আরেকটি মৃত্যু

আরেকটি মৃত্যু

কয়েক মাস আগে শুভ্রা একবার রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়েছিল, রক্তের গ্রুপ জানতে। নিজের মধ্যমা আঙুলে সূচ ফোটানের সাথে সাথে একবিন্দু রক্ত ভেসে উঠলো, আর তাই দেখে শুভ্রা ভয়ে সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়েছিল। রক্ত বড্ড ভয় পেত শুভ্রা। নিজের নামের মতই ওর মনটাও ছিল সাদা, তীক্ষ্ণ লালের সেখানে কোন স্থান ছিল না।

সেই শুভ্রা গতরাতে ধারালো একটা ব্লেড দিয়ে নিজের রগটা কেটে একটু একটু করে শরীরের সব রক্ত কিভাবে নিঃশেষ করে দিয়েছিল সেই হিসেব এখনও অনেকে মিলাতে পারেনি। হ্যা শুভ্রা আত্নহত্যা করেছে। কয়েকমাস আগে

শুভ্রতা ঠিক চুপচাপ ধরনের মেয়ে ছিল না। আবার খুব বেশি হৈচৈ দেখলেও সেখান থেকে পালিয়ে যেত। খুব বেশী বকবক করতো না আবার খুব নীরব ধরনের মেয়েদের দেখলেও সমালোচনা করতে ছাড়ত না। আসলে ও ছিল খুব পরিমিত মাত্রায় সাধারণ। আজকাল অবশ্য সবাই অসাধারণ হবার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। তাই সাধারণ হওয়া ব্যাপারটাও অসাধারণ হয়ে উঠেছে।

সুন্দর একটা ক্যাম্পাস, একটা ভাল সাবজেক্ট (এ্যপ্লাইড কেমেস্ট্রি) কিছু ভাল বন্ধু, বেশ কিছু পরিচিত মানুষ নিয়ে শুভ্রতার জীবন ভাল কিংবা মন্দ একরকম কেটে যাচ্ছিল। ব্যবসায়িক পরিবারের মেয়ে শুভ্রতার খুব বেশিকিছুর অভাবও ছিল না, শুধু একটি ব্যাপার বাদে। ব্যাপার বলাটা ঠিক হচ্ছে না, বলা যেতে পারে একটি মানুষ বাদে। সেই মানুষটি হলো বেস্ট ফ্রেন্ড। বাংলার যার আভিধানিক অর্থ শ্রেষ্ঠ বন্ধু।

কয়েক মাস বাদে শুভ্রা যখন থার্ড ইয়ারে উঠলো, তখন এই অভাব ঘুচিয়ে দিল তনয়া। ফার্মেসী ডিপার্মেন্টে তনয়াও থার্ড ইয়ারে পড়ত। কিভাবে যেন হয়ে গেল বন্ধুত্বটা। কিভাবে যেন মিলে গেল দুজনের পছন্দগুলো, চিন্তাভাবনা। অথচ মাত্র পাঁচ/ছয় মাস আগেও মুখ চেনাচেনি থাকলে কথা হতনা ওদের। অথচ আজ দুজনে এক ছেলের প্রেমে পড়ে, একসাথে ওদের থেকে কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলে সমালোচনা করে, একসাথে নিজেদের স্যারদের অভিশাপ দেয়, একসাথে থাকে, একসাথে ঘুরে। শুভ্রার মাঝে মাঝে মনে হয় তনয়া মেয়েটা না এলে হয়তো জানা যেত না লাইফটা তেমন খারাপ কিছু নয়। চাইলে উপভোগও করা যায়।

একবার হলো কি, শুভ্রতার পিছনে একটা ছেলে বেশ ঘুরঘুর শুরু করলো। বিশালদেহী ছেলেটাকে দেখতে পাক্কা একটা অসুরের মত। ইংলিশ ডিপার্মেন্টের এই ছেলের গুণপনার শেষ নেই। ছেলের অলরেডি একাধিক গার্লফ্রেন্ড তো আছেই, সেই সাথে গাঁজা টানার ব্যাপারে সে এই ক্যাম্পাসে বিশ্ববিখ্যাত। অবশ্য শুভ্রার কাছে এইসব তথ্যের মোলিক সোর্স তনয়াই। যাই হোক এমন একটা ছেলে প্রায় পিছু নেয়া শুরু করলে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। শুভ্রা ভয়টা তনয়া আঁচ করতে পারে আর শুভ্রার বদলে সে ছেলেটার মুখোমুখি হয়। ওদের মধ্যে কি কথা হয়েছে জানা না গেলেও বোঝা যায় খুব মিষ্টি কিছু হয়নি। সে না হোক, ওর পর থেকে কিন্তু ছেলেটা আর শুভ্রা কোনদিক বিরক্ত করতে আসেনি। এইভাবে তনয়া শুভ্রাকে আগলে রাখে মাসের পর মাস। শুভ্রাও চেষ্টা করে প্রিয় বন্ধুকে পুরোটা দিয়ে আগলে রাখতে। প্রায় সময়ই রাতে একে অন্যের বাড়িতে থেকে যেত ওরা। গল্প করে কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা।
এভাবেই কাটছিলো শুভ্রার জীবন।

এমনি একদিন শুভ্রা ক্যাম্পাসে এসে জানলো ক্যাম্পাসের এক মেয়ের শরীরে নগ্নতা ভাইরাল হয়ে গেছে গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে। যদিও মেয়েটার মুখের উপর চুল দিয়ে ঢাকা ছিল বিধায় কেউ এখনো চিনতে পারেনি মেয়েটিকে। তবে যে ভাইরাল করেছে সে দাবী করেছে মেয়েটি এই ক্যাম্পাসের। একদল তরুণ-তরুণী তাই নিজেদের দায়িত্ব তুলে নিয়েছে যেভাবেই হোক মেয়েটিকে আইডেন্টিফাই করার। যদিও তারা সফল হতে পারছে না।

শুভ্রার এই জঘন্য ভিডিও দেখার কোন অভিরুচি ছিল না। কিন্তু মেয়েটিকে আইডেন্টিফাই করার জন্য প্রত্যেকের দেখা যেন বাধ্যতামূলক হয়ে উঠলো। এক ব্যাচমেটের পীড়াপীড়িতে শুভ্রাকে দেখতেই হলো। সেই সময় কেউ যদি শুভ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো তাহলে দেখতে পেত কিভাবে মাত্র সেকেন্ডের ব্যবধানে একটি মুখ টলটলে ফর্সা থেকে ফ্যাকাশে রক্তাভ হয়ে ওঠে। শুভ্রা সমস্ত শরীরটা ঘিন ঘিন করে উঠলো। ওর শরীর প্রচণ্ড করে চাইলো হড়হড় করে বমি করে দিতে।

ভাইরাল ভিডিওটিতে সে মেয়েটিকে দেখানো হয়েছে সেখানে প্রথম থেকে তার মুখ চুল দিয়ে ঢাকা ছিল কিন্তু তার শরীরের পোষাক একটি একটি করে খুলে নিচ্ছে দুটো হাত এবং হাত দুটি মেয়েটির নগ্নতা প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত থামলো না। হাত দুটো বড় চেনা শুভ্রার, বড় চেনা। কিন্তু শুভ্রা জানে বাকী পৃথিবী ঐ হাত দুটো নয়, পুরো শরীরটাকে নিয়ে কৌতূহল দেখাবে আর হয়তো বের করে নেবে ঐ অচেতন দেহখানার অভাগ্য মালিকের নাম।

২ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের এই ভিডিওটিতে সবাই দেখছিল একটি মেয়ে নগ্ন করা হচ্ছে কিন্তু শুভ্রা দেখলো একটি মেয়েকে হত্যা করা হচ্ছে। শুভ্রার পা যন্ত্রের মত যেন স্বয়ংক্রিয় ভাবে ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের দিকে। কিন্তু আজ সেখানে তার বেস্ট ফ্রেন্ড যার বাংলা আভিধানিক শব্দ শ্রেষ্ঠ বন্ধু, সেই তনয়াকে খুজে পেল না।

খুব অসহায় লাগছিল শুভ্রার। খুব বেশি একা লাগছিল। কান্নার খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল ওর চোখ দুটোর। কিন্তু ক্যাম্পাসে সে উপায় নেই। সব ক্লাস বাদ দিয়ে শুভ্রা একটা সিএনজি ঢেকে কোনভাবে বাসায় চলে গেল। শুভ্রার পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে শূণ্যতা। কিছুতেই কোন হিসাব মেলাতে পারছেনা। শুভ্রা শুনেছিল অন্ধবিশ্বাসের থেকে বড় পাপ আর নেই কিন্তু সেই পাপের এতবড় শাস্তি ও ভাবতেও পারেনি।

স্বাভাবিকভাবেই তনয়াকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু শুভ্রাকে অবাক করে দিয়ে একটা কল আসে ওর ফোনে। ওপার থেকে ভেসে আসে পুরুষ কন্ঠ। সেই ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের অসুরদর্শী, নেশাখোর এবং চরিত্রহীন ছেলেটা। সে শুভ্রাকে জানায়, সে ইচ্ছা করেই ভাইরাল ভিডিওটি দেখেনি, কারণ সে জানে ভিডিওতে মেয়েটির পরিচয়। সে জানে মেয়েটি শুভ্রা। এমনকি সে আগে থেকে জানতো এমন কিছু হবে তাই সেই মেয়েটিকে সাবধান করতে বার বার পিছন পিছন গেছে কিন্তু বিনিময়ে তাকে খুব বাজেভাবে শাসানো হয়। তবুও সে মেয়েটিকে রক্ষা কর‍তে চেয়েছিল কিন্তু ঠিক সেসময় ছেলেটির বাবা মারা যায় তাই সে আর কিছু করতে পারেনি। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই সে শুভ্রার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। শুভ্রা লজ্জায়, ঘেন্নায় নিজের সাথে যুদ্ধ করে শুধু ছেলেটিকে একটি প্রশ্ন করতে পারলো, ” আপনি আগে থেকে সবকিছু কিভাবে জানতেন?” প্রতি উত্তরে শুভ্রা যা শুনলো সেটা সম্ভবত পৃথিবীর জনঘ্যতম মানসিকতার একটা দৃষ্টান্ত।

তনয়া নামের মেয়েটি একটা মিনমিনে নরকের কীট এবং ওর বয়ফ্রেন্ড ওর থেকেও ঘৃণ্য। একবার তনয়াকে এক সিনিয়রের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে তনয়ার বয়ফ্রেন্ড। বয়ফ্রেন্ড সাথে সাথে ব্রেক আপের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তনয়া যেভাবেই হোক সম্পর্ক টা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল কারণ ওর বয়ফ্রেন্ডের ডেবিট কার্ড দিয়ে ওর যাবতীয় মেটে। ঠিক সেইসময় দুর্ভাগ্যবশত শুভ্রা যাচ্ছিল ওদের পাশ দিয়ে। ওর বয়ফ্রেন্ড তখন শুভ্রাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে। আর তনয়াকে একটা এসাইমেন্ট দেয়। এই যে মাত্র পাশ দিয়ে যে মেয়েটা গেল ওর নগ্নভিডিও যদি সে ওর বয়ফ্রেন্ডকে এনে দিতে পারে তবেই ওদের সম্পর্ক টা টিকবে আর আজকের ঘটনা সব ভুলে যাবে। আর এইসবকিছু তনয়ার বয়ফ্রেন্ড একদিন বন্ধুদের ক্যাফেতে বলছিল আর সেখান থেকেই ছেলেটির কানে আসে।

আর তারপর থেকেই তনয়া বাজপাখির মত নজরে রাখত শুভ্রাকে। খুব সাবধানে একটু একটু করে মিশেছে ওর সাথে। ভাল সেজে খুব কাছের মানুষ হয়েছে। তারপর একদিন শুভ্রারই বাসায়, শুভ্রারই ঘরে তীব্র ঘুমের ঔষধ মেশানো খাবার খাইয়ে উদ্দেশ্য হাসির করেছে। আর ভিডিওটা ওর বয়ফ্রেন্ড দেখার পর ভাইরাল করে দিতে সময় নেয়নি।

এটুকু শোনার পর শুভ্রা কেটে দিয়েছে ফোনটা। আর কিছু শোনার শক্তি ছিল না ওর। শুভ্রা জানত যে ওর ভিডিও ভাইরাল করেছে ওর নামটাও আজকালের মধ্যে রটিয়ে দেবে। সেদিন ঠিক সেইসময়ে ঐ করিডোরে ওদের পাশ দিয়ে যাওয়াটা যদি ফিরিয়ে আনতে পারতো শুভ্রা, খুব ইচ্ছা করছে শুধু একটিবার ঐ সময়টুকু ফিরে পেতে। কিন্তু সময় যে বহতামান নদী। সে স্রোত চলে গেছে সে আর ফিরে আসে না।

অতঃপর আরেকবার একটি মেয়ে নিরুপায় হল, আরেকবার অবিশ্বাসের জয় হলো, আরেকবার হল মৃত্যু। যে মেয়েটা নিজের এক ফোঁটা রক্তে জ্ঞান হারিয়েছিল সে তুলে নিল একটা ধারালো ব্লেড। বুকভরা অভিমান নিয়ে চলে সে গেল। কাউকে বলা হল না ওর বেচে থাকার গল্পগুলো।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত