মায়ের বুকের উপর পরপুরুষ দেখে প্রীতম আর সহ্য করতে পারেনি।মাঝে মাঝে ওই মানুষটি প্রীতমের মায়ের কাছে আসতো প্রীতম বুঝতে পারলেও হাতে নাতে কখনো ধরতে পারেনি!প্রীতম এক দৌড়ে রান্নাঘর থেকে ধারালো বটি নিয়ে এসে ওই মানুষটির ঘাড় বরাবর কোপ দিলে ঘাড় থেকে মাথা অনেকটা ঝুলে পড়ে।চিরচির করে রক্তের ফুলকি সারা ঘর ছড়িয়ে পড়তে লাগে। কিছুক্ষণের মধ্যে গলাকাটা মুরগীর মত ছটফট করতে করতে চোখের সামনে ওই মানুষটির মৃত্যু হয়।
প্রীতমের মা প্রীতমের গালে কষে একটি থাপ্পড় দিয়ে বলল একি করলি তুই? তুই আমার সন্তান না,আমাকেও মেরে ফেল তুই।তোর মত সন্তানের মা হয়ে বেঁচে থাকতে চাইনা আমি। প্রীতমকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। আদালতে খুনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে প্রীতম বলে হ্যাঁ আমি নিজে হাতে ওই মানুষটিকে খুন করেছি।বটিতেও প্রীতমের হাতের ছাপ পাওয়া যায়। প্রীতমকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় কেন ওই মানুষটিকে খুন করেছে সে তার কোন জবাব দেয় না! প্রীতম যেন শুধু একটি কথাই বলতে শিখেছে ‘আমি ওই মানুষটিকে খুন করেছি’। এর পরের আর কোন বাক্য তার জানা নেই,একদম বোবা।
আদালত প্রীতমের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়।তারপরও তার চোখে মুখে ক্লান্তির কোন ছাঁয়া দেখা যায় না। তার কাছে ফাঁসি যেন স্বাভাবিক কিছু হতে যাচ্ছে এমনটাই মনে হয়। রাতের বেলায় সে হাউমাউ করে কাঁন্না শুরু করে দিয়েছে। এ কাঁন্না ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর কথা ভেবে ভয়ের কাঁন্না নয়,এ কাঁন্না লজ্জার কাঁন্না। বারবার সবাই জিজ্ঞাসা করছে ওই মানুষটিকে কেন খুন করেছো আর ওই কথাটি বললেই চোখের সামনে যে দৃশ্য ভেসে উঠে তা দেখে মনে হয় এক্ষণি কেন আমার ফাঁসি হয় না? আমি ফাঁসি থেকে বাঁচতে কাঁন্না করছি না।
আমি কি করে বলবো মায়ের বুকের উপর পরপুরুষ দেখে কোন সন্তানই এমন কাজ না করে থাকতে পারবে না?আমি কি ভাবে বলবো অচেনা অদেখা পরপুরুষের সঙ্গে মায়ের রাত্রিযাপন করার কথা?
যে মাকে আজ থেকে দশ বছর আগে বাবা নামক আরেক পুরুষ ডিভোর্স না দিয়েই পালিয়ে গেছে। একদিনও আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি আমরা বেঁচে আছি না মরে গেছি।সেই মা কোলেপিঠে করে অন্যের বাসায় কাজ করে আমাদের অভাবের সংসার কোন ভাবে টেনেটুনে পার করে দেয়। তারপরও আমাকে কোন দিন অন্যের বাসায় কাজ করতে বলেনি।মার কাছে আমি যেন সোনায় সোহাগা ছিলাম। অভাবের সংসার আমাদের বাসায় খুব কম ই রান্না হতো, অন্যের বাসায় কাজ করে আসার সময় অনেক খাবার নিয়ে আসতো, সে খাবার নাকি ওরা ফেলে দিত।
যখন ছোট ছিলাম মার সঙ্গে আমিও যেতাম যে বাসায় কাজ করতো সে বাসায়। সে বাসায় আমার মত একটি ছোট ছেলেও ছিল পিন্টু। ওরা টেবিল ভরা খাবার নিয়ে খেতে বসতো আর খাওয়ার সময় হলে মা আমাকে অন্য এক রুমে ছিটকিনি লাগিয়ে রেখে আসতো যেন আমি বাহিরে না আসতে পারি।খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সাহেব পিন্টুরা যখন তাদের রুমে চলে যেতো তখন মা আমাকে রুম থেকে রেব করে নিয়ে আসতো।আর রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখি এতো এতো খাবার। ওরা না কি বেশি খাবার খাই না, তাহলে এতো খাবার নিয়ে কেন খেতে বসে?
মাকে বললাম মা ওরা তো বেশি খাবার খাই না। আর আমরা তো অনেক খাবার খাই ওদের আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেয় আর আমরা এদের বাসায় থাকি, আমরা শুধু খাবো আর খাবো। তাহলে মাঝে মাঝে আর আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে না। সে দিন মা আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদে ছিল। সে দিন বুঝিনি কেন মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ছিল।
বাবার অভাব কোন দিন বুঝতে নেয়নি মা।অভাবের সংসার হলেও বন্ধুদের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলার জন্য কোন কিছুরই কমতি দেয়নি ।স্কুল ব্যাগ থেকে শুরু করে সাইকেল সব কিছুই না চাইতেই পেয়ে যেতাম। একবার স্কুল থেকে আসার সময় বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে পড়ে আমার বাম হাত ভেঙ্গে যায়। মা যেন পাগলপারা হয়ে গিয়ে ছিল ভাঙ্গা হাত দেখে। এক মাস এক ফোটাও ঘুমায়নি,দিন রাত শুধু আমার পাশে বসে থাকতো আর কাঁদতো। অন্যের বাসায় কাজ করাও ছেড়ে দিয়ে ছিল মা।মামা বাড়ি থেকে আমাকে দেখতে এসে কিছু চাল আর মুড়ি দিয়ে গিয়ে ছিল। কোন ভাবে মা ওই চাল মুড়ি দিয়েই এক মাস পার করে দিয়ে ছিল তারপরও মা আমাকে রেখে অন্যের বাসায় কাজ করতে যায়নি।
আর মাত্র তিন দিন পর প্রীতমের ফাঁসির কার্জ সম্পন্ন করা হবে।তারপরও তার মা একবারো তাকে দেখতে যায়নি।আর প্রীতমও ওর মাকে দেখতে ইচ্ছে বোধ করেনি।আর তিন দিন পর ফাঁসি,শেষ সময়ে শেষ বারের মত প্রীতম যেন মাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। অনেক ভাবে তার মাকে খবর দেয়া হয়েছে শেষ দেখা দেখতে চাই প্রীতম।কোন মতেই রাজি হয় না প্রীতমের মা প্রীতমের সামনে আসতে।প্রীতমের মা আদরের সন্তানকে কেন দেখতে যায় না? লজ্জায় না রাগে?
আর মাত্র দু’টি সকাল দেখতে পাবে প্রীতম। ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই দু’জন পুলিশ এসে তাকে গাড়ি ভরে কোথায় যেন নিয়ে যেতে লাগলো। গাড়িতে উঠে বুকের ভিতর কেমন যেন ধুকধক করতে শুরু করে দিল।হয়তো আজকেই শেষ হয়ে যাবে এই পৃথিবীর আলো বাতাস শ্বাস নিঃশ্বাস সব কিছুই অন্ধকারে ঢেকে যাবে। গাড়িতে বসে জানালার দিকে চেয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে আর দু’চোখ বেয়ে অশ্রুর নোলা জল গড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দে।
প্রীতম হঠাৎ একটু খেয়াল করে দেখে গাড়ি যেন তার চিরচেনা গ্রামের মেঠো পথ ধরে চলছে।গাড়ি যতই গ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই যেন বুকের ভিতর ধুকধক কম্পন বেড়েই চলছে। নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বুকের ভিতরে ছটফটানি ক্রমাগত বেড়েই চলছে, তৃঞ্চায় যেন বুক ফেটে যাচ্ছে, বুকের ভিতর থেকে যেন হাউমাউ করে কাঁন্নার আওয়াজ বের হতে চাচ্ছে।গা ঘেমে পানির স্রোত বয়ছে,চোখ ফেটে যেন রক্ত বেরিয়ে পড়বে।শরীরের প্রত্যেকটি লোম যেন খাড়া হয়ে গেছে। গা মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি দিয়ে শিউরে উঠছে,এখনি গরম আবার এখনি ঠান্ডা অনুভব করছে।
প্রীতম মনে মনে বলছে আজ আমার এমন হচ্ছে কেন? আজ তো আমার খুশির দিন।মাকে শেষ দেখা দেখবো, মায়ের পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইবো, মাকে জড়িয়ে ধরে শেষ বারের মত মন ভরে চিৎকার করে কাঁদবো। মার নিজ হাতের জীবনের শেষ খাবার খাবো।
গাড়ির জানালা দিয়ে প্রীতমের বাড়ি দেখা যাচ্ছে, বাড়ির চারপাশে অনেক লোকজন ভিড় করে আছে।গাড়ি থেকে নেমে প্রীতম কাঁন্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে,পাগলের মত বলতে শুরু করেছে আমার বাড়িতে এতো মানুষের ভিড় কেন সবাই কাঁন্না করছো কেন।আমার মা কই আমার মা কই বলতে বলতে মায়ের ঘরে গিয়ে দেখে মা চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে। জিহ্বা বেরিয়ে আছে,নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে মুখের ভিতর গিয়ে শুকিয়ে গেছে,গলায় রশির কালো দাগ পড়ে গেছে,গলা ফুলে গেছে।
মায়ের লাশের পাশে একটি কাগজ পড়ে আছে। আত্মহত্যার আগে লিখে গেছে। পৃথিবীতে সন্তানের কাছে মায়ের কলঙ্ক হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়ায় অনেক ভাল। তবে আজ তোকে না বলা অনেক কথা বলে যাচ্ছি। যে মানুষটিকে তুমি গোপনে আমাদের বাসায় আসতে দেখতিস সে মানুষটি অন্যকেউ নয়, সে মানুষটি তোর জন্মদাতা পিতা। আজ থেকে পনেরো বছর আগে মিথ্যে খুনের দায়ে ফাঁসির আসামী হয়ে ফেরারি হয়েছিল।
তোর বাবা ছয়মাসে একবার অতি গোপনে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যেতো। তুই যখন ঘুমিয়ে থাকতিস তোর কপালে অনেক চুমু খেতো অনেক আদর করতো তোকে।তোর বাবাকে কত বার বলেছি তোর সঙ্গে কথা বলতে, কিন্তু তোর বাবার একটিই কথা যে দিন আমি আমার মিথ্যে কলঙ্ক দূর করতে পারবো সেই দিন ই আমি মুখ দেখাবো আমার সন্তানের কাছে তার আগে নয়।পনেরো বছর পর তোর বাবা একটি সুখের সংবাদ নিয়ে এসে ছিল। যার খুনের অপরাধে ফেরারি হয়ে দিন রাত পালিয়ে বেড়ায় সেই খুনের আসল অপরাধীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে আর পুলিশ তাকে দশ দিনের রিমান্ড নিলে সব কিছুর স্বীকারোক্তিও করে।
এক সপ্তাহের মধ্যে তোর বাবা নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে বলে পাগলের মত ছুটে এসে ছিল সেই রাতে। আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদে ছিল তোর বাবা। পনেরো বছর পর আবার আমরা আগের জীবন ফিরে পাবো। ছেলে সন্তান নিয়ে আমরা সুখের সংসার সাঁজাব।তখন তোর বাবার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ালেও মনের মাঝে আনন্দের জোয়ার বয়েছিলো। সেই রাত ই তোর বাবার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে তা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।”ছেলের হাতে বাবার খুন”, “ছেলের চোখে মায়ের কলঙ্ক”এ যেন এক কালো অধ্যায়। এ কালো অধ্যায় কালো চাদরেই ঢাকা থাকুক। ভাল থাক হে পৃথিবী, ভাল থাকুক পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষগুলো।
মায়ের শেষ কথাটুকু পড়া শেষ করে কাগজের টুকরো হাত থেকে জমিনে পড়ে গেল।প্রীতম যেন কাঠের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।প্রীতমের পৃথিবী যেন ভনভন করে ঘুরছে। তার কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।দু’চোখ বেয়ে গড়গড় করে অশ্রুর ঝর্ণা ঝরে পড়ছে। প্রীতমকে ঘিরে মানুষের ভিড় জমে গেছে। প্রীতমের পায়ে বেড়ি পরানো আছে। সে নির্বাক হয়ে এক পা দু’ পা করে গাড়িতে গিয়ে বসলো। গাড়ি গুড়গুড় করে মাকে ছেড়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে লাগলো। প্রীতম হা-আ করে চেয়ে আছে,তার চিরচেনা বেড়ে উঠা পথগুলোর পানে।