ভালবাসার শেষ ঠিকানা

ভালবাসার শেষ ঠিকানা

নীলা অবশেষে আমার বাসায় আসতে রাজি হলো। কিছুক্ষণ আগে নীলা ফোন করেছিল। “তোমার বাসায় আসতে আমার আপত্তি নেই।” ফোনের ওপার থেকে নীলা বললো। কথাটা শুনে আমি বেশ খুশি হলাম। মনে মনে ভাবলাম, এবার ঠিকমত একটা সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারবো। আমি বললাম, “শেষমেশ তবে রাজি হলে। ঠিক আছে তাহলে আজ বিকালে চলে আসো।” “কিন্তু তোমার মা “মা আছে তো কি হয়েছে। কোন সমস্যা নেই।” “ঠিক আছে। আমি তাহলে বিকালে আসবো।” নীলা ফোন রেখে দিল। আমার মধ্যে এক চাপা আনন্দ কাজ করতে শুরু করলো, যে আনন্দ কারো সাথে ভাগাভাগি করতে পারছি না।

নীলা হুট করেই সিদ্ধান্তটা নেয় নি। অনেক সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে তবেই সিদ্ধান্ত টা নিয়েছে। আবার বলা যায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্তটা তাকে নিতে হয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে নীলা আমার সাথে দেখা করতে চাইলো। কি যেন জরুরী কিছু কথা বলবে। আমরা একটা পার্কে দেখা করলাম। নীলা আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, “বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করা হচ্ছে।” কথা টা শুনে যেন আমি আকাশ থেকে পড়লাম। জিজ্ঞাসু মনে জানতে চাইলাম, “কি বলো! তুমি মাত্রই অনার্স ২য় বর্ষে পড়ছো আর এখনই তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে?” “বাসা থেকে ভালো একটা পাত্রের সন্ধান পেয়েছে তাই হঠ্যাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাত্রকে কোন ভাবেই হাত ছাড়া করতে চাই না তাঁরা।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “তাই বলে এখনই বিয়ে দিতে হবে? তোমার পড়াশোনা শেষ করতে এখনো অনেক সময় বাকী।” “সেটা তাঁরা ভাবছে না। শুধু বিয়ের চিন্তাই তাদের মাথায়। যেন বাসা থেকে আমাকে পার করতে পারলেই বেঁচে যায় সবাই।” আমি চুপ করে বসে ভাবতে লাগলাম এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিত। ভাবলাম, এই যুগে এসেও একটা মেয়ের ভবিষ্যৎ একজন ছেলের হাতে তুলে দিয়ে পরিবার দায় মুক্ত হতে চায়! নীলা আমার হাত চেপে ধরে বললো, “তুমি কিছু করো। আমি এই বিয়ে করতে রাজি না।” আমি নীলাকে আশ্বস্ত করে বললাম, “চিন্তা করো না। কিছু একটা নিশ্চয় করবো।” আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। কোন পরিবারই চায় না তাঁদের মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাক, আরোও যদি হয় ভালো কোন ছেলের সাথে। এরই মধ্যে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। বিয়ে না ভাঙতে পারি, সঠিক সিদ্ধান্ত অন্তত পেতে পারি।

আমি নীলাকে বললাম, “আচ্ছা তুমি একদিন আমার বাসায় আসবে? বিকাল বেলায় আসবে আবার রাতেই ফিরবে।”
“কি বলতে চাইছো, খুলে বলোতো।” “খুলে বলার মত কিছু না। তুমি আসো তারপর সব বুঝতে পারবে।” আমার কথা শুনে নীলা ভাবনায় পড়ে গেল। ও আমাকে প্রচণ্ড ভালবাসে, একই সাথে প্রচণ্ড বিশ্বাসও করে। করবেই না কেন, কখনও আমার প্রতি ওর বিশ্বাসে একবিন্দু ধুলো পড়তে দিইনি। নীলার কপালে সংকুচিত হতে লাগলো। অনেক গভীর ভাবনায় ডুবে আছে ও। ও জানে এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া ওর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত হবে। আমি বললাম, “এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া বা জানানোর দরকার নেই। পরে জানালেও চলবে।”

আজ ১১ দিন পরে নীলা ওর সিদ্ধান্ত জানালো। নীলা প্রথমবার আমার বাসায় আসবে তাই আমিও উল্লসিত। আমি মনে মনে কিছু পরিকল্পনা ঠিক করলাম। এখন শুধু নীলার আসার পালা। ঘড়িতে বিকাল চারটা ঘন্টা বাজছে। এখন শীতকাল চলছে। শীতকালের বিকাল চারটা মানে সূর্য তেজোহীন হয়ে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়তে আরম্ভ করবে। কিন্তু নীলার এখনো খোঁজ নেই। দশ মিনিট পরে দরজায় কড়া নড়লো। আমি উঠে গেলাম। দরজা খুলেই নীলাকে দেখতে পেলাম। শাড়ী পড়ে এসেছে। কপালে ছোট একটা কালো টিপ, ঠোঁটে হালকা করে লাল লিপস্টিক দেওয়া। নীলার চোখদুটো এমনিতেই সুন্দর সেই চোখে কাজল দেওয়াতে দেখতে অপরূপ লাগছে। এত সুন্দর নীলাকে আমি আগে কখনো দেখিনি।

আমি বললাম, “তোমাকে স্বর্গের পরীর মত লাগছে যদিও আমি কখনো স্বর্গের পরী দেখিনি। আমার ধারণা তোমার আর তাদের রূপের খুব বেশি তফাত হবে না। ” নীলা হাসিমাখা মুখে বললো, “চাইলে এই পরীকে তোমার ঘরে আজীবন বন্ধী রাখতে পারো।” নীলার হাসি হাসি মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সব ধরণের পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। আমি বললাম, “চলো, ছাদে চলো।” নীলা বললো, “কেন?” আমি ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হাত ধরে ওকে ছাদে নিয়ে গেলাম। ছাদের পশ্চিমদিকে একটা টেবিল পেতে রেখেছিলাম। টেবিলের দুইপাশে দুটো চেয়ারও, যেন মুখোমুখি দুজন বসতে পারি। টেবিলের উপর ফ্ল্যাক্স ভর্তি চা, চিনি আর দুইটা কাপ রাখা আছে। কিছুক্ষণ আগে আমিই রেখে গেছি। নীলা কফির থেকে চা খেতে বেশি পছন্দ করে তাই চা এর ব্যবস্থা করেছি। নীলার প্রিয় চিপসও আছে।

চেয়ারে বসতে বসতে নীলা অবাক দৃষ্টিতে চারিদিক দেখতে লাগলো। “বাহ্! কি চমৎকার ছাদ তোমাদের। কত সবজি লাগানো তোমাদের ছাদে।” সবজি লাগানো দিকটার দিকে তাকিয়ে নীলা বললো। বর্গাকৃতি ছাদের উত্তর আর পূর্ব পাশে সবজি লাগানো আর দক্ষিণ দিকে কিছু ফুল গাছ। পশ্চিম দিকটা শীতকালে ফাঁকা রাখা হয় যেন বিকালে আরাম করে মিষ্টি রোদ পোহানো যায়।  “সবজি গুলো ভাড়াটিয়া করিম চাচা লাগিয়েছেন। উনি এগুলো খুব পছন্দ করেন। প্রায় দিনই উনি সবজি কেটে আমাদের বাসায় দিয়ে আসেন। আর ঐ যে ফুলগাছ গুলো দেখছো, ওগুলো আমি লাগিয়েছি। তুমি একটু বসো।” বলে আমি ফুলগাছের দিকে এগোলাম। একটা গোলাপ এনে নীলা দিলাম। সদ্য তোলা টাটকা গোলাপ পেয়ে নীলা ভীষণ খুশি হলো।

তারপরও মন খারাপের ভান করে বললো, “গোলাপ টা না ছিঁড়লেও পারতে। গাছেই সুন্দর দেখাচ্ছিল।” আমি বললাম, ” সুন্দর দেখালেও সৌন্দর্যকে অনেক সময় ছিঁড়তে হয়। কিছু কিছু সুন্দর সম্পর্ক যেমন না চাইলেও ছিঁড়তে হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ফুলটি ছেঁড়ার পর মনে হয় আর বোধ হয় কখনো এত সুন্দর ফুল ফুটবে না, কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার নতুন কুঁড়ি জন্ম দেয়, আবার সৌন্দর্যে ভরে উঠে গাছটি।” নীলা বললো, “কিছু কিছু সময় তোমার কথা বুঝতে আমার খুব কষ্ট হয়। আচ্ছা তুমি তো গল্প লেখো, আমাকে একটা  গল্প শোনাওতো এখন।”

“গল্প শুনতে চাও?”
“হ্যাঁ। তার আগে এক কাপ চা খাবো।”
“ঠিক আছে।”

আমি ফ্ল্যাক্স থেকে দুই কাপে চা ঢাললাম। নীলার দিকে এক কাপ এগিয়ে দিয়ে গল্প বলতে শুরু করলাম। “ভদ্র লোকটির নাম বুলবুল খান। কম বয়সেই অনেক টাকার মালিক হন। লোকটির বাবা স্ট্রোক করে মারা যাবার পর বাবার সব সম্পত্তির মালিক হন একমাত্র ছেলে বুলবুল খান। লোকটির বাবা মারা যাওয়ার ছয় মাসের মাথায় লোকটির মা ও মারা যান একটি দুর্ঘটনায়।

“বুলবুল সাহেব একটি মেয়েকে ভালবাসতো। মেয়েটির নাম ছিল কানিজ রহমান। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।
বুলবুল সাহেবের মা মারা যাওয়ার দুই মাস পরে মেয়েটির বাড়িতে বুলবুল সাহেব বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। কিন্ত্য মেয়েটির পরিবার সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। মেয়েটির পরিবার মনে করে, উচ্চ বিত্তবান লোকেরা সব সময় টাকার পিছনে ছুটে। স্ত্রী, ছেলেমেয়ের প্রতি তাদের কোন মায়া থাকে না। “এরকম মনে করারও একটা কারণ আছে। মেয়েটির ফুফুকে তার পরিবার দেখেশুনে উচ্চবিত্ত পরিবারের একজনের সাথে বিয়ে দেয়। কিন্তু সে সম্পর্ক বেশিদিন টিকে না। দুই বছরের মাথায় বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কারণ ছিল, ভালনাসার ঘাটতি। একটা সম্পর্কে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে টিকিয়ে রাখতে হলে ভালবাসার প্রয়োজন টাই বেশি।

“মেয়েটি অর্থাৎ কানিজ রহমান পরিবারের কথা না শুনে লোকটির হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। তারপর বিয়ে করে সংসার করতে শুরু করে। ৩ বছরের মাথায় তাদের একটি ছেলে হয়। ভদ্রলোক টি ছেলেটির নাম রাখেন রৌদ্র। বাবা, মা আর একমাত্র ছেলের সংসার খুব ভালোভাবে চলছিল। কিন্তু একটা সময় এসে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হতে শুরু করলো। তাঁরা মনে করতে লাগলো তাদের মধ্যে ভালবাসা কমতে শুরু করেছে। তাঁরা নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে ভুলে যাচ্ছিল। তাঁদের মধ্যে রহস্য, আগ্রহ বলে কিছুই ছিল না। একে অপরকে পুরোপুরি জেনে ফেলেছিল বলেই এমন হয়েছিল।

মানুষ প্রতিদিন নতুনভাবে ভালবাসা পাওয়ার জন্য নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পারা, নিজেকে রহস্যময়ী করে তোলার এক অসীম ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়। যে রহস্য মানুষকে প্রতিদিন একে অপরের প্রতি আগ্রহী করে তোলে এবং নতুন করে ভালবাসতে শেখায়। কিন্তু তাঁরা যেন সেটা ভুলেই গেছিলো। ঝগড়া হওয়ার পরেও ছেলেটির কথা চিন্তা করে এক অসুখী জীবন তাঁরা পরিচালনা করছিল। “রৌদ্রের বয়স তখন ৮ বছর। একদিন রৌদ্রের মা পা পিছলে বাথরুমে পড়ে গেলেন। ডাক্তার জানালো যে, শিরার সমস্যার কারণে এমন হয়েছে। আরো জানালো যে, হয়তো কিছুদিন পর পা অবশ হয়ে যেতে পারে। হলোই তাই, ৫ মাসের মধ্যেই হুইল চেয়ারে তাঁর জায়গা হলো।

“একদিন সন্ধ্যায় বুলবুল সাহেব হঠ্যাৎ করে একজন মহিলাকে নিয়ে বাসায় হাজির হলেন। রৌদ্রের মাকে জানিয়ে দিলেন, একজন অচল মানুষের সংসার করা সম্ভব না। সাথে নিয়ে মহিলাকে তিনি বিয়ে করেছেন এবং তাকে নিয়েই এখন থেকে থাকবেন। পরদিন বুলবুল সাহেব বাড়িটা রৌদ্রের মায়ের নামে লিখে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। এদিকে মহিলা তাঁর ছেলেকে নিয়ে মহাসংকটে পড়ে গেলেন। স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় পাথরের মত হয়ে গেলেন। ছেলেটিকে জড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন প্রতিদান রাতে।” আমার বলা শেষ হলে নীলা জিজ্ঞাসা করলো, “কি ব্যাপার থামলে যে, এখানেই শেষ?” আমি উত্তর দিলাম, “আপাতত এখানেই শেষ।” নীলা বললো, “অসমাপ্ত! লোকটির উপর ঘৃণা হচ্ছে। তবে গল্পটি অসমাপ্ত না হয়ে পুরোপুরি শেষ হলে ভালো লাগতো।” “আপাতত এই পর্যন্ত না হয় থাক। একদিন শেষ করা যাবে। ”

এখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঝুলে পড়েছে। একটু পরেই রাতের সীমানায় ঢলে পড়বে। পুরো শহর অন্ধকারে ঢেকে যাবে। অথচ অন্ধকারের আগে কত সৌন্দর্য দেখার আছে। রাতেও সৌন্দর্য আছে কিন্তু সেটা সবার জন্য না। নিশাচরদের জন্য। শেষ বিকালের আলো নীলার মুখজুড়ে পড়ছে। চেহারাটা সূর্যের লাল আভায় আভাসিত হচ্ছে।
চিবুক গুলো যেন ফুটন্ত গোলাপের পাপড়ি হয়ে আছে। নীলার মুখটা হাতে একবার ধরতে ইচ্ছা করছে। নীলার স্পর্শের জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠছে। হঠ্যাৎ বুকের মধ্যে এক শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করলাম।

নীলা উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি ব্যাপার, উঠে দাঁড়ালে যে?” “তুমিও একটু উঠে দাঁড়াও তো।” নীলা ওর হাত দুটো দুইদিকে প্রসারিত করতে করতে বললো।আমি উঠে দাঁড়ালাম। নীলা বললো, “দেখো, আমাদের দুজনের ছায়া কতদূর পর্যন্ত গিয়েছে।” পাশের ছাদগুলো সমান উচ্চতা বিশিষ্ট হওয়ায় ছায়াগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমি দেখলাম আমাদের ছায়া পাশের দুটো বিল্ডিং ছাড়িয়ে গিয়ে লম্বাকৃতি হয়ে গেছে। অথচ কিছুক্ষণ আগেই ছায়া দুটো আমাদের ছাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমি বুঝতে পারলাম, আজকের রাতের পর থেকে আমার আর নীলার দূরত্ব ছায়ার মতই বেড়ে যাবে। একসময় সন্ধ্যা নামলে ছায়াগুলো অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে। কোন দূরত্বও বোঝা যাবে না, ছায়াও দেখা যাবে না।

কিছুক্ষণ হলো সন্ধ্যা নেমে গেছে। আমি নীলাকে নিয়ে রুমে ঢুকলাম। রুমে ঢুকেই নীলা এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। আমার বুঝতে বাকী রইলো না, নীলা মাকে দেখতে চাইছে। মাকে দেখে আশ্বস্ত হওয়ার চেষ্টা করছে।
আমি নীলাকে বললাম, “আসো।” নীলা যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। আমার কথায় ঘোর কাটিয়ে বললো, “কোথায়? আচ্ছা, তোমার মাকে দেখছি না যে।” আমি বললাম, “মা আছে, তুমি আসো। ”

নীলা ভয়ে ভয়ে আমার পিছন পিছন আসতে লাগলো। আমি একটা রুমের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। নীলাও ঢুকলো আমার পিছন পিছন। ভিতরে ঢুকেই নীলা ভূত দেখার মত আঁতকে উঠলো। একজন মহিলা মুখ নীচু করে বসে আছেন। এলোমেলো চুল, হাত -পা গুলো যেন অবশ। আমি বললাম, “নীলা, আমার মা।” নীলা অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুই বললো না। আমি বললাম, ” আমার মা হাঁটতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না। আমার মা, একজন অনুভূতিহীন মানুষ।”

নীলা ব্যাপারটা সামলে উঠতে পারছে না। কখনোই সে এরকম টা আশা করেনি হয়তো। আশাহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এখনো। চোখের পাতা নড়ছে না। আমি নীলাকে ধরে মায়ের বিছানার উপর বসিয়ে দিয়ে বললাম, “নীলা, তোমাকে আমার বাসায় দুইটা কারণে ডেকেছি। এক, আমার মাকে পরিচয় করিয়ে দিতে আর দুই, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না এটা বলার জন্য।” এই কথাটি শুনে যেন নীলার ঘোর কেটে গেল। মনের মধ্যে প্রচণ্ড ধাক্কা খেল। আস্তে করে আমার দিকে ফিরে তাকালো। চোখমুখে অবাক বিস্ময় স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম।

অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইলো, “মানে? বিয়ে করতে পারবে না কেন?” আমি উত্তর দিলাম, “আমার মায়ের জন্য।” “আন্টির জন্য বিয়ে করবে না! দেখো, বিয়ের পর তো আমরা দুজন মিলে আন্টিকে দেখাশোনা করতে পারবো।”
“সে করা যাবে কিন্তু তুমি পারবে না।” “কেন পারবো না?” “আমাদের সম্পর্কটা মাত্র ৫ মাসের। এই অল্প সময়ে দুজনের মধ্যে এতটা ভালো বোঝাপড়া হয়ে উঠেনি যে তুমি এতটা ত্যাগ করতে পারবে। আমরা বিয়ে করলে করলে তোমার সব চাওয়া-পাওয়া থাকবে আমাকে ঘিরে কিন্তু আমার সবটাই চাওয়া যে আমার মায়ের জন্য।”

“না, এমন কিছু হবে না। তোমার চাওয়াই থাকবে আমার চাওয়া। তোমার মত তোমার মাকে আমিও ভালবাসবো।”
“তুমি পারবে না। ভালবাসতে ভালবাসতে একসময় বিরক্তি এসে যাবে। আর আমার মায়ের প্রতি কারো বিরক্তি মানে আমার কষ্ট।” “আচ্ছা ভালবাসাতে কখনো বিরক্তি থাকে? শুনেছো কখনো?” “শুনিনি, তবে দেখেছি। তোমাকে যে গল্পটা বলেছিলাম সেটা নিছক কোন গল্প নয়, সত্য ঘটনা। রৌদ্র আমারই ডাকনাম ছিল। ছোটবেলাতেই সে নামটাকে বিসর্জন ছিলাম, প্রচণ্ড ঘৃণায়। আর তোমাকে যে বলেছিলাম, আমার বাবা নেই সেটা মিথ্যা। অবশ্য একদিক থেকে মিথ্যা নয়, যে মানুষটা আমার মাকে এই অবস্থায় ফেলে চলে যেতে পারে সে আমার বাবা হতে পারে না।” আমি নিজেকে আর সংযত করতে পারছিলাম না। দুচোখ বেয়ে জল পড়তে শুরু করেছিল। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেললাম কিছুক্ষণ।

চোখের জল মুছে আবার বলতে শুরু করলাম, “আমার মা প্রথমদিকে শুধু হাঁটতে পারতো না। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর মা তেমন কথা বলতো না। আস্তে আস্তে মায়ের কথা বলার পরিমাণ কমে গেল। একদিন দেখি মা আর কোন কথাই বলছে না। এর পর থেকে মা কথাগুলো শেষ করতে পারলাম না। অঝোর ধারায় চোখের জল ঝরতে লাগলো। আমি মেঝেতে হাঁটু গেড়ে মাথা নীচু করে কেঁদেই চললাম। নীলা বিছানা থেকে উঠে এসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে ভেজা ভেজা কণ্ঠে বললো, “কান্না বন্ধ করো। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। কথা দিচ্ছি, তোমার মাকে তারচেয়ে বেশি ভালবাসবো।” আমি ধীরে ধীরে উঠে নীলার সামনে দাঁড়ালাম। নীলা শাড়ীর আঁচল দিয়ে আমার চোখের জল মুছে দিল। নীলা আমাকে কতটা ভালবাসে সেটা আমি জানি। পৃথিবীতে খুবই কম ভাগ্যবান মানুষই আছে যারা স্বার্থহীন নিখুঁত ভালবাসা পায়। আমি সেই ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন।

আমি নীলার দুই কাঁধে দুইহাত রেখে বললাম, “আমি জানি তো। তুমি আমাকে কতটা ভালবাসো, আমিও তোমাকে কম ভালবাসি না। কিন্তু নীলা, আমি সত্যিই তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি জানি তুমি আমার মায়ের কষ্টের কারণ হবে না তবুও ভয় হয়। মা যদি সামান্য হলেও কষ্ট পান! আমি তো আমার মাকে কষ্ট দিতে পারবো না। আমার মা যে আমার সব ভালবাসার উর্ধ্বে। আমার মা, আমার ভালবাসার শেষ ঠিকানা।” নীলার চোখে জল টলমল করছে। যখন তখন চোখের কাজলের বাঁধ ভেঙে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। নীলার জন্য প্রচণ্ড মায়া হচ্ছে। এত সুন্দর একটা মেয়েকে আমি কষ্ট দিচ্ছি। মেয়েটির চোখের জলের মত মেয়েটির ভালবাসা স্বচ্ছ ছিল অথচ আমি সেই জলে কাজলের রঙ লেপন করে দিচ্ছি!

আমি নীলার কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি মা ও আমার দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে। আমি অস্পষ্ট স্বরে শুনতে পেলাম নীলা আমাকে ডেকে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু কান্নার আবেশে বলতে পারছে না। আমি নীলার কথা থামিয়ে দিয়ে বললাম, “নীলা, তুমি চলে যাও। আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার মা আমার পৃথিবী। আমি এই পৃথিবী নিয়েই খুশী থাকতে পারবো। ” নীলা আর কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম, নীলার চোখের কাজল মুছে যেতে শুরু করেছে। হাসিমাখা মুখটিতে কাজল ধোয়া পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কান্নার আওয়াজও কানে ভেসে এলো।

আমি আস্তে করে মায়ের কোলে মাথা রাখলাম। কান্নাকে কষ্ট করে আটকে রাখার কোন চেষ্টাই করলাম না। শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। আমার পৃথিবীকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম আমার মুখে কয়েক ফোঁটা জল পড়লো। আমি বুঝতে পারলাম, আমার পৃথিবী কাঁদছে! আমার মা কাঁদছে! আমি আস্তে করে ডাকলাম, “মা!”

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত