শেষ পর্যন্ত সমস্যাটার একটা সমাধান আমি খুঁজে পেলাম। স্বর্ণাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। অসহ্য এই মেয়েটাকে যে কোন কুক্ষণে বিয়ে করেছিলাম। মেয়েটার জন্য আমার জীবনের সমস্ত আনন্দ পানি হয়ে ভেসে যাচ্ছে। কি আছে মেয়েটার মধ্যে! একেবারে সেকেলে। অবাস্তব সেকেলে!! আমার অফিশিয়াল পার্টিতে ও আমার জন্য লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
আবার নাকি আমাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে। করে তো একটা রিসেপশনিস্টের চাকরি। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ডিউটি। মাস শেষে আট হাজার টাকা এনে তুলে দেয় আমার হাতে। এখনকার যুগে এটাতো কোনও টাকাই না। চা-সিগারেটের খরচ আরকি। আমার বেতনটা অবশ্য খারাপ না। তারপরও এই যুগে এরকম আভিজাত্যের সাথে চলা যায় না। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার সেটা হলো উপরে উঠা দরকার। এই পজিশনে পরে থাকলে চলবে না। যেটা স্বর্ণাকে দিয়ে সম্ভব না। ওর ফ্যামিলিতে এমন কেউ নেই যে আমাকে এত্তটুকুও হেল্প করতে পারে।
এক্ষেত্রে আমার জন্য বড় ধরণের একটা অপরচুনিটি লামিয়া নামের মেয়েটি। আমার এম.ডির মেয়ে। এক অফিশিয়াল পার্টিতে পরিচয়। সেই পরিচয়টা অল্প অল্প করে অনেক গভীরে চলে গেছে এখন। আমার সুদর্শন চেহারায় একদম মজে গেছে মেয়েটি। যে কোনও সময় আমাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত। কিন্তু তার আগে স্বর্ণা নামের ভূতটাকে ডিভোর্স দিয়ে সরিয়ে ফেলতে হবে। তারপর লামিয়াকে বিয়ে করতে কোনো বাধা থাকবে না। বাবার একমাত্র মেয়ে। তাই তিনি মেয়ের ইচ্ছার কোনোরকম অমত করবেন না। বিয়ের সাথে সাথে শুরু হবে প্রমোশনের খেলা। আর শ্বশুর মশাই গত হলেই তো একেবারে মওকা। একেবারে পুরো প্রপার্টির মালিক বনে যাব আমি। এই সুযোগটা কোনোভাবে হাত ছাড়া করা যায়,বলুন???
কিন্তু স্বর্ণাকে ডিভোর্স দেওয়া যাবে না। জীবন থাকতে ও ডিভোর্স লেটারে সই করবে না। আর ডিভোর্স লেটার পেয়ে যদি সুইসাইড করে বসে সেটা আবার আরেক ঝামেলা হয়ে দাঁড়াবে।
সুতরাং… … …
আমাকে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। খুন করবো আমি স্বর্ণাকে। এছাড়া সামনে আর কোনো রাস্তা নেই। লামিয়াকে একটা অপরচুনিটি হিসেবে পাওয়ার জন্য খুনটা আমাকে করতেই হবে। নাহলে একটা বড় সুযোগ চিরজীবনের মত হাত ছাড়া হয়ে যাবে আমার।
খুনটা আমি খুব নিখুঁতভাবেই করবো। এমনকি স্বর্ণাও জানবে না ওকে আমিই খুন করেছি। পুরো একটা সাইলেন্ট লিড করবে কাজটায়।
আজ শুক্রবার। আমার অফিস নেই। স্বর্ণা যে হসপিটালে চাকরি করে সেটা খুব নামকরা। বাইরে থেকেও প্রচুর রোগী আসে। আর তাই শুক্রবারেও ওর হাফ-ডে অফিস করতে হয়। দুপুর দেড়টা বাজলেই বাসা থেকে বের হবে আর আসবে ঠিক সাড়ে ছ’টায়। এসেই আবার রান্নাঘরে ঢুকে পরে।
দুপুর পর্যন্ত আমাকে খুব উৎকন্ঠায় থাকতে হলো। স্বর্ণা কখন যাবে এই নিয়ে। ওর সাথে ঠিকমত কথাও বলতে পারলাম না। বারবার আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু স্বর্ণার চোখে কিছুই ধরা পড়লো না। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে বের হয়ে গেলো।
আর স্বর্ণা বের হয়ে যাওয়া মাত্রই আমার সমস্ত দ্বিধা উদ্বেগ যেনো উবে গেলো। প্ল্যান অনুসারে আমি কাজ শুরু করে দিলাম।
আমার প্রথম কাজ হলো একটা কয়েল দেড় ঘন্টায় কতটুকু পুড়ে তা বের করা।
দুটো কয়েল নিলাম। একটা জ্বালিয়ে দিলাম আর মোবাইল ফোনের রিমাইন্ডারে ঠিক এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিট সেট করে দিয়ে সোজা বসে পড়লাম টিভি দেখতে। কয়েলটা ধীরে ধীরে ধোঁয়া আর ছাইয়ে কনভার্ট হচ্ছে আর আমার ফুর্তিটাও ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে।
চমকে উঠলাম রিমাইন্ডারের এ্যালার্ম শুনে। টিভির চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে কখন যে দেড় ঘন্টা পার হয়ে গেলো তা টেরও পাই নি। উঠে দ্রুত কয়েলটা নিভিয়ে ফেললাম। কয়েল দুটো একটার উপর আরেকটা রাখলাম। দেখলাম কয়েলটা দেড় ঘন্টায় পাঁচ খাঁজের কিছু বেশি পুড়েছে। নতুন কয়েলের ঠিক সেই জায়গায় মার্কার পেন দিয়ে দাগ দিয়ে নিলাম।
আপাতত কাজ শেষ। আবার বসলাম টিভি দেখতে। চারটা পঞ্চাশে এ্যালার্ম দিয়ে।
ঠিক টাইমে আবার ঝটপট উঠে পড়লাম। সোজা চলে এলাম রান্নাঘরে। একটা কাগজকে ভাঁজ ভাঁজ করে কয়েলের টেম্পোরারি স্ট্যান্ড বানালাম। অরিজিনাল স্ট্যান্ড ব্যবহার করা যাবে না। কারণ সেটা ক্লু হয়ে যেতে পারে। রান্নাঘরের দুদিকের জানালাই বন্ধ করে দিলাম। কিছু ওয়েস্ট পেপার রাখলাম কয়েল স্ট্যান্ডের পাশে। যাতে কয়েলের ছাই আর কাগজ পোড়ানোর ছাই একত্র হয়ে বিলীন হয়ে যায়। কেননা কয়েলের ছাইটাও একটা ক্লু হয়ে যেতে পারে। কারণ রান্না ঘরে তেমন কেউ একটা কয়েল জ্বালায় না। আর কাগজের ছাই কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। দিয়াশলাইয়ের কাঠি বাঁচানোর জন্য রান্নাঘরে ওয়েস্ট পেপার প্রায়ই অনেকেই রাখে।
এবার কয়েলটা স্ট্যান্ডের উপর রেখে দিয়াশলাইয়ের ঠিক পাঁচটা কাঠি রাখলাম কয়েলের দাগ দেয়া জায়গার একটু পিছনে। কারণ স্বর্ণা যদি এসে একটু রেস্ট নেয়। যদিও ও রেস্ট নেয় না,তবুও আমি রিস্ক নিতে চাইছি না। আর রেস্ট যদিও না নেয়, তাহলেও পরিস্থিতির কোনো হেরফের হবে না।
কয়েলটা জ্বালিয়ে দিলাম। আর সবশেষে গ্যাসের চুলা দুটো ফুল পাওয়ারে চালিয়ে দিয়ে, দরজা ভালো করে বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
স্বর্ণা অফিস থেকে এসেই রান্না ঘরে যাবে। আর আমি ঠিক পাঁচটায় চুলার গ্যাস ছেড়ে দিয়েছি। একটানা দেড় ঘন্টা গ্যাস ছাড়া থাকলে গোটা ঘর ভর্তি হয়ে যাবে গ্যাসে। আর দেড় ঘন্টায় ঠিক যতটুকু পুড়বে ঠিক তার কাছেই রাখা আছে দিয়াশলাইয়ের কাঠি। দেড় ঘন্টার মধ্যে কয়েলটা জ্বলতে জ্বলতে কাঠির জায়গায় পৌঁছে যাবে। আর সাথে সাথে জ্বলে উঠবে পাঁচটা কাঠি।
স্বর্ণা ঠিক যে মুহূর্তে রান্নাঘরে ঢুকবে তার দুই-এক মিনিটের মধ্যেই ঘর ভর্তি গ্যাস দিয়াশলাই কাঠির আগুন পেয়ে ঠিক বোমার মত বিস্ফোরিত হবে। আর স্বর্ণা?বুঝতেই পারছেন।
আমার পুরো প্ল্যান সাকসেস হয়ে যাবে। সব ঠিকঠাক রেখে দরজায় তালা মেরে আমি হাওয়া খেতে বেরিয়ে পড়লাম। ইচ্ছেটা এরকম সাতটার দিকে এসে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেব। পাশের পার্কে এসে বসলাম। প্রায় একঘন্টা কেটে গেলো। প্রায় ছ’টা বাজে। আর মাত্র আধঘণ্টা। তা হলেই আমার পুরো প্ল্যান সাকসেস হয়ে যাবে।
হঠাৎ একটা সন্দেহ মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো। সবকিছু ঠিকঠাকমত করেছি মনে পড়ছে। কিন্তু চুলার গ্যাস ছেড়েছি কি-না কোনোক্রমেই নিশ্চিতভাবে মনে করতে পারছি না। নাহ, ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে আসা দরকার। কাছেই তো বাসা। পাঁচ মিনিটের রাস্তা। অগত্যা আবার বাসার রাস্তা ধরলাম।
রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাসের গন্ধতেই টের পেলাম, নাহ, ভুল হয়নি। গ্যাস ছেড়েই গিয়েছিলাম। কয়েলটা ঠিকঠাক আছে কি-না দেখার জন্য কয়েলের দিকে তাকালাম।
আর মুহূর্তেই আঁতকে উঠলাম। ‘এ কি!’ একটা কাঠি কিভাবে যেন গড়িয়ে কয়েলের আগুনের উপর গিয়ে পড়েছে। আধ সেকেন্ডের মধ্যে বুঝে গেলাম কি ঘটতে যাচ্ছে। একটা চিৎকার দিয়ে সোজা লাফ দিলাম কয়েলের উপর। কাঠিটাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য।
কিন্তু তার আগেই ব্যাপারটা ঘটে গেল অবিশ্বাস্যভাবে। জ্বলে উঠল কাঠিটা আর গোটা ঘরের গ্যাস মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হলো। আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম নিয়তি আমার দিকে তাকিয়ে ক্রূর হাঁসি হাসছে। হাঁসিটার মর্মও বুঝতে আমার দেরী হলো না।
জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালে। আমার চোখ-নাক-ঠোঁট-সারা দেহ পুড়ে গেছে! লামিয়া কি আর কখনও আমাকে বিয়ে করবে??উপরের সমাজে উঠব কি করে!!!