দুখের নগর

দুখের নগর

জানালার বাহিরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এয়ার বাসের ভেতরের আলোও নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। যাত্রীরা সব ঘুমুচ্ছে। কী আশ্চর্য! মাত্র একঘন্টা পেরুলো অথচ এরই মাঝে সবার স্বজনদের ছেড়ে যাওয়ার বিভৎস শোক, বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যাওয়ার পৈশাচিক ফুর্তি সব তলিয়ে গেলো ঘুমের বাণে।

মেহরুনের ঘুম আসছেনা। সবুজ শাড়ী পরা ছিমছিমে গড়নের এক কমবয়সী এয়ার হোস্টেস পর্যবেক্ষণ করতে আসছে। মেহরুনের কাছে এসে তাকে সজাগ পেয়ে হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো :- “হাও ক্যান আই হেল্প ইউ ম্যাম! ডু ইউ নিড এনিথিং?” মেহরুন মেয়েটির ডানহাতে ঝাপটে ধরে বলছে:- ” আই নিড ইউর কোম্পানি সিস্টার! আই হ্যাভ টু টক উইথ সামওয়ান। আমি আর পারছিনা।”

এই আবছা অন্ধকারেও বিমানবালা মেয়েটি মেহরুনের চোখের কোণায় চকচক করা চোখের পানি দেখতে পেলো। মেহরুনের হাতটাকে তার দুহাতে চেপে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মেহরুনের সীটের পাশে ফ্লোরে। মেহরুনের কোলে ভরসার হাত রেখে মেয়েটি বলছে:- “আমি বাংলা জানি ম্যাম, আপনি বলুন। আমি আছি আপনার সাথে।”

মেয়েটির আন্তরিকতায় মেহরুন মুগ্ধ হলো, সাথে মনে পড়ে গেলো তার ছোটবোন মেহজাবিনের কথা, যে সবসময় মেহরুনের সাথে লেগে থাকতো আঠার মতো। মেহরুন মনভার করে একমুহূর্তও থাকতে পারতো না। “কী হয়েছে দিদি? বলনা আমাকে! বলনা প্লিজ! বলনা বলনা!” করে জালিয়ে মারতো মেহরুনকে। অথচ সেই ছোটবোন আজ তার বিয়ের অনুষ্ঠানে বাড়ি ভর্তি গেস্টদের সামনে মেহরুনকে চোখ রাঙিয়ে বলেছে “get lost with your Bodeful face!”

মেহরুনের জন্মের সময় তার মা ডেলিভারি জনিত কারনে মারা যান। মেহরুনের লালন পালন ও সংসার গোছানোর জন্য মেহরুনের বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। মেহরুন বিমানবালা মেয়েটিকে তার নাম জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি বলে:- “আমি অরুণিমা মিত্র। নেমপ্লেটে লেখা আছে, অন্ধকার তাই দেখতে পাচ্ছেন না।”

:- “আচ্ছা অরুণিমা, সব অনিষ্টের দায়ভার মানুষের উপরেই কেন চাপে? স্রষ্টা কেন শুধু মঙ্গলের সাধুবাদ নিবেন। অনিষ্ট কি তার দেয়া নয়?”

:- “হ্যা। জগতের ভালো মন্দ সবই স্রষ্টার হাতে।”

:- “আমার যেদিন এস এস সি রেজাল্ট হয়। স্কুল থেকে রেজাল্ট শীট নিয়ে প্রায় উড়তে উড়তে বাসায় যাচ্ছিলাম আর বাবা মায়ের তৃপ্ত হাসিমুখ মনে মনে কল্পনা করছিলাম। বাসায় এসে দেখি বাবা স্ট্রোক করেছে, বাবাকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর আমার ছোট চাচাকে আমার রেজাল্ট শীটটা দেখাচ্ছিলাম। রেজাল্ট এ+ দেখে ছোটচাচা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেও ছোটচাচি মুখ শক্ত করে আমাকে ‘অপয়া’ বলেছিলো। যেন বাবার স্ট্রোকের জন্য আমার রেজাল্টই দায়ী।

এইচ এস সির পরে বাবা নিজে আমাকে কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দেন IELTS করার জন্য। আমি IELTS করি এবং হাই রিকুয়ার্ড পয়েন্ট পাই। যেদিন বাবাকে এই খবরটা দিলাম বাবা খুসিতে কেঁদে ফেলেছিলো। বাবা টাকা জোগাড় করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যেদিন কানাডা এম্বাসি থেকে আমাকে কনফার্মেশন লেটার পাঠায় সেদিনই বাবা মারা যান। বলো বোন, এতে কি আমার কোনো হাত আছে? সেদিন আমার সৎ মা সবার সামনে আমার মুখ দেখতে চায়নি। আত্বীয়স্বজন কেউ কেউ আমাকে সান্তনা দিলেও তাদের চোখে আমি আমার প্রতি চাপা ক্ষোভ দেখতে পাই। যেন আমার মা-বাবার মতো তাদেরকেও একদিন মেরে ফেলবো। সেদিন সত্যিই নিজেকে নিজের কাছে অপয়া রাক্ষসী মনে হয়েছিলো।”

:- “তারপর কি আর যাওয়া হয়নি কানাডা পড়তে?”

:- “প্রথমে পরিস্থিতি ও অসহায়ত্ব বুঝে এরকমই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং আমার মা’ও চাইছিলেন আমি কানাডা না গিয়ে যেন টাকাগুলো সব ফেরত নিয়ে নিই যতটুকু সম্ভব। কিন্তু আমার ছোটচাচ্চু আমাকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন, “তোর বাবা বেঁচে নেই যে তোর জন্য আর কিছু করতে পারবে, যতটুকু করে গেছেন সেটুকুই তার দেয়া তোর জীবনের একমাত্র সম্বল ভেবে কাজে লাগা ও ভালোমতো পড়াশোনা করে নিজের জীবনটা নিজেই সাজা।”

:- “চমৎকার কথা বলেছিলেন আপনার ছোটচাচ্চু। তারপর কী হলো?”

:- “নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন বন্ধুবান্ধব, সবমিলিয়ে নতুন জীবন সুন্দরই ছিলো। কিন্তু ভেতরে একটা জায়গা ফাঁকা লাগতো। আমার রুমমেটদের বাসা থেকে ফোন আসতো, তাদের বাবা, মা, ভাই-বোনেরা খবরাখবর নিতো কিন্তু এক আমিই ছিলাম যার কাছে বাড়ির কোনো গল্প ছিলোনা। কেউ আমার খবর নিতো না। মাঝে মাঝে আমার ছোট চাচা ও মেহজাবিন ফোন করতো। মেহজাবিন কখনো আমাকে সৎবোন ভাবেনি। আপনবোনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে কিন্তু বাসায় মা ও চাচীদের কারনে আমার সাথে খুব বেশি যোগাযোগ রাখতে পারেনা। বিদেশে আমার প্রথম ঈদে ছোটচাচা ফোন করে বলেছিলো বাড়িতে আসতে। আমার কী যে খুশি লাগছিলো দেশে যাবো বলে। বাড়ির সবার কথা মনে হচ্ছিলো, সবার ছবি চোখে ভাসছিলো। আমার আনন্দে আমার রুমমেটরা আমাকে পাগল হয়ে গেছি কিনা সন্দেহ করেছিলো। পরে ওদের কাছে পঞ্চাশ মার্কের এক মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হলো যে আমি পাগল হইনি।”

:- “মজার তো ব্যাপারটা! কী কী প্রশ্ন করেছিলো তারা? আচ্ছা এটা পরে শুনা যাবে, তারপর বলুন, সেই ঈদে দেশে এসেছিলেন?”

:- “না, টিকিট কেটে চাচ্চুকে কনফার্ম করতে ফোন দিলে চাচ্চু কাঁদো কাঁদো স্বরে আমাকে বলে, “মা’রে, এই পৃথিবীতে অন্যকে খুশি করা বিরাট কষ্টের, অথচ এটার কোনো প্রয়োজনই নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তুলনামূলক সহজ কাজ হচ্ছে নিজেকে খুশি করা ও খুশি রাখা। তুই বাড়িতে আসলে বাকিরা যে যা’ই হউক তুই খুসি হবিনা। তোর কষ্ট বাড়বে। তুই বরং ওখানেই থাক মা, ওখানেই থাক!” ছোটচাচ্চুর কথাগুলো খুব কষ্টদায়ক হলেও এই কথাগুলো আমাকে আরো শক্ত করেছে। নিজেকে চেনার ও নিজেকে নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছে। বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি।”

:- “একটা মেয়ের জন্য তার নাড়ি ভুলে থাকাটা যে কতটা কষ্টের সেটা আমি বুঝি ম্যাম। তারপর কী হলো? ওকে ওয়েট ওয়েট, আমি বরং দুইগ্লাস জুস নিয়ে আসি। জুস খেতে খেতে দুইবোন বসে গল্প করি!”

অল্পক্ষণের পরিচয়েই মেয়েটা মেহরুনকে বোন ডাকলো। এটা নিশ্চয় তার প্রফেশনাল বিহেইভ এর বাইরে। তাছাড়া দুজন ছেলে ভাইভাই হতে যতটা সময় লাগে মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা কয়েক হাজারগুণ বেশি লাগে। এদের ক্ষেত্রে লাগলো না। সহজ অনুমানেই বলা যায় এরা দুজনই সমান দুখিনী। প্রাচুর্যের সমুদ্রে ভাসা প্রাণিদের মাঝে আত্মগরিমা বেশি, সহজে কাউকে আপন করেনা। দুইগ্লাস লাইটলেমন জুস দুজনের হাতে। মেহরুন আবার বলা শুরু করলো:- “আমি নিজেকে প্রায় গুটিয়েই নিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস করতে জেনেছি যে এখানেই আমার সব। আমার স্টাডি, আমার জব, আমার ক্যারিয়ার। এসব ছাড়া আমার আর কিছু নেই এবং আর কিছুর প্রয়োজনও নেই।

গ্র‍্যাজুয়েশনের পর আমার পার্মানেন্ট জব পার্মিট হয়। জব নিয়ে আমি খুবই ব্যস্ত ও ভালো সময় পাড় করছি।
ছোটচাচ্চুর কাছ থেকে আমার জব এর কথা জেনে আমার মা আমার সাথে যোগাযোগ করতে থাকে। আমি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারলেও আমার কাছে এতো আনন্দ লাগতো মা যখন আমার খোঁজ নিতো, কেয়ার করতো, সংসারের ভালোমন্দ সব শেয়ার করতো। আমি সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম জানো অরুণিমা! আমার কাছে মনে হতো আমার সাথে কিছুই হয়নি। সবকিছু আজন্ম ঠিকঠাক। প্রতিটা সকাল হতো নতুন এক অনুভূতি নিয়ে। নিজেকে একা লাগতো না। মনে হতো আমার সব আছে। হঠাৎ মা একদিন আমাকে ফোনে বলছে মেহজাবিনের বিয়ে ঠিক করেছেন উনারা। কানাডারই কোন ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র‍্যাজুয়েট। কী ভেবে যেন প্রথমে একটা ধাক্কা লাগলেও উনাদেরকে আর সেটা বুঝতে দেইনি।

আমি খুব আগ্রহের সাথে ছেলের ব্যাপারে জানতে চাইলে কী ভেবে যেন ব্যাপারটা এড়িয়ে যায় সবাই। মেহজাবিন নিজেও কিছু বলেনা ওর হবু বর সম্পর্কে। খুব জানতে চাইলে বলে “তুমি তো বিয়েতে আসছোই, তখনই দেখে নিবে ও সব জেনে নিবে।” আমি বড়বোন হিসেবে মেহজাবিনের সর্বোচ্চ ভালোটাই চাইবো, এটাই স্বাভাবিক। কেমন ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে সেটা অবশ্যই আমার জানার প্রয়োজন। ছেলে কানাডায় পড়াশোনা করেছে এটাই সবকিছু নয়। এরবাইরেও একটা ছেলের অনেক পরিচয় আছে, তার বৈশিষ্ট্য আছে, আচার স্বভাব আছে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ ব্যাপারে কথা বাড়ানো আমার অনধিকার চর্চা মনে হচ্ছিলো আমাকে জানাতে ওদের অনিহা দেখে।তবুও বিয়ের শপিং থেকে শুরু করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর টোটাল খরচ আমিই বহন করি।”

:- “বোনের বিয়েতে গিয়েছিলেন নিশ্চয়?”

:- “হ্যা, গিয়েছিলাম। দীর্ঘ ছয় বছর পর আমি আমার জন্মভূমিতে পা রাখি আমার বোনের বিয়ের আগেরদিন সকালে। যাদের গোমরা মুখ ও বাঁকা চোখ দেখে দেশ ছেড়েছিলাম দেশে ফেরার পর তাদের হাসিমুখ আমার চোখে জল নামিয়ে এনেছিলো। বাড়িতে গিয়ে মেহজাবিনের হবু বরকে দেখে আমার দম আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা।
এই ছেলে ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টায় পড়েছে পরিবেশ বিজ্ঞানে। আমার ইরানি রুমমেট জিনসি’র সাথে দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্ক ও ক্যাজুয়াল লিভ টুগেদার করার পর পার্মানেন্ট রেসিডেন্সিয়াল পার্মিট পেয়ে ওকে ডাম্প করে বিয়ে করে ফেলে এক কানাডিয়ান বিধবা তরুণীকে।

ছেলেটা মানুষিক বিকারগ্রস্ত একজন কামতাড়ির পুরুষ। আমার মাথায় কিছুই ধরছেনা সে মুহুর্তে আমি কী করতে পারি! এই ছেলের কাছে বোন বিয়ে দিলে বোন আমার বেঁচে থেকেই নরকের কষ্টভোগ করবে। সবকিছু ফাঁশ করে দিলে বিয়েটা ভেঙে যাবে, বোনটা সাময়িক কষ্ট পাবে। কিন্তু আমি এটা ভাবিনি যে বিয়ে ভাঙার দায়ভার সব আমার ঘাড়ে চাপবে। যে বোনের ভালোর জন্য আমি এটা করলাম সেই বোনই আমাকে আমার অভিশপ্ত সেই উপাধি ধরে ডেকেছে। আমাকে বলেছে “যে অপয়া রাক্ষসী তার নিজের বাবা-মা’র জীবনই কেড়ে নিতে পারে, সে কী করে তার সৎবোনের সুখ সহ্য করবে!”

তুমিই বলো বোন,(বিমানবালা অরুণিমাকে) আমি কি আমার বোনের সুখ ছিনিয়ে নিতে চেয়েছি? আমি কি আমার বাবাকে মেরেছি? আমার মাকে কি আমি মেরেছি? কেন এই অভিশাপ নিয়ে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে? কেন শুধু আমিই এতো কষ্ট পাবো বোন? নিজের মায়ের স্নেহ পাইনি, বাবাও চলে গেলো আমাকে ছেড়ে। এই কষ্টটুকুই কি যথেষ্ট ছিলোনা? মা-বাবার মৃত্যুর দায়ভার মাথায় নিয়ে কেন বেঁচে থাকতে হবে আমার? আমি কী দোষ করেছিলাম বিধাতার কাছে বোন? কত আশা করে কত ফূর্তি নিয়ে দেশে এসেছিলাম ছোটবোনের বিয়ে দিতে। সেই বিয়ে ভাঙার দায় নিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরতে হচ্ছে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া বেহায়া মনটাকে নিয়ে! কেন আমার সাথেই এমন হয়? কেন? কেন?”

সীটে মাথা এলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে মেহরুন। বারো হাজার কিলোমিটার এর পথ তেরো ঘন্টায় অতিক্রম করে টোরেন্টো এয়ারপোর্টে পৌছে ফ্লাইট থেকে নামার সময় মেহরুনের হাতে একটা কার্ড দেয় অরুণিমা মিত্র। মেহরুনের হাতদুটো আরেকবার চেপে ধরে অরুণিমা বলে, “শুধু আপনার জীবনেই নয়, দুঃখ সবার জীবনেই থাকে। একদিন আসবেন, আমার দুঃখগুলো শুনিয়ে আপনাকে ঋণমুক্ত করবো।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত