সন্দেহ

সন্দেহ

অনেকক্ষণ যাবৎ খেয়াল করছি তিথী কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। ঘড়ি দেখলাম, প্রায় ২০ মিনিট হল। এত সময় ধরে কার সাথে কথা বলছে ও। থেমে থেমে প্রাণখুলে হাসছে তিথী। ওর হাসিটা বরাবরই আমি খুব পছন্দ করি। কিন্তু ঠিক এই মুহুর্তে ওর এই হাসিটা বুকে বিঁধছে। খুব অস্বস্তি নিয়ে বিছানায় শুয়ে ওকে লক্ষ্য করে যাচ্ছি। প্রায় আধঘন্টা পর ওর কথা বলা শেষ হল….

–কার সাথে কথা বলছিলে???
– -আরে ইমনের সাথে। ওই যে তোমাকে বলেছিলাম কলেজ লাইফে আমাকে প্রপোজ করেছিল। ওর নাকি বিয়ের কথা চলছে সেটা নিয়েই কথা বলছিলাম।
— যে ছেলেটা কলেজ লাইফে তোমাকে প্রপোজ করেছিল তার সাথে এত কিসের কথা সেটাও আবার এত হাসাহাসি করে?

— তুমি এভাবে কেন বলছ? ওটা তো অনেক আগের কথা। এখন তো আমরা বন্ধু।
— শোন তিথী, যে ছেলে তোমাকে একবার প্রপোজ করেছে সে আর কখনো তোমাকে শুধু বন্ধু ভাবতে পারবে না। ছেলেদের হাড়ে হাড়ে চিনি আমি।
–ইমন ওরকম ছেলে নয়। ও অনেক ভাল ছেলে।
— ও তাই নাকি?? অনেক খোঁজখবর রাখ দেখি ওর। নিয়মিতই কথা হয় তাইনা??
— কিসব বাজে কথা বলছ। নিয়মিত কেন কথা হবে। অনেকদিন পর আজ ফোন দিল।
–ও, একটা ছেলে রাত একটায় ফোন দেবে আর তার সাথে হেসে কুটিকুটি হয়ে কথা বলতে পারবে আর আমি বললেই বাজে কথা। আমি অফিস থেকে ফোন দিলে কখনো ৫ মিনিটের বেশি কথা বলেছ?? অথচ কলেজ লাইফের দিওয়ানার সাথে এত রাতে আধঘন্টা কথা বলেছ।

–মুখ সামলে কথা বল। দিওয়ানা মানে কি! ছিঃ। নিজের স্ত্রীকে বিশ্বাস নেই তোমার।।

আমি আরো অনেক কথা শোনাতে চাইছিলাম ওকে। কিন্তু ও ঝগড়া করতে চাইছিল না। কেউ ঝগড়া করতে না চাইলে তার সাথে একতরফা ঝগড়া করা যায় না। আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ও বালিশটা নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়ল। একা একা কিছুক্ষণ গজগজ করে আমিও শুয়ে পড়লাম। ঘুমাক ও ফ্লোরে, আমি ওকে তুলতে যাব না।

সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। পাশ ফিরে দেখি তিথী আমার পাশেই শুয়ে আছে। মনে মনে একটু হাসলাম। যে মেয়েটা একটু বেশি অন্ধকার হলেই ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়, সেই আবার জেদ করে ফ্লোরে থাকতে গেছে। শেষরাতে হয়তো ভয় পেয়ে আবার বিছানায় চলে এসেছে।বাচ্চাদের মত গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে তিথী। অপরুপ লাগছে ওকে।যাক রাতে হয়তো ঘুম হয়নি ওর। এখন আর ডেকে লাভ নেই। ঘুমাক একটু। নাস্তাটা আজ বাইরেই করে নেব।

অফিসে কাজের ফাঁকে বার বার তিথীর কথা মনে পড়ছিল। মেয়েটার সাথে এতটা খারাপ ব্যবহার করলাম একটাবার সরিও বলে আসিনি। অন্তত একটা চিরকুট তো লিখে আসতে পারতাম। আমার যখনই ওর কথা বেশি মনে হয় তখনই ওর ফেসবুক আইডিতে ঢুকি। আজও ঢুকলাম। আমাকে নিয়ে লেখা ওর ফেসবুক পোস্টগুলোতে যেন ওর স্পর্শ মিশে থাকে। হঠাৎ ওর আইডির একটা জিনিসে চোখ আটকে গেল। আরো ভাল করে চেক করলাম। নাহ্, মনে যে ভয়টা ছিল সেটাই সত্যি হল। অফিসের পুরোটা সময় অস্বস্তিতে কাটল। কিছুতেই মাথা থেকে বিষয়টা সরাতে পারলাম না। যত দ্রুত সম্ভব বাসায় গিয়ে তিথীর মুখোমুখি হতে হবে।

অনেক্ষণ ধরে কলিংবেল চাপছি কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই। এমনিতে মেজাজ খারাপ তার উপর দরজা খুলতে দেরী। আরো খারাপ হয়ে গেল মেজাজটা। কিন্তু দরজা খুলতেই সব রাগ পানি হয়ে গেল। ওকে বলেছিলাম লাল পাড়ের হলুদ শাড়িটা আদীবাসিদের মত করে পড়লে তোমাকে দারুন লাগবে। আজ ঠিক সেভাবেই শাড়ি পরে আছে ও। সত্যি অসাধারণ লাগছে ওকে। হাতটা ধরে আয়নার সামনে নিয়ে গেলাম ওকে।

— বলেছিলে তো তোমাকে নাকি হলুদ শাড়িতে মানায় না। এখন আয়নাতে একবার তাঁকিয়ে দেখতো। তুমি নিজেই প্রেমে পড়ে যাবে। একটু লাজুক হাসল তিথী। আমাকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলল। খাবার টেবিলে বসে বারবার ফেসবুকের কথাটা মনে পড়ছিল। কিন্তু বলার উপলক্ষ পাচ্ছিলাম না। শেষপর্যন্ত থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম-

— আজকে নিলয়ের পোস্টটা অসাধারণ ছিল, তাই না??একেবারে নোবেল পাবার যোগ্য
–কোন পোস্টটা??
–ঐ যে সকালে তুমি লাইক দিলে
— ও, কি জানি। পড়িনি তো লেখাটা। এমনি লাইক দিয়ে দিছি।
— ও খুব ভাল। লেখা না পড়ে কেবল নিলয়ের নামটা দেখে এরকম মানহীন, ফালতু পোস্টে লাইক দিলে। আহারে, কতটান তোমার নিলয়ের প্রতি।
— কিসব বাজে কথা বলছ। তুমি কি আমার মন খারাপ না করলে শান্তি পাওনা
–তুমি তাহলে কেবল নাম দেখে এরকম মানহীন পোস্টে লাইক দিলে কেন??

— একটা সামান্য লাইকের জন্য এতকথা কেন?
— সামান্য না,, তুমি….
–এনাফ। দিনের পর দিন অনেক সহ্য করে এসেছি। প্রতিটা দিন তোমার একে ওকে জড়িয়ে আমাকে কথা শোনাতে হবে। আমি আর পারছি না। এবার মুক্তি চাই আমি। আই কান্ট টলারেট এনিমোর..
— মানে??( বুকটা ধক করে উঠল)
— হ্যা, মুক্তি চাই আমি

আজ আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। অথচ ঘর সাজানো হয়নি, কেক আনা হয়নি, কোন গিফ্ট কেনা হয়নি,দাওয়াতও দেয়া হয়নি কাউকে। বরং এ মুহুর্তে কোর্টে অপেক্ষা করছি ডিভোর্সের আবেদন পত্রে সাক্ষর করার জন্য। এই মুক্তিটাই ও চেয়েছিল আমার কাছে। হ্যা,অনেক খারাপ আমি, অনেকবেশি মানসিক টর্চার করতাম ওকে। কিন্তু তারচেয়ে বেশি ওকে আমি ভালবাসি। ওর পাশে আমি ছাড়া আর সবাইকে আমি ঈর্ষা করি। অতিরিক্ত ভালবাসা অনেক খারাপ, ভালবাসার মানুষটাকে ধরে রাখা যায় না। কলমটা হাতে নিলাম। কাঁপছে হাতটা, হ্যা অনেক বেশি কাঁপছে। তবু মনটাকে শক্ত করলাম। বিবাহবার্ষিকীতে ওর চাওয়া উপহারটা থেকে ওকে বঞ্চিত করতে পারব না। মুক্তি দেব ওকে আমার মত জানোয়ারের ভালবাসা থেকে।

ডিভোর্সের আবেদন পত্রে সাক্ষর করার পর নাকি কোর্ট ৩ মাস সময় দেয় নিজেদের সিদ্ধান্ত যাচাই করার জন্য। আমাদেরকেও ৩ মাস সময় দিয়েছে কোর্ট। কোর্টের কাজ শেষ করে একই গাড়িতে দুজন বাসায় ফিরছি। তিথী অপরপাশের জানালার পাশে বসেছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছি না। আমি জানিনা ও কি ভাবছে কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ওকে ছাড়া নিজেকে ভাবতেও পারছি না। একটা সুযোগ পেলে নিজেকে একেবারে বদলে ফেলতাম কিন্তু সেটাও হয়তো পাব না।

আমি ভেবেই নিয়েছিলাম এই ৩ টা মাস হয়তো ও আমার সাথে এক ছাদের নিচে থাকবে না। বাসায় ফিরেই ওর ব্যাগ গুছানো দেখে বুঝলাম আমার ভাবনাটাই ঠিক। তিথী ওর বাবার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। ঠিক একবছর আগে বউ করে ওকে এ বাসায় এনেছিলাম আর ঠিক একবছর পরেই ও এ বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে ওর হাতটা ধরে জোর করে ওকে আটকাই, কিন্তু হায়, সেই অধিকারটা আমি হারিয়ে ফেলেছি। ছোট একটা কাগজ আমার ভালবাসার থেকে বড় হয়ে সামনে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখা ছাড়া কিছুই করতে করতে পারলাম না

ওকে ছাড়া সবকিছু যেন এলোমেলো লাগছে। ঘরটার প্রাণটাই যেন হারিয়ে গেছে। এখনো অফিস থেকে বাসায় ফিরে কলিংবেল চাপ দেই ভেতর থেকে কারো দরজা খুলে দেবার আশায়। কিন্তু না,প্রতিদিনই বাইরে থেকে দরজা খুলতে হয়। আর ভেতরে ঢুকতেই একটা হতাশা ঘিরে ধরে। তিথী আমার শখের লাল পাড়ের হলুদ শাড়িটা রেখে গেছে। মাঝে মাঝে ওটা হাতে নিয়ে বসে থাকি।শাড়িটাতে ও গায়ের গন্ধ মিশে আছে। আমার প্রিয় জিনিসগুলো একটাও নিয়ে যায় নি ও। কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল তো তিথী নিজে।

আমার এই অগোছাল আর বেহাল দশা দেখে পাশের বাসার আংকেল আন্টি আমার পাশে দাঁড়ালেন। অনেক সান্তনা দিচ্ছেন উনারা কিন্তু পুরোটাই যে বৃথা যাচ্ছে সেটা উনারাও বুঝতে পারছেন। আমার খাওয়া দাওয়ার দায়িত্বটা উনারাই নিয়েছেন। সকালের নাস্তাটা বাইরে করি, বাকি দুবেলা উনাদের অনার্স পড়ুয়া মেয়েটা রুমে খাবার দিয়ে যায়। মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালই। নাম অর্থি। এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। প্রতিদিন খাবার নিয়ে এসে আমার খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটা সেটা নিয়ে গল্প করে আমার মন ভাল করে দেয়ার চেষ্টা করে। খাওয়া শেষ হলেও কিছুক্ষণ বসে থাকে তারপর এটো প্লেটগুলো নিয়ে চলে যায়। ইদানিং মাঝে মাঝে পড়া বুঝে নেবার জন্যও রুমে আসে।

দেখতে দেখতে ১৫ টা দিন কেটে গেল। এর মধ্যে একবারের জন্য তিথী আমার সাথে কোন যোগাযোগ করেনি। সেদিন খুব জ্বর লাগছিল। অফিস থেকে এসেই বিছানার উপর পড়লাম। জ্বরের ঘোরে কেবল তিথীর মুখটা চোখে ভাসছিল, ওর একটু স্পর্শ প্রত্যাশা করছিল মনটা। রাতেরবেলায় অর্থি খাবার নিয়ে এল। আমার এ অবস্থা দেখে একটু বেশিই যেন বিচলিত হয়ে পড়ল মেয়েটা। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথায় পানি দিতে চাইল। না করার মত অবস্থা তখন আমার ছিল না। অনেকটা সময় নিয়ে দক্ষ সেবিকার মত মাথায় পানি ঢেলে দিল মেয়েটা। তারপর হাতটা ধরে বসাল। তোয়ালে দিয়ে মাথাটা মুছে দিচ্ছে ঠিক এমন সময় জ্বরের ঘোরে তিথীকে দেখতে পেলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে এদিকেই তাঁকিয়ে আছে ও। ঘোর জিনিসটা খুব খারাপ। খালি উল্টাপাল্টা জিনিস দেখা দেয়। তিথী তো চলে গেছে। ও এখানে আসবে কি কি করে। কিন্তু কিছু একটা কথা যেন শুনতে পেলাম-

— বাহ্, কয়েকটা দিন আমি ছিলাম না। আর এর মধ্যেই এতকিছু কন্ঠটা তো তিথীরই। তাহলে কি এটা ঘোর নয়। ও সত্যি ফিরে এসেছে। অর্থির দিকে একবার তাঁকালাম। মেয়েটা জড়োসড়ো হয়ে মাটির দিকে তাঁকিয়ে আছে। হয়তো কি বলবে জবাব খুঁজছে-

— তিথী আপু, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমি-
— চুপ করো। তুমি যাও এখান থেকে। আমি যা বলার ওকেই বলছি।

রুম থেকে বের হয়ে গেল অর্থি।এদিকে তিথী রাগে যা পারছে বলে যাচ্ছে। কিন্তু ও তো আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইছিল। তাহলে অন্য মেয়ের সাথে আমাকে দেখে এত রাগল কেন। তারমানে কি এখনো আমাকে ভালবাসে?? আমি একমনে এসব ভাবছি। তিথীর রাগের কথা গুলো ভালবাসা বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ তিথী এগিয়ে এল আমার দিকে।চোখে চোখে তাঁকাল আমার-

–কি ভেবেছ তুমি? আমার সাথে ডিভোর্স হলে ওকে নিয়ে ঘর বাঁধবে?? তা হতে দেব না আমি। এখনো আমি তোমার স্ত্রী। অন্য কারো দিকে তাঁকালে চোখ তুলে ফেলব কথাটা বলেই আমার কলারটা শক্ত করে চেপে ধরল। কিন্তু আমার শরীরের স্পর্শ পেতেই যেন ওর সমস্ত রাগ মুহুর্তেই চলে গেল

–একি! তোমার জ্বর??
— হুম
–আমার জন্যই এসব। এতগুলো দিন খুব কষ্টে কাটিয়েছ, তাই না??
— হুম
— তাহলে আমাকে আনতে যাওনি কেন?? চলে যাবার সময় কেন হাতটা ধরে আটকাওনি??
— সাহস হয়নি। ভেবেছিলাম অধিকার হারিয়ে ফেলেছি।
–কিছুই হারাওনি।
— চলে যাবেনাতো আবার??
— না কক্ষনো যাবনা। তোমার বকাগুলোই যে ভালবাসা সেটা বুঝিনি তখন।
–তাহলে নিলয়ের পোস্টে লাইক দিতে কেন??
— আরে আমাদের গ্রামে নিলয় নামে একটা চোর ছিল।

নিলয়ের পোস্ট দেখলেই আমার ঐ নিলয় চোরার কথা মনে পড়ত। তাই লাইক দিয়ে দিতাম। ওর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম। আমার সাথে সাথে তিথীও হাসছে। কোন চোরকে আর আমার সংসারের সুখ চুরি করতে দেবনা। তিথীর মুখের এই হাসিটা সারাজীবন দেখতে চাই আমি।।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত