আজ শুক্রবার,আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশট্রেশ হয়েই আয়নার সামনে বসে গেলাম সাজুগুজু করার জন্য।আজ আমার পালিয়ে করা বিয়ে মানে একটু পর আমি পালাবো।মায়ের কাছ থেকে গতো রাতে বান্ধবীর জন্মদিন বলে একটা শাড়ি নিয়ে রেখেছিলাম।সবাই লাল শাড়ি পরে বিয়ে করে কিন্তু আমি একটা সবুজ শাড়ি চেয়ে নিলাম মায়ের কাছ থেকে যেনো কোনো সন্দেহ না করে।
সাজুগুজুতে আমার আবার হাত খুব পটু…মাঝে মাজেই বউ টউ সাজাই বিয়েতে তাই নিজের সাজতে খুব একটা দেরি হলো না…।ধুমধাম করে হালকা একটু সেজে চুলে বেলি ফুলের তোড়াটা গুঁজে দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম মা’কে বলে।ওর আবার বেলী খুব পছন্দ কিনা তাই এইত্তো আর মিনিট খানেক পরেই পৌছে যাবো নির্দিষ্ট গন্ত্যব্যে।তারপর আমি আর ও।
সব কিছু ভাবতে ভাবতে কেমন যেনো মনটা ভালো আবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে,বার বার মায়ের মুখটা মনে পড়ছে,বাবার শাসন আর ছোট্ট ভাইটার হোদলকুতকুতে চেহারাটা মনে পড়ে যাচ্ছে। নাহ আমাকে এতো ভেঙ্গে পড়লে চলবে না,আমি যে হিমেলকে অনেক ভালোবাসি।ওকে ছাড়া আমি বাঁচবইনা।তাই ওর কাছে আমার যেতেই হবে।ওই তো ওকে দেখা যাচ্ছে,রিকশা ভাড়াটা হিমেলই মেটালো..বাব্বা এখনি কেমন বউ বউ লাগছে নিজেকে।
-কইগো চলো আর কতোক্ষন???যাবেনা???
-যাবো দাড়াও রাইয়ান(ওর বন্ধু) আসবে।ও আসলেই যাবো।
-ওহ আচ্ছা ব্যাবস্থা বুঝি ওই সব করেছে?
-হুমম,ওর মেসেই বাসর সাজানো,যাবে দেখতে???
-না না আগে বিয়েটা করে নেই একবারেই বাসর দেখবো।
-আরে বাবা চলোনা আগে দেখি,তারপর স্বপ্নগুলো সাজাতে সাজাতে যাবো বিয়ে করতে…হা হা হা হা)
ওর হাসিটা খুব খটখটে লাগলো কানে তাও এড়িয়ে গেলাম ভাবলাম,বেচারা হয়তো বিয়েটা নিয়ে খুব টেনশন করছে। রাইয়ান আসলে ওর সাথে ওদের মেসে গেলাম,ওরে বাবা কি সুন্দর সাজিয়েছে ওরা,মনে মনে ভাবলাম..।আমার কপালে এতো সুখ ছিলো ভাবতেই পারিনি কখোনো। রাইয়ান আমাদের বসিয়ে রেখে চা আনতে গেলো,ঘুরে ঘুরে রুমের সবটুকু দেখছিলাম আমি মনে এক অসাধারন অনুভুতি।
চুপচাপ সিঁড়ির উপর বসে আছে রিনি।পা দুটো অসাড় হয়ে আছে,কিছুতেই এগুচ্ছে না।কিন্তু যে করেই হোক যেতেই হবে ৫তলা অব্দি।কোনো মতে পা টানতে টানতে দরজা পর্যন্ত গেলো রিনি।কলিংবেলে কয়েকটা চাপ দিয়েই অজ্ঞান হয়ে পরে গেলো রিনি…।কাজের বুয়া কুলসুমের মা দরজাটা খুলে দিয়েই চিৎকার…
-আপাগো দেইখা যান রিনি আপার কি হইছে…পইড়া আছে ক্যান জাহানারা বেগম দৌড়ে আসে,দেখে গাঢ় সবুজের মাঝে লাল রংটা বড্ড উজ্জ্বল হয়ে পতাকার মতো লেপ্টে আছে তার সোনা মেয়ের গায়ে…
সেদিন থেকে জাহানারা বেগমের কথা বন্ধ…।রিনির ছোট ভাইটা আপুর এই অবস্থায় স্কুলে যায়না…।বাবা সারাটা দিন পারলে জায়নামাজের উপর বসে কাঁদে আর বলে, “কি পেলাম আমি,৪১বছর হয়ে গেলো দেশ স্বাধীন করলাম…এই আমার স্বাধীনতা??? আমার মেয়েটা কি পেলো বিশ্বাস করে??” ডাক্তার এসে দেখে বলে গেলো ওকে যেনো কোনো মানসিক ভাবে চাপ দেওয়া না হয়। দিনের পর দিন কাটতে লাগলো,ঘরের কোনে লাইট নিভিয়ে কুকড়ে পরে থাকা,দিনের পর দিন না খেয়ে থাকা রিনির অভ্যাসে পরিনত হলো..কিন্তু এভাবে আর কতোদিন???
জাহানারা বেগম ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগলেন,তিনি মেয়ের পাশে দাড়ালেন খুব ভালোভাবে…বললেন বান্ধবীদের সাথে মিশতে আগের মতো…রিনির বন্ধু বান্ধবীদের আসতে বললেন বাসায় রেগুলার…ওরা আসতে শুরু করলো,সাথে সাথে রিনিও আবার আগের মতো হাসতে শুরু করলো ধীরে ধীরে…প্রায় আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো রিনি। একদিন খুব সকালে বাসার বেল বাজতেই রিনিই উঠে গেলো দরজা খোলার জন্য…।খুলেই দেখে নিলয় হাতে একগাদা বই নিয়ে হাজির,নিলয় ওর ভার্সিটির বন্ধু। রিনি খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো নিলয় এর দিকে,এতো দিন তো নিলয় আসেনি ওর সাথে দেখা করতে,তাহলে আজ হঠাৎ???
-কি আমাকে ঢুকতে দিবে নাকি এভাবেই দাড়িয়ে থাকবো,তোমার হুমায়ুন আহম্মেদ এর যা ওজন….ওরে বাবা…!!! কথায় সম্বিত ফিরে লজ্জা পায় রিনি…
-হ্যা হ্যা আসো…তুমি আজ হঠাৎ?
-কেনো আসতে মানা???
কি করবো বলো তুমি ২ মাস হয়ে গেলো ভার্সিটিতে যাওনা…প্রতি সপ্তাহে একটা করে হুমায়ুন জোগাড় করছি আর জমাচ্ছি,যখন মনে হলো এবার যা জমেছে তাতে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে দেখে তাই দিতে এলাম,আবার এক্ষুনি চলে যাবো…বলেই একটা সুন্দর হাসি দেয় নিলয়।
–না না সে কি এক্ষুনি যাবে মানে ,মায়ের সাথে দেখা করে যাও বলতে না বলতেই জাহনারা বেগম ঢুকলেন ড্রয়িং রুমে..
-মা ও নিলয় আমার সাথে পড়ে…
-আন্টি আদাব…ভালো আছেন???আপনার শরীর ভালো???
-হ্যা বাবা আছি এখন আগের থেকে ভালো,তোমার বাসার সবাই ভালো আছে?
-জ্বী ওনারা ভালো আছেন রিনি আমি আজ যাই আবার আসবো পরে,আন্টি যাই ) জাহানারা বেগম বললেন
-কিছু খেয়ে যাও বাবা,একটু চা করি।
-না আন্টি আমি আবার আসবো এখন একটু কাজ আছে একটা টিউশন আছে…
রিনি ওর রুমে গিয়ে বইয়ের প্যাকেট গুলো খোলে….৮টা বই আর সাথে ৮টা গানের সিডি…সবই রবীন্দ্রনাথ রিনির সিডি গুলো দেখেই মন ভালো হয়ে যায়…প্রতিটা সিডির উপরে নাম্বার লেখা….১,২,৩,৪——-৮ আর প্রতিটাতে একটা করে চিরকুট।রিনির খুব অবাক লাগে কি ব্যাপার ??? কারন চিরকুটে লেখা
১নং সিডির ৪ নং গান
২নং সিডির ৯ নং গান
৩নং সিডির ৫ নং গান
৪নং সিডির ৬ নং গান
৫নং সিডির ১১ নং গান
৬নং সিডির ৭ নং গান
৭নং সিডির ৪ নং গান
৮নং সিডির ১নং গান
লেখাটা পড়ে খুব কৌতুহল বোধ করে রিনি। একে একে প্রতিটা সিডি চালায় ও আর নাম্বার গুলো সিলেক্ট করে দেয়…
১নং –আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে….
২নং –আমারও পরানো যাহা চায়….
৩নং –আমি যেনে শুনে বিষ করেছি পান….
৪নং –ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে…
৫নং –ভালোবাসি ভালোবাসি…..
৬নং –আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল…..
৭নং –সহেনা যাতনা…..
৮নং-বড় আশা করে এসেছিনু কাছে ডেকে লও….
আর শেষ চিরকুটটায় একটা ফোন নাম্বার লেখা রিনির দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে,এখন বৃষ্টি হলে ভালো হতো বোধহয়।