অনেক ভালবাসা স্নিগ্ধা আর মুহিত এর মধ্যে।দুইজন দুইজনের জন্য এতই পাগল, ঠিক যেমন পাগল থাকে একটা নেশাগ্রস্ত যুবক ফেন্সিডিলের জন্য। কবির ভাষায় যাকে বলে শয়নে- স্বপনে শুধু তুমি আর তুমি। ওদের এই ভালবাসার বয়স প্রায় ৫ বছর। হঠাৎ করেই পরিচয়, হঠাৎ করেই ভালবাসা।কিন্তু বিয়েটা হঠাৎ করে হয়নি মুহিত আর স্নিগ্ধার।এই দেরি টা পরিবারের জন্য না।নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আগে নিজেরা নিজের পায়ে দাঁড়াবে,তারপরেই বিয়ে করবে। যদিও মুহিত আগেই স্টাবলিশড হয়ে গেছিল,কিন্তু স্নিগ্ধার জন্য মুহিত অপেক্ষা করেছিল,তার পাশে থেকে তাকে সাহস জুগিয়েছিল মুহিত। এখন তারা দুইজনেই একজোড়া সুখী কপোত-কপোতী। একজনের ব্যথা লাগলে আরেকজন কাঁদে,একজন সুখী হলে আরেকজন হাসে,কেউ কাউকে ছাড়া এক মুহুর্ত থাকতে পারেনা।
ভালই চলে যাচ্ছিল দুজনের হাসিখুশি আনন্দে ভরা ছোট্ট সংসার। সকাল সকাল একসাথে ঘুম থেকে উঠে একসাথেই নাস্তা বানিয়ে খেয়ে অফিসে চলে যায়।।অফিসের সময়টুকুই শুধু দুজন দুজনকে দেখতে পায়না। সামনে দেখতে না পেলে কি হবে,প্রতি পনের মিনিট পরপর মুহিতের ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে স্নিগ্ধার ছেলেমানুষি ভরা দুষ্টু হাসি।স্নিগ্ধাও এদিক থেকে পিছিয়ে নেই।নিজের অফিসের ডেক্সটপ এর ওয়ালপেপারে সবসময়ই খুজে পাওয়া যায় মুহিতের সাদা শার্ট পরা সেই ছবিটা যেটা সেই দিন তোলা হয়েছিল যেদিন দুইজন দুইজনের মনের কথা খুলে বলেছিল।
অফিস টাইম শেষে দুইজন মোক্তার মোড়ের মিস্টির দোকানের দই-চিড়া খেয়ে বাসায় ফেরে।তারপর সারা দিন কি কি করল,সবকিছু উগলে দেয় একে অন্যের সামনে।সেই সাথে চলে মুড়ি আর চা। কথায় কথায় একসময় স্নিগ্ধা বলল,”মুহিত,চলো না,আমরা দুজন থেকে তিনজন হই।” মুহিত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।ম্লান একটা হাসি দিয়ে স্নিগ্ধার হাত চেপে ধরে বলল,”ঠিক আছে।” দিনের পর দিন,মাসের পর মাস যেতে থাকল।এভাবে দুবছর পার হয়ে গেল। কিন্তু ,কেন জানি স্নিগ্ধার স্বপ্ন টা পূরন হল না। মুহিত খেয়াল করছিল,স্নিগ্ধা দিনে দিনে আরো বেশি বিমর্ষ হয়ে পড়ছিল।ভালমত খাওয়া দাওয়া করত না।আগের সেই চঞ্চল স্নিগ্ধাকে খুজে পেল না মুহিত।
একদিন অফিস থেকে বাড়িতে দেরিতে ফিরল মুহিত।স্নিগ্ধা আগেই বাড়িতে এসে রাতের খাবার তৈরী করেছিল।
মুহিত বাসায় এসে স্নিগ্ধাকে নিজের কাছে এনে বসাল।স্নিগ্ধা মুহিতের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল,চোখের পাতাটা ফুলে উঠেছে,আর সাদা চোখজোড়া রক্তবর্ণ হয়ে আছে। এ অবস্থা দেখে স্নিগ্ধা অস্থির হয়ে উঠল।বারবার মুহিত কে জিগেস করল,”কি হয়েছে তোমার?” মুহিত স্নিগ্ধা কে পাশে বসিয়ে ওর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চোখে চোখ রাখল। স্নিগ্ধা বুঝতে পারছিল মুহিত তাকে কিছু একটা বলার জন্য ছটফট করছে কিন্তু বলতে পারছে না। তখন নিজেকে শান্ত করে স্নিগ্ধা বলল,”তুমি আমাকে যেটাই বলতে চাও,প্রাণ খুলে বল।যত ভয়ঙ্কর ,যত কষ্টকর,যত লজ্জার অথবা যা-ই হোক,আমাকে খুলে বলো,প্লিজ মুহিত।”
মুহিত গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,”স্নিগ্ধা,তোমায় আজ পর্যন্ত কিছুই দিতে পারিনি।ছোট্ট একটা চাকরি করি।আহামরি লাখ লাখ টাকা বেতন না আমার।একটা ছোট্ট ভাড়া ফ্ল্যাটে তুমি তোমার সোনার সংসার গুছিয়েছ।কোনো রকম বিলাসিতা চাও নি আমার কাছে। কখনো তার জন্য নিজেকে ছোটও মনে করনি।নিজের চাকরির পাশাপাশি আমাকে যথেষ্ট সময় আর ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছ। কখনো কোনো অযুহাত দেখাও নি।আমায় কখনো কোনো কিছুর অভাব বোধ করতে দাওনি। অথচ আমি ??? এই বলে মুহিত মাথা নিচু করে ফেলল।
স্নিগ্ধা মুহিতের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল,দুহাত দিয়ে মুহিতের গাল দুটো ধরে বলল,”তুমিও তো আমায় কখনো কষ্টে রাখ নি।কি পাইনি আমি বল? টাকা পয়সা কিংবা বিলাসিতা নিয়ে আমি কখনো অহংকার করিনি।তার কারন আমার কাছে অহংকার করার মত আরো মূল্যবান একটা জিনিস আছে। কি সেটা জানো? ” মুহিতের বুকের বাম দিকটায় হাত রেখে বলল “এই যে,এই মন টা। যেটা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী বস্তু।যে মন আমাকে পাগলের মত চায়,আমাকে নিবিড়ভাবে ভালবাসে। এই অমূল্য জিনিস থাকতে আমি কেন অর্থের পিছে ছুটতে যাব,বল? আমার কোনো কথায় কি তোমার মনে হয়েছে মুহিত? যে আমি টাকার অভাব বোধ করছি? ” মুহিত মাথা নাড়ল।বলল “না স্নিগ্ধা,তুমি কখনোই আর পাঁচটা মেয়ের মত না।একারনেই তো তোমাকে আমি এত ভালবাসি। ”
স্নিগ্ধা বলল,”যে মানুষ টা আমাকে এতটা সাপোর্ট দিয়েছে সবসময়, সবসময় আমাকে অনুপ্রেরিত করেছে, মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় তৈরী করতে যে আমার পাশে সবসময় থেকেছে, আজ তার চোখের জল কি আমি মুছিয়ে দিতে পারিনা মুহিত? ” মুহিত হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। স্নিগ্ধা নিজেকে শান্ত রাখল।এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দিল মুহিতকে।মুহিত যখন একটু শান্ত হল,তখন স্নিগ্ধা মুহিতের পাশে এসে বলল, “কাল অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি।সেন্ট জোসেফ চ্যারিটি স্কুল এন্ড অরফানেজ এ আমার স্কুলের এক বান্ধবি কাজ করে।ওর সাথে দেখা করতে যাব।তুমি যাবে আমার সাথে? ” এই বলে একটা মৃদু হাসি দিল স্নিগ্ধা।
মুহিত হতবাক হয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইল। স্নিগ্ধা বলল,”আমি অনেক আগে থেকেই জানি, আমাদের সংসার দুইজন থেকে তিন জনের হবে না।আমি আগেই ড.কনক এর সাথে পরামর্শ করে টেস্ট করিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি।তাই তুমি কষ্ট পাবে ভেবে তোমাকেও কিছু বলিনি।ভেবেছিলাম,তোমায় আর কোনো দিন সন্তানের কথা বলব না।কারণ তুমি কষ্ট পাবে। আমি বুঝতেই পারি নি,তুমিও তোমার চেক আপ করাবে।” মুহিত দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে বলতে লাগল,”কিছুই দিতে পারিনি তোমায় আমি,কিছুই না।আমি ব্যর্থ।
আমার ভালবাসা ব্যর্থ। আমি আসলেই অযোগ্য।তোমার অযোগ্য।আমাকে তুমি মাফ করে দাও স্নিগ্ধা।প্লিজ স্নিগ্ধা একটুখানি হেসে বলল,”এই দুনিয়ায় বিধাতা যদি কাউকে আমার জন্য সৃষ্টি করে থাকেন,সেই মানুষটা হলো তুমি।বিধাতা নিশ্চই অযোগ্য কাউকে তৈরী করেন না…আকাশের যোগ্য যেমন চাঁদ,সাগরের যোগ্য যেমন নদী,ফুলের যোগ্য যেমন ভ্রমর.. ঠিক তেমনি স্নিগ্ধার যোগ্য শুধু মুহিত। আর কেউ না।”এই বলে স্নিগ্ধা মুহিত কে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল।মুহিত স্বস্তির এক নিশ্বাস ফেলল স্নিগ্ধার অজস্র ভালবাসা-মাখা উষ্ণ বুকে।
পরদিন সকাল ১০ টা। সিএনজি থেকে নেমেই স্নিগ্ধা আর মুহিত মাথার উপর দেখতে পেল লাল বাগানবিলাস দিয়ে ঢাকা একটা সাইনবোর্ড “সেন্ট জোসেফ চ্যারিটি স্কুল এন্ড অরফানেজ ” স্নিগ্ধা উত্তেজনায় শক্ত করে চেপে ধরল মুহিতের হাত।