নরপিশাচ

নরপিশাচ

ডিভোর্স পেপারটা সাইন করে হাসতে হাসতে কোর্টের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলাম। সাথে সাথে সাত বছরের বিবাহিত জীবনের ইতিটা টানলাম। আমার কান্ড দেখে সবাই তো পুরো অবাক হয়ে যায়। তারপর বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। স্বামী নামের নরপশুটা থেকে আজ আমি মুক্ত। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছা করছে। ইসলাম ধর্মের শরিয়ত মোতাবেক স্ত্রী গর্ভবতী হলে স্বামীর সাথে তালাক হয় না কিন্তু আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা জোড় করে আমাদের ডিভোর্স করিয়ে ফেললো। তাদের দাবী আমার পেটের বাচ্চাটা তাদের ছেলের না।

আমি ছয় মাসের অন্তঃসত্বা। আমার স্বামী এগারো মাস দেশের বাহিরে। তাদের দাবী ও ভুল ছিলো না।
সবার কাছে আমি এখন চরিত্রহীনা। আজ মা, মেয়ের ঈদের দিন। সারাদিন রোদেলাকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরবো, বাহিরে খাবো, তারপর সন্ধ্যার পরে ফুচকা খেয়ে বাসায় গিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দেবো।চোখটা যে বড্ড ক্লান্ত কতরাত ঘুমাইনি তার কোন হিসাব নেই। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা চেয়েছিলো রোদেলাকে ওদের কাছে রাখতে কিন্তু রোদেলা তার বাবার কাছে থাকবে না। মেয়ের জন্য আইনের লড়াই ছাড়া মেয়েকে নিজের করে পেয়ে গেলাম।

আর কেউ না বুঝলেও মায়ের কষ্ট সন্তান বুঝতে পেরেছে। জন্মদাতা বাবা মাই তার সন্তানকে চিনলো না, পরের কথা কি আর বলবো? বাবা কোর্টে দাঁড়িয়ে সবার সামনে বলেছে আমি তার মেয়ে না তার মেয়ে মারা গেছে, আজ থেকে আমি না তার সন্তান, আর না সে আমার বাবা। আমার মেয়েটা ছোট হলেও আমাকে অনেক বোঝে।

সকাল না হতেই ঘুম ভাঙলো মেহেদীর ফোনের রিংটোনে। আগামীকাল তারা পারিবারিকভাবে বৈঠকে বসতে চায় রোদেলার বিষয়ে ফাইনাল ডিসিশন নেবে। মেহেদী আমাকে ফোন করে হুমকি দিয়েছে ভালোয় ভালোয় রোদেলাকে ওদের কাছে ফিরিয়ে দিতে। এই সাত বছর চুপ করে থেকেছি বলে আজও চুপ করে থাকবো তুমি ভাবলে কিভাবে…? এখন সময় হয়েছে মুখোশের আঁড়ালে থাকা নরপশুটার নোংরা চেহারাটা খুলে দেবার।

মেহেদী চেয়েছিলো ওদের বাসায় মিটিং বসাতে আর আমার ভাই চেয়েছিলো আমাদের বাসায়। আমি না বলে দিয়েছি কারণ মেহেদিদের বাসা কিংবা বাবার বাসায় কোনটায় যাওয়ার অধিকার আমার নেই। তাই কোন একটা রেস্টুরেন্ট এ দুই পরিবারকে বসতে হবে এটাই ফাইনাল সিদ্ধান্ত। মা,মেয়ে ম্যাচিং করে একই রঙের ড্রেস পরেছি। বাসা থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু কোন রিক্সা সিএনজি কিছুই নেই। হাঁটতে হাঁটতে সামনে কিছুদূর এগিয়ে আসার পরে রিক্সা পেলাম।

মেহেদীর সাথে বিয়েটা হয়েছিলো সাত বছর আগে পারিবারিক ভাবে। আমি এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না। বাবা এক প্রকার জোড় করেই বিয়েটা দিয়েছিলো। ছেলে শিক্ষিত, ভদ্র ফ্যামেলি, ভালো চাকরি করে,দেখতে সুন্দর এটাই হলো তাঁর যোগ্যতা। কোন খোঁজ খবর নেবার প্রয়োজন মনে করেনি ছেলেটা ভালো কিনা,,,চরিত্র কেমন কিছুই জানার দরকার পরেনি আমার পরিবারের। আমি মনে হয় তাদের কাঁধের বোঝা হয়ে ছিলাম। আসলে গ্রামে মানুষের কাছে মেয়েরা কুঁড়িতে বুড়ি হয়ে যায়।

বিয়ের পর দু’বছর শ্বশুর বাড়িতে ছিলাম অবশ্য মেহেদী চেয়েছিলো বিয়ের তিন মাস পরেই ওর কাছে নিয়ে যাবার জন্য কিন্তু রোদেলা পেটে আসলো। শুরু হলো সমস্যা মেহেদী কিছুতেই বাচ্চা রাখবেনা আমাকে এর্বোশন করাবে। আমার শ্বশুর শ্বাশুরির বাঁধার কারণে বাচ্চাটাকে ফেলতে পারিনি। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা আর ঢাকা যেতে দিলনা কারণ যদি মেহেদী বাচ্চাটা এর্বোশন করায় এই ভয়ে। রোদেলার বিষয়টা নিয়ে মেহেদী আমার উপর খুব নারাজ ছিলো।

ওই দু’বছর ছিলো আমার বিবাহিত জীবনের সুখের দিন। ঢাকা যাবার পরে শুরু হয়েছিলো আমার কষ্টের জীবন। পাঁচটা বছর নরকের মধ্যে ছিলাম। আধঘণ্টার মধ্যে রেস্টুরেন্ট পৌঁছে গেলাম। রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে রেস্টুরেন্টর ভিতরে ঢুকে দেখি ওরা সবাই বসে আছে। আমাকে দেখেই শ্বশুর বাড়ির লোকেরা উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করে দিয়েছে।

— ভেবেছিলাম ঘরের লক্ষ্মী সে। কারণ ওকে মেহেদির বউ করে আনার পর ছেলেটা পাঁচ বছরের মধ্যে তিন তিন বার প্রোমোশন পেয়েছে। এখন দেখি একটা দূষ চরিত্রা অলক্ষ্মী,,সমাজের কাছে আমাদের মান সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে মানুষের কাছে। এখন মুখ দেখানো দ্বায়। আমাদের ধারণা ভুল ছিলো মেহেদী ওর নিজের যোগ্যতায় প্রোমোশন পেয়েছে। তোর লজ্জাকরেনা সবার সামনে আসতে। তোর মত চরিত্রহীনা মেয়ের বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া ভালো। ছিঃ স্বামী থাকতে আবার পরপুরুষের কাছে যাওয়া লাগে।

— ওনাদের কথা শুনে নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারলাম না আমি ও বলা শুরু করলাম ওনাদের কুলাঙ্গার ছেলের যোগ্যতার কথা।

হ্যাঁ আপনারা ঠিকেই বলেছেন আপনাদের ছেলের আসলেই অনেক যোগ্যতা আছে না হলে নিজের বউকে অন্য পুরুষের হাতে তুলে দিতে পারে। আজকে আমার এমন পরিস্থিতির জন্য আমি না মেহেদী নিজেই দায়ী। আমাদের বিয়ের এক বছর পর অনৈতিক কাজের জন্য মেহেদীর সেনাবাহিনীর চাকরি চলে যায়। এরপর একটা মাল্টিমিডিয়ায় চাকরি হয়। উপরে উঠার জন্য সে মরিয়া হয়ে যায়। এতটাই নিচে নামে যে নিজের স্ত্রীকে বসদের কাছে পাঠায় রাত কাটানোর জন্য। এই মাত্র আপনারা বললেন না মেহেদী নিজের যোগ্যতায় প্রোমোশন পেয়েছে ভুল আমার যোগ্যতায় সে মাত্র পাঁচ বছরে তিন তিন বার প্রোমোশন পেয়েছে।

রোদেলাকে মেরে ফেলবে এই ভয় দেখিয়ে আমাকে জোড় করে একাধিক পুরুষের সাথে থাকতে বাধ্য করেছে। আর এই হলো আপনাদের ছেলের যোগ্যতা। এখন আপনারাই বলেন আমি কি অসতী, অলক্ষ্মী নাকি চরিত্রহীনা। লজ্জা কার থাকা উচিত আমার না আপনাদের। একটা কুলাঙ্গার সন্তান জন্ম দিয়েছেন আবার তাকে নিয়ে গর্ব করেন। আমি এই সমাজ,সংসার মানসম্মান সব কিছু ভুলে গেছি কারণ আমি মা। আমার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মেহেদীর সব কথা মেনে নিয়েছি। দিনের পরদিন আমাকে এই অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। কত পা ধরে কেঁদেছি। নিজের স্বার্থের জন্য যে নিজের স্ত্রীকে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারে সে নিজের মেয়েকে ও অন্যের হাতে তুলে দেবেনা তার গ্যারান্টি কি..?

এখন থেকে আমি রোদেলার বাবা, মা সব। কথাগুলো বলে রোদেলাকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে চলে আসলাম। আমার মেয়েকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো যেখানে কেউ আমার অনাগত সন্তানের গাঁয়ে কলঙ্কের দাগ না দিতে পারে। কিন্তু আমি কি পারবো মানুষরুপি হায়নাদের হাত থেকে আমার মেয়েটাকে বাঁচতে..???

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত