আফ্রিকার জোহানসবার্গ এ আছি।পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী এলাকা।কয়েকদিন আগেও পাশের দোকানের একজন বাংলাদেশি কে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।তবুও,জীবনের মায়া ভুলে আজ পাঁচবছর ধরে পড়ে আছি।
এখানকার টাকার চেয়েও সন্ত্রাসীদের দাম অনেক বেশি।তাদের কে ক্যাশ থেকে সব টাকা উজাড় করে, দিয়ে দেওয়াটাই আমাদের মত তুচ্ছ বাংলাদেশির কাজ। তবুও সুহানার কথা চিন্তা করে এখানে পড়ে আছি আমি। যাকে না দেখলে পাঁচমিনিট থাকতে পারতাম না,অথচ আজ পাঁচ বছর ধরে তাকে না দেখে পড়ে আছি,এই কুখ্যাত শহরে।
আমার আর সুহানার স্কুল থেকে সম্পর্ক।তার ভালবাসা পেতে কতবার যে তার পিছনে পিছনে ঘুরেছি,তার হিসেব নেই।রক্ত দিয়ে চিঠি লেখা,কবিতা লেখা,গান গাওয়া,বান্ধবীদের থেকে তার একটি কথা শুনার জন্য হাজার টাকাও নষ্ট করা,সবই করেছি। অনেক কষ্টে তার মনও পেয়েছি।যখন তার বাবা আমাদের ভালবাসার কথাটা জানতে পারেন,তখন তিনি আমাকে পাঁচবছরের সময় বেঁধে দেন,যাতে সুহানার যোগ্য হয়ে আমি গড়ে উঠতে পারি। অবশেষে নিজের ভিটেমাটি,জমি-জমা বন্ধক দিয়ে আফ্রিকায় আসি।আসার সময় আমাকে দালালের খপ্পরে পড়তে হয়।দশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে আমাকে ডুপ্লিকেট ভিসা দেওয়া হয়।আমার সাথে আরো দশ জনের মত ছিল।আমাদের কে প্রথমত বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স দিয়ে দুবাই আসতে হয়।তারপর সেখান থেকে মোজাম্বিক।
মোজাম্বিকের এক পাহাড় রয়েছে,যেটা পার হলেই আফ্রিকা।কিন্তু এই পাহাড়ের সীমান্তে হাজার বাংলাদেশির স্বপ্ন ভেঙে গেছে,জীবন হারিয়েছে কতজন, তার কোনো হিসেব নেই।এখানের প্রতিরক্ষা সীমান্তরক্ষীদের হাতে পড়লে রক্ষা পাওয়া দুষ্কর।আর সেই পথে বাংলাদেশ থেকে আসা ১০ জনের মধ্যে আটজন ফেরত যেতে হয়েছিল।বাকি দুজনের মধ্যে আমি একজন, যে এই আফ্রিকার জোহানসবার্গ এ ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ক্রমে পড়ে আছি। সুহানার সাথে প্রতিদিন কথা হয়।তার বাবার অসুস্থতার কারণে, আজ কয়েকবছর ধরে আমার টাকায় তাদের সংসার চলে।সুহানার ফ্যামিলি কেই আমি আমার নিজের ফ্যামিলিই মনে করি। আফ্রিকায় পাঁচবছর হতে চলল।বিবাহের জন্য এখন আমি সম্পূর্ণ যোগ্য। আমি বাংলাদেশে আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই সুহানার সাথে আমার বিবাহ হবে। যা ভাবতেই খুব ভালো লাগছে।
কিন্তু সব ভালোর মাঝেই একটি খারাপ থাকেই।সেদিন বিবাহের কিছু জিনিসপত্র কেনার জন্য আর বিমানের টিকিটের জন্য ক্যাশে আমার টাকা ছিল।হঠাৎ এক আফ্রিকার সন্ত্রাসী পিস্তল হাতে আগমন ঘটে দোকানে।সে আসে দোকানে,অন্য দিনের মত টাকা নিতে।কিন্তু সেদিন আমার জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান টাকাগুলো ছিল।সে এসে আমার দিকে বন্ধুক তাক করে যখন ক্যাশ থেকে সব টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছিল,ঠিক তখন আমি জীবনের পরোয়া না করে কান্না মাখা চোখে,তার মাথায় আঘাত করি।তারপর বন্ধুক টা নিয়ে সব টাকা ছিনিয়ে নেই। সে ঘটনার পর আমাকে আফ্রিকার সেই সন্ত্রাসীর সহোদররা, আমাকে মারার জন্য খুঁজছে। তাদের সামনে পড়লেই আমার খুন হওয়া ছাড়াহ,আর কোনো উপায় নেই। অনেক কষ্টে বন্ধুর মাধ্যমে টিকিট কাটি। যাওয়ার এক সপ্তাহ পর সুহানার সাথে আমার বিয়ে।
ইতিমধ্যে বিবাহের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন।লোকাল গাড়ি করে যখন এয়ারপোর্ট এর দিকে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ দেখি একদল সন্ত্রাসী আমাদের গাড়িটা দাঁড় করায়।একজন একজন করে বের করে চেক করতে থাকে,আমার খোঁজে। আমি শুধু আল্লাহ,আল্লাহ বলতে থাকলাম।আর মনে মনে বললাম,’যদি এই যাত্রায় বেঁচে যেতে পারি,আফ্রিকায় আর কোন দিন আসবোনা।
যখনি আমাকে নামিয়ে আমার মাথায় মাংকি টুপিটি খুলতে বলল,তখন আমার বুকটা ভয়ে ধুমড়ে-মুচড়ে গেল।এই বুঝি প্রাণ হারালাম। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে সেই জায়গায় পুলিশের গাড়ি আচমকা চলে আসলে তারা সবাই পালিয়ে যায়।আর আমি আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া করতে লাগলাম। বিমানে বসে সুহানার ছবিটা নিয়ে কল্পনা করতে লাগলাম,কখন তাকে আমার কাছে পাবো।কখন তাকে চিৎকার দিয়ে বলবো, ভালবাসি। অবশেষে বাংলাদেশে চলে আসলাম।এয়ারপোর্ট এ নেমে ফেসবুক অন করতেই দেখি,ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে একজন এক্সিডেন্ট করা রোগীর জন্য “ও নেগেটিভ” রক্তের প্রয়োজন।
রোগীর ইমিডিয়েট রক্ত না পেলে,মারা যাবে শুনে,নির্ধারিত নাম্বারের মাধ্যমে ফোন দিয়ে রক্ত দিয়ে এলাম।লোকটির নাম আমির। ঢাকায় দোকান আছে।দোকানে যেতে গিয়ে বাস এক্সিডেন্ট করেছে,তার বাবা এমনটাই জানালো।
তার বাবা আমার সম্পর্কে জানতে চাইলে,আমার জীবনের সব কথা খুলে বললাম।তারপর উনার কাছ থেকে ছোট একটা থ্যাংকস নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। বাড়িতে যেতেই ব্যাগটা রেখে ছুটে গেলাম সুহানার কাছে।সুহানা আমাকে দেখেই দূর থেকে দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আর বলল–প্রতিদিন তোমার আসার অপেক্ষায়, সকাল থেকে বিকাল অবধি তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকি।যদি এসে আমাকে না পেয়ে,ফিরে যাও তাই।
আমি কপালে একটা চুমু দিয়ে বললাম-ওমা,তাই।এতো ভালবাসো আমায়! সে মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো–হুমম। সামনের শুক্রবার আমাদের বিয়ে।কিন্তু বিবাহের আগে আমি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লাম।আমার বমি,ডায়রিয়া আর জ্বর হলো। হাসপাতালে তিনদিন ভর্তি হয়ে আছি।অথচ সুহানার ফ্যামিলির কেউ আমাকে দেখতে অবধি এলোনা। কয়েকদিন পর সুহানার বাবা আমার কাছে এলো।এসে বলল–বাবা!লজ্জা পাওয়ার কিছুই নাই!আমি তোমার বাবার মতই।তোমাকে একটা কথা বলি। আমি বললাম-জ্বী বাবা!বলেন। উনি কন্ঠটাকে গম্ভীর করে বললেন–দেখো!তুমি আমার মেয়ে কে ভুলে যাও। আমি কান্না মাখা গলায় বললাম–আমার অপরাধ!
–দেখো বাবা।আফ্রিকায় থাকো।কি আকাম-কুকাম করছো,সেটা আল্লাহই ভাল জানেন।যার কারণে তোমার এইডস হয়েছে।তুমি আমার মেয়েটারে রেহায় দাও। আমি কান্না চেপে হাসি টেনে বললাম–বাবা!সুহানা ছাড়া আমি কোনো মেয়ের দিকে তাকায় না অবধি।আমার এইডস কিভাবে হবে?
—দেখো।আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করবানা।তোমরা যারা বিদেশে থাকো,তোমরা সব কিছুই করো।সেটা আমি ভালোই জানি।তোমার মত একটা মরণ ব্যাধি রোগীর সাথে আমার মেয়ের বিবাহ দিয়ে আমার মেয়ের জীবন শেষ করতে চাইনা। দরজার আড়াল থেকে সুহানা সব কথা শুনছে।তার বাবা উঠে যাওয়ার পর। সে ভিতরে আসলো। আমি কান্না মেখে বললাম–সুহানা আমাকে বিশ্বাস করো।আমার সামান্য অসুখ হয়েছে।আমার কয়েকদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবো।
–দেখো “জাহান” আমি তোমার কাছ থেকে এমন আশা করিনি।তোমার এমন অধপতন হবে,তা কল্পনাও করতে পারিনি।একবার সমাজের কথাও ভাবলেনা।এই রোগ নিয়ে দেশে এলে!তোমার উচিৎ ছিলো বিদেশেই আত্মহত্যা করা।ছি জাহান ছি। সে যে সুহানা আমাকে ছেড়ে গেল,সে আর এলোনা।আমার বিবাহের দিনেই বিবাহ হল,আমার সাথে নয়;অন্য কারো সাথে।আমিও তার বিবাহের পর সুস্থ হয়ে গেলাম।আর চিনে নিলাম মানুষ কে। তার স্মৃতি নিয়ে আবার রওনা দিলাম সে আফ্রিকার মরণের মুখে।
বাসের জন্য অপেক্ষা করছি হঠাৎ একটা লোক এসে আমার সামনে দাঁড়াল।লোকটি বলল-ভাই! আপনি জাহান না?
আমি বললাম–জ্বী। সামনের দিকে তাকাতেই দেখি লোকটি সুহানার হাত ধরে আমার সামনে চোখ ছলছল করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে জড়িয়ে ধরল।আর সুহানা কে দেখিয়ে বলল–আমি যে ফেরেশতার কথা প্রতিদিন বলি,সে ফেরেশতা হলো এই উনি।যার রক্তের কারণে আজ আমি বেঁচে আছি।ভাগ্যিস!বাবা আপনার একটা ছবি তুলে রেখে ছিলেন,না হলে তো সে ফেরেশতাকে দেখতেই পারতাম না।
লোকটি হাত ধরে বললেন–ধন্যবাদ ভাই আপনাকে। আমি বললাম–এতে ধন্যবাদের কি আছে!মানুষ তো মানুষের জন্য ই। লোকটি বলল–ভাই!আপনার রক্ত দেয়ার জন্য আমি বেঁচে যাওয়াতেই বাবা,আমাকে আপনাদের এলাকায় খুশি হয়ে বিবাহ করিয়েছেন।এই হলো আমার স্ত্রী সুহানা। সুহানা আমাকে সালাম দিলো।আমি সালাম নিলাম।লোকটি বলল–ভাই,কোথায় যাচ্ছেন? আমি উত্তর দিলাম–আফ্রিকায়!
–কিন্তু বাবা যে বলল,সেখানে গেলেই আপনাকে মেরে ফেলবে,কেন মৃত্যুর মুখে আবার যাচ্ছেন?
–আমার মৃত্যু তো অনেক আগেই হয়ে গেছে।যাচ্ছি,সেটা বাস্তবে রুপ দিতে।কিছু
স্বার্থপর মানুষগুলো কে দেখে বারবার মরার চেয়ে,একবারে মরাই ভালো। এই বলে আমি চলতে শুরু করলাম,মৃত্যুর দিকে।আর সুহানা আর সুহানার হাজবেন্ড আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো।