মর্গে যখন মামার লাশটা দেখলাম তখন মনে হলো মামা এখুনি ধমক দিয়ে আমাকে বলবেন, ইস্টুপিড কোথাকার ! আর কতকাল তোদেরকে বসে বসে খাওয়াবো? ২বছরে একটা চাকরি পর্যন্ত খুঁজতে পারলিনা? দূর হ আমার সামনে থেকে !”
কিন্ত না ,মামা চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন । পাশে মামী আর নিতু কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলেছে । মা আমার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন । সামনে যাচ্ছেন না । চোখে একফোঁটা পানি নেই তার । কেমন যেন পাথর হয়ে গেছেন । হয়তো কষ্টে কষ্টে তার আবেগ চলে গেছে সব । কিংবা ভাইয়ের মৃত্যুতে নয় বরং আমাদের থাকা-খাওয়ার চিন্তায় তার মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গিয়েছে । মামা বেঁচে থাকতে আর যাই হোক থাকা-খাওয়ার চিন্তা আমাদের ছিলোনা । ২৭ বছরের বেকার ছেলে নিয়ে এখন মা কিভাবে জীবনযাপন করবেন খোদা জানে ।
বিকেলে মামার জানাজায় যাওয়ার আগে মাকে খুঁজছিলাম । মামির রুম এর সামনে যেতেই শুনলাম মামার শাশুড়ি কাকে যেন বলছেন , ” কি মেয়েরে বাবা ! ভাই মরলো অথচ একটু চোখের পানিতো দূরের কথা আহাজারী ও করলোনা ! এখন এই বেকার বুড়ো ছেলে নিয়ে এসে আমার মেয়ের ঘাড়ে পড়বে । ” বুদ্ধিমত্তার জোড়ে বুঝতে পারলাম , মা সেই ঘরে নেই । মাকে আর না খুঁজে আমি জানাজায় চলে গেলাম ।
সব গল্পে বেকারদের একটা দুটো টিউশন থাকে । যেটা দিয়ে কোনোমতে তারা দিন চালায় । আমার সেটাও নেই । বাবা যখন মারা গিয়েছিলেন আমার বয়স তখন ১০ । মামার বাসায় উঠার পর সেখানে ছিলাম ২ বছর । এরপর ধরে-বেঁধে মাকে আবার বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় । সেখানে সংসার করেছিলেন ৫ বছর । এরপর ডিভোর্স । আমাদের আবার মামার কাছেই ঠাই হলো । মামার কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে চলা, উঠতে বসতে মামীর খোটা শুনা এসব নিয়েই আমাদের জীবন চলছিল । মা ছিলেন এ বাসার অলিখিত কাজের বুয়া । কেউ তাকে কাজ করতে বলতো না । কিন্তু তাও তিনি গাধার মত সারাদিন খেঁটে যেতেন ।হয়তো এখন আরো বেশী খাটবেন । সন্ধ্যায় জানাজা থেকে ফেরার পথে বুঝলাম ভীষণ খিদা লেগেছে । পেট আর মানছেনা । সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। মা খেয়েছে কিনা কে জানে । পকেট এ ২০ টাকা আছে । টং দোকানে গেলে কিছু খাওয়া যেত । কিন্তু আশেপাশে মুরব্বি সব । একলা একলা টং দোকানে খেতে যাওয়ার উপায় নেই ।
বড়খালু জীবন বাঁচালেন । হঠাৎ করে সবাইকে বললেন, “আপনাদের তো মনে হয় কিছু খাওয়া হয়নি । বাসায় রান্না হয়েছে নাকি তাও ঠিক নেই । আপনাদেরকে খাওয়াই কোথাও চলেন । ” মুরব্বিরা প্রথমে আপত্তি করলেও পরে খালুর কথায় মানলেন । খালু সবাইকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন । খাবার অর্ডার দেয়ার পর কিচ্ছুক্ষন পরেই চলে আসলো । আমার সামনে গরম গরম নান রুটি আর তন্দুর মুরগি । বাবা বলতেন ,পোড়া মুরগি । রুটিটা ছিঁড়ে মুখে দিতেই মার কথা আবার মনে পড়লো । মুরব্বিরা অনবরত আমাকে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন ,”একটা কিছু করো বাবা । এভাবে আর কয়দিন । এখন মামা ও নেই । তোমার মা চলবে কিভাবে ?”
আমি কিছুক্ষণ খাবার নাড়াচাড়া করে উঠে গেলাম । খালুকে বললাম ,বাসায় যাচ্ছি । পকেট এ ভাড়া নেই, হাঁটা ধরলাম । বাতাস হচ্ছে । হাঁটতে খারাপ লাগছেনা । মনে মনে ভাবছি, একটা রিক্সা কিনে নিয়ে মার সাথে একটা বস্তিতে উঠে যাব । তাও যদি সমাজের কাছ থেকে নিস্তার পেতাম । কিন্তু রিকশা কেনার টাকাটাও আমার কাছে নেই। যখন বাবা ছিল তখন সময়টা খুব মধুর ছিল । মামা,খালা,চাচা সবাইকে আপন লাগতো । ঈদ এর সময় খেলনা আর মিষ্টি নিয়ে সবাই বাসায় আসতো । বাবা খুব ভালো পজিশন এ ছিলেন । তাই হয়তো তখন এত কদর ছিল আমাদের । একদিন সকাল বেলা মা স্কুলে যাওয়ার জন্য ডাকতেই আমি বললাম ,”মা পেট কামড়াচ্ছে । যাবোনা স্কুলে ।” মা এটা নিয়ে হাউকাউ শুরু করলেন। বাবা উঠে এসে বললেন ,”মাঝে মাঝে পেট কামড়ানো এলাউড।” মা আর কিছু বলেননি।
নাস্তার টেবিলে বাবা আমাদেরকে অনেক হাসালেন। এরপর আমার কপালে চুমু দিয়ে অফিস এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। তার কয়েকঘন্টা পর আমাদের টিএনটি লাইনে কল এলো । বাবা রোড একসিডেন্ট এ মারা গেছেন ।
বাবার মৃত্যুর পর কেউ ই আমাদেরকে সাহায্য করেনি । মার শ্বশুর বাড়িতে জায়গা ছিলোনা কখনই । প্রেম এর বিয়ে হলে যা হয় । শুধু মামা ই আমাদেরকে নিজ হেফাজতে রাখার দায়িত্ব নেন । মামা ভীষণ আদর করতেন । কিন্তু আস্তে আস্তে কেন যেন সব বিষাদময় হয়ে উঠে । মামীর জ্বালায় মা আরেকটা বিয়ে করলেন । তাতেও শান্তি পেলেননা । বাসায় ঢুকতেই দেখলাম মা সিঁড়ির গোড়ায় বসে আছেন । উপরে মামী অনবরত চিল্লাছেন । আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে ?” মা উত্তর দিলেন ,”তোর মামার উকিল ফোন করেছিল । তোর মামা তার জায়গা জমি আর টাকার ৭০ ভাগ তোকে আর বাকি ৩০ ভাগ নিজের মেয়েকে লিখে দিয়েছে । ”
আমি আর কথা বাড়ালাম না । এক কাপড়ে মাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম । আসার সময় দারোয়ান বললো , “চিঠি এসেছে” । চিঠি খুলে দেখলাম চাকরির লেটার । বাবার চাকরিটা আমার হয়েছে । আমি আর মা খোলা রাস্তায় হাঁটছি । রাত হয়ে গিয়েছে । বাতাসে গাছপালা উড়ছে । মাথার উপরে বিশাল একটা চাঁদ । মার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে । কিন্তু কোনো আওয়াজ করছেন না । নিঃশব্দে কাঁদতে পারেন মা । আমি মাকে বললাম, “কাঁদছো কেন মা ? সব তো ঠিক হয়ে যাচ্ছে । আমাদেরকে আর রাস্তায় ঘুরা লাগবেনা ।” মা উত্তর দিলেননা। হঠাৎ মা বলে উঠলেন,”খোকা ,তুই ও যদি মারা যাস ?” আমি নির্বাক হয়ে মার দিকে তাকিয়ে রইলাম । মৃত্যু ,হায় মৃত্যু ।