হাসপাতাল থেকে বের হয়েই একটা রিক্সার খোজ করছি।রাত বেড়ে চলেছে। ঢাকা শহরটাকে বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ঘড়িতে একবার সময়টা দেখে নিলাম।বারোটা বেজে বিশ মিনিট। রিক্সা পাবো কি পাবো না এই কথা ভাবতেই হুট করেই একজন লোক এসে হুড়মুড় করে গায়ের উপর এসে পড়লো।অাচমকা ধাক্কা সামলানো বেশ কঠিন। মাটিতে পড়ে যেতে যেতে কানে আসলো, চোর! চোর! চোর! বিষয়টা বুঝতে আর এক মুহুর্ত দেরি হলো না। লোকটা তখন আমার থেকে হাত দশ এগিয়ে গেছে। দিলাম ছুট। ফাঁকা রাস্তা দৌড়াচ্ছি একটা অজানা লোকের পিছনে।একটা সময় ধরেও ফেললাম।
চারিদিকে অন্ধকার। মুখটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে দেহের গড়ন অনুমান করে বুঝলাম, বেশ হালকা পাতলা একটা লোক। বয়স অান্দাজ করা খুব মুশকিল। লোকটাকে ধরতেই বেশ জোড়াজুড়ি করতে লাগলো নিজেকে ছুটিয়ে নেওয়ার। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলো না শক্তি দেখাতে। একটা সময় স্থির হয়ে দাড়ালো। পিছনের লোকগুলো তখন বেশ খানিকটা দুরে। হয়তো অন্ধকারে চোরের গতিবিধি ঠিক ধরতে পারেনি। ঠিক এমন সময়ই একটা অপ্রস্তুতকর ঘটনা ঘটে গেল। লোকটা আমার পায়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। পুলিশে চাকরি করার সুবাদে অপরাধীর অাচরণ আমার কাছে নতুন নয়। যদিও এখন আমাকে একজন সাধারণ মানুষ বললেও ভুল হয় না। দুইদিনের ছুটিতে আছি। হঠাৎ করেই মায়ের অসুখটা বেড়ে গেছে। তাই ছুটি নিতে হয়েছে।লোকটার অাচরণে বেশ অবাকই হলাম, সাথে কৌতুহলী। জীবনে কম অপরাধী ধরিনি। চোর, ডাকাত, খুনি আরও অনেক অপরাধী। হ্যাঁ আমি মানছি ওরা ছলনার অাশ্রয় নেয় বটে, কিন্তু এই লোকটার অাচরণ মোটেও তেমন মনে হলো না।
কি করবো ভাবছি ঠিক তখনি লোকটা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে উঠলো,”ভাই আমাকে দয়া করে ধরিয়ে দিবেন না। আজ যদি আমি ধরা পড়ি তাহলে খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। ” ক্ষতি হয়ে যাবে? কিসের ক্ষতি। হ্যাঁ ক্ষতি অবশ্য হবে, লোকের গনধোলাই ছাড়াও হাজতে যাওয়া পর্যন্ত কোনোটাই আশ্চর্য্যের কিন্তু কথাগুলো যেন অন্য কিছু ইঙ্গিত করছে।লোকটাকে ততক্ষণে পা থেকে উঠিয়ে দাড় করিয়েছি। ঠিক সেই মুহুর্তেই কয়েকজন লোক এসে ঘিরে ধরলো, তাদের মধ্যে একজন বললো,
– ভাই এইদিক দিয়ে কাউকে যেতে দেখেছেন? ব্যাটা পকেট মেরে পালিয়েছে। যদি একবার ধরতে পারি তবে দেখাবো মজা। আপনি দেখেছেন? উত্তরে কি বলবো বুঝতে পারছি না। হাতে একটা মৃদু চাপ অনুভব করলাম। অন্ধকারেও লোকটার দিকে একবার তাকালাম। মুখটা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না, তবে চোখে মুখে যে অনুনয়ের ছবি ফুটে উঠেছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না।
– কই না তো, এইদিক দিয়ে কেউ যায়নি। লোকটা তখনো আমার হাতটা চেপে ধরে আছে। আমি আমার ডান হাতটা ওর হাতের উপর রেখে ইশারাতে একটা আশ্বাসের ইঙ্গিত দিলাম।
– আপনি এখানে এত রাতে কি করছেন? আর পাশের লোকটা কে?
বলেই একটা লাইটের আলো আমাদের উপর ফেললো। সেই লাইটের আলোতে লোকটা মুখ উজ্জল হয়ে উঠলো। বয়স খুব একটা বেশি না। বয়স তিরিশ হবে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে আধ-ময়লা জামা, চুলগুলো উস্কোখুস্কো। হঠাতই একজন বলে উঠলো,
– এই তো এই লোকটার মতই। এই আমার পকেট মেরেছে। কথাটা শুনেই আমার হাত চেপে ধরে থাকা লোকটা ভয়ে কাচুমাচু হয়ে গেল।অবস্থা বেগতিক দেখে পকেট থেকে নিজের একটা কার্ড বের করে বললাম,
– এটা আমার বন্ধু। উল্টাপাল্টা কথা বললে সোজা থানায় নিয়ে যাবো। যাও এখান থেকে। ভয়ে লোকগুলো আস্তে আস্তে চলে গেলেও একজন একটু কাচুমাচু করছিলো। তারপর সেই লোকটাও চলে গেল। সবাই চলে যেতেই লোকটা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তারপর আমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালো। হয়তো আমি পুলিশ জেনেই ভয় পেয়েছে। আমি ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললাম,
– ভয় নেই, মনে হচ্ছে খাওয়া হয়নি সারাদিন। চলো কোথাও বসা যাক।
লোকটা কোনো আপত্তি করলো না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে চক্ষু লজ্জা আর বাহ্যিক লজ্জা খাটে না। রাত অনেক হয়েছে, দোকানপাট তেমন খোলা নেই। কিন্তু রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে অালোতে দেখলাম যুবকটা চারিদিকে বার বার তাকাচ্ছে। হয়তো একটা দোকান খুজছে। কিন্তু খাবার দোকান চোখে পড়ছে না। হঠাৎ যুবকটা বলেই ফেললো,
– স্যার, এইদিকে মনে হয় দোকান খোলা পাবেন না। খুব ক্ষিধে পেয়েছে। আমার জানা একটা দোকান আছে। সারারাত খোলা থাকে, বলছি সেখানে যদি যুবকটা তার পুরো কথা শেষ না করে বাম হাত দিয়ে মাথাটা চুলকাতে লাগলো। আমি মৃদু হাসলাম। তারপর বললাম,
– হ্যাঁ সেটাই তো দেখছি। চলো দেখি তোমার সেই চেনা দোকানে। আমার কথা শুনে যুবকটা বেশ খুশি হলো। তারপর সামনে সামনে হাটতে লাগলো। কে বলবে এই সেই যুবক যে কি না, পকেট মেরে পালাচ্ছিলো? কেইবা বলবে? আমি নিজেও একজন পুলিশ কর্মকর্তা? অন্য সময় হলে মাজাতে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যেতাম থানায়। কিন্তু আজ! বরং অদ্ভুদ।
মিনিট পনেরো হাটার পর একটা ছোট্ট দোকানের সামনে এসে পৌছালাম। সত্যিই দোকানটা এখনো খোলা। কিন্তু দোকানের ভেতরে যে দোকানদার আছে সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একটা কেরোসিন বাতি টিম টিম করে জ্বলছে। খদ্দেরও নেই দোকানে। আশেপাশে একবার তাকালাম। উহু, খদ্দের যে আসবে তারও কোনো নিশ্চয়তা দেখছি না। তাহলে এই দোকান সারারাত খোলা থাকে কেন?
– আসেন স্যার, ভেতরে আসেন। চাচা, গরম গরম চারটা রুটি দেন তো।
অামাকে ভেতরে ডেকে এনে কাউকে চাচা বলে সম্মোদন করে চারটা রুটির অডার দিলো। এই রাতেও গরম রুটি? হবে হয়তো। ভেতরে বসার জন্য দুইদিকে দুইটা বেঞ্চ রাখা। টেবিল নেই। একটা বেঞ্চে বসতেই যুবকটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে নিচু কণ্ঠে বললো,
– স্যার কিছু মনে করবেন না, আসলে সারাদিন কিছু খাইনি তো, তাই চারটা রুটির কথা বললাম। আপনি কিছু খাবেন? আমি আবারও মৃদু হাসলাম। তারপর বললাম,
– আমার কিছু লাগবে না। চাইলে তুমি আরও দুইটার কথা বলতে পারো।
– না না স্যার রুটিগুলো বড় বড়, দুইটা খেলেই পেট ভরে যায়। তাতেই চারটা দিতে বললাম। আর যদি লাগেই তখন পরে বলা যাবে।
– না আমি খাবো না, তোমার নাম তো জানা হলো না। কি নাম তোমার?
এরই মধ্যে দুইটা রুটি আর আর তরকারি আসলেন। লোকটার দিকে একবার তাকালাম। বয়স আন্দাজ ষাট্ট হবে। তবে শরীর বেশ শক্ত। একটা কালো চাদরে নিজের পুরোটা শরীর ঢেকে রেখেছেন। রুটি দিয়ে তিনি চলে গেলেন। যুবকটা রুটি ছিড়ে তাতে একটু তরকারি নিয়ে মুখে দিতে দিতে বললো,
– আমার নাম সিধু। এখানেই থাকি। এখান থেকে মিনিট পাঁচেক হাটলেই আমার ঘর।
– সিধু? বা বেশ সুন্দর নাম তো।
– আমাদের আবার সুন্দর অসুন্দর দিয়ে কি হবে? পেটে তো ভাত নাই। আর বোনটাও হাসপাতালে।
– ও তাই বুঝি পকেট মেরে পালাচ্ছিলে?
সিধু কোনো কথা বললো না। মাথা নিচু করে খেতে শুরু করলো। বুঝলাম একটু লজ্জা পাচ্ছে। একটা রুটি শেষ না হতেই লোকটা আরও দুইটা রুটি আর সাথে কিছ্র তরকারি দিয়ে গেলন। লোকটা চলে যেতেই সিধু বললো,
– হ্যাঁ, বোনটার জন্যই। আমি কিন্তু এইসব করি না। যদি করতাম তাহলে কি ধরা খেতাম? বোনটা কয়েকদিন ধরে খুব জ্বর। হাসপাতালে ভর্তি করেছি। ডাক্তার বললো কালকে সকালে টাকা লাগবে। হাতে টাকা নেই। তাই বাধ্য হয়ে আবারও কথা শেষ না করেই খেতে লাগলো সিধু। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। সিধুও কোনো কথা বললো না। খাওয়া শেষ হলে সিধু বললো,,
– স্যার, খুব উপকার হলো, সারাদিন কিছু খাইছিলাম না। টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে জীবন শেষ।
– তুমি কিছু করো না?
– না, কাজের জন্য ঘুরছি কিন্তু কেউ কাজ দিতে চায় না।
– কেন কাজ দিতে চাইবে না কেন?
– পরিচয় না থাকলে কে দিবে কাজ? বাবা মা তো নেই। কখনো ছিলো নাকি সেটাও জানতাম না। দেখিনি কখনো। এবার একটু অবাকই হলাম। তারপর প্রশ্ন করলাম,
– দেখোনি?তাহলে তোমার বোন?
– ওহ, মায়া? নিজের না। কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। মায়া হলো তাই রেখে দিছি। ওর মুখের দিকে তাকালেই খালি মায়া মায়া লাগে তাই নামটাও মায়াই রেখেছি।
– তোমার কথাবার্তা কিন্তু মোটেও রাস্তার ছেলেদের মত না সিধু।
– হ্যাঁ স্যার। লেখাপড়া শিখেছি, কিন্তু মাট্রিক পরীক্ষা দিতে পারিনি। টাকা পাবো কই এত। তাই আর দেওয়া হয়নি।
– বাহ্ বেশ ভালো তো। তোমার বয়স কত হবে, তিরিশ? কথাটা শুনেই সিধু হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর বললো,
-না না স্যার এবার মনে হয় বাইশ হবে। সঠিক জানি না। বাবা মা থাকলে হয়তো বলতে পারতো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম সিধুর দিকে। সিধুর বয়স সবে বাইশ? কিন্তু ওকে দেখলে যে কেউ মনে করবে তিরিশ ছুইছুই করছে। কিছু কিছু মানুষের বয়স অনুমান করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। সিধুও তাদেরই একজন। আর কোনো কথা বললাম না। ঘড়ির দিকে তাকালাম। দুইটা বাজতে চলেছে। উঠে দাড়ালাম। সিধুও আমার সাথে উঠে দাড়ালো। দোকান থেকে বেরিয়ে যাবো ঠিক তখনি পিছন ঘুরে প্রশ্ন করলাম,
– ম্যানিব্যাগে কত আছে দেখছো?
– না স্যার।
– দেখো তো কত আছে। সিধু পিছনের প্যাকেট থেকে চুরি করা ম্যানিব্যাগটা বের করে টাকাগুলো গুনে বললো,
– সাতশ টাকার মত।
– কত লাগবে? সিধু এবার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
– তা তো বলতে পারি না স্যার।
-এই নাও কার্ড। সকালে ফোন দিও কোনো একটা দোকান থেকে। আমিও যাবো হাসপাতালে। সিধু কার্ডটা হাতে নিলো। তারপর বললো,
-আজ তাহলে যাই স্যার।
কথাটা বলেই সিধু অন্ধকার রাস্তায় মিলিয়ে গেল।বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম সেইদিকে। চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার। সিধুকে দেখা যাচ্ছে না আর, অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছে। বাস্তবেও হয়তো সিধুদের জীবন অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ওরা সব সময় আর দশটা সাধারণ মানুষের মত আলোর খোজ পায় না। ওরা ধরা ছোয়ার বাইরে থাকে সব সময়। ঘড়িতে সময় বেড়ে চলেছে। আজ আর রিক্সা পাবো না, পেলেও উঠতে ইচ্ছে করছে না। হেটেই চলে যাবো।