আমার সৎ মায়ের সাথে আমার মেলামেশা ইদানিং বাড়ির অন্যেরা ভালো চোখে দেখছে না। আমাদের দুজনকে ঘিরে কিছু সন্দেহের প্রেক্ষিতে গত পরশু মাগরিবের পরপরই ছোট চাচা বাসার সবাইকে বৈঠকখানায় ডেকেছিলেন।
সেদিন ওদের তীর্যক প্রশ্নের জবাবে আমি অকপটে স্বীকার করেছিলাম যে, আমার সৎ মা’কে মাঝে মাঝে আমি ‘মা’ এর পরিবর্তে ‘আপা’ বলে ডাকি। এমন উত্তরে ছোট চাচা সোফা থেকে উঠে এসে কষে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলেছিলেন, “হারামজাদা, তুই কত বড় পাপ করতাছস, জানস? শায়লা তর মা হয়। সৎ মা তো, মা ই! আল্লায়ও তরে মাফ করবো না।”
সকাল থেকে বাবা সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। ভোরবেলায় ধানের গোলাঘরের পাশের রাস্তা দিয়ে ঝুড়ি কাঁধে হেঁটে যাওয়া এক জেলের কাছ থেকে কেজি দেড়েক পাঁচমিশালী মাছ কিনে আমার সৎ মায়ের হাতে দিয়ে বলতে শুনেছিলাম, “নেও, এইগুলো কাইটা রাইখো, রূপক ছোট মাছের চচ্চরি পছন্দ করে, রাতে কইরা দিও। আমার আইজ ফিরতে দেরী হইতে পারে। তোমরা খায়া লইও।”
চাচা যখন আমাকে থাপ্পড় দিয়ে সোফায় বসতে যাচ্ছিলেন তখন আমার সৎ মা উঠানে মাটির ছোট কালো ছড়ানো হাঁড়িতে মাছগুলোর ক্ষুদে রূপালী আঁইশগুলো ঘষে পরিস্কার করছিলেন। ফ্যাঁস ফ্যাঁসে চিকন শব্দের সে আওয়াজে আমি যেনো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমার সৎ মা শায়লা হাঁটুর উপর কনুইয়ের উপর্যুপরি চাপে মাছগুলো থেকে খসে পড়া ক্ষুদে আঁইশগুলো ফিলামেন্ট বাল্বের আলোতে নিংড়ে জলস্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন।
সে সময় উঠোনের মাঝখানে ইট দিয়ে তৈরী অস্থায়ী আধানেভা চুলোয় কেউ মিষ্টি আলু পোড়াতে দিয়েছিলো। ওখান থেকে আলু পোড়া গন্ধ বৈঠকখানায় আসতে মেজ চাচী চুলার দিকে যাওয়ার আগে আমার দিকে কঠিন চোখে চেয়ে বলেছিলেন, “শায়লা তোর ঘরে বারবার যায় কেন আমরা কিছু বুঝিনা মনে করছস? আমি নিজের চোখে তদের জড়াজড়ি করতে দেখছি।” মেজ চাচার দিকে তাকিয়ে মেজ চাচী আবার বললেন, “আপনেই কন, সেদিন কি কইছিলাম! খারান, আমি আলুগুলা তুইলা আসতাছি।” বড় চাচা সোফাতে আধশোয়া অবস্থায় আমার দিকে হাতের ছড়ি উঁচিয়ে বললেন, “আমি আগেই কইছিলাম অরে বদ জ্বীনে ধরছে, আজ থেইকা তুই আর আকামত দিবিনা। তরে নাপাকে ধরছে।”
আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিলো না। একবার মজলিস ভেঙ্গে উঠে যেতে ইচ্ছে করলেও এর শেষটা দেখার ইচ্ছায় চুপ ছিলাম। বড় চাচী ঘোমটা টেনে বড় চাচার পাশের বেতের সোফায় বসে ছিলেন। কাঁদোকাঁদো স্বরে আমার উদ্দেশ্যে বললেন, “রূপক, বাপ, এ্যারা এইসব কি কয়? তুই চুপ কইরা আছছ কেন? কতা ক!”
বড় চাচীর আবেগজড়িত কণ্ঠে বলা কথাগুলো শুনে আমার ভেতরেও খানিকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিলো। ছোট থেকেই তাঁর নিজের মেয়ের চেয়েও যত্ন করে আমাকে খাওয়াতেন, পরাতেন, পরম যত্নে হাতপাখার আলতো বাতাসে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে প্রায়ই বলতেন, “রূপক, বাপ, ঘুমাছ না কেন? সক্কালে ইস্কুলে যাইতে হইবো না?”
আমার আনেত্র কপালে রাখা তাঁর কোমল হাতের আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে অন্ধকারে পিটপিট করে তাকিয়ে বলতাম, “বড় মা, মায় কবে বাড়িত আইবো?” বড় চাচী হাতপাখা থামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেন, “তর মায় আরেক দ্যাশে ঘুমাইয়া আছে। তুই ভালা কইরা লেহাপড়া করলে তর মায় আইবো।” তখনো আমার ঘুমহীনতা বুঝতে পেরে সামান্য ধমকের সুরে বলতেন, “সকালে ইস্কুল আছে না? লেহাপড়া না করলে তর মায় কেম্নে আইবো? এই রূপক, ঘুমাইবি না?”
অল্পক্ষণের মধ্যেই বৈঠকখানায় পোড়া মিষ্টি আলু নিয়ে মেজ চাচী ঢুকেছিলেন। কিছু বলতে উদ্যত হবেন সে মুহূর্তে আচমকা বাবা বৈঠকখানায় ঢুকে আমাকে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, “কিরে রূপক, দাঁড়ায়া আছস কেন? যা, বাইর বাড়ি থাইকা এক মুঠা শোলা নিয়ে তর মায়েরে দে। চুলা জ্বালাইতে হইবো না?”
বাড়িতে বাবা চলে আসায় সেদিনের মতো মজলিস থেমে গিয়েছিলো। মেজচাচী সবার অলক্ষ্যে আমার দিকে চেয়ে ভেঙচি মুখে বাবাকে বলেছিলেন, “ভাইজান, আলুপোড়া খান, অর শোলা আনতে হইবোনা। আমি যাইতাছি।”
আজ বাইরে প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। আমার সৎ মা বাইরে নেড়ে দেয়া শুকনো কাপড়গুলো বাঁ হাতের কব্জি হতে কনুই পর্যন্ত কয়েক পরতে অবিন্যস্তভাবে ভাঁজ করে আমার দরজায় এসে দাঁড়ালেন। বাবার বাইরে যাওয়া নিশ্চিত হয়ে তিনি আমাকে দরজার বাইরে থেকে ডেকে বললেন, “দরজা খোল, রূপক!” আমি দরজাটা সামান্য খুলে ক্ষীণস্বরে বললাম, “শায়লাপা, জামাটা বারান্দার তারে রাইখা যাও।” দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হলে তিনি ডান হাতটা দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, “আমারে এখনো তর ‘আপা’ ডাকতে ইচ্ছা করে?”
আমার মুখের বাঁ দিকের দাড়িগুলো চুলকাচ্ছিলো। বুড়ো আঙুল উল্টো করে সামান্য চুলকিয়ে বললাম, “তুমি এখন যাও। বাসায় লোকজন আছে।” দরজাটা খোলার জন্য অল্প চাপ দিয়েও আমার সৎ মা কি মনে করে যেনো ফিরে যাওয়ার সময় প্রশ্ন করলেন, “তর বাপ কহনো তর গায়ে হাত তুলছে?” প্রশ্নটা করে তিনি আর এক মুহূর্ত দেরী না করে ফিরে যাচ্ছিলেন। আমি একটা আতঙ্ক নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আব্বায় কাল রাতে তোমারে অনেক মারছে তাই না?” প্রশ্নটা এড়িয়ে আমার চোখের দিকে না তাকিয়ে বললেন, “টেবিলে ভাত রাখা আছে, গোসল কইরা খায়া নে।”
দুপুরের কৌনিক অন্ধকারে ঘর থেকে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে আমি আমার সৎ মা শায়লার সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে যাওয়া দেখলাম। স্বামীর একচ্ছত্র অধিকারে স্ত্রীর কোমল শরীরে তোলা নিষ্ঠুর হাতে বাটিকের মতো ফুলে উঠা নৃশংস কুচারুকর্ম না দেখে একটা অন্তস্থ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ে থাকাই আমার কাছে স্বস্তিকর মনে হলো।
প্রায় আট বছর আগে আমি একবার ঠিক এভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটেছিলাম। তখনও আমি তাঁকে আপা বলে ডাকতাম। আমার চেয়ে মাত্র বছর দুয়েকের বড় পাড়াতো বোনকে আপা বলে ডাকাতে কারো আপত্তি ছিলোনা। একদিন স্কুলে টিফিন ব্রেকে মেয়েদের কমন রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হোঁচট খেয়ে আমার পড়ে যাওয়াতে সমস্ত মেয়ে মহলে হাসি ছড়িয়ে পড়েছিলো। আমার ডান হাঁটু ছিলে রক্তে ভিজে খাকি প্যান্ট কালচে রঙ ধারণ করলে এই শায়লাপা আমাকে টিউবওয়েলের সামনে নিয়ে বলেছিলেন, “দেইখা হাঁটতে পারস না? দেখি, প্যান্ট উঁচা কর!”
সেই প্রথম কোনো অনাত্মীয় নারী আমার পা স্পর্শ করেছিলো তাতে এক ধরণের নারীজাত মায়া আমার পা থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত ভর করে আমাকে সামান্য ব্যাথা থেকে উপশম দিয়েছিলো। একমুঠো চিবানো দূর্বাঘাস আমার হাঁটুর ক্ষতে দিয়ে শায়লাপা আমাকে বলেছিলেন, “নড়াচড়া করিস না, সামান্য জ্বলবো, একটু পরে ঠিক হইয়া যাইবো।” ঐদিন রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলাম। বিলের মাঝখানে ডিপ টিউবওয়েলের পাকা ড্রেনে শায়লাপা হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে শুয়ে আছে। আমাকে ডেকে বলছেন, “রূপক, কাছে আয়।”
আমি নোংরা মন নিয়ে কাছে যেতে শায়লাপা আমাকে শুদ্ধভাবে বললেন, “দেখ্ দেখ্ আমারও হাঁটু কেটে গেছে। দূর্বাঘাস চিবিয়ে লাগিয়ে দিবিনা?” আমি হন্যে হয়ে চারিদিকে দূর্বাঘাস খুঁজছিলাম। বিরান প্রান্তরে শুধুই বালি আর বালি। ডিপ টিউবওয়েলের নিরবিচ্ছিন্ন জলস্রোত বালিতে মিশে নিরন্তর বিলীন হয়ে যাচ্ছিলো দেখে আমি চিৎকার দিকে মাটিকে বলছিলাম, “কিরে মাটি, দূর্বাঘাস দিবিনা?”
যতক্ষণ আমি সে প্রান্তরে দূর্বাঘাস খুঁজছিলাম ততক্ষণ আমার মনের চোখে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দেয়া শিশুত্ব হতে সদ্য মুক্ত কিশোরের উদ্দাম যৌনতার হৃদপিণ্ডে এক ধরণের প্রেমের অনুভবে শায়লাপার শুয়ে থাকার দৃশ্যটা চোখে ভাসছিলো। শরীর ঘেমে যখন ঘুম ভাঙলো তখনই আমি প্রথম এই শায়লাপার জন্য গভীর এক প্রেমবোধ অনুভব করেছিলাম। আমাদের বাড়ি থেকে ছয়বাড়ি দূরে ঘুমিয়ে থাকা শায়লাপা তখনো কি জানতো যে তার চেয়ে দু’বছরের ছোট এ পৃথিবীর একজন কিশোর ছেলে তাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছিলো? গত দুইদিন সবার সামনে যেতে মাত্রাতিরিক্ত লজ্জাবোধ লাগছিলো। লজ্জার সাথে ক্ষুধার ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কের কারণে এ দুইদিন আমার ঠিকমতো খাওয়া হয় নি। আজ এখন একটু বেশি ক্ষুধা লেগেছে। কিছুদিন আগে হলেও চুপিসারে রান্নাঘরে গিয়ে আমার সৎ মা শায়লাকে বলতাম, “আমি গেলাম, তুমি ঠিকঠাক খাবার নিয়া আমার ঘরে আসো।”
শায়লাপা সন্তর্পণেই ভেঙচি কেটে বলতেন, “অত ঢং করস ক্যান? আমি তর বাপের বউ, তর না। অত খাইতে ইচ্ছা করলে যা বিয়া কইরা বউ আন। সেই তরে খাওয়ায়া দিবো।” সাময়িক অভিমান করে আমি বলতাম, “বিয়া কইরা কি হইবো? তুমি না খাওয়ালে কও, চইলা যাই।” অদ্ভুত এক অবান্তর অনুভূতি নিয়ে শায়লাপার অনেকটা কাছাকাছি যেতে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলতেন, “যা, ঘরে যা। তরকারি বাইরা আসতাছি।”
তাঁর শাড়ির আঁচলে লেগে থাকা মাছ ধোয়া পানির আঁশটে গন্ধ যখন আমার নাকে আসতো তখন আমার গর্ভধারিণী মায়ের কথা মনে পড়তো। যতদূর মনে পড়ে আমার মায়ের শরীরেও একটা আঁশটে গন্ধ ছিলো। লোকমুখে শুনেছি, আমি বেড়ালের মতো ছোঁকছোঁক স্বভাবে তাঁর কাছে গিয়ে বলতাম, “মা, মা, মাছ, মাছ আমার মুখ দিয়ে লালা ঝরতো। মা তাঁর সামান্য ভেজা আঁচল দিয়ে আমার মুখের লালা মুছিয়ে দেবার সময় আমি মায়ের হাঁটু জাপটে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তারপর থেকে বেশ কিছুক্ষণ একটা আঁশটে গন্ধ আমার নাকে লেগে থাকতো। পরক্ষণেই তিনি আমার দুহাতের নিচের অংশে ধরে পাঁজা কোলা করে উপরে উঠিয়ে শিশুতোষ হাসি হেসে বলতেন, “আমার রূপকের অন্নেক খিদা লাগছে, তাই না বাপজান?”
আমার মায়ের তখন সম্ভবত ছয় সাতমাস চলছিলো। শিমুল তুলোর বিছানায় যখন মা শুয়ে থাকতেন আমি মায়ের পেটে উঠতে চাইলে তিনি আমাকে সরিয়ে দিয়ে বলতেন, “আস্তে বাপ, এইহানে একটা ছুট্ট বাবু আছে। অয় ব্যাথা পাইবো, তুই আমার বুকের কাছে আয়।”
আমি গুটিশুটি মেরে মায়ের বুকের কাছে শুয়ে নাক ফুলিয়ে তার শরীরের ঘ্রাণ নিতাম। কি অমৃতের মতো সে ঘ্রাণ! একটা আঁশটে পোড়া ন্যাকড়ার সাথে হারিকেনে ব্যবহৃত কেরোসিনের হালকা তাপে জ্বলা কাঁচা দুধের ঘণ সরের ক্ষীণ ঘ্রাণে আমার মাকে জড়িয়ে ধরে রাখার চেয়ে সুখকর আর কিছুই ছিলো না।
এই শায়লাপার শরীরেও আমি ঠিক অমনই ঘ্রাণ পেয়েছিলাম প্রায় আট বছর আগে। স্কুলে তখন আমাদের নিয়ে কানাঘুষো চলছিলো। সবাই বলাবলি করছিলো রূপকের সাথে শায়লার প্রেম! স্কুলের পাশের সিঙ্গারার দোকানের ক্যাশে বসা সুবাস কাকা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এইগুলা কি শুনি রূপক! তর বাপের কানে গ্যালে কি হইবো একবার ভাবছস?” আমি অর্ধেক কামড় দেয়া সিংগাড়া একঢোকে গিলে গলায় আটকে গেছে এমন অভিনয়ে সেখান থেকে বের হয়েছিলাম।
সেদিন টিফিনের পর প্রথম ক্লাসে ইসলাম শিক্ষার নুরুল মুন্সী স্যার আমার সামনে বেত উঁচিয়ে বলেছিলেন, “শয়তানের কাজ কি জানস?” শেষ বেঞ্চের আগের বেঞ্চ থেকে মাকসুদ উচ্ছ্বসিত হাসি চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলো, “আমি কই স্যার? মাইয়াগর কমন রুমের সামনে ঘুরাঘুরি করা।” নুরুল স্যার মাকসুদের কথার কোনো প্রতিবাদ না করে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিলেন, “মন দিয়া পড়ালেহা কর। মাইয়াগো মইদ্দে শয়তান থাকে। অহনও সময় আছে, আমি যেন আর কিছু না শুনি!”
ঠিক পরের ক্লাস ব্রেকে শায়লাপাকে আমি এক পলক দেখার জন্য ওদের কমনরুমের সামনের কদম গাছের নিচে গিয়েছিলাম। ভেতর থেকে গুঞ্জন শুরু হওয়ার পর কয়েকটা মেয়ে ছুটোছুটি করে টিচার্স রুমে যাচ্ছিলো। শায়লাপার ক্লাসে পড়া বিথী আপা আমাকে দেখে চিৎকার দিয়ে বললো, “তাত্তাড়ি আয় রূপক, শায়লা অজ্ঞান হইয়া গ্যাছে, ডাক্তারের কাছে নিতে হইবো।” কখন যে আমি এক দৌড়ে ওদের কমনরুমে ঢুকে পড়েছিলাম একদম টের পাইনি। পাজাকোলা করে শায়লাপাকে নিয়ে বের হওয়ার সময় তাঁর শরীরের কিছু অংশ আমার নাকের খুব কাছাকাছি আসায় সেই প্রথম আমি আমার মায়ের শরীরের ঘ্রাণ অন্য শরীরে অনুভব করি।
তারপর দ্বিতীয়বারের মতো আরেকদিন সেই ঘ্রাণ পেয়েছিলাম। খাঁ বাড়ির দক্ষিনে বড় পুকুর পাড়ে সেদিন দুপুরে কেউ ছিলো না। পাড়ার চাচীরা গোসল সেরে চলে যাওয়ার পর শায়লাপা পুকুর ঘাটে এসেছিলেন। পাশের মস্ত বড় তেঁতুল গাছের নিচের খড়ের গাদার আড়ালে আমি ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম কখন শায়ালাপা আসবে। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম গোসলের পর শুভ্র এক মানবী লাল রঙা গামছাতে তার কুচকুচে কালো ভেজা চুলগুলো মুড়িয়ে পুকুর থেকে উঠে আসবে। এই ফাঁকে পাড়ের নিচে পড়ে থাকা চারটা আধভাঙা পাকা তেঁতুল কুড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
শায়লাপা গোসল শেষে উঠে এসে খড়ের গাদার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অকস্মাৎ আমাকে দেখে সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো জ্ঞান হারান। আমার হাতের তেতুলগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছিলো। আমি ক্ষণিকের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শায়লাপাকে ধরে ঝাঁকাতে থাকি। মৃদুর চেয়ে অধিকতর কম্পনের ঝাঁকুনিতে তাঁর গামছা মোড়ানো চুলের মুঠো ভাঁজ ছড়িয়ে বেরিয়ে আসার সময় শায়লাপার জ্ঞান ফিরে আসে। দূর্বলতাবশত তিনি আমার ঘাড় ও কাঁধ ধরে উঠে বসার সময় আমার নাক তাঁর কানের পাশের ভেজা চুলের খুব কাছাকাছি আসায় আমি আমার মায়ের শরীরের পুরোনো ঘ্রাণ টের পেয়েছিলাম। অমন ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় খুব অপরাধবোধ কাজ করছিলো। শায়লাপা উঠে বসে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হেসে বলেছিলেন, “লুকাইয়া মাইয়াগর গোসল দেখস, তাই না?”
সে মুহূর্তে অপরাধবোধের চেয়েও লজ্জাবোধ আমাকে বেশী পেয়ে বসেছিলো। অত্যাধিক লজ্জায় কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে আমি শায়লাপাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেছিলাম, “তোমার কিছু হইলে আমি বাঁচমুনা।” আমার পরক্ষণের নির্লিপ্ততা দেখে শায়লাপা মুখ খুলেছিলেন। একটা উদাসী গম্ভীর মুখে গলা কাঁপিয়ে বলেছিলেন, “আব্বায় আমার বিয়ার লাইগা তাড়াহুড়া করতাছে।” আমাদের বাহুবন্ধন আগলা করে দাঁড়িয়ে শায়লাপা আবার বলেছিলেন, “তুই মন দিয়া পড়ালেহা কর। আমার লগে তর কিছু হইবোনা। আমি যাই।”
অপরাধবোধ, লজ্জাবোধের পর আর দুঃখবোধ জন্মায়ানা বলে আমি তখনো কাঁদিনি। ড্যাবড্যাবে চোখ দিয়ে শুধু শায়ালাপার চলে যাওয়া দেখে দেখতে দেখতে ছড়িয়ে থাকা তেঁতুলগুলো কুড়িয়ে ঘরে ফিরেছিলাম। গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় সে দিন খুব কেঁদেছিলাম। হাউমাউ করে ঘরের খিল লাগিয়ে কান্নার ধ্বনি তাহাজ্জুদ পড়তে ওঠা বড়চাচীর কানে যেতে তিনি আমার দরজায় কড়া নেড়েছিলেন। বলেছিলেন, “কি হইছে বাপ? রূপক, দরজা খোল!”
অথচ সেই পৃথিবীর কেউ জানেনি আমি কেনো অতটা বুক ফাটা আর্তনাদে সে রাতে কেঁদেছিলাম। যোহরের আজান দিয়েছে। বাবার বাসায় এসে খাওয়ার কথা থাকলেও আজ দুপুরে তিনি আসবেন না। গতকাল সন্ধ্যায় পাড়ার চায়ের দোকানে লোকমুখে আমার সাথে আমার সৎ মায়ের কথিত সম্পর্কের কথা শুনেছেন। কাল রাতে আমাকে ডাকার ধরণ শুনেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম ব্যাপারটা বাবার কান পর্যন্ত গড়িয়েছে। আমি নিশ্চুপ থাকাতে বাবা তখন দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুই না শিক্ষিত পোলা! এতটা নীচে নামছস কেম্নে? মাইনষে কি কয় এইসব? শ্যাষে তুই আমার মরন দ্যাকতে চাস?” আমি সে প্রসঙ্গে বাবার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে সাহস পাচ্ছিলাম না। ছোট্ট জবাবে বলেছিলাম, “আব্বা তুমিও আমারে ভুল বুঝলা?”
অথচ আমি জানতাম আমার সৎ মা শায়লার প্রতি আমার প্রছন্ন পুত্রসুলভ ব্যবহারের পরিবর্তে প্রকট একটা যৌগিক মোহ কাজ করতো। সেটা অকপটে স্বীকার করার মতো সাধ্য ছিলোনা বলেই আমি নিজের প্রকট মোহকে উপেক্ষা করে বাবার সম্মুখে নিজের নিষ্পাপ চেহারা প্রদর্শনের পর চোখে জল এনে সেখান থেকে উঠে পড়েছিলাম। ফিরে এসে আমার ঘরের উত্তর দেয়ালে সাঁটা কাঠের ফ্রেমের বড় আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে নিজের গালে কষে এক থাপ্পড় দিয়ে বলেছিলাম, “রূপক, শায়লা তোর মা হয়!” পরক্ষণেই মনে হলো যেনো আমার পিছনে শায়লাপা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে যেনো বলছে, “আমারে যহন ছাইরা দিছিলো তহন কই আছিলি? নতুন কইরা তর বাপের লগে বিয়া দিলি, নিজে করতে পারলি না? কই আছিলি তহন?”
ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়েছিলো। আমার সৎ মা শায়লা তখন পাশের ঘর থেকে চিৎকার দিচ্ছিলেন। বাবার উপর্যুপরি লাঠির আঘাতে শায়ালাপার মুখে গোঙ্গানির সাথে বিকট চিৎকারে কান্নাহীন প্রতিবাদী কণ্ঠে একবার বলতে শুনেছিলাম, “মারেন, আরো মারেন। মাইরা ফালান আমারে তারপর সম্ভবত তিনি মূর্ছা গিয়েছিলেন। বাবা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর কণ্ঠ শুনতে না পেয়ে অন্ধকারেই সপাং সপাং করে আরো কয়েকটা ঘা দিয়ে ক্ষান্ত হয়েছিলেন। একসময় বারান্দায় বের হয়ে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিলেন যে, আগামীকাল একেবারেই তিনি রাতের বৈঠকে উপস্থিত হবেন। এর আগে আর আমার মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছা তাঁর মধ্যে অবশিষ্ট নেই। আরো কিছু অস্পষ্ট কথায় বোঝা গিয়েছিলো আজকের রাতের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হবে যে, হয়ত আমাকে আগামীকাল এ বাড়ি ছাড়তে হবে।
প্রায় বছর দুয়েক আগে একবার কয়েকদিনের জন্য এ বাড়ি ছেড়েছিলাম। বাবা তখন দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য বেশ তড়িঘড়ি করছিলেন। কথাটা আমার কানে আসলেও আমি গুরুত্ব না দিয়ে সামান্য ইতস্ততবোধ নিয়ে বাবার ঘরে ঢুকে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “রাতে খাইছো?” আমাকে দাদার ব্যবহৃত সেগুন কাঠের কালচে চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “আয়, বস।”
খানিকক্ষণ দুজন চুপচাপ থাকার পর বাবা বললেন, “তুই বড় হইছস, তরে কওয়াই যায়, ওই যে মকিমের মাইয়া নামডা কি জানি, ওহ শায়লা, শায়লা! মাইয়াডার আগে একবার বিয়া হইছিলো। ভালা ঘরেই হইছিলো। পোলাপান হইবোনা দেইখা জামাই তালাক দিছে। অরে তর কেমন লাগে?” বাবার মুখে শায়লা নামটা শুনে আমি তটস্থ হয়ে এক শীতল মূর্তির মতো সে চেয়ারে বসেছিলাম। আমার নীরবতা দেখে বাবা আবার বললেন, “অরে তর নতুন মা বানাইলে কেমন হইবো?”
আমার শিরদাঁড়া বেয়ে যেনো শীতল রক্তস্রোত বেয়ে বেয়ে উঠছিলো। মুহুর্তের মাঝে আমাদের সব অতীত আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সেই শায়লাপা! বিগত আট বছর ধরে আমার খুব কাছের এক মনোদৈহিক আকাংখিত দ্বৈত চরিত্রের স্বপ্নের মানবী, আমার প্রণয়িনী মাতৃরূপী আমার শায়লাপা!
বাবার আর কোনো কথাই আমার কানে ঢুকছিলো না। ঝিঁঝিঁ পোকার মতো একটা চিকন সানাইয়ের তীক্ষ্ণ সুর আমার কানে প্রবেশ করে সেটা বড় স্কেল ধারণ করে পর্দায় যেনো ড্রামের মতো বাজছিলো। একমুঠো শব্দকে থামিয়ে দিতে আমি দুহাতে কান চেপে ঝিম মেরে বালিশে মুখ গুঁজে ছিলাম। চোখের জলে বালিশ ভেজা সোঁদা গন্ধে আমার মনে পড়েছিলো, শায়লাপার শরীরের পরতে পরতে এক অকৃত্রিম ঘ্রাণ আছে, যা অনেকটা আমার মায়ের শরীরের ঘ্রাণের মতো। শুধুমাত্র এই ঘ্রাণের দাবীতে তিনি আমার মা হতে পারেন না? হয়ত পারেন, হয়ত একদমই না!
প্রকৃতি নিসৃত বৈকালিক ক্লান্তিতে যখন বাড়ির সবাই ঘুমন্ত তখন চুপিসারে শায়লাপা দরজা ঠেলে আমার ঘরে ঢুকলেন। আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, রাতের পারিবারিক বৈঠকে তাঁকেও ডাকা হয়েছে। দুপুরে ছোট চাচী উচ্চস্বরে আদেশ করেছেন যে, তিনি যেনো সন্ধ্যার মধ্যেই সব রান্নাবান্না শেষ করে রাখেন। সন্ধ্যার পরপরই বৈঠক শুরু হবে। আমি খাটের উপর কাত হয়ে শুয়ে আছি দেখে আমার পাশে দাঁড়িয়ে শায়লাপা বললেন, “বসতে কইবিনা?” সামান্য উঠে একটু সরে তাঁর জন্য জায়গা করে দিয়ে বললাম, “ঘরে আইলা যে! বাড়িত মানুষ নাই?” আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে শায়লাপা চুপ করে আছেন। যেনো হাজার বছরের ক্ষুরধার দৃষ্টির সম্মিলিত রশ্মিগুলো আমার দিকে প্রবল গতিতে এগিয়ে এসে আমার উপর আছড়ে পড়বে। এমন দৃষ্টিতে সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, “অমন কইরা কি দেখো?”
একটা নির্লিপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অন্যদিকে তাকিয়ে শায়লাপা বললেন, “তর বাপটা ভালা মানুষ, অরে ছাইরা যাইতে আমার খারাপ লাগবো।” আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম, “তুমি যাইবা ক্যান? সবাই জানে সব দোষ আমার। আমিই তো তোমার কাছে কাছে ঘুরঘুর করি। তুমি যাইবা না, যাওনের দরকার হইলে আমি যামু, তুমি ক্যান?” আবারো এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে শায়লাপা বেশ সময় নিয়ে বললেন, “রূপক!” “কি?” “পয়লাবার যহন আমার বিয়া হইছিলো সেদিন তুই কই আছিলি?”
আমি সেদিন কোথায় ছিলাম? পশ্চিমের বড় রাস্তা দিয়ে বরযাত্রীরা এসেছিলো। শায়লাপাদের উঠানে চারটা কলাগাছ পাতা ঝরিয়ে ফুট দেড়েক মাটির ভেতর গেঁথে বরকে বরণ করে নেয়ার গেট বানানো হয়েছিলো। আমাদের গ্রামে তখন সবেমাত্র বরকে গেটে আটকিয়ে টাকা দাবী করার রীতি শুরু হয়েছিলো। পৌষের শুরুর সে দিনে পাড়ার কিছু উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা শরবতসহ কয়েক রকম ফলফলাদি নিয়ে অপেক্ষারত ছিলো। গোলাপী নীল বেগুনী কাগজের দিস্তা তিনকোনা মতো কেটে আঠা দিয়ে পাটের চিকন দড়িতে আটকানো বেড়ার পাশে আরও কিছু হাফপ্যান্ট পরা বাচ্চারা চোখ বড় বড় করে চেয়ে ছিলো কখন বরযাত্রা আসবে! শায়লাপার বড় গৃহস্থ ঘরে বিয়ে হয়েছিলো। এটা দেখে পাড়ার অনেকেই অবাক হলো। তবে আমি একদম অবাক হইনি। এতটা সর্বগুণে গুণান্বিতা মেয়ের বাহ্যিক সৌন্দর্য্য প্রথম দর্শনে মুগ্ধ হবেনা এমন পুরুষ থাকতে পারেনা বলে আমি সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম। আমার শায়লাকে কেউ যদি বিয়ে করে নিয়ে যায়! আমি রূপক থাকতে অন্য কেউ তাঁকে বিয়ে করবে? এ হতে পারেনা!
চিরন্তন সত্য এই ছিলো যে, আমার সাধ্য ছিলোনা সে বিয়ে আটকানোর। সদ্য মেট্রিক পাশ করা একটা আনাড়ি ছেলে কিভাবে এমন অসম সম্পর্কের পরিণতি দিতে পারে? বিলের ধারের সেই ঝুলে পড়া বড় বটগাছের গোড়ার ফাঁকের গুহায় ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা ছাড়া আর কি করার ছিলো আমার? আমি আর কোথায় থাকতে পারতাম?
আমার এক্ষণের স্তব্ধতা দেখে শায়লাপা বললেন, “তরে খুঁজতে আমি কয়জনরে পাঠইছিলাম জানস? তর কোনো খোঁজ আছিলো না। আমারে তহন বুজতে পারস নাই? তরে আমি কি কইতে চাইছিলাম? কথা ক রূপক!” এমনিতেই গত দু’দিন ধরে পেছনের ঘটনাগুলো আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। শায়লাপার বিয়ের পর আমাকে একবার তাঁর শশুরবাড়ির এলাকায় যেতে হয়েছিলো। সে এলাকার কয়েকজন বয়জেষ্ঠ মুরুব্বী আমাকে চিনতে পারায় বাধ্য হয়েই তখন একবার শায়লাপার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। সত্যি বলতে বিয়ের এক বছরের মধ্যে তাঁর প্রতি অনুভূতিগত টান বেশ অনেকটা কমে গিয়েছিলো।
সেই পুরোনো মনস্তাত্ত্বিক বিক্রিয়া আবার নতুন করে মাথা চাঁড়া দিয়ে ওঠাতে কেনো যেনো নতুন অন্য এক ভালোলাগা আমার মধ্যে কাজ করতে শুরু করলো। আমি নিশ্চিত ছিলাম সে অনুভূতি কোনো প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির প্রাসঙ্গিকতায় প্রকট ছিলোনা। এমনটা ছিলো যে, আমি নিয়ম করে কারণে অকারণে তাঁর সাথে শুধুমাত্র যোগাযোগ রক্ষা করতে শুরু করেছিলাম। ব্যাস অতটুকুই। বিয়ের বছর তিনেক পর লোকচক্ষুর অন্তরালে শায়লাপা একদিন আমাকে বলেছিলেন, “অহন কাউরে ভালোবাসস?” আমি সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়েছিলাম, “বাসি তো!” শায়লাপা আর কোনো প্রশ্ন করেন নি। তিনি জানতেন আরো গভীরের অন্য কোনো প্রশ্নে প্রবেশ করলে আমার উত্তরে নিজে জড়িয়ে পড়বেন। এই পৃথিবীতে কে ই বা প্রশ্নের জালে আটকে পড়ে বিজিত লজ্জায় রাঙা হতে চায়? আমার সৎ মা শায়লা আমার বিছানায় বসে বললেন, “তর বাপের বিয়ার প্রস্তাবে কেন রাজি হইছি জানছ?”
আমার জানতে চাওয়ার অনাগ্রহ তোয়াক্কা না করে তিনি বললেন, “তুই সবসময় আলাভোলা। কোনো কিছুই ঠিকঠাক করতে পারস না। আট বচ্ছর ধইরা তরে চিনি আমি শায়লাপা থেমে গেলেন। আমি জানি আমি শায়লাপাকে যতটা বুঝি, ততটা কেউ তাকে বোঝেনি। আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আমি সেই শুরু থেকেই তাঁকে ভেবে নিয়েছি। আমি জানি তিনি শুধু আমার জন্যই এ বিয়েতে রাজী হয়েছিলেন৷ আমার আট বছরের প্রণয়িনী না হোক অন্তত তাঁর জন্য হওয়া এলোমেলো আমি যেনো তাঁর কাছাকাছি থাকতে পারি। নিভৃতের ভালোবাসা এক ধরণের আচ্ছন্ন ঋণ, সে ঋণ শোধের প্রবণতা জন্ম থেকে জন্মান্ততে মানুষ তার মনের ভেতর বহন করে চলে। শায়লাপা হয়ত আমার নিভৃতের ভালোবাসার ঋণ শোধের প্রত্যয়েই এ বাড়িতে আছেন। কেনো যেনো আমার বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে। আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বললাম, “শায়লাপা, তুমি যাও এখন। কেউ আইতে পারে।”
আমাকে হাত দিয়ে থামিয়ে শিয়রের দেয়ালে ঝোলানো আমার মায়ের সাদাকালো ছবিটার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “তর মায় একদিন আমার পিঠ হাতাইয়া কইছিলো, ‘শায়লারে, আমার রূপক তর চাইতে বড় হইলে হের লগে তর বিয়া দিতাম।’ ভাইগ্যডা কি দেখ! আমি তর বাপের বউ!” খানিকটা থেমে আবার বললেন, “তুই বাড়িত না থাকলে আমি মাঝে মইদ্দে এই ছবিখান দেখি। আমি কি সেই মানুষটা হইতে পারমু? কেউ কি কারো মতন হইতে পারে? এনার কথা তর মনে পড়েনা?”
আমার ভীষণ খারাপ লাগার এক পর্যায়ে আমি শায়লাপাকে জড়িয়ে ধরি। আমার সৎ মা শায়লা আমাকেও সমযোগী স্থিততায় জাপটে ধরে কোনো কথা বললেন না। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শেষ বিদায়ী কান্না শেষ না করে বিচ্ছিন্ন হলাম। চোখ মুছতে মুছতে শায়লাপা আমার ঘর থেকে দৌড়ে চলে গেলেন। মনে হলো যেনো আমার মা মাত্রই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন! পিনপতন নীরবতায় বৈঠক শেষ হলো। বৈঠকের শেষ দিকে খুব গোপনে ডেকে আনা হুজুর সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছিলেন, “পুরুষদের মইদ্দে কেউ কি যেনা করতে দ্যাকছেন?” ছোট চাচা বেশ কয়েকবার বৈঠকের মাঝে আমাক মারতে উদ্যত হয়েছিলেন। বড় চাচী উঠে তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “খারা, আগে হুজুরের কতা শুন।”
হুজুরের প্রশ্নে সবাই নিশ্চুপ ছিলো। তিনি আরো বললেন, “চারজন যোয়ান পুরুষ যদি নিজ চক্ষে যেনা করতে দেখার সাক্কী দ্যায় তাইলে অগরে মাডির মইদ্দে গলা পর্যন্ত পুইতা পাত্থর মারনের কতা কইতাম। তয় এক মাইয়া হেগরে নাপাকি অবস্থায় দ্যাকচে। এর বিচার চাইলে আমি কমু পোলারে এগারোডা দোররা মাইরা ত্যাজ্য করতে হইবো, আর বউরে এক তালাক দিয়া রাখতে হইবো। এইডাই ধর্মের বিচার।”
সম্পূর্ণ ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বাবা অন্য সবার কথার বিভিন্ন যুক্তিতে আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করলেন। আমার সৎ মাকেও সর্বসম্মুখে এক তালাক দিলেন। এক রকম ভীষণ হতাশা ও দুঃখবোধে কঠিন হৃদয়ের বাবা কাঁদলেন। কান্না সামলে বাইরে বের হওয়ার সময় বলে গেলেন আজ রাতে তিনি বাসায় ফিরবেন না। ভোর হলেই যেনো আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।
আমার খুব ইচ্ছে করছিলো বাবাকে জড়িয়ে ধরে তাঁকে ফিরিয়ে বলি, “আব্বা, আব্বাগো, আমি কোনো পাপ করিনাই। তোমরা বিশ্বাস করো আমি শায়লারে মায়ের মতো ভাবতে পারিনা, আমার মা তো একজনই আছিলো। আব্বাগো, মাইনষের কতায় তুমি আমারে ভুল বুইঝো না!”
ছোট চাচা গরুর মলন ঘোরানোর ছড়ি দিয়ে এগারোটা ঘা আমার পিঠে মারলেন। শায়লাপার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছিলো। ছলছল চোখে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে ছিলেন। ছোট চাচা শায়লাপার দিকে এগিয়ে ছড়ি দিয়ে তাঁর পিঠে তিনটা আঘাত দেয়ার পর আমার সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিলো। আমি শায়লাপাকে নিজের বাহুর অধীনে নিয়ে পিঠ পেতে বলেছিলাম, “আল্লাহর দোহাই লাগে, অরে আর মাইরেন না। বাকিগুলা আমারে দ্যান।” শায়লাপা মুর্ছা গেলে সবাই ধরাধরি করে তাঁকে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলো। সমবেত সবাই আমাকে ঘরে চলে যেতে বললেন। সব গুছিয়ে ভোর হলে যেনো সবার অলক্ষ্যে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই সেকথা আবারো জানানো হলো।
মায়ের সাদাকালো ছবিটা নামিয়ে ঘরের আলমারির ভেতরে যত্নে রাখা মায়ের ব্যবহৃত সোনালী পাড়ওয়ালা কমলা-সাদা জমিনের একটা তসরের শাড়ি আর একটা উলের মোটা চাদর বের করে ব্যাগে ঢুকালাম। আমার পিঠের আঘাতগুলো এত জোড়ালো ছিলো যে মনে হচ্ছে আগামী মাসখানেক চিৎ হয়ে শুতে পারবো না। এখন সামান্য জ্বরজ্বর বোধ হচ্ছে। সকালের অপেক্ষায় সময় যেনো পার হচ্ছে না। সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবে মনের ভেতর কেমন যেনো একটা শূন্যতাবোধ তৈরী হলো। চোখ একবার সামান্য ভিজে যাচ্ছে আবার চোখ শুকালে সবার প্রতি একটা ঘৃণাবোধ জেগে উঠছে।
হঠাৎই দরজায় মৃদু টোকা দেয়ার আওয়াজে আমি এগিয়ে যাই। খিল খুলতেই দরজা ঠেলে শায়লাপা ঢুকে আমার মুখ চেপে ধরে আমার আশ্চর্যবোধ প্রসূত প্রশ্ন থামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, “চুপ, কোনো কতা কইবিনা। চল, অহনই বাইর হইতে হইবো। তিনডায় একটা ট্রেন আছে। আমি সব গোছাইয়া লইছি।”
আমার কোনো সমীকরণ মেলাতে ইচ্ছে হলো না। আমি জানি শায়লাপাকে আমি আমার সাথে নিগৃহ যাত্রায় কোনো মতেই থামাতে পারবো না। ঘন্টাখানেক পরেই এক্সপ্রেস ট্রেনের ঝিকঝিকে ছুটে চলায় যাত্রাগত শীত নিবারণের জন্য আমি আমার মায়ের মোটা উলের চাদর শায়লাপার গায়ে চাপিয়ে দিয়ে বলবো, “তুমি তো দেহি আমার মায়ের মতোন!”
আমার কথা শুনে শত চিন্তার মেঘ একপাশে সরিয়ে শায়লাপা মৃদু হাসবেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে ব্যাগ থেকে মায়ের সেই সোনালী পাড়ের শাড়িটা বের করে প্রথম ভাঁজটা খুলবো। একটু পরে সেটা তাঁর হাতে তুলে দিতেই তিনি মৃদু হাসিটার সীমারেখা টেনে যত্নের হাতে সে শাড়ি স্পর্শ করে মন খারাপ করে বলবেন, “তর মায়ের! না?”
ট্রেন ছুটে চলছে। আমাদের নিরন্তর গন্তব্যের দিকে ছুটে চলা অসংগায়িত সম্পর্কের বেড়াজালে দুজনে পাশাপাশি বসে আছি। আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই। যেনো আমরা জানিনা কিভাবে কথা বলতে হয়! আমরা যেনো যুগ যুগ ধরে একে অন্যের চিরচেনা মানুষ হয়েও খুব, খুব অচেনা! বেশ কিছুক্ষণ পর কি মনে করে যেনো শায়লাপা আমার কাঁধে তাঁর মাথা সামান্য এলিয়ে নীরবতা ভেঙ্গে বললেন, “আমারে একবার মা কইয়া ডাকবি?”