজছে।কয়েকটা হাঁস ডাঁকতে ডাঁকতে পানির দিকে ধেয়ে যাচ্ছে।পাশের বাড়ির রহিমার মা ভাত রান্না করছে তার রান্না করার পাতিলের আওয়াজ স্পট আসছে।আর রহিমা সে হাঁসগুলোকে বাড়ির দিকে আনার জন্য ডাকছে, আয়, আয়, চৌ চৌ। আয় আয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে।তাই দূরে উড়ে যাওয়া পাখিগুলো তাদের নীড়ে ফিরে যাচ্ছে।মানুষগুলো তাদের কাজ কর্ম শেষ করে বাসায় ফিরছে। সবাই সবার কাজে ব্যস্থ।সবার জীবন চলছে,সামনে এগিয়ে চলছে। সবাই ব্যস্থ থাকলেও যেন সবাই সুখেই আছে। এ লগ্নে সবকিছুই গতিশীল। ঠিক এই মুহুর্তে একমাত্র স্থিতিশীল প্রানি বোধ হয় রুপসা। বারান্দায় একা বসে আছে।চুলগুলো অগোছালো ভাবে শরীরের চারিপাশে ছড়িয়ে আছে।

রুপসা স্থিতিশীল হলেও তার চোখের জল স্থিতিশীল নয়।এ তরল পদার্থ আপন গতিতে চোখ থেকে বেড় হয়ে আসছে কাঁলো কুচকুচে চোখের মাঝে থেকে।তরল পদার্থগুলো হয়তো নিজেও জানে না কেন সে বয়ে চলছে।তবে হয়তো সে তরল পদার্থের বের হয়ে আসতে কষ্ট হচ্ছে।এখানে হেতু হলো,রুপসার কুচকুচে কাঁলো ভ্রুরের যত্নে জ্বল এতদিন লুকিয়ে ছিল।আর এখন অজানা এক কারনে তাকে সেই প্রিয় স্থান থেকে বিতাড়িত হতে হচ্ছে। দেখতে দেখতে আকাশটা অন্ধকার রুপ ধারন করেছে।ঠিক যেন রুপসা হৃদয়ের মত।তার হৃদয়ও ধীরে ধীরে অন্ধকারে লুকিয়ে যাচ্ছে। এই গোধূলী লগ্নে রুপসার হৃদয়ও গোধূলী বৈশিষ্ট্য ধারন করেছে। আজ সকালে রুপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিল। একা নয় সঙ্গে ছিল সুমন পাটোয়ারী।

বিশেষ কোন কাজের নিমিত্তে নয়।এই সামান্য একটা গর্ভপাত(Abortion) করতে হবে।এ কথাটা অবশ্য সবার কাছে জটিল মনে হতে পারে তবে সুমন পাটোয়ারীর কাছে এটা সামান্য একটা ব্যাপার মাত্র।এটা তারই ভাষ্য।গতকাল রাতে যখন রুপসা ফোন করে সুমন পাটোয়ারীকে তার Pregnancy এর কথা কান্নারত কন্ঠে জানায়,তখন সুমন খুব সহজেই বলে,আরে এসব নিয়ে চিন্তা করো নাতো।আগামীকাল সকালে হাসপাতালে আসো।ছোট্র একটা Abortion করিয়ে দেব।সব ঠিক হয়ে যাবে।এ কথা বলা শেষ হতে না হতেই ফোনটা রেখে দেয়।রুপসা এ বাক্য শোনার পর খুব করে কান্না করছিল।এমন কিছু করতে হবে সে কখনো কল্পনা করেছিল না।তার পেটের মধ্যে থাকা আরেকটা প্রানকে হত্যা করতে হবে সে এমন ভেবেছিল না কখনোই। সুমন পাটোয়ারী নিজে সঙ্গে থেকে সকাল সকালেই রুপসার গর্ভপাত করিয়ে দিয়েছে।নার্সের কথা অনুযায়ী ১২ সপ্তাহ পার হয়েছিল।তবুও রুপসা বুঝতে পারেনি।গতকাল বুঝতে পেরেই সুমনকে ফোন করে।আর তারপর হাসপাতাল।

১২ সপ্তাহ পার হয়েছে বিধায় Suction Aspiration পদ্ধতিতে রুপসার গর্ভপাত করতে হয়েছে। রুপসা লাবন্যময়ী পল্লীগ্রামের একটা সাদাসিধে মেয়ে।বাবা মায়ের আদরের দুলালী।পাড়াগায়েও তার সুনাম। সবাই তাকে ভীষণ ভালোবাসে।সে বাবা-মায়ের দ্বিতীয় কন্যা।বড় কন্যার তুলনায় রুপসাকেই সবাই ভালোবাসে বেশি বেশি।রুপসা ও রুকসানার বয়সের পার্থক্য মাত্র ২ বছরের।রুকসানা ছোট বেলা থেকেই রুপসাকে হিংসা করতো।কিন্তু রুপসা কখনোই রুকসানাকে খারাপ বাসে নি।খুব ভালো বাসতো। রুপসা বাড়িতে আদর বেশি আদর পেতো।পাড়াগায়েও বেশি সম্মান পেতো।

স্কুলেও ভালো ছাত্রীর খ্যাতি পেতো।রুকসানা বড় হয়েও রুপসার মত হতে পারতো না।কেননা সে ভালো গুনগুলো রুকসানার মাঝে ছিলই না।একই ক্লাসে পড়তো।একই বাড়িতে তবুও রুপসাই ভালো রেজাল্ট করতো। খুব ভালো পড়াশোনা করতে পারেনা বিধায় মাধ্যমিক পরীক্ষার পরপরেই রুকসানার বিয়ে দেওয়া হয়।আর রুপসা পড়াশোনা চালিয়ে যায়। রুকসানার বিয়ে হয়ে যায় উপজেলা সদরেই।রুপসা মাধ্যমিক পাশ করে উপজেলার মহিলা কলেজে ভর্তি হয়।রুকসানার মনের মধ্যে যে হিংসা ছিল। সে হিংসা বর্ধিত হয়ে আক্রোশে রুপান্তরিত হয়ে যায়।তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে আর আদরের ছোট মেয়েকে পড়াশোনা করানো হচ্ছে বিধায় বাবা-মায়ের উপরও অনেক বেশি অভিমান। রুকসানা প্রায়ই ছক আকঁতো কিভাবে রুপসার জীবন ধ্বংস করা যায়।এদিকে রুপসা কখনো ভাবেইনি তার বড় বোন তাকে হিংসার দৃষ্টিতে দেখে।

রুকসানা অনেকদিন ছক করতে করতে একটা নিকৃষ্ট ছক মনের মধ্যে গেঁথে নেয়।রুপসার জীবন নষ্ট করার কুবুদ্ধি তার মাথায় চলে আসে।একদিন রুকসানা স্বামী সুমন পাটোয়ারীকে প্রস্তাব দেয় রুপসার সাথে শারিরিক সম্পর্ক করার জন্য।একথা শুনার পর সুমন পাটোয়ারী অবাক হয়ে যায়।রুকসানার প্রস্তাবটাকে প্রত্যাখ্যান করে।রুকসানা সব খুলে বলে সুমনকে। রুকসানার কুপ্রস্তাবে এক সময় রাজি হয়ে যায়। কেননা যেখানে নিজের ঘরের বউ অন্য নারীর সঙ্গে মিলনে সহয়তা করবে সেখানে আপত্তির কি আছে!! যেখানে পুরুষ মানুষ সুযোগ পেলেই অন্য নারীতে চোখ দেয়।আর সুমন সেখানে বউয়ের এমন প্রস্তাবে না জবাব দিবে কেমন করে??

সব প্লান-পরিকল্পনা মোতাবেক রুপসাকে ডাকা হয় তাদের বাসায়। রুপসা আনন্দের সাথেই বোনের বাড়িতে যায়।সেদিনই বাসায় ফিরবে।বড় বোনের জড়াজড়িতে রুপসা থেকে যায় সেখানে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।রুকসানার ষড়যন্ত্রকারী মন উতলা হয়ে ওঠতে থাকে ।রুপসা মনের আনন্দে টিভির রুমে বসে বাংলা সিনেমার গান শুনছে। দেখতে দেখতে রাত নয়টা বেঁজে যায়।সারাদিন সুমন পাটোয়ারী বাসাতেই ছিল সেদিন।শালিকার সাথে অনেক হাঁসি-ঠাট্টা, মজা করেছে সারাদিন।অনেকবার কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুপসার দিকে।রুপসা বুঝতে পেরে মুখের উপরেই বলেছে, দুলাভাই নজর ঠিক রাখেন। নজরটাকে হেফাজত করতে শেখেন দুলাভাই।।

পাশের রুমে রুপসা হালকা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছে।ঠিক তখনই রুকসানার কন্ঠ শুনা যাচ্ছিল।তাই রুপসা গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়।তার তখন আর কতই বা হবে। এগারো সাড়ে এগারোর মাঝামাঝি। রুকসানার সাথে তার দুলাভাই সুমন পাটোয়ারীও রুমে ঢুকে। মুহুর্তের মধ্যে শকুনের মত ঝাপিয়ে পড়ে তার দেহের উপর।বড় বোনের সামনেই রুপসাকে ছিড়ে ছিড়ে খেতে থাকে।ঠিক যেমন শকুন মাংস ছিড়ে খায়। রুপসা বুঝে ওঠতে পারে না।কি কারনে করা হলো তার সাথে??কেন তার উপর অমানবিক নির্যাতন চলে।।কি বীভৎস দৃশ্য ছিল!!এমন দৃশ্য হয়তো পৃথিবীর কোন মানুষই কল্পনা করেনি।সেখানে রুপসা কিভাবে কল্পনা করে থাকবে আগে থেকেই?

রুকসানা তার আক্রোশের সবটুকুর কারন সেদিন বলে রুপসার কাছে।রুপসা এসব অভিযোগ জেনে চিৎকার করে বলেছিল, তোকে সবাই অপছন্দ করার পিছনে আমার দোষটা কোথায়? হিংসার সবটুকু ঢেলেছে সেদিন রাতে।স্বামীর সব বীর্য যেন হিংসারই অংশ। নিজের বড়বোন মায়ের সমান।কিন্তু সেই মায়ের সমতূল্য তার আজ তা সম্মান নিয়ে খেলা করার মুল হোতা মোবাইলে এমন বীভৎস দৃশ্য ধারণ করছিলেন সেই বড় বোন নামের নিচু মনের মানুষিকতা একজন নারী। এ ক্ষেত্রে রুকসানাকে নারী বলা ঠিক হবে না বোধ হয়।কেননা এমন কর্মকান্ড একজন নারীর দ্বারা সম্ভব নয়।রুকসানা যেন পুরো পৃথিবীর নারী জাতীর কলঙ্ক।

এমন নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর।নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রুপসা। কিন্তু মা-বাবার ভালবাসার কথা ভেবে বেঁচে থাকার জন্য নতুন করে জীবন শুরু করে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই বড় বোন নামের সেই জঘন্য নারী রুপসার জীবনে আবার উত্থান হয়।ভিডিও ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে প্রায়ই রুপসার সাথে নিকৃষ্ট কাজ করতে বাধ্য করেন।রুপসা তবুও টিকে থাকতে চেয়েছে।ধীরে ধীরে তাদের দুজনের হাতের পুতুল হয়ে যায়।আর এদিকে আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করতে পারে না।মা-বাবার ভালবাসার কথা মনে পড়ে।তাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন তার পিতামাতার।সব কষ্ট সহ্য করেও পিতামাতার স্বপ্ন পুরোন করার নিমিত্তে বেঁচে থাকতে হয় তাকে। গোধূলীর সন্ধ্যার বৈশিষ্টের ছায়া যেন তার উপরেই আবিষ্ট করেছে।

এমন অন্ধকার জীবন নিয়ে সামনের পথ চলাটাকে খুব কঠিন মনে হচ্ছে।রুপসা তার জীবনের সব হারিয়ে যেন একটা উন্মাদে পরিনত হয়েছে। তার মা অনেক দিন বলেছে, রুপসা তোর কেমন যেন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে মা।তোর কি কিছু হয়েছে।ভেতরের জ্বালাকে পোক্ত করে ধরে উত্তর দিয়েছে, না মা।কিছু হয়নি তো। তার মা বুঝতে পারতো কিছু একটা হয়েছে।কিন্তু জানতো না কি হয়েছে।মায়ের মন। তাই প্রায়ই একই কথা বলতো।আর রুপসা একই উত্তর দিতো।কিন্তু পরে একা রুমে খুব করে কান্না করতো। বাবা-মাকে কিছু বলতে পারতো না।এদিকে আত্মহত্যাও করতে পারতো না।। কিন্তু আজকের গোধূলী লগ্নটাকে খুব আপন মনে হচ্ছে রুপসার কাছে।আজকে নিজের ভেতরে জীবন্ত প্রানিটাকে হত্যা করে এসেছে। পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। এ সব আত্মহত্যার মূল কারনগুলোর মধ্যে ‘ যৌন অত্যাচার’ অন্যতম প্রধান করান।

আজকে রুপসার কাছে পৃথিবীটা অসহ্য, বিরক্ত মনে হচ্ছে।বাবা মায়ের কথাও তার মনে পড়ছে না। তাই নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার জন্য পথ একদম খোলা। রুপসা তাই করতে শুরু করে। রাত আটটা ঘড়ির কাটায় দেখা মিলছে।।খেতে ডাকলে সবার গিয়ে রাতের খাওয়া শেষ করে। তারপর সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে।তখন সে পরপারে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।রুমে আগেই একটা মোটা রশি নিয়ে রেখেছিল।বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার প্লান করেনি সে।কারন ততোটা বোঁকা মেয়ে সে না। যে বিষের গন্ধ পেয়ে তাকে সবাই বাঁচাতে আসবে। রশি দিয়ে আত্মহত্যা করা একদম নিরাপদ।কেউ জানতে পারবে না। রাতের মধ্যেই মরে থাকবে। তার প্লান অনুযায়ী সে সফল হয়।রশিতে ঝোলার কিছু মুহুর্তের মধ্যেই ছটফট করতে করতে প্রান পাঁখি উড়ে যায়। মৃত্যুই যেন তাকে মুক্তি দেয়।

সকালে আবিষ্কার করে রুপসাকে একটা লাশ হিসেবে। পাড়াগায়ের কেউ বিশ্বাস করতে পারেনা। সবাই বলাবলি করে।এ মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে না।এমন ভালো মেয়ে আত্মহত্যা করবে কোন দুঃখে। হ্যাঁ।সত্যি তো।এটা আত্মহত্যা না।এটা একটা মার্ডার। বড় বোন ছোট বোনকে হত্যা করেছে। কিন্তু এ সত্য কেউ কোন দিন জানতে পারবেন না। এ রহস্য কোনদিন উন্মোচিত হবে না। তবে রুকসানার আক্রোশ কষ্টের শূল হয়ে নিজেকে কষ্ট দেবে।কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার মত কেউ থাকবে না। শুধু অবশিষ্ট থাকবে রুকসানা ও তার আক্রোশ।।।।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত