মরিয়ম ভয়ে এখনো বাড়ি যায়নি। বাড়ি গেলেই তার মা আজ খুব মারবে। সেজন্য রাস্তার ধারে দুর্বা ঘাসে বসে আছে। বিকেল বেলা সেঁজুতি বেগম বলেছিল, “এই কালি, গাছতলা থেকে পাতা কুঁড়িয়ে নিয়ে আয়। নয়তো রান্নাও করতে পারব না, কপালে ভাতও মিলবে না।” মরিয়মকে তার মা কালি বলেই ডাকে। দশ বছরের মরিয়ম মায়ের কথার অর্থ খুঁজে পায় না। ভাত কিভাবে কপালে মিলবে। সে ঝাড়ু আর চটের বস্তা নিয়ে পাতা কুঁড়াতে গিয়েছিল। কিন্তু তার সখি আয়েশা বলল, মরিয়ম চল তাড়াতাড়ি। টিভিতে নাগিন ছবি হচ্ছে।
মরিয়ম নাগিন ছবি দেখার লোভ সামলাতে না পেরে আয়েশার সাথে ছুটে যায়। ঝাড়ু আর চটের বস্তা গাছ তলাতেই পড়ে থাকে। মরিয়ম আর আয়েশা বড় বাড়ির জানালার শিক ধরে নাগিন ছবি দেখায় মগ্ন। সেঁজুতি বেগম মরিয়মকে খুঁজতে এসে দেখে গাছতলায় ঝাড়ু আর চটের বস্তা পড়ে আছে। সেঁজুতি তাড়াতাড়ি কিছু পাতা জমিয়ে বাড়ি ফিরল। তার যে চূলায় রান্না বসাতে হবে।
মরিয়ম ছবি শেষ করে এসে গাছতলায় ঝাড়ু খুঁজে পায়নি। বাড়ির কাছে যেতেই মরিয়ম শুনতে পায় তার মা রান্না ঘর থেকে জোর গলায় বলছে, এমন মেয়েকে ছোটবেলা লবন খাইয়ে মেরে ফেলা উচিত ছিল। আসুক আজ বাড়িতে, পিঠের ছাল যদি না তুলি আমি মির্জাচরের মেয়ে না। মরিয়ম তখন থেকে এখনো বাড়ি ফিরেনি। সন্ধা বয়ে যাচ্ছে। পাশেই বাঁশ বাগানে ঝিঁ ঝিঁ পোকা সুর তুলে গান ধরেছে। মরিয়ম হাতের চড়ে একেকবার দুইটা তিনটা করে মশা মারছে। মাথার উপরে মশাদের দল ভীর করে আছে। একটু পড়েই দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি রওনা দেবে রাতের আহার জোগাড় করার জন্য।
ইকবার হোসেন বাড়ি ফিরলেন সাতটায়। ঘরে ফিরে সেঁজুতি বেগমের মুখ গোমড়া দেখে তার বুঝতে বাকি নেই, আজও মরিয়মের নামে বিচার আছে। চার বছর বয়সের ছোট মেয়ে তানিয়া বাবার পেছনে গিয়ে কাঁধে ভর করে আছে। ইকবাল হোসেন জানতে চাইলেন, মরিয়ম কোথায়? সেঁজুতি বেগম জবাবে বলল, দেখো গিয়ে কোথাও মরে পড়ে আছে নাকি। মরলেও তো আমি শান্তি পেতাম। এই কালি আমার জীবনটা শেষ করে দিল। ইকবাল রাগ দেখিয়ে বলল, “তুমি সবসময় কালি কালি বলো কেন? মরিয়ম তো তোমারই মেয়ে, নাম ধরে ডাকতে পারো না?”
-আমার মেয়ে নাকি তুমি জানো না? সন্দেহ করছ আমাকে? ইকবাল কথার জবাব না দিয়ে টর্চ লাইট নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। সে জানে সেঁজুতি এখন গায়ে পড়ে ঝগড়া করবে। সেঁজুতির ধারণা ইকবাল তাকে সন্দেহ করে। মনে সন্দেহ না থাকলেও মানুষের কথায় সন্দেহ ঢুকে যায় মনে।
চার ব্যাটারির টর্চ লাইট নিয়ে ইকবাল মরিয়মকে খুঁজছে। কোথায় গেল মেয়েটা? ছোটবেলা থেকে মেয়েটাকে একদম দেখতে পারেনা সেঁজুতি। দিনের পর দিন অবহেলা, অনাদর আর মারধোর করেই যাচ্ছে। ছোট মেয়ে তানিয়ার গায়ের রং খুব ফর্সা। কিন্তু মরিয়মের গায়ের রং কালো। এতে ইকবালের মনে কোনো দুঃখ ছিল না। কিন্তু মরিয়মের চেহারার সাথে ইকবাল বা সেঁজুতির চেহারার কোনো মিল নেই। সেঁজুতির চাচাত ভাই কামালের সাথে অনেক মিল। মরিয়ম আর কামাল কোনোদিকে গেলে সবাই এক বাক্যে বলবে এটি কামালের মেয়ে। এখনো কম কথা শোনায় নাকি মানুষ? পাশের চরে বিয়ে করেছে ইকবাল। দুই গ্রামের মানুষই বেশ চেনা জানা। অনেকে হাসির ছলে বলে, কিরে ইকবাল! কামালের মেয়ে ঘরে আনলি নাকি? ইকবাল জবাব দেয় না। একদিন সেঁজুতিকে শুধু বলেছিল, মানুষ তো এমন উল্টাপাল্টা কথা বলে। তখনই সাপের মতো ফোঁস করে উঠেছিল সেঁজুতি। তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো? বাপের বাড়ি গিয়ে আমি চাচাত ভাইয়ের সাথে রাত কাটাইছি?
ইকবাল মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলে, চুপ চুপ। মানুষ শুনলে শরম। সেঁজুতি হঠাৎ কেঁদে দেয়। কেঁদে কেঁদে বলে, বাবা আমাকে কোথায় বিয়ে দিল? আজ আমার চরিত্র নিয়েও কথা শুনতে হল। ইকবাল ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আর কিছুই বলে না। মির্জাচর বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই ছিল না ইকবালের। শুধু বাবার কথা রাখতে গিয়ে আজ এই অবস্থা। নয়তো এমন ডাকাতের এলাকায় কেউ আত্মীয়তা করে নাকি? কারো সাথে ঝগড়া হলেই মির্জাচরের নারী পুরুষ মিলে ট্যাটা বল্লম নিয়ে মারামারি করতে বেরিয়ে পড়ে। ইকবাল অনেক সময় ভয়েও অনেক কথা চেপে রাখে।
মরিয়মকে পাওয়া গেল বাঁশ বাগানের কাছেই। শুয়ে কান্না করছে মেয়েটা। ইকবাল টর্চ ধরার সাথে সাথে মরিয়ম উঠে বসল। তার বুঝতে বাকি নেই, বাবা এসেছে। তার একমাত্র ভালোবাসা। দৌড়ে গিয়ে বাবা’কে জড়িয়ে ধরল মরিয়ম। দশ বছরের এত বড় মেয়েকে কোলে নেয়া যায় না। মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, চল বাড়িতে। দেখি আমার মেয়েটাকে কে কী বলে। মরিয়ম তার বাবার হাত চেপে ধরে শক্ত করে। একটি মাত্র ভরসার হাত। একটি ভালোবাসার হাত চেপে মরিয়ম বাড়ি ফিরে।
সেঁজুতি তানিয়াকে ঘুম পাড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। মরিয়মকে ঘরে ঢুকতে দেখে সেঁজুতি বলে উঠল, ঐ কালি। কই গিয়া মরছিলি? ইকবাল দরজার আড়াল থেকে গরুর হালের লাঠি হাতে নিয়ে তেড়ে এলো। ‘আর একবার যদি কালি বলিস, পিটিয়ে লম্বা বানিয়ে দেব।’
-কী? তুমি আমাকে মারবে? সকালেই আমি বাবার বাড়ি চলে যাব। আর তুই, তুই আমার নামে কী বলেছিস তোর বাবার কাছে? কতক্ষন পাহাড়া দিয়ে রাখবে তোকে? মরিয়ম বাবা’কে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। মনে ভয় ঢুকে, বাবা বাড়িতে না থাকলে না জানি মা আবার মারে। দশ বছরের মরিয়ম অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে। বাবা’কে একদিন প্রশ্নও করেছিল, ‘বাবা, এটা কি আমার সৎ মা?’ উত্তরে ইকবাল বলেছিল, নারে মা। তোর মা’কে জ্বিনে ধরছে। তাই তোর সাথে এমন করে। মরিয়ম পাল্টা প্রশ্ন করে, তো তানিয়াকে না মেরে আদর করে কেন? আমি কালো বলে আমাকে মারে? ইকবাল সাহেব ছল ছল চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, উত্তর দিতে পারে না।
বাচ্চারা মাটির কলস ভাঙ্গা, পাতিল ভাঙ্গার টুকরো দিয়ে খেলে। বিদেশী জাতের নিম গাছের কাঠি খেলে কেউ হারে কেউ জিতে। মরিয়ম সন্ধার আগে কাঠি কুঁড়াতে গিয়েছিল। সেঁজুতি মরিয়মকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও না পেয়ে রাগে ফোঁসতে থাকে। মরিয়ম ঘরে ফিরতেই কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করে মরিয়মকে মারধোর শুরু করে।
‘ঐ কালি, বল কই গেছিলি? মরতে গেছিলি? মরলি না কেন?’
মারধোর শেষে মরিয়মকে খেতে দেয়। মেয়েটি কান্না করে বলে, মা আমাকে আর কত মারবে? মানুষ কি তাদের ছেলে মেয়েদের এত মারে? পাষাণী সেঁজুতিরও কথাটি শুনে একটু মায়া হল। মরিয়মকে কাছে ডেকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। মরিয়ম এবার নিঃশব্দে কান্না করছে। এই প্রথম মনে হয় একটু ভালোবাসা পেল মায়ের কাছ থেকে। সেঁজুতি কুপির আলোয় হঠাৎ খেয়াল করল, মরিয়মের ঘাড়ের কাছে পাঁচ আঙ্গুলের চিহ্ন বসে গেছে। সেঁজুতির চোখ ছলছল করছে। এতটা মারা ঠিক হয়নি মেয়েটাকে।
ইকবাল বাজারে চায়ের দোকান থেকে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ল। পথে দেখা মির্জাচরের কুতুব আলীর সাথে। সবাই তাকে মিচকা শয়তান নামেই জানে। মানুষের বদনাম বলে বেড়ায়, ঝগড়া লাগিয়ে মজা পায়। প্রতিটি সমাজেই এমন কিছু কুতুব আলী থাকে। ইকবালকে এই কুতুব আলীই প্রথম বলেছিল, ‘কামালের মেয়ে ঘরে তুলে আনলি নাকি?’
ইকবালকে পথে পেয়ে কুতুব আলী একাই বলে যাচ্ছে, “বুঝলি ইকবাল, আমি উচিত কথা বলি বলে লোকে আমাকে দেখতে পারে না। সত্য কথা সবসময় তিতা লাগে। তোর বাবা’কে কত করে বললাম, সেঁজুতি ছিল পাড়া বেড়ানি, কামালের সাথে ছিল লটর ফটর। তোর বাপ আমার কথা শুনল না। এখন কী হলো? মেয়েটার চেহারা হলো কামালের মতো। আরে বেক্কল মানুষও তো বুঝবে মেয়েটার চেহারা কেন কামালের মতো?” ইকবাল দাঁড়িয়ে পড়ল। কুতুব আলীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আপনার কাছে কিছু জানতে চেয়েছি? কেন আমার পিছু নিয়েছেন?
-দেখলি? একটু আগে কী বললাম? উচিৎ কথা তিতা লাগে। প্রতিবার কি তুই সেঁজুতির সাথে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বসে থাকতি? পুরোনো প্রেমিকের সাথে কিছু করলে টের পাবি? ইকবাল কথা না বলে দ্রুত হেঁটে বাড়ি চলে আসে।
সকাল থেকে মরিয়মের প্রচন্ড জ্বর। সেরে সেরে জ্বর আসে। কখনো কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। কখনো গরমে জ্বর ছেড়ে দেয়। ইকবাল হঠাৎ লক্ষ করে মরিয়মের ঘাড়ের কাছে হাতের আঙ্গুলের চিহ্ন। নিশ্চয় সেঁজুতি মেরেছে। রেগে আগুন হয়ে ইকবাল যখনি লাঠি নিবে সেঁজুতি ইকবালের হাত ধরে বলল, না জেনে আমার উপর দোষ দিও না। তোমার মেয়ে গতকাল সন্ধায় নিম গাছের কাঠি কুঁড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে হয়তো বদ জ্বিনের হাতের চড় খেয়েছে। দেখো না সকাল হতেই জ্বর? তুমি বরং সামু কবিরাজকে ডেকে এনে ঝাড় ফুঁক দেয়ার ব্যবস্থা করো।
ইকবাল ভূত বিশ্বাস না করলেও মানুষকে জ্বিনে ধরে এটা সে জানে। কিছুটা শান্ত হয়ে ইকবাল ছুটল কবিরাজের সন্ধানে।
কবিরাজের ঝাড় ফুঁক আর ডাক্তারের ঔষধে কাজ হলো না। তিন দিন পর মরিয়ম মারা গেল। বাড়ি ভর্তি মানুষের ভীড়। অনেকেই মুখ ফসকে বলে দিল, মেয়েটা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। নয়তো সেঁজুতি এমনিতেই মেরে ফেলত। সেঁজুতি মাটিতে লুটিয়ে কান্না করলেও মানুষের কথাগুলো তার কানে এসেছে। সে জানে মরিয়মের সাথে কত বড় অন্যায় করেছে। কোনোদিন মেয়েটাকে একটু আদরও করেনি। সে জানে মরিয়মের খুনি সে নিজেই। সেদিন রাতে এত মারধোরের পরই মরিয়মের জ্বর এসেছিল।
সেঁজুতি মনে মনে চাইতো মরিয়ম মরে যাক। একজন মা হিসেবে কেউ এমনটা কখনো কাম্য করে না। কিন্তু সেঁজুতি তার পাপ ঢাকতেই এমনটি কামনা করেছিল। সে যে বড্ড পাপী। পুরোনো প্রেমিকের সাথে বিয়ের পরও যে মেয়ে পাপে লিপ্ত হতে পারে তার চেয়ে বড় পাপী কে হতে পারে? সে স্বামীর বিশ্বাস নিয়ে খেলেছে তাকে ক্ষমা করবে কে? তবুও তো সব ভুলতে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা যে সেঁজুতির কলঙ্কের দাগ চেহারায় মেখে জন্ম নিল। যত দিন যাচ্ছিল মেয়েটার চেহারায় সেঁজুতি তাকালেই তার নিজ পাপের কথা মনে পড়ত। তাই তো মেয়েটাকে কোনোদিন ভালোবাসা হয়নি। কেবল অবহেলা, অনাদরে বড় হয়েছিল মরিয়ম।
ইকবাল আর এখন সন্ধা রাতে বাড়ি ফিরে না। বাড়ি ফিরে আর মরিয়মকে পায় না। মেয়েটা যতদিন বেঁচে ছিল কষ্টই পেয়ে গেল। ছলছল চোখ থাকে সবসময় ইকবালের। কখনো ফোটা ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে।
ছোট মেয়েটাকে ইকবাল তার মায়ের কাছে রাখল। সেঁজুতি গেল বাবার বাড়ি কিছুদিনের জন্য। এখানে থাকলেও পাগলামি করে। ফিসফিস করে একাই কী যেন বলতে থাকে।
মরিয়ম মারা যাবার বিশ দিনের মাথায় সেঁজুতি গলায় দড়ি দিল। কিন্তু ইকবালের বাড়িতে না। বাবার বাড়িতে গিয়েই এমন কান্ড করে বসল। কেউ জানে না সেঁজুতি কেন গলায় ফাঁস নিল। কিন্তু সেঁজুতি জানে। এই পাপের বুঝা আর বয়ে বেড়ানো সম্ভব ছিল না তার। প্রতিনিয়ত তার কানে মরিয়মের কথাটি বাজতে থাকে। “মা আমাকে আর কত মারবে? মানুষ কি তাদের ছেলে মেয়েদের এত মারে?” ফাঁসিতে ঝুলার আগে মনে মনে সেঁজুতি ভাবছিল, “আমার খুব ইচ্ছে আমি আমার মেয়ে মরিয়মকে একটু মন ভরে আদর করি।”
সমাপ্ত