কাঁচের পুতুল

কাঁচের পুতুল

– তোমার শ্বশুর মনে হয় তোমার দিকে কুনজর দেয়, তাই না মাধবী?

শাফিন কে চা দিয়ে তাড়াহুড়ো করে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম আবার,কিন্তু থমকে গেলাম শাফিনের উদ্ভট প্রশ্ন শুনে। পেছন ফিরে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,

– মানে? কিসব আবোলতাবোল বলতেছো? চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে শাফিন পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

– নাইলে দুপুরবেলা সবার প্লেটে ভাত তুলে দিতে পারছো,শুধু বাবার প্লেট ছাড়া। কেন? আমার বাপের সামনে যাইতে কি তোমার অস্বস্তি হয়?

– ওমা! বাবা-ই তো বললেন,উনি নিজের হাতে নিতে পারবেন। তাই আমিও…

আমার পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই চায়ের কাপটা টেবিলের উপর ধাম করে রেখে শাফিন চেঁচাতে শুরু করলো,

– এই থামো তো। বিয়ের পর থেকে দেখতেছি,আমার বাপ-মা’রে তো তুমি মানুষ হিসাবেই গণ্য করো না। কতবার বলছি না,আমি আমার বাপ-মা’র অপমান সহ্য করতে পারি না একদম?

– তুমি এইভাবে কেন কথা বলতেছো শাফিন? কি করছি আমি? বাবা তো সবসময় ই নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করেন।আমি কিছু করতে গেলে বিরক্ত হন। তারপরও তোমার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য জোর করে বাবার অনেক কাজ করে দিই। এজন্য বাবা আমার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন। শাফিন এবার চোখমুখ কঠিন করে আমার দিকে তেড়ে আসে,

– ওই হারামজাদী,মুখে মুখে তর্ক করতে না করছি না কতদিন? বেশি তেল বাড়ছে তোর,না? তোর তেল কেমনে কমাইতে হবে,এইটা কিন্তু আমি জানি।

– দেখো শাফিন,তুমি কিন্তু শুধু শুধুই আমার সাথে রাগারাগি করতেছো। দুইদিন পর পর তোমার এই অন্যায় আচরণগুলা আমি আর হজম করতে পারতেছি না।

শাফিনের দিকে আর না তাকিয়ে আমি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে শাফিন আমার ডান হাত ধরে আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে কষে একটা চড় বসিয়ে দেয় আমার গালে। এবার আমারও ধৈর্য্যের সীমা অতিক্রম হয়ে যায়। গলা উঁচু করে বলতে থাকি,

– কি সমস্যা তোমার? কি পাইছো আমাকে তোমরা?রাতদিন এই সংসারে গাধার মত খাটতে থাকি তারপরও তোমাদের মন পাই না। সারাদিনের বান্দিগিরি শেষ কইরা আবার তোমার মন যোগানের কাজে লাইগা পড়তে হয়। আর মেজাজ কি শুধু তোমার একার আছে? আর কারো নাই? তোমার এই জানোয়ারগিরি আর কত সহ্য করবো?

আমার চেঁচামেচি শুনে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি,দেবর-ননদ সবাই ছুটে এলো। ইতিমধ্যে আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে শাফিন। আমার দেবর বাঁধা দিতে আসলে তাকেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় সে। আর আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ভয়ে কেউ শাফিনের ধারেকাছে আসছেন না। কারণ তাদের ছেলের মেজাজ আর জেদ সম্পর্কে তারা সবাই অবগত। তাই দূর থেকে মারতে নিষেধ করছেন শুধু। অথচ কারো কোনো নিষেধ বারণের তোয়াক্কা না করে শাফিন তার মনের খায়েশ মিটিয়ে একনাগাড়ে চড়-থাপ্পড়-লাথি দিয়ে চলেছে আমাকে,তার সাথে অকথ্য ভাষায় বাবা-মা তুলে গালাগালি তো আছেই। আমার ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে,সেদিকে তার খেয়াল নেই। এর মধ্যে শাফিনের একটা ইমার্জেন্সী কল আসে। তাই অগত্যা তাকে বেরিয়ে যেতে হয়। যাওয়ার আগে বলে যায়,

– ভাগ্যের জোরে বাঁইচা গেলি এখন। কিন্তু সবসময় তো আর ভাগ্য সায় দিবে না, কথাটা মাথায় রাখিস।

উঠে দাঁড়ানোর মত শক্তি পাচ্ছিলাম না অথচ এই অবস্থাতেই আমাকে রাতের রান্না শেষ করতে হয়েছিল। শ্বাশুড়ি কোমরে ব্যাথার অজুহাত দিয়ে সারাদিন শুয়ে বসে থাকে,আর ননদ টা’র এস.এস.সি পরীক্ষা। কাজের লোক রাখার নিয়ম নেই এ বাড়িতে।

সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেলে,থালা-বাসন ধুয়ে সব গুছাতে গুছাতে রাত ১২.৩০ বেজে যায়। ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিই। ঠিক তখনি শাফিন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার যৌনচাহিদা মেটানোর জন্য। আমি বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করি,অনুরোধ করি আজকের দিন টা ছেড়ে দেয়ার জন্য,কিন্তু আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে শাফিন তার কাজে লেগে পড়ে। এক এক করে আমার শরীরের কাপড় খুলতে থাকে। বিছানায় সে আমার সাথে কখনোই স্বামীর মত আচরণ করে না,তখন তার আচরণ হয়ে যায় ক্ষুধার্ত এক পাগলা কুকুরের মত। শাফিনের প্রতিটা স্পর্শ আমার গায়ে কাটার মত গিয়ে বিঁধছে। প্রচণ্ড ব্যথায় আর যন্ত্রণায় যখন কাতরাচ্ছিলাম, সে তখন আমার মুখ চেপে ধরে রেখেছিলো আর আমি অসহায়ের মত শুধু ছটফট করছিলাম।

– মাধবী দরজা টা খোল্, তুই কি ঘুমাইতেছিস?

ধড়মড় করে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম,আমার পুরো শরীর ঘেমে নেয়ে গেছে। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে খেয়াল করলাম চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

– এই মাধবী, দরজা বন্ধ কইরা কি করতেছিস কিছুই তো বুঝতেছি না।

মায়ের ডাক শুনে সম্বিত ফিরে পেলাম। এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম আমি! সেই বিভৎস রাতগুলো এখনো আমার পিছু ছাড়ে নি,প্রায়ই স্বপ্নে এসে হানা দেয়। বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজা খুলে দেখলাম,আম্মা একটা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

– সেই কখন থাইকা দরজা ধাক্কাইতেছি! কি করতেছিলি এতক্ষণ? কারেন্ট চইলা গেছে,নে মোম টা ধর্। আম্মার হাত থেকে মোমবাতি নিতে নিতে বললাম,

– বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমাইয়া গেছি টের পাই নাই। কারেন্ট কখন গেছে?

– একটু আগে। এখনি ভাত বাড়বো নাকি কারেন্ট আসলে?

– কারেন্ট আসুক। আহির বাসায় নাই?

– কারেন্ট যাওয়ার সাথে সাথে হাওয়া খাইতে বাইর হইয়া গেছে। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর আম্মা আমার ঘরে আসলেন,

– কালকে তোর ছোট চাচার কাছে যাবি বলছিলি,মনে আছে? মোবাইল চার্জে দিতে দিতে উত্তর দিলাম,

– হুম আছে। স্কুল থাইকা সোজা ওইখানেই যাব।

– ভালমতো বুঝাইয়া বলবি আর ওদের কোনো কথায় মাথা গরম করবি না।

এ কথার কোনো উত্তর দিলাম না আমি। আমাকে চুপ থাকতে দেখে আম্মা চলে গেলেন নিজের কাজে। বিশাল বড় ড্রয়িংরুমের সাজসজ্জাতে বিলাসিতা স্পষ্ট। দরজা জানালার পর্দা থেকে শুরু করে দেয়ালের টাইলস পেইন্টিং এর মধ্যেও আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে। প্রায় আধঘণ্টা বসে থাকার পর ছোট চাচী আসলেন। উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম আমি। সালামের উত্তর দিয়ে তিনি আমাকে বসতে বললেন,

– অনেকক্ষণ হইছে আসছো, না? আমি আসলে অনলাইনে কয়েকটা নেকলেসের ডিজাইন দেখতেছিলাম। মুচকি হেসে বললাম,

– ঠিক আছে চাচী, সমস্যা নাই। তারপর তিনি আমার মুখোমুখি বসলেন,

– ভাবী, আহির,মেহের ওরা সবাই কেমন আছে?

– ভালো আছে।

– তুমি কি স্কুল থাইকা আসলা?

– হ্যাঁ,এছাড়া তো আর সময় হয় না আমার। চাচী, চাচ্চু বাসায় নাই?

– আছে, তার শরীর টা ভাল না তাই শুইয়া আছে। আমি জানি তুমি কি জন্য তোমারে চাচ্চু রে খুঁজতেছো। সেদিন যখন তুমি তোমার চাচ্চুর কাছে ফোন দিছিলা,আমি তখন সামনেই ছিলাম।

– ও আচ্ছা। তো কোনো ব্যবস্থা কি হইছে?

– কি যে বলবো মাধবী! আসলে তোমার চাচার ব্যবসার অবস্থা এখন খুব একটা ভাল যাইতেছে না,তার উপর আবার নতুন ব্যবসায় হাত দিছে। বুঝতেই তো পারতেছো। ৬০/৭০ হাজার টাকা তোমাদের ধার দেয়া এই মুহূর্তে ওর পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু তারপরও তোমার চাচ্চু বলছে,হাজার পাঁচেক ম্যানেজ কইরা দিতে পারবে। চাচী টাকার অংক টা বলে যেন আমার মুখে কুলুপ এঁটে দিলেন।। কয়েক মিনিট চুপ থাকার পর চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। সংগে সংগে চাচী প্রশ্ন করলেন,

– কি ব্যাপার,চইলা যাইতেছো? আমি পেছন ফিরে তাকালাম,
– জ্বী।

– আরে শুনো,বসো,আসল কথাই তো বলি নাই। অনেকটা জোর করেই চাচী আমাকে বসালেন,

– তোমার জন্য একটা ভাল পাত্র পাইছি। মা,ভাই-বোন রে নিয়া আর কত ভাববা! তোমার নিজের তো একটা জীবন আছে, না? তাছাড়া আহির কিছুদিন পরে চাকরী পাইয়া বউ ঘরে তুলবে,তখন আর তোমার ওই বাসায় জায়গা হবে না। নতুন বউ আইসা ঠিক ই তোমারে বিদায় কইরা ছাড়বে। তাই বলতেছি,এই অপমানের আগেই মানে মানে কাইটা পড়ো। শুনো, পাত্র আমার চাচাতো ভাইয়ের ননদের ছেলে। বিদেশে থাকে, বিশাল বড়লোক। হ্যাঁ বয়স টা একটু বেশি,তাতে কি! তুমি ডিভোর্সী জাইনাও বিয়ে করতে রাজি হইছে,এইটাই তো অনেক। আর…

– চাচী আমাকে এখন উঠতে হবে। আমার তাড়া দেখে চাচীর হাসিমাখা মুখটা মলিন হয়ে গেল।

– ও। ভাত খাইয়া যাও? ভাত দিই টেবিলে?

– না। বাসায় আম্মা অপেক্ষা করতেছে আমার জন্য।

– দুপুরবেলা আসলা,আর না খাইয়া চইলা যাবা! তোমার চাচ্চু শুনলে রাগ করবে। আমার আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছিলো না একদম। চলে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম,চাচী গলা উঁচিয়ে বলছেন,

– পাঁচ হাজার টাকায় হইলে জানাইয়ো তোমার চাচ্চু রে। বিকাশে পাঠাইয়া দিবে নে।

বাইরে প্রচণ্ড রোদ। ভ্যানিটিব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে মাথার উপর মেলে ধরলাম। তারপর ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম,

“এই ছোট চাচ্চুর জন্য বাবা কি না করেছেন! নিজের কাছে রেখে পড়াশুনা করিয়েছেন,বাবার স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলেছেন। নিজের প্রয়োজনের কথা না ভেবে ছোট চাচ্চুর শখ-আহ্লাদ পূরণ করেছেন। এগুলো আমি আমার নিজের চোখে দেখেছি। যদিও তখন আমার বয়স কম ছিল কিন্তু তারপরও মোটামুটি সব-ই বুঝতাম। চাচ্চু যে আজ এত বড় ব্যবসায়ী হয়েছেন,দু’চারটা বড় বড় ব্যবসার মালিক হয়েছেন,সেটাও আমার বাবার কল্যাণে। প্রথম ব্যবসার পুরো টাকাটাই বাবা দিয়েছিলেন। আর আজ সেই চাচ্চুই আমাদের দূর্দিনে আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। দুনিয়াটা কি আসলেই এত স্বার্তপর!”

বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন আমাদের কদর ছিল তাদের কাছে,তাছাড়া তখন আমরা আর্থিকভাবেও বেশ স্বচ্ছল ছিলাম। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর আত্নীয়-স্বজনগুলো তাদের আসল রূপ দেখাতে শুরু করে। আর আমার ডিভোর্সের পর থেকে তারা আমাকে আর আমার পরিবার কে অনেকটা এড়িয়ে যেতে থাকেন। বাবা তার নিজের পছন্দ করা ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। আমিও আপত্তি জানাই নি। কারণ ছোটবেলা থেকে বাবার সিদ্ধান্তগুলো কে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে এসেছি আমি। বাবা ছিলেন আমার আদর্শ। তাই তিনি কোনো ভুল করতে পারেন,এটা যেন আমি ভাবতেই চাইতাম না। কিন্তু ভাগ্যের উপর কারো হাত থাকে না। বাবা আমার একটা সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ভাল ভেবে বিয়েটা দিয়েছিলেন।

বিয়ের একমাসের মাথায় আমি জানতে পারি আমার স্বামীর মেয়েমানুষের নেশা আছে। লজ্জায় কাউকে এ কথা জানাই নি তখন। ভেবেছিলাম আমার ভালবাসা দিয়ে তাকে শুধরে দিবো। কিন্তু তা আর হল না। উল্টো দিনের পর দিন আমার উপর তার অত্যাচার বাড়তে লাগলো। সংসারের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে দু’দিন পর পর আমার গায়ে হাত তুলতো সে। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ছিলেন নিরুত্তাপ। ছেলের মুখের উপর কথা বলার সাহস তাদের ছিল না। শারীরিক আর মানসিক অত্যাচারগুলো দিনকে দিন বেড়েই চলছিলো। তাই আর সহ্য করতে না পেরে বিয়ের একবছর যেতে না যেতেই সেই সংসার ছেড়ে চলে আসি আমি। আব্বা সব শুনে চোখের পানি ফেলে আমার কাছে মাফ চাইলেন,

– মা রে, আমারে তুই মাফ কইরা দে। ভুল হইছে আমার,আর মাশুল দেয়া লাগতেছে তোর। তুই কোনো চিন্তা করিস না। ওই সংসারে তোরে আমি আর ফেরত পাঠাবো না। তুই এখন আবার নতুন কইরা জীবনটা শুরু কর্। না,আমি তোরে আবার বিয়ে করতে বলতেছি না। বলতেছি, তুই নিজে কিছু করার চেষ্টা কর্। সাবলম্বী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন কর। তার জন্য যা যা করতে হয় সবরকম সাহায্য আমি তোরে করবো। আল্লাহর রহমতে আমার তো আর টাকা-পয়সার সমস্যা নাই। তোর যা ইচ্ছা হয় কর। ব্যবসা,চাকরী যেটা ইচ্ছা। তারপর যদি তোর কখনো মনে হয় তুই আবার সংসারী হবি,তাতেও আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। আমি সবসময় তোর পাশে থাকবো রে মা,সবসময়।

কিন্তু খুব বেশিদিন বাবা আমার পাশে থাকতে পারলেন না। কয়েকমাস পরেই বাবা হার্ট এট্যাকে মারা গেলেন। তারপর থেকে শুরু হয় আমাদের জীবনযুদ্ধ। আব্বার ফার্ণিচারের ব্যবসায় লোকসান চলতে থাকে। বাবা মারা যাওয়ার একমাস আগে আমাদের এলাকার একটা হাইস্কুলে জয়েন করেছিলাম আমি। ছোট দুই ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচ আর সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম বলে চার-পাঁচজন স্টুডেন্ট নিয়ে একটা ব্যাচ পড়াতে শুরু করলাম। বাবার ব্যবসাটা কে আবার দাড় করানোর জন্যে ছোট চাচ্চুর কাছে ৬০/৭০ হাজার টাকা ধার চেয়েছিলাম। এই ক’টা টাকা ধার দেয়া অসম্ভব কিছু ছিল না তার পক্ষে। সে আশা নিয়েই চেয়েছিলাম কিন্তু আজ বুঝলাম আপন মানুষগুলোও একটা সময়ে গিয়ে প্রতিবেশীর রূপ ধারণ করে ফেলে। বাসায় ফিরে দেখি,আম্মা টেবিলে ভাত বেড়ে বসে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

– তুমি এখনো খাও নাই? শুকনো মুখে উত্তর দিলেন,
– না, তোর জন্য অপেক্ষা করতেছিলাম।

– আচ্ছা,আমি হাতমুখ ধুইয়া আসতেছি।

খাবার টেবিলে অন্যান্য দিনের মত আজ কোনো সাংসারিক প্রসঙ্গ তুলছেন না আম্মা,চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা খেয়াল করে আমিই কথা শুরু করলাম,

– আম্মা,করল্লা ভাজি টা বেশি তিতা লাগতেছে। আর কিছু রান্না করো নাই? আম্মা আমার দিকে ডালের বাটি টা এগিয়ে দিলেন। ডাল নিতে নিতে জানতে চাইলাম,

– আহির আর মেহেক খাইছে?

– হুম। খানিক বাদে প্লেটে ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে মাথা নিচু করে প্রশ্ন করলেন আম্মা,

– ব্যবসা টা কি তাইলে এইবার বন্ধ হইয়া যাবে,মাধবী?

– কেন আম্মা? এই কথা কেন বলতেছো?

– তুই আসার কিছুক্ষণ আগে তোর ছোট চাচী ফোন দিছিলো।

আমি আর কিছু বললাম না। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে এলাম। এই ফার্ণিচারের ব্যবসাটাই আব্বার শেষ স্মৃতি। তাই একের পর এক লোকসান হওয়ার পরেও আমি ব্যবসা বন্ধ করতে চাই নি। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে,আর কোনো উপায়ও নেই। এই অসহায়ত্বের সময়গুলো তে আব্বার কথা মনে পড়ে খুব। আব্বা বেঁচে থাকলে এমন দিন আমাদের দেখতে হত না হয়তো। ওয়াশরুমে গিয়ে বেসিনের কল ছেড়ে দিয়ে কাঁদলাম কিছুক্ষণ। সন্ধ্যায় ব্যাচ পড়ানোর সময় আম্মার চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছিলাম। তখন কিছু বলি নি। পড়ানো শেষ করে স্টুডেন্টরা চলে যাওয়ার পর রান্নাঘরে উঁকি দিলাম,

– কি হইছিলো আম্মা? এইভাবে চিল্লাইতেছিলা কেন তখন? ভাতের পানি চুলায় বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হলেন আম্মা। তারপর আহিরের ঘরের দিকে যেতে যেতে আবার চেঁচাতে শুরু করলেন,

– কি হইছে এইটা আমারে ক্যান জিজ্ঞেস করতেছিস? এই নবাবজাদা রে জিজ্ঞেস কর্। সারাবছর পড়াশুনা করে না,পরীক্ষার আগের দিন রাইতে তার পড়ালেখার ক্যারা উঠে। হারামজাদা তখন দুনিয়াদারি ভুইলা যায়। কত কইরা বললাম,বাজার থাইকা আধা কেজি কাঁচামরিচ আইনা দে,রাত্রের রান্না বসাবো। আমার কথা কানেই নিলো না! আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ কইরা দিলো!

– আহ আম্মা। থামো তো, পড়তেছে পড়তে দাও। মরার আগে ঔষুধ খাইলে কিছু হয় না। পার্স টা হাতে নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় আম্মা ঝাঁঝালো স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

– তুই আবার কই যাইতেছিস?

– বাজারে,কাঁচামরিচ আনতে।

– হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই ই যা। তুই ই তো এই ঘরের মাগনা কামলা। তুই ছাড়া আর কেউ আছে নাকি….

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওইটুকুই শুনতে পেয়েছিলাম। আম্মার পরের কথাগুলো আর শুনতে পাই নি। কাঁচামরিচ কিনে বাসায় ফেরার সময় গলির মোড়ের চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম,কয়েকটা বখাটে ছেলে তখন শিশ দিচ্ছিলো আমাকে দেখে। আর কিছু কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করছিলো। আমি দ্রুত গতিতে হাঁটা শুরু করলে ওদের মধ্য থেকে তিন চারজন আমার পিছু নিলো। অন্ধকার রাস্তা,আশেপাশে তেমন মানুষজনও নেই। খুব ভয় পাচ্ছিলাম আমি। এক পর্যায়ে ওদের একজন আমার শাড়ির আঁচল ধরে টান দিলে আমি আঁৎকে উঠলাম। বাকিরা আমাকে ঘিরে ফেললো। আমার গা ঘিনঘিন করে উঠছিলো ওদের চাহনি দেখে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

– কি হচ্ছে এসব? যেতে দিন আমাকে।

– আহা! আমাদের সামনে এত সতী সাবিত্রী সাজার দরকার নাই তো। কতরাত ধইরা জামাই ছাড়া থাকতেছো,শরীরের চাহিদা বইলাও তো একটা কথা আছে নাকি! আর কেউ না বুঝলেও আমরা তোমার কষ্ট টা বুঝি। তাই তো লীলাখেলা করতে চইলা আসলাম সুন্দরী।

ওরা ধীরে ধীরে আমার কাছে আসার চেষ্টা করছিলো,আমি পিছু হটে যাচ্ছিলাম। ইটের সাথে পা লেগে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিচ্ছিলাম,ঠিক এমন সময় আমাকে কেউ একজন পেছন থেকে ধরে সামলে নিলো। তাকিয়ে দেখলাম,আহির! আহির কে দেখে জানোয়ারগুলো যে যার মত দৌঁড়ে পালিয়ে গেল।

বাসায় এসে আম্মার সাথে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো আহির। আমাকে কেন বাজারে যেতে দিলো সেজন্য। আম্মা কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম,আমার ফিরতে দেরী হচ্ছিলো দেখে আহির আমাকে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য বের হয়েছিলো তখন। আহিরের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা কাল থেকে। রাত জেগে পড়াশোনা করছে। ভাবলাম,এক গ্লাস দুধ গরম করে নিয়ে যাই। দুধ গরম করে নিয়ে আহিরের ঘরে গিয়ে দেখতে পেলাম,টেবিলের উপর দু’হাতে ভর দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে সে। আমি কাছে গিয়ে ওর চুলে হাত বুলাতে শুরু করলাম,

– ঘুম আসতেছে তোর আহির? আহির মাথা তুলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– তুই আবার বিয়ে কর না আপুনি। প্লিজ বিয়ে কর। আমাদের কথা তোর আর ভাবতে হবে না। রেজাল্টের পর আমি ঠিক একটা চাকরী যোগাঢ় কইরা নিতে পারবো। তারপর আম্মা আর মেহেকের দায়িত্ব নিবো। আমার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো নিঃশব্দে। দু’তিনমাস পর হঠাৎ একদিন একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললো আহির। আম্মা রাগান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– মেয়েটা কে?

মাথা নিচু করে আহির উত্তর দিলো,

– আম্মা, তোমাদের কে না জানাইয়া আমি বিয়ে কইরা ফেলছি। এছাড়া আমার কিছু করার ছিল না।

– নিজেই তো চলতেছিস বোনের টাকায়। এখন আবার আরেকজন কে নিয়া আসছিস। তোর বিবেকে বাঁধলো না একটুও?

আমি তখন স্কুলে ছিলাম। বাসায় এসে পুরো ঘটনা শুনে খুশি হব নাকি রাগ হব বুঝে পাচ্ছিলাম না। মেয়েটা কে দেখে আমার ভীষণ মায়াও লাগলো। ওর তো কোনো দোষ নেই। ও আহির কে ভালবাসে। তাই পরিবার থেকে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর কোনো উপায় না পেয়ে আহিরের সাথে পালিয়ে আসে। মেয়েটার নাম “জেরিন”। আহিরের দুই বছরের জুনিয়র। ওরা একই ভার্সিটি তে পড়ে। জেরিন কে আম্মা প্রথমে মেনে নিতে না পারলেও পরে ঠিকই মেনে নেয়। জেরিন কে আমি শিখিয়ে দিয়েছিলাম,কি কি করলে আম্মার মন জয় করা যাবে। সেই অনুযায়ী কাজ করে জেরিন আম্মার লক্ষ্মী বউ হয়ে উঠলো।

এদিকে আহির চাকরী বাকরী না খুঁজে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই আহির অনেকটা অলস প্রকৃতির আর আরামপ্রিয়। একমাত্র ছেলে বলে আব্বা খুব আদর-যত্ন করতেন ওকে। তাই ছোটবেলার অভ্যাস এখনো পুরোপুরিভাবে বদলাতে পারে নি। আম্মা চাকরীর কথা বললে বলে, “কয়েকটা কোম্পানি তে সিভি দিবো ভাবতেছি। এইসব নিয়া বেশি চিল্লাইয়ো না তো আম্মা,ভাল লাগে না”। আমি ওর উপর জোর করতে পারি না, ওকে খুব বেশি ভালবাসি তো তাই হয়তো।

কিন্তু সংসার টা এখন আমার একার পক্ষে টানা আর সম্ভব হচ্ছে না। মেহেকের প্রাইভেট টিচারের বেতন বাকি পড়েছে তিনমাসের,দিতে পারছি না। তাছাড়া জেরিনের পড়াশুনার খরচটাও এখন আমাকে চালাতে হচ্ছে। আর ব্যবসা তো প্রায় বন্ধই বলতে গেলে। একদিন মেহেক রাগ করে আমাকে বলে বসলো,

– তোমার ভাইবউয়ের পড়াশুনার খরচ তো ঠিকই দিতে পারতেছো। কিন্তু নিজের বোনের বেলায় কি করতেছো? এগুলা অন্যায় হইতেছে না? তোমার ভাই কি এগুলা দেখে না? বউসহ তোমার ঘাড়ের উপর বইসা খাইতেছে,লজ্জা করে না ওর! জেরিন এ কথা শোনার পর সারাদিন না খেয়ে থাকে। রাতে আহির বাসায় ফিরে জেরিন কে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে, তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে,

– কি খাবো আমি? কার টাকায় খাবো? তোমার মত এমন শিক্ষিত,শারীরিকভাবে সুস্থ একটা জামাই থাকার পরও আমাকে আরেকজনের রোজগারে চলতে হইতেছে কেন এখনো? বলো,উত্তর দাও?

– আশ্চর্য, কি হইছে? তুমি এইভাবে চেঁচাইতেছো কেন? আস্তে কথা বলো নয়তো…

– নয়তো কি, হ্যাঁ? কি করার ক্ষমতা আছে তোমার? আপুনি একটা মেয়েমানুষ হইয়া এত বড় সংসার টা টানতেছে। আর তুমি? তুমি তো পুরুষ মানুষ! ধুর,কারে কি বলি! যার কিনা বউয়ের জন্য একটা প্যাড কিনতে গেলেও বোনের কাছে হাত পাতা লাগে,ছিঃ! তোমার আত্নসম্মানবোধ না থাকলেও,আমার আছে,বুঝছো? শুনো আহির, যতদিন না পর্যন্ত তুমি নিজে রোজগার শুরু করবা,ততদিন পর্যন্ত আমার সাথে কোনো কথা বলতে আসবা না। কথাটা যেন মনে থাকে। পাশের ঘর থেকে আম্মা সবটা শুনতে পেয়ে ওদের ঝগড়া মিটমাট করে দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি বাঁধা দিলাম। বললাম,

– থাক না আম্মা। ওদের স্বামী-স্ত্রী’র ব্যাপার ওদেরকেই মিটমাট করতে দাও। আমরা এইখানে নাক না গলাই?

এত যত্নে আগলে রাখা সংসারটায় বুঝি এবার ভাঙন ধরে যাবে ভেবে আশংকা করেছিলাম। দুশ্চিন্তায় সারারাত ঘুম আসে নি। আমি বাইরে থেকে যত টা শক্ত মন-মানসিকতা নিয়ে সবার সামনে ঘুরে বেড়াই,ভেতরে আমি ঠিক ততটাই দূর্বল। কিন্তু আম্মা,আহির আর মেহেকের সামনে তা প্রকাশ করি না আমি। আমাকে ভেঙে পড়তে দেখলে ওরাও যে হার মেনে যাবে।

সেদিন জেরিনের কথাগুলো আহিরের আত্নসম্মানে লেগেছিলো খুব। ফলাফলস্বরূপ অনেক চেষ্টার পর একমাসের মধ্যেই বেসরকারি একটা কোম্পানি তে ভাল পদে চাকরী পেয়ে যায় সে। কিন্তু এ চাকরীর জন্য দরকার মোটা অংকের ঘুষ। আহির খুব আশাহত হয়ে পড়ে। আমার বিয়ের গয়নাগুলো থেকে কিছু গয়না আমি জেরিন কে দিয়ে দিয়েছিলাম। বাকিগুলো রেখে দিয়েছিলাম মেহেকের বিয়ের জন্যে। সবার অজান্তে সেই গয়নাগুলো বিক্রি করে দিলাম। আর গয়না বিক্রির টাকাটা আহিরের হাতে তুলে দিলাম চাকরীর ঘুষ দেয়ার জন্য। আহির প্রথমে নিতে না চাইলেও আমি জোর করার পর নিতে বাধ্য হল। টাকাটা দেয়ার সময় আহির কে বললাম,

– মেহেকের জন্য আমি কিছুই অবশিষ্ট রাখতে পারি নি। তোর ভরসায় ওকে রেখে দিলাম। আহির আমার দু’হাত চেপে ধরে আমাকে আশ্বস্ত করলো,

– তুই একদম চিন্তা করিস না আপুনি। মেহেক কে আমি গয়না দিয়ে ভরিয়ে দিবো,দেখে নিস। তুই শুধু আমার জন্য দুয়া করিস।

আহিরের চাকরী টা হয়ে গেল। জেরিন পড়াশুনা শেষ করে আমাদের অনুমতি নিয়ে নিজের ইচ্ছায় একটা চাকরী তে জয়েন করলো। সব কিছু এখন খুব ভালভাবে চলছে। সংসারের আর্থিক টানাপোড়ন এখন আর নেই। আব্বার ব্যবসা টা আহির আবার নতুন করে শুরু করেছে। আহির আমাকে জোর করে স্কুলের চাকরী আর ব্যাচ পড়ানো ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু আমি অনেক বলেকয়ে স্কুলের চাকরী টা রাখলাম,ব্যাচ পড়ানো ছেড়ে দিলাম।

এর মধ্যে এক প্রতিবেশী আন্টির প্ররোচনায় পড়ে আম্মা আবার আমার বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করলেন। আমি রাজি হচ্ছিলাম না বলে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। বাসায় তখন তুমুল অশান্তি এ নিয়ে। আমিও কথায় কথায় বাসা থেকে চলে যাওয়ার হুমকি দিই। পরদিন স্কুল থেকে সরাসরি চলে গেলাম কলেজ ফ্রেন্ড নীতুর বাসায়। মন মেজাজ ভাল নেই দেখে ভাবলাম কিছুক্ষণ আড্ডা দিলে অনেকটা ফ্রেশ লাগবে। ফোনে চার্জ নেই তাই বাসায় জানাতে পারলাম না। আড্ডা শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। বাসায় ঢোকার সাথে সাথে আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিলেন,

– আমার উপর রাগ কইরা তুই কই চইলা গেছিলি মাধবী? তোরে আর কোনোদিন বিয়ের জন্য প্রেশার দিবো না আমি। তাও তুই আমারে ছাইড়া চইলা যাইস না।

ইদানীং মাথাব্যথার কারণে স্কুলে ক্লাস নিতে পারি না ঠিকমতো। বাসায় চলে আসতে হয়। কোনো কাজ করতে গেলে হাত কাঁপা শুরু হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে স্কুলের চাকরীটা ছেড়ে দিলাম। বেশ কয়েকদিন এভাবে চলার পর জেরিন আমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেল। ডক্টর কিছু টেস্ট দিলেন। রিপোর্টে ধরা পড়লো আমার ব্রেইন ক্যান্সার হয়েছে,লাস্ট স্টেজে আছে এখন।

খবরটা শোনার পর আমি একটুও বিচলিত হই নি। তবে আহির,জেরিন,মেহেক আর আম্মা পাগলামি শুরু করে দিয়েছিলো। একেকজন আমাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়েছে। আমি ওদের সবাই কে আমার ঘরে ডেকে বুঝিয়ে বললাম,

– তোমরা এমন পাগলামি করতেছো কেন? শুনলাম,জেরিন নাকি নিজের গয়নাগাটি বিক্রি করতে চাইতেছো? আর আহির, তুই নাকি ফার্ণিচারের দোকান টা বন্ধক দেয়ার চেষ্টা করতেছিস? কেন? ডক্টর তো বলেই দিছেন, আমার এখন আর কোনো চিকিৎসা নাই। তাইলে এই নিষ্ফল চেষ্টাগুলা তোমরা কেন করতেছো? যতদিন বাঁইচা আছি,ততদিন অন্তত তোমাদের সবাইকে নিয়া ভালভাবে বাঁচতে দাও। প্লিজ মেহেক আর জেরিন আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। আহির চোখের পানি আড়াল করার জন্য এ ঘর থেকে চলে গেল। আর আম্মা নীরবে চোখের পানি মুছতে লাগলেন।

ধীরে ধীরে আমি আমার শারীরিক পরিবর্তনগুলো খুব ভালভাবে টের পাচ্ছি। এক গ্লাস পানিও নিজের হাতে নিয়ে খেতে পারছি না। মাথাব্যথার তীব্র যন্ত্রণায় ঘুম না হওয়ার ফলে চোখের নিচে কালি জমেছে। কথা জড়িয়ে আসে এখন। তবে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আমি আমার সব দায়িত্ব পালন করে যেতে পারছি। মানুষের মৃত্যু হয় তখন, যখন পৃথিবীর কাছে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। আমারও নিশ্চয়ই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে এ সংসারে। যে ক’টা দিন আছি,দু’চোখ ভরে আমার আপনজনদের পূর্ণতাগুলো দেখে যেতে চাই শুধু। আসলে এ পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্মই হয় শুধু অন্যকে দিয়ে যাওয়ার জন্য। আমিও সেই মানুষদের মধ্যে একজন হতে পেরে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করছি আজ।

একদিন মধ্যরাতে ঘুমের মধ্যে অসহ্য এক যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলাম। টের পাচ্ছিলাম,আমার পুরো শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অন্য কোনো এক অচিন দেশে পাড়ি জমাচ্ছি। মেঘের রাজ্যে ভেসে বেড়াচ্ছি। সেই মেঘেদের ভীড়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আব্বা দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিতে চাচ্ছেন। ঠিক যেমনি ছোটবেলায় আমার স্কুল ছুটির পর দূর থেকে দেখতে পেতাম আব্বা দু’হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমাকে কোলে নেয়ার জন্যে,আর আমি দৌঁড়ে যেতাম। এখনো ঠিক তেমনি দৌঁড়ে যাচ্ছি আব্বার কাছে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত